রাতের রং কাল

ভয় (জুলাই ২০২০)

Jamal Uddin Ahmed
  • ৪২০
অন্ধকার রাত। টিপটিপ বৃষ্টি। চিকন বিদ্যুতের রেখা থেকে থেকে নাচছে ছায়াকালো লোকালয়ের মাথার ওপর । নৌকাটা পুরনো। তার যাত্রী তিনজন – মা, ছেলে ও মেয়ে। খাইরুন তার ছেলে কদমা ও মেয়ে করিমুনকে নিয়ে নৌকায় চড়েছে জুড়ি ব্রীজের নিচ থেকে।

বর্ষার শুরুতেই উপনদী জুড়ির খরস্রোতা রূপ দেখা যায়। ভাটিতে গিয়ে মিশেছে কুশিয়ারার সাথে। নদীর দুপাড় জুড়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বাস। বেশির ভাগই স্থানীয়; তবে ভিন জেলা থেকে অনেক বাস্তুহারা ও দুস্থ লোক এসে বসতি গড়েছে এ এলাকায় গত কয়েক দশক ধরে। অস্থানীয়দের মধ্যে সংখ্যায় নোয়াখালী-কুমিল্লা এলাকার লোকজনই বেশি – প্রায় সবাই নদী শিকস্তির শিকার। খাইরুনের বাপ-দাদারা এসেছিল চাঁদপুর এলাকা থেকে। তার জন্ম এখানেই। হাবুল্যা অর্থাৎ তার স্বামী গেদা অবস্থায় নোয়াখালীর রামগতি থেকে পরিবারের সাথে হিজরত করেছিল পূর্বাঞ্চলের উদ্দেশে; পরে থিতু হয়েছে জুড়িতে এসে।

একটাই ছাতা। খাইরুন ও করিমুন ছাতার নিচে; কদমা গায়ে জড়িয়েছে পলিথিন দিয়ে বানানো রেইনকোটের মত একটা পুরনো বৃষ্টিরোধক। বৃষ্টি-বাদলার দিনে হাবুল্যা ওই পলিথিনের রেইনকোট পরে মাছ ধরতে যেত।

খাইরুনকে পেটানোর পর সখিনাকে নিয়ে বিটুমিনের ড্রাম দিয়ে বানানো ঘরের মূল কক্ষ মানে ঘরের যে অংশে আণ্ডা-বাচ্চাসহ তারা সবাই একসাথে ঘুমাতো সেটিতে ঢুকতে ঢুকতে হাবুল্যা ঘোষণা করে দেয় যে বিয়ান্যাবালা ঘুম থেকে উঠে ওদের দেখতে পেলে সে দা দিয়ে আইড় মাছের মত টুকরো টুকরো করে কেটে গাঙে ভাসিয়ে দেবে। খাইরুন গলা ফাটিয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করেছে, মারও খেয়েছে জনমের মত। ছ’বছরের কদমা অসহায়ের মত কেঁদেছে চালার বাইরে দাঁড়িয়ে আর চার বছরের করিমুন মায়ের আঁচলের সাথে লেপ্টে থেকে মায়ের সাথে কান্নায় যোগ দিয়েছে। নল-খাগড়া এবং ছনের তৈরি পাশের ঘর থেকে হাবুল্যার মা-বাবা হৈ হল্লা শুনেও দরজা খুলে বেরিয়ে আসেনি। ছেলের সাথে এমনিতেই তাদের সম্পর্ক নেই বহুদিন থেকে। তবে সে সম্পর্ক অহিনকুল পর্যায়ে পৌঁছোয় ছেলের লুচ্চামি যখন ঘাটে-নৌকায় মুখরোচক গল্পে পরিণত হয় তখন থেকে।

কদমা বৈঠা হাতে গলুইয়ে বসে আঁখ চিবাচ্ছে। ছোট হলেও সে সাঁতার জানে। বাপের সাথে অনেক বার গাঙে এসেছে; এই নৌকারই গলুইয়ে বসে বৈঠা নাড়াচাড়া করেছে আর তার বাপ ঝাঁকি জাল ফেলে মাছ ধরেছে। দয়া করে দাদার দেয়া অল্প ক’টি ছোটমাছ মা কোনোমতে রান্না করে দিয়েছিল বলে তারা ভাই-বোন মিলে রাতের খাবারটা খেয়েছিল। মা খেয়েছিল কিনা তা খেয়াল করেনি। কারণ তখনই হাবুল্যা সোনারূপা চা-বাগান শ্রমিকের কন্যা সখিনাকে নিয়ে ঘরে ঢোকে।

আকাশে বিজলীর চমক একটু একটু করে বাড়ছে। অন্ধকার নদীর বুকে ভাটির টানে নৌকা ভেসে যাচ্ছে খাইরুনের জীবনের গতির মত করে। এ মৌসুমে মেছোদের আরোও নৌকা থাকার কথা নদীতে। কিন্তু অনেকদূর চলে এলেও দুয়েকটা দ্রুতগামী ইঞ্জিনবোট ছাড়া আর কোনো জেলেনৌকা দেখা যায়নি। মহামারির ভয় হয়তো নদীপাড়ের মানুষের চলাচলকেও সীমিত করে দিয়েছে। করিমুন মায়ের কোলে কাত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লেও মেঘের গুড়গুড় আওয়াজে সে কেঁপে কেঁপে উঠে মাকে জড়িয়ে ধরছে। কখনও চোখ খুলে ভয়াল অন্ধকার দেখলেই বলে, ‘মা-রে আমার ডর লাগে।’খাইরুন মেয়েকে চেপে ধরে বলে, ‘চউক বন্ধ করি ঘুমাই থাক।’এর বেশি কিছু আর বলবার নেইও তার। বজ্র-বৃষ্টি-সঙ্কুল নিশুতি রাতে ভরাগাঙে এই নিরুদ্দেশ-যাত্রা কি তার জন্য কম ভয়ঙ্কর! এখন তার জীবনটাই এই রাতের মত অন্ধকার।

বিদ্যুতের ঝলকানিতে খাইরুন দেখতে পায় নৌকার গলুইয়ে কদমা পা লম্বা করে শুয়ে আছে। তারা ঘর থেকে পুরনো কাপড়চোপড় এবং আরোও কিছু টুকটাক জিনিস দুটো পলিথিনের ব্যাগে পুরে বেরোনোর সময় চৌকির ওপর ফেলে রাখা এক টুকরো আখ দেখে কদমা সেটা তুলে নিয়েছিল। সেটি চিবাতে চিবাতে এক ফাঁকে সেও এই দুর্যোগের মধ্যে রেইনকোটের মধ্যে মাথা ঢুকিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। রাতের গভীরতা, ক্রমবর্ধমান বিদ্যুতের চোখরাঙানি এবং হুংকারের মধ্যে খরস্রোতা নদীতে লাশের মত ভেসে চলা নৌকায় ঘুমকাতুরে দুটি শিশুকে নিয়ে সে যাচ্ছে কোথায় এ কথা ভাবতেই খাইরুনের গায়ে কাঁটা দেয়। এ মুহূর্তে নদীতে কোনো ইঞ্জিনবোটও চলছে না। দুয়েকটা মাছ পানিতে ডিগবাজি খেলেই কেবল আশেপাশে প্রাণের একটু অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়।

ভাগ্যান্বেষণে ভেসে আসা অস্থানীয়দের পূর্বপুরুষের পেশা কী ছিল তা নতুন প্রজন্মের অনেকেই জানে না। ধারনা করা হয়, প্রায় বিনা পুঁজিতে জীবিকা নির্বাহের সহজ উপায় হিসেবে উদ্বাস্তু অভিবাসীরা মাছ ধরার কাজ বেঁচে নিয়েছিল। সময় গড়ালে এটাই তাদের মূল পেশায় পরিণত হয়। খাইরুনের বাপ-চাচারাও – যারা নদীর পুবপাড়ার বাসিন্দা, একই পেশার লোক। পেশাগত কারণ ছাড়াও অস্থানীয় লোকদের মধ্যে একটি বন্ধন আপনাআপনি গড়ে ওঠায় প্রায় সবাই সবাইকে চেনে। প্রথম দিকে যখন ‘মানুষ’এবং ‘নোয়াখাইল্যা’র মধ্যে প্রায়ই মারামারি হত তখন এই বন্ধনটার কার্যকারিতা প্রমাণিত হত। স্থানীয়রা অন্য জেলার লোকদের ‘নোয়াখাইল্যা’অভিধায় চিহ্নিত করত এবং কখনও মারামারি বেঁধে গেলে হাঁক দিয়ে এলাকাবাসীকে জানাত, ‘ওরে, মাইনসে আর নোয়াখাইল্যায় মারামারি লাগি গেছে রে…।’ কালক্রমে এই প্রবণতা লুপ্ত হয়ে গেছে। বর্তমানে নতুন প্রজন্মের মধ্যে সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক দূরত্ব নেই বললেই চলে। তবে ভাষাগত জগাখিচুড়ি এখনও পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়নি।

যতই সময় যাচ্ছে খাইরুনের ভীতি ক্রমশ বাড়ছে। অতীত আর বর্তমান দুটো মিলে চিপে চিপে তার চোখ থেকে জলও ঝরাচ্ছে। তবে বৃষ্টির ছাটের সাথে মিশে যাওয়ায় তা আর আলাদাভাবে বোঝা যাচ্ছে না। বউয়ের গায়ে হাত তোলাকে খাইরুনও সামাজিক প্রথা হিসেবে মেনে নিয়েছিল, কিন্তু বিয়ের সাত-আট বছর পর ঘরে দুটি সন্তান রেখে সখিনার মত ছিনালের জন্য হাবুল্যা যে সব ওলট-পালট করে দেবে এটা সে মেনে নেবে কেমন করে? পাশের বাড়ির টেণ্ডলের কথা সে প্রথমে বিশ্বাসই করেনি। কিন্তু তার শশুর যেদিন লাঠি উঁচিয়ে হাবুল্যার দিকে তেড়ে এসে বলল, ‘তরে জবো করি হালাইয়াম খানকির পুত’ সেদিনই খাইরুন বুঝল তার কপাল পুড়েছে। তারপর জুড়ি নদীতে অনেক জল গড়িয়েছে। খাইরুন অনেক যুদ্ধ করেছে; গ্রামের লোকজনও অনেক নিষ্ফল চেষ্টা করেছে; বলেছে, ‘হাঙ্গা তুই আরোও দুইটা কর আপত্তি নাই, ওই বেশ্যা মাইয়াটারে ছাইড়া আয়।’ তবুও হাবুল্যাকে ফেরানো যায়নি। অথচ এই হাবুল্যা মাছ ধরার নাম করে পুবপাড়ে নৌকা ভিড়িয়ে পান খাওয়ার অজুহাতে খাইরুনদের বাড়িতে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গড়াগড়ি দিত। কিছুদিন পর হাবুল্যার পরিবার থেকে প্রস্তাব এলে খাইরুন প্রেমিকার মতই আনন্দিত হয়েছিল। হাবুল্যাকেই তার জীবনের একমাত্র পুরুষ হিসেবে জেনেছিল। সেই হাবুল্যাই তাকে দাগা দিয়ে কেমন করে চা-বাগানের কুলির গতরবেচা মেয়েকে ঘরে নিয়ে এল!

কদমা ঘুমিয়ে পড়লেও নৌকা প্রায় তীর ঘেঁষেই ভাটির দিকে চলেছে । মাঝে মাঝে কোনো ঝোপ বা খাগড়ার বনের সাথে ধাক্কা খেলেও থেমে থাকছে না। হঠাৎ পাশের এক খাগড়া বনে ঝপাৎ করে শব্দ হলে খাইরুন ভয়ে কেঁপে ওঠে। নৌকার দুলুনিতে কদমার ঘুম ছুটে গেলে লাফ দিয়ে উঠে সে বলে, ‘কিরে মা?’

মা কিছু বলছে না দেখে কদমা আবার জিজ্ঞেস করে, ‘ভয় পাইছস?’

‘না, কিতা জানি ঝাপ দিছে পানিত।’মুখে ‘না’বললেও খাইরুন ভয় পেয়েছে সেটা বোঝা যায়।

কদমা বলে, ‘ধুর, ইতা উদ। বুচ্চস? মাছ ধরে আরি।’

এতটুকুন ছেলের অভিজ্ঞতা দেখে খাইরুন এক ধরণের সুখ অনুভব করে। কিন্তু পরক্ষণেই সে আবার অনিশ্চয়তার অন্ধকারে তলিয়ে যায়। হারামজাদা হাবুল্যা বিয়ের পর খাবলাখাবলি করতে করতে বলত, ‘তোরে সিনেমার নায়িকার মতন লাগেরে খাইরুন…।’

খাইরুন কিছুটা লজ্জায়, কিছুটা আনন্দে বলত, ‘আহা রে, কী আল্লাদ।’ সে কখনও সিনেমা দেখেনি। তবে শ্যামাঙ্গী সুডৌল খাইরুন যে গ্রামের আর দশটি মেয়ের মধ্যে চোখে পড়ার মত এটা সে নিজেও জানে।

হাবুল্যার সিনেমার গল্প শুনতে শুনতে খাইরুনের মনেও কেমন নেশা নেশা লাগে। খাইরুনের মনের ভাষা পড়ে নিয়ে ঠিকই বিয়ের এক মাস যেতে না যেতেই হাবুল্যা সিনেমা দেখাতে তাকে কুলাউড়ায় নিয়ে যায়। কদমা পেটে আসার আগে আরোও কয়েকবার সে হাবুল্যার সাথে সিনেমা দেখতে গিয়েছে। এরপর সংসারে কত পরিবর্তন এসেছে। বিয়ের সোয়াবছরের মাথায় কদমা, তার দু’বছর পর করিমুন এসেছে তাদের যৌথ পরিবারে। একসময় আরোও অনেকের মত বাপ-মায়ের সাথে বনিবনা না হওয়ায় তাদের চুলা পৃথক হয়েছে। ততদিনে তাগড়া হাবুল্যার বিটুমিনের ড্রাম দিয়ে একটি ঘর বানানোর পয়সাও জমে গেছে।

এসব কথা তার মনে এসে স্থির হবার আগেই কুলির মেয়ে সখিনার ছিনালমার্কা মুখচ্ছবি সব লণ্ডভণ্ড করে দেয়। খাইরুন বিতৃষ্ণায় এক দলা থুথু ফেলে নৌকার বাইরে। তখনই হঠাৎ প্রচণ্ড শব্দে বিদ্যুৎ চমকালে করিমুন ‘মা রে’ বলে চিৎকার দিয়ে খাইরুনকে ঝাপটে ধরে। বিদ্যুতের আলোয় নদীর ওপর পাড়ে অনতিদূরে বেশ কয়েকটি ঢেউটিনের ঘর চোখে পড়ে খাইরুনের। এগুলো কি মানুষের বসতবাটি না ইশকুল, নাকি কোনো বাজার সেটি বুঝবার আগেই ওখান থেকে টর্চের তীব্র আলো এসে পড়ে তাদের নৌকায়; সাথে হাঁক, ‘অ্যাই, কে যায়?’

খাইরুনের বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে। সে কাতরে উঠে অনুচ্চ কণ্ঠে বলল, ‘আল্লাগো, তুমি কী বিফদে ফালাইলা!’

ওপারের লোকটাও হয়ত বুঝতে পেরেছে নৌকায় কোনো জেলেটেলে নেই; নইলে শিশুর চিৎকার শুনবে কেন? আর দুর্যোগের রাতে এসময়ে এরকম খোলায় নৌকায় কারা-ইবা যায়! সে আবার ডাক ছাড়ে, ‘অ্যাই নাওয়ে কে, মাতো না কেনে?’

কদমাও বাজ পড়ার শব্দে লাফ দিয়ে উঠে বসেছিল। সে-ও লোকটার ডাকাডাকিতে ভয় পেয়ে যায়। খাইরুনের দিকে তাকিয়ে সে বলে, ‘এখন কিতা করিয়াম, মা?’

খাইরুন বলে, ‘আল্লা আল্লা কর।’

লোকটা এবার অধৈর্য হয়ে বলে, ‘অ্যাই, তুমরা চুর নি? নাও লাগাও, নাও লাগাও; ই পারও আও।’

এবার কদমা মায়ের উপদেশের অপেক্ষা না করে গলা উঁচু করে বলে, ‘আমরা চুর না, ইখান আমরার নাও।’

লোকটা বলে, ‘ভাইস্যা যাওয়ার আগে নাও লাগা বেটা, পরে বুঝমু কার নাও।’

খাইরুনের কপালে আগুন, মাথার উপর ঠাটা, পায়ের নিচে গভীর জল – এখন চোখের সামনে অজানা যমদূত। নিজেকে নিয়তির ওপর সঁপা ছাড়া গত্যন্তর নেই দেখে সে কদমাকে বলে, ‘বাজান, করার কিছু নাই, কুনুরকম নাওখান টানি ওই পারো লই যা।’ তারপর সে করিমুনকে জড়িয়ে ধরে দোয়াদরুদ জপতে আরম্ভ করে।

নৌকা ওপারে পৌঁছাতে পৌঁছাতে আরোও পঞ্চাশ গজ ভাটিতে চলে যায়। ওই লোকটিও টর্চ টিপতে টিপতে নৌকা পর্যন্ত হেঁটে গিয়ে বলে, ‘বাজার ঘাটো লইয়া আয় নাও।’ খাইরুন এতক্ষণে বুঝতে পারল এটা তাহলে একটা বাজার। আর ওই লোকটি নিশ্চয়ই বাজারের পাহারাদার বা ওরকম কিছু।

লোকটা একটা দোকানঘরের ছাউনির নিচে দাঁড়িয়ে বলে, ‘গাছর জড়র লগে নাও বান্দিয়া তুমরা উফরে আও।’

ছেলেমেয়েরা ভয় পেয়েছে কিনা সে চিন্তা খাইরুনের মাথা থেকে ইতিমধ্যে উবে গেছে। করিমুনের হাত ধরে কাঁপতে কাঁপতে সে যখন তীরে উঠল তখনই এক হাতে টর্চ ও অন্য হাতে একটা লাঠি নিয়ে দাঁড়ানো লোকটিকে সে দেখতে পেল। তার পরনে উলটো করে বাঁধা লুঙ্গি, মাথায় গামছা – গায়ে আর কোনো পোশাক নেই। বিদ্যুৎ চমকালে খাইরুন দেখতে পেল আরেকটি লোক মেঝেয় পাতা চাটাইয়ে বসে ঝিমুচ্ছে ।

কদমা পিছু পিছু এসে মায়ের পাশে দাঁড়ালে লোকটি ওদের মুখে টর্চের আলো ফেলে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে। কিন্তু কাউকে চিনতে না পেরে জিজ্ঞেস করে, ‘তুমরার বাড়ি কই?’

খাইরুন, কদমা এবং করিমুন পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে, কিন্তু কেউ কিছুই বলে না।

বৃষ্টিতে ভিজছে দেখে লোকটি ওদের হাতের ইশারায় দোকানের বারান্দায় উঠতে বলে। ঝিমধরা লোকটি তখন মাথা তুলে ওদের দিকে তাকায়। খাইরুনের নাকে কটা গন্ধ লাগে। গন্ধটা তার কাছে কিছুটা পরিচিত। মাঝে মাঝে হাবুল্যার জামা-কাপড় ও মুখে সে এরকম গন্ধ পেয়েছে। পরে জেনেছিল ওটা গাঁজার গন্ধ।

বিদ্যুতের ঝলকানিতে বৃষ্টিভেজা প্রাণীগুলোকে দেখাই যাচ্ছিল, তবু ভালভাবে পরখ করার জন্য ঝিমধরা লোকটি প্রথম লোকটির হাত থেকে টর্চ নিয়ে খাইরুনের মুখের উপর আলো ফেলে দাঁড়াতে দাঁড়াতে জিজ্ঞেস করে, ‘বেয়াপার কিতা?’

খাইরুন থতমত খেয়ে যায়। আসলে তার কোনো নির্দিষ্ট ব্যাপার নেই। যা আছে তা দুঃখের একপ্রস্ত অগোছালো গাঁথা। কিন্তু দুজন নেশাখোর পুরুষ – বোঝা যায় যে তারা এই বাজারের নৈশপ্রহরী – এই কুক্ষণে তার সামনে দণ্ডায়মান, এ অবস্থায় থরহরি খাইরুন কীভাবে তার পাঁচালি কীর্তন করবে আর কীভাবেই বা অজানা গন্তব্যের কথা বলবে ভেবে পায় না। কদমা ও করিমুনের নীরবতা বলে দিচ্ছে যে তারাও ভয় পেয়েছে। অগত্যা আঁচল দিয়ে মুখ মুছে গ্রেপ্তার করা আসামির মত খাইরুন কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘ভাইগো, আমরার কেউ নাই; আমার বদমাশ সোয়ামী আমরারে ফিডাইয়া বাইর করি দিছে। কুনু উফায় আছিল না তাই এই নিশারাইতে সাগরো ঝাফ দিছি।’

উপায়ন্তর না দেখে প্রহরীদের প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় সব প্রশ্নেরই জবাব খাইরুনকে দিতে হয়েছে। এসবের মাঝেই দ্বিতীয় প্রহরী একবার টর্চ জ্বেলে খাইরুনের বাম গালে হাত বুলিয়ে ওই জায়গা লাল হয়ে আছে কেন তা জিজ্ঞেস করেছে। খাইরুন ভয়ে কুঁকড়ে গেলেও চোখের জল মুছতে মুছতে কীভাবে হাবুল্যা তার মাথাটা বরাক বাঁশের খুঁটিতে চেপে ধরেছিল তার বর্ণনা দিয়েছে। এবং লক্ষ করেছে সওয়াল-জওয়াবের ফাঁকে ফাঁকে প্রহরী দুজন নিজেদের মধ্যে চোখাচোখি করছে। করিমুন কয়েকবার ঘ্যানঘ্যান করে বলেছে, ‘মা, ঘুম পাইছে।’কিন্তু খাইরুনের সেদিকে নজর দেয়ার অবস্থা নেই।

ইতিমধ্যে বৃষ্টি ঘন হয়ে পড়তে শুরু করেছে এবং বিজলীর তাণ্ডব কিছুটা কমেছে। প্রথম প্রহরী বলল, ‘ই মেঘ-তুফানো তুমরা কই গিয়া মরবায়; উবাও।’ তারপর একটা পাতার বিড়িতে আগুন ধরিয়ে সে দ্বিতীয় প্রহরীকে বারান্দার একপাশে টেনে নিয়ে গেল। তারা কী পরামর্শ করল তা খাইরুন শুনতে পারল না। একটু পর ফিরে এসে প্রথম প্রহরী বলল, ‘হুনো, রাইত বেশি বাকি নাই। মনু মিয়ার চা’র দোকানটা খোলা পড়ি রইছে, একটা ভাঙ্গা চকিও আছে; বাচ্চাগুলার কষ্ট অর, তারারে হুতাইলাও। বিয়ানে দেখমুনে কিতা করা যায়।’

ভেজা গায়ে পিটুনিখাওয়া শরীর নিয়ে খাইরুনের নিজেরও দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি নেই। প্রহরীদের সাথে কথা বলতে বলতে সে এক সময় অসাড়ের মত চাটাইয়ে বসে পড়েছিল। লোকটার কথা তার কাছে ভরসার মত মনে হল। তাছাড়া নিশুতি রাতের এই মঞ্চে ভরসা করার বিকল্প আর কিছু নাইও। কদমা এতক্ষণ কিছু না বললেও প্রহরীর কথা শুনে বলল, ‘মা রে, আমারও ঘুম পাইছে।’খাইরুন তখন কদমা আর করিমুনের হাত ধরে আস্তে করে তার পাশে বসায়।

খাইরুন প্রথম প্রহরীর কথায় সাড়া না দেওয়ায় দ্বিতীয় প্রহরী একটু চড়া গলায় বলে, ‘জাগাতো পাওয়া গেছে, আগে বাচ্চাগুলারে নিয়া হুতাও।’ সাথে প্রথম প্রহরীও যোগ করল, ‘অয় অয়, আগে বাচ্চাগুলার বেবস্তা করো, বাদে তুমার।’

এবার কোনো কথা না বলেই খাইরুন বাচ্চাদের টেনে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। কদমার রেইনকোট তখনও গা থেকে খুলেনি। খাইরুন ছাতা খুলে সাথে আনা পলিথিনের ব্যাগ দুটো নিয়ে করিমুনকে চেপে ধরে দ্বিতীয় প্রহরীকে অনুসরণ করে। তিন দোকান পরেই মনু মিয়ার খোলা চায়ের দোকান। করোনার কারণে বাজারে লোক সমাগম কম হওয়াতে গতমাস থেকে মনু মিয়া আর দোকানে বসে না। দ্বিতীয় প্রহরী টর্চ মেরে দোকানের এক পাশে রাখা পায়াভাঙা ছোট্ট চৌকিটি দেখিয়ে খাইরুনকে বলে, ‘তারারে আগে হুতাই দেও। তুমার বেবস্তাও অইব। ডরাইও না, আমরা আছি।’তারপর সে দ্রুত সেখান থেকে বেরিয়ে আসে।

ছোট চৌকির ওপর শোয়াতে না শোয়াতে করিমুন ও কদমা গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল। খাইরুনের মাথা আর কোনো কাজ করছে না, শরীরটাও ভেঙ্গে পড়েছে। সে পাশে রাখা একটা নড়বড়ে বেঞ্চির ওপর ধপাস করে বসে পড়ে। সন্ধ্যা থেকে এ পর্যন্ত তার ওপর দিয়ে যে কী ঝড়-ঝাপটা বয়ে গেল তা আর সে জোড়া দিয়ে ভাবতে পারছে না; সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। মাথাটা পেছনের টিনের দেয়ালে ফেলে দিয়ে চোখ বন্ধ করে ঘুমাবার চেষ্টা করেও কাজ হচ্ছে না। এভাবে কিছুক্ষণ কেটে যাবার পর হয়ত একটু তন্দ্রাভাব এসেছিল; সে মুহূর্তে একটা তীব্র আলো চোখে পড়তেই সে হকচকিয়ে সোজা হয়ে বসে।

‘বাচ্চারা ঘুমাই গেছেনি?’, দ্বিতীয় প্রহরীর গলার আওয়াজ।

খাইরুন জড়সড় হয়ে বসে রয়, কিন্তু কিছু বলে না। লোকটার ফিরে আসাতে তার অস্বস্থি লাগে। কদমা আর করিমুন ঘুমিয়ে পড়ায় আরোও অসহায় বোধ করে সে। নিরুপায় হয়ে ঝোঁকের মাথায় ঘর থেকে বেরিয়ে এসে জুড়ি ব্রীজের নিচ থেকে নৌকার ছাড়ার সময়েও তার মনে কোনো ভয় ছিল না। তবে জনমানবহীন নদীতে বজ্রবৃষ্টির দাপট বেড়ে গেলে বাচ্চাদের কষ্ট দেখে মনটা খারাপ হয়েছিল। অবশেষে এই বাজারে এসে প্রহরীদের বদান্যতা দেখে তার বুকের ধুকপুকানিটা প্রায় কেটেই গিয়েছিল। কিন্তু এখন?

দ্বিতীয় প্রহরী বলে, ‘ইখানো তুমার জাগা অইত নায়। আও, তুমারে জাগা করিয়া দেই।’

খাইরুনের সন্দেহ ঘনীভূত হয়। সে বলে, ‘না ভাই, লাগতো না। আমার অইব, বাচ্চা থুইয়া আমি যাইতাম না।’

‘ইতা কিতা কও, ভাইয়ে তুমার লাগিয়া জাগা ঠিক করছইন; আও আও।’দ্বিতীয় প্রহরী তাড়া দেয়।

খাইরুনের অবিশ্বাস বাড়তে থাকে। সে সিনেমায় এ রকম অনেক অঘটন দেখেছে। সে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে, ‘ভাই, আফনারা আমার মায়ের পেটের ভাইয়ের লাখান উপকার করছইন। বিয়ান্যাবালা আমরা যাইমু গিয়া। আফনার পায়ে পড়ি আফনে চলি যাইন।’

লোকটা রেগে গিয়ে বলে, ‘অ্যাই বেটি, কাইল যে তোরে থানাত পাটাইমু, জানসনি?’

‘থানায় পাটাইবেন কিতার লাই ভাই; আমরাতো কুনু দুষ করি নাই’, বলে খাইরুন হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দেয়।

দ্বিতীয় প্রহরী ধমক দেয়, ‘চুপ চুপ, আস্তে, ভাইয়ে কিতা কয় হুনিয়া আয়।’

ওদের আসতে দেরি হচ্ছে দেখে প্রথম প্রহরী হাঁক দেয়, ‘কিতারে কিতা অইল?’ সে ওই ছাউনির নিচে দাঁড়িয়ে পাতার বিড়ি টানতে টানতে অধৈর্য হয়ে পড়েছে।

প্রথম প্রহরীর হাঁক শুনে খাইরুন তার শরীরের অবশিষ্ট বল হারিয়ে ফেলে। তার চোখের সামনে যেন দোযখের আরেকটি প্রকোষ্ঠ খুলে যায়। সে পরিষ্কার বুঝতে পারে দ্বিতীয় প্রহরী তার গালের লাল দাগে হাত বুলিয়েছিল কেন। লুচ্চা হাবুল্যা ছাড়া কেউ কোনোদিন তার গায়ে হাত বুলায়নি। আজ কি তবে তার নিরুদ্দিষ্ট জীবনের নতুন পর্বের সূচনা হতে যাচ্ছে। চিৎকার করলেও কেউ শুনবে না। কদমা আর করিমুন জেগে উঠলেও তারা কিছুই করতে পারবে না। তাছাড়া মায়ের কালিমার ছিটা ওদের গায়ে লাগুক তা খাইরুন চায় না।

দ্বিতীয় প্রহরী খাইরুনের মুখে টর্চের আলো ফেলে পুলিশের মত আদেশ করে, ‘চল্।’

খাইরুন কলের পুতুলের মত মনু মিয়ার দোকানের বেঞ্চি থেকে উঠে দাঁড়ায়।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
ফয়জুল মহী অনন্য অপূর্ব  শব্দ বুনন ।
অনেক ধন্যবাদ।

১৯ নভেম্বর - ২০১৭ গল্প/কবিতা: ১৪৯ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪