এক
-কিরে পেত্নী! তোকে না বলেছিলাম দুই বেণি করে চুল বাঁধবি; তারপর ধুতুরাফুল বাঁধবি ঝুঁটিতে...
-দেখ সজলভাই, তুমি খুব জ্বালাচ্ছো ইদানীং। টুম্পা দু’চোখের তারা ডানেবাঁয়ে ঘুরিয়ে, মাথার পেছনের স্বাস্থ্যবান বেণিটা ঝটকা মেরে বুকের উপর ফেলে, হাত দুটি কটিদেশের দু’পাশে বসিয়ে, ঝগড়ার ভঙ্গিমায় সজলের কথার উত্তর দিলো।
ইউনিফর্ম গায়ে, বইয়ের ব্যাগ কাঁধে নিয়ে স্কুল থেকে ফিরছিল টুম্পা। হাঁটাদূরত্বে মদনগঞ্জ বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়। বাড়ি থেকে বেরিয়ে ডিষ্ট্রিক্টবোর্ডের রাস্তা ধরে দশমিনিট হাঁটলেই ঐতিহ্যবাহী মদনগঞ্জ স্কুলে পৌঁছা যায়। এটা শুধু টুম্পারই স্কুল নয়, সজলও একই স্কুলের ছাত্র। তবে দেড়মাস পর এসএসসি পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলেই সজলের স্কুলের পাট চুকে যাবার কথা। টুম্পা সবে নবম শ্রেণীতে উঠছে। হলে কী হবে, তার চলাবলার ঘোটকী ঘোটকী ভাব বুঝিয়ে দেয় সে এখন উচ্চবিদ্যালয়ের একজন উচ্চশ্রেণীর ছাত্রী। কিন্তু সজলভাই তার সাথে এমন হেলাফেলা করে কথা বলে যেন সে প্লে-গ্রুপের ঝুনঝুনিওলা এক পিচ্ছি মেয়ে।
শুধু বেণিই নয়, চুল খোলা থাকলে সে দেখেছে সজলভাই একটা কিছু বলবেই: এ্যাই, জ্বীনের মতো চুল খুলে রেখেছিস কেন, সুন্দর করে খোঁপা বাঁধতে পারিস না? একটা জবাফুল গুঁজে রাখবি খোঁপায়, বুঝলি? এসব। টুম্পাও কম যায় না। শুনিয়ে দেয় গরমগরম দু’কথা। তবে রাগ করে নয়; কখনো একটু ঝাল, কখনো ঝালমিষ্টি, কখনো একটু টকঝাল।
দু’বাড়ি দূরের প্রতিবেশী ওরা – সজল আর টুম্পা। দূরাত্মীয়ও বটে। আসা-যাওয়া আছে দুই পরিবারের মধ্যে। এইতো সেদিনও কানামাছি, গোল্লাছুট, হাঁড়িপাতিল এসব খেলা কত খেলেছে তারা। তারপর পুকুরের পানি ঘোলা করে সাঁতার কাটাতো ছিল নৈমিত্তিক। তাদের সাথে আরোও একদঙ্গল বাঁদর ছিল – পান্নু, মানিক, জোসনা, হাসিনা এবং গুটিকয় অনিয়মিত সাথী। কিন্তু নিজেদের অলক্ষ্যেই অল্পদিনে কেমন করে ঢিলে হয়ে গেল দলের গিঁট। বইয়ের বোঝা যতই ভারি হতে লাগলো বাঁদরামির মাত্রা ততই কমে আসলো। কিন্তু গ্রামের অনটনের পাটাতনে অনেকেরই বইয়ের বোঝা ভারি হওয়ার পরিবর্তে শুন্যই হয়ে গেল।
ইদানীং সজলভাই বেশি নজর দিচ্ছে নাকি টুম্পাই বেশি নজর কাড়ছে তা গবেষণার বিষয় বটে। তবে কুচ্ কুচ্ যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে হয়ে যাচ্ছে তা তাদের বাক্যবাণে বেশ টের পাওয়া যায়। এই যেমন চুল বেণি করার ব্যাপারটা। টুম্পার চুল, পোশাক, কাজল, লিপষ্টিক এসবের প্রতি সজলের ঘনঘন দৃষ্টি পড়ছে আজকাল। স্কুলের পাঠ শেষ করার আগেই পণ্ডিত পণ্ডিত ভাব এসে গেছে তার মধ্যে। টুম্পা রেগে গিয়ে বড়দের কাছে নালিশ করতে যাবে ভেবেছিল দুয়েকবার। পরে রাগ পড়ে যাওয়ায় ক্ষান্ত দিয়েছে। পিচ্চি হলেও মেয়েতো! মেয়েদের মন কোমল হয়। এটা কোন গৎ নয়, টুম্পা নিজেও তা অনুভব করে। সজলভাইকে কড়াকথায় জবাব দিলেও নিজের বুকের ভেতর একখণ্ড মাখনের উপস্থিতি টের পায় সে। সজলভাইয়ের সাথে গরম হয়ে কথা বলতে গেলেই তার ভেতরে আঁচ লাগে আর মাখনখণ্ডটিও তখন দ্রবীভূত হতে আরম্ভ করে।
সজল বললো, তোকে জ্বালালাম কোথায়! চুলের লেজে ফুল বেঁধেই দ্যাখ না কত্ত সুন্দর লাগে।
-তাই বলে ধুতুরা? আমি কি পাগল?
-ঠিক আছে, ধুতুরা না হোক, বেলী বাঁধ। সজল বললো।
-আচ্ছা, আমার চুল আর ফুল নিয়ে তোমার সমস্যা কী? ঠোঁট উল্টে টুম্পা বললো, কলেজে পড়ার কত শখ। ঘোড়ার আণ্ডা পাবে পরীক্ষায়, পড়ালেখা রেখে টো টো করে ঘুরে বেড়াচ্ছ, এসএসসি পাশ তোমার হবেনা।
সজল খেয়াল করে টুম্পা একটু একটু করে কথাবার্তায় পাকা হয়ে উঠছে। সে বললো, দেখিস পরীক্ষার ফল বেরোলে মিষ্টির জন্য আমার পিছে পিছে তুই ঘুরবি।
-তোমার মিষ্টি খাওয়া আমার হবেনা। কথাটা বলার জন্যই বললো টুম্পা। কিন্তু অনুচ্চ সত্যটি হলো,সে মনেপ্রাণে চায় সজল পাশ করুক,চাই মিষ্টি খাওয়াক বা না খাওয়াক। কেন চায় তা সে জানে না। শুধু বুঝতে পারে ভেতরের মাখনখণ্ডটি অল্প অল্প করে পেলবতা পাচ্ছে।
দুই
চেষ্টা চলছে দ্বিমুখী। পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়া কঠিন জেনেও চেষ্টা করে যাচ্ছে সজল। অন্তত চারটা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তিপরীক্ষা দেবে সে। যে কোন একটায় হয়ে গেলেই শোকর আলহামদুলিল্লাহ। অন্যদিকে আর্মির লং কোর্সে ঢোকার অদম্য বাসনা তার মনে। সেনাবাহিনীর ক্যারিয়ার তার কাছে জৌলুসময় মনে হয়। আত্মীয়দের মধ্যে দু’জন সেনা কর্মকর্তা আছেন। তাদের চৌকস জীবন দেখে বহু আগে থেকেই সজলের মনে স্বপ্নটা বাসা বেঁধেছে। সুঠাম দেহের অধিকারী হলেও সে জানে প্রতিরক্ষা বাহিনীর চাকুরি পাওয়া অতো সহজ না। রেহনুমা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে বলেছে, ওই চিন্তা ছাড়, তুই সৈনিক হতে পারবিনা। সজল হতাশ না হয়ে বলেছে, না পারি, চেষ্টাতো করতে পারি।
রেহনুমা সজলের সহপাঠী। বাংলা কলেজে। দু’বছরেই খুব কাছের বন্ধু হয়ে পড়েছে দুজন। অপরিচিত যে কেউ প্রথম দর্শনেই বলে দেবে ওদের সম্পর্ক একটু অন্যরকম। হয়তো তাদের মনের অবস্থান শুন্যদূরত্বে । কিন্তু সহপাঠীদের মধ্যে মতভিন্নতা আছে। অধিকাংশের ধারণা, এদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক বলে কিছু নেই। অল্পসংখ্যকের ধারণা এরা তারছেঁড়া। কয়েকজন মনে করে, কিছু একটা থাকলেও থাকতে পারে। তবে সজল নিজেই এখনো সমীকরণটা মেলাতে পারেনি।
কলেজের ক্লাশ শুরুর দিনগুলোতে একে অপরের সাথে পরিচিত হতে হতে সবাই সবার বন্ধু হয়ে গেল। হৈহুল্লোড়ে সবাই সমান অংশীদার। তো যা হয় আর কি, কেউ কারো সাথে একটু বেশি ঘনিষ্ট হয়ে যায়, কেউ কাউকে একটু বেশি পছন্দ করে। এমনি করে রেহনুমা ও সজল বেশি ঘনিষ্ট হতে হতে একেবার রাখঢাকহীন সহজ সম্পর্কের মধ্যে চলে আসে। একসাথে ক্যাফেটারিয়ায় খাওয়া, কলেজ প্রাঙ্গণে আড্ডা দেওয়া এসব তাদের কাছে ডালভাত হয়ে যায়। প্রথম দিকে বন্ধুদের টিপ্পনী-টিটকারি যা ছিল তা সময়ের সাথে সাথে মিইয়ে গিয়েছিল। তাদের আড্ডাবাজি যে শুধু কলেজকেন্দ্রিক ছিল তা নয়। বইমেলা, জাদুঘর, চিত্র প্রদর্শনী, রমনা বটমূল এসব জায়গায় তারা একসাথে ঘুরে বেড়িয়েছে। তবুও অজানা কারণে তাদের এই সমভিব্যাহার কোন ইতিবাচক উপসংহারে পৌঁছায়নি। সজল যদিও একটু উশখুশ করেছে,রেহনুমার মধ্যে কোন বিকার দেখা যায়নি। অনেকবার কিছু একটা বলবে বলবে করেও রেহনুমার নিস্পৃহতার জন্য সে কিছু বলতে পারেনি। কলেজ-জীবনতো শেষ হয়েই গেল। এখন কে কোন পথে হাঁটবে নিয়তিই ঠিক করে দেবে।
লেখাপড়ার চিন্তা, চাকুরির ধান্ধা, রেহনুমার রহস্যময়তা এসব তালগোলের মধ্যেও হঠাৎ হঠাৎ টুম্পা এসে উঁকি মারে সজলের মনের আয়নায়। এখন সে বুঝতে পারে সত্যিসত্যি সে দুর্বল হয়ে পড়েছিল টুম্পার প্রতি। তখন কৈশোরিক প্রলয় আলবৎ ছিল। এখন সে আর কিশোর না থাকলেও মনের উত্তুঙ্গ আবেগতো কমে যায়নি। যদিও তার বিচরণের বিস্তৃতি ঘটেছে অনেক,তবুও টুম্পার টগবগানি মন থেকে একেবারে ঝেড়ে ফেলতে পারেনি। টুম্পা এখন তার নাগালের বাইরে চলে গেছে বলেই হয়তো ভেতরে ভেতরে এত ছটফটানি। এসএসসি পরীক্ষার পরপরই তাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়েছে। টুম্পার বাবা-মা প্যারিসপ্রবাসী সুপাত্রকে হাতছাড়া করেননি। বিয়ের প্রস্তাব আসার সাথে সাথেই ঘটনাটা ঘটিয়ে দিয়েছেন। নিশ্চয় টুম্পাও সানন্দে রাজি হয়েছিল। পৃথিবীর স্বর্গরাজ্য প্যারিস! ক’দিন পর সেই স্বর্গের বাসিন্দা হয়ে যাবে একথা ভাবতে ভাবতে টুম্পা নিশ্চয়ই শিউরে উঠছিল। খবরটা শোনার পর সজলের ভেতরটা মোচড় দিয়েছে অনেকবার। কেন সে টুম্পার কাছে কথাটা সরাসরি পাড়লো না এ আক্ষেপটা তাই সূঁচ হয়ে খোঁচায় তাকে প্রায়ই। আবার ভাবে, বলেই কী লাভ হতো। তার পায়ের তলার মাটি শক্ত হতে হতেই গাঁয়ের মেয়ে টুম্পার বিয়ের বয়স পার হয়ে যেত। এ অবস্থা টুম্পার বাবা-মা কেন গ্রামের কেউই মেনে নিত না। এ স্বান্তনার পরও রক্তক্ষরণ থামেনি সজলের।
সময়ের চাকা যতই ঘুরছে সজলের জীবনভাবনাও রূপ পাল্টাচ্ছে ক্রমশ। কখনো সে বেশ আশাবাদী হয়ে ওঠে, আবার কখনো বিষাদের অতল গহ্বরে তলিয়ে যায়। লেখাপড়া কি আর করতে পারবে, সেনাবাহিনীর সোনার হরিণ কি ধরতে পারবে এসব ভাবনা তার জীবন-ক্যানভাসের বাকি রঙগুলোকে গুলিয়ে দিচ্ছে মাঝে মাঝে। তবে এটা ভাবতে তার ভাল লাগে যে যদি সে সেনাবাহিনীতে চান্স পেয়েই যায়, রেহনুমা ধোঁয়াশার আড়াল থেকে বেরিয়ে আসবেই। সজল তখন প্রকাশ্য দিবালোকে তাকে হেঁচকা টানে দাঁড় করিয়ে বলবে, ওঠ ছেড়ি, পর বেনারশী; আর ফুটানি মারিস না!
কলেজের দ্বিতীয় বছরে মানিকমিয়া এভেন্যুর ফুটপাতে বসে বাদাম চিবোতে চিবোতে রেহনুমাকে একদিন ভ্যাবলার মতো বলেছিল সজল, আচ্ছা পষ্ট করে বলতো রেনু,তোর কি কেউ আছে?
-মানে? রেহনুমা চোখ দুটি গোল করে জিজ্ঞেস করে।
-মানে তোর কোন পছন্দের মানুষ...সজল কথাটি বলার সাথে সাথে রেহনুমা চোখগুলো ছোট করে যেভাবে তাকালো তাতে মনে হলো এখনই বজ্রপাত হবে। সজল সে ঝুঁকি না নিয়েই ফস্ করে বলেলো, মানে কেউ না থাকলে আমার কথাটা একটু ভেবে দ্যাখ না! দু’বছর ধরেতো মরীচিকা হয়েই আছিস।
-বামুনরে! শখ কত! জানিস আমার মার্কেট রেট? গলায় টাইবাঁধা তরুণ আমলা, চোখে চশমাপরা সরকারি কলেজের লেকচারার গোলাপ হাতে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। খবদ্দার! প্রেমপিরীতির কথা উচ্চারণ করবি না। বইমেলার বাড়াবাড়ির কথা মনে নেই? তুই আমার বেষ্ট ফ্রেণ্ড; তাই থাক। ওকে?
রেহনুমার কথা শুনে সজলের দুইঠোঁট ফাঁক হয়ে থুতনিটা একটু ঝুলে পড়েছিল। যে এক শুন্যদূরত্বের রহস্যময় সম্পর্কে তারা জড়িয়ে আছে তার নাম খুঁজে পায়নি সজল ।
তিন
সেনাবাহিনীর লং সার্ভিসতো হলোই না, সজলের পড়াশোনাও শেষ করতে হলো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বিষয় অর্থনীতি। এজন্য খুব একটা দুঃখ নেই তার। ভাগ্যদেবী সদয় হয়ে তার একটা ভাল গতি করে দিয়েছেন বলা যায়। ইউএসএইডে চাকুরিটা পাওয়ার পর মনের আকাশের গুমোট মেঘ, দৃষ্টিপথে থমকে দাঁড়ানো কুয়াশা প্রায় অপসৃত হয়ে গেছে সজলের। চাকুরিতে ঢোকার পর উন্নত কাজের পরিবেশই তাকে স্মার্ট করে তুলেছে। ওয়াশিংটনে ট্রেনিং নিতে গিয়েছে একবার। ম্যানিলা,ব্যাংককও ঘোরা হয়েছে অফিসের খরচে। চেনাজানার গণ্ডি দৈর্ঘেপ্রস্থে বেড়েছে অনেক। এদিকে বন্ধু-সহকর্মি, পরিবার-পরিজন থেকে চাপ আসছে ঘরে সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালানোর ব্যবস্থা করতে। কিন্তু সজল ইদানীং বিবাহবন্ধনে বাঁধা পড়ার তাগিদ অনুভব করছে না খুব একটা। শম্পাই শুধু গাঁটছড়ার বিষয়টিকে গুরুত্ত্বপূর্ণ করে তুলতে আদাজল খেয়ে লেগেছে।
শম্পা দিনে দু’চারবার এমন মানসিক চাপ সৃষ্টি করে যে সজল তা সামাল দিতে হিমশিম খেয়ে যায়। তাদের ঘনিষ্টতার রকমসকম ঘনিষ্ট সহকর্মিরা বোঝেনা তা নয়। এই যেমন,সজলের জন্য টিফিনের একটা অংশ বরাদ্দ করেই রেখেছে শম্পা। কাজের ফাঁকে আম, আপেল, পেয়ারা, চকোলেট একটু না একটু সজলের সাথে শেয়ার করবেই সে। আর এ সুযোগেই কথার প্যাঁচের মধ্যে ফেলে নিংড়াতেই থাকবে তাকে। সজল হুম, হচ্ছে, ভেরি সুন এসব কথার ফাঁকফোকর গলে বেরোবার চেষ্টা করে। তাছাড়া সহকর্মি কেউ সামনে পড়ে গেলে আম-আপেলের এক পিস্ অনাকাঙ্ক্ষিতভাবেই সে পেয়ে যায়। বিনিময়ে শম্পার সাথে ভালমন্দ দু’চার কথা বলে সৌজন্য দেখায়। এই অবসরে সজল বুকটা ভরে শ্বাস নেয়ার সুযোগ পায়।
সম্পন্ন পরিবারের শম্পা সজলের বছরখানেক পরে জয়েন করেছে ইউএসএইডে; একই সেকশনে। দেখতে মহাসুন্দরী না হলেও ঈর্ষণীয় স্মার্ট। বাবার ডেপ্যুটেশনে দু’তিনটি দেশে দূতাবাসে চাকুরি করার সুবাদে শম্পাও দুনিয়া ঘোরার সুযোগ পেয়েছে। লেখাপড়াও করেছে বিদেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। এমন সৌভাগ্য অল্পজনেরই হয়। শম্পা তাদেরই একজন । তার সাথে ভাব জমানোর জন্য সবাই বলতে গেলে একপায়ে খাড়া। তার ক্ষুরধার স্মার্টনেস সজলের মতো বাঙালকেও টানটান করে তোলে। সুযোগ পেলে শম্পার সামনে সেও তার সর্বোচ্চ ঝকমকানি প্রকাশ করে। শুরুটা এভাবেই।
সম্পর্ক পরিপক্ক হতে খুব বেশি সময় লাগেনি তাদের। যেদিন প্রথম শম্পার প্রস্তাবেই গুলশানের একটি রেষ্টুরেন্টে ফ্রায়েড চিকেন খেতে খেতে একটা সন্ধ্যা কাটালো তারা সেদিনই তাদের সম্পর্ক বন্ধুর মতো সহজ হয়ে গেল। বিলটা সঙ্গত কারণে শম্পাই পরিশোধ করলো। তারপর শম্পাদের গুলশানের অফিসার্স কোয়ার্টার পর্যন্ত পায়ে হেটে গেল দু’জন। আলোছায়ামাখা ফুটপাথ বেয়ে চলতে চলতে টুকরো টুকরো কথা – কখনো অফিসের কখনো ব্যক্তিগত – বলতে বলতে একসময় গুডবাই বলে দু’জনই বিদায় নিল। পরবর্তী এক বছর তাদের সম্পর্কটা শুধু দড়ির মতোই পাক খেয়ে গেছে। দড়িটা লম্বা হতে হতে ফুটপাত, লেকপাড়, রেস্তোরাঁ, শপিংমল,সিনেমা হয়ে বাসার ভেতর পর্যন্ত পৌঁছে গেছে।
বাসা পর্যন্ত সম্পর্কটা পৌঁছানোর একটা উপক্রমনিকাও আছে।এক সন্ধ্যায় রিকশা করে বাসায় ফিরতে ফিরতে ব্যাপারটা সহজ করে দিলো শম্পাই। অন্যান্য কথা বলার ফাঁকে হঠাৎ করে পাশে বসা সজলের গায়ে কনুই দিয়ে একটা ধাক্কা মেরে বললো, ইউ আর অ্যা স্টুপিড! একথায় সজল চমকালো না তেমন, কারণও নেই। শুধু শম্পার দিকে মাথা ঘুরিয়ে বোকার মতো তাকালো। অমনি শম্পা মাছরাঙার কুশলতায় টুপ করে একটা চুম্বন এঁকে দিলো সজলের ঠোঁটে। তারপর নিঃশব্দ,অতল একটা দৃষ্টি রাখলো সজলের চোখে।
প্রায় একই রকম একটা কাণ্ড ঘটেছিল রেহনুমার সাথে সেই কলেজজীবনে। বইমেলা থেকে হুডতোলা রিক্সায় ফেরার পথে কাণ্ডটি ঘটিয়েছিল সজলই । জেদের বশে টুপ করে একটা চুমু খেয়ে বসেছিল রেহনুমাকে। এজন্য তিনমাস কথা বলেনি রেহনুমা। অনেক স্যরি-টরি বলার পর স্বাভাবিক হয়েছিল সম্পর্ক । বাকি দিনগুলোতো রহস্যের ভেতর দিয়েই কাটিয়ে গেল সে।
চট্টগ্রামে ভাইয়ের কাছে চলে যাবার আগে রেহনুমাও যে উদ্ভট কাণ্ড করেছিল সেটিও রহস্যময়। যাবার ঠিক দু’দিন আগে সন্ধ্যাবেলা নিউমার্কেটের এক নিরিবিলি রেষ্টুরেন্টে কিছুটা সময় কাটাবে বলে ঠিক করেছিল তারা। দু’জনের মনই স্বাভাবিকভাবে বিষাদভারাক্রান্ত ছিল। আইসক্রিম, ফালুদা খেয়ে দু’ঘন্টাভর মূলত স্মৃতির ঝুড়িই হাতড়েছিল তারা। মিলনের শিস তেমন জোরালো ছিলনা; বিরহের বীণই ছিল সরব। প্রথমবারের মতো রেহনুমার চোখদু’টিও চিকচিক করে উঠেছিল একবার। সজল মনমরার মতো বসেছিল সারাক্ষণ। রেহনুমা ভাইয়ের উদ্দেশ্য সম্মন্ধে প্রায় নিশ্চিত ছিল। সে কোন কলেজে গিয়ে ভর্তি যদিও হয়, বিয়ের পিঁড়িই হবে তার আশু নিয়তি। তাই নিজের ভাবনা বাদ দিয়ে সে বরং সজলের ভবিষ্যৎ নিয়ে অধিক উদ্বিগ্ন ছিল। রেষ্টুরেন্টের টেবিল ছেড়ে উঠতে উঠতে পরিবেশ হালকা করার জন্য হয়তো সজল বলেছিল,দেখিস, আর্মিতে আমার হয়ে গেলে আর কোন জারিজুরি শুনবো না। রেহনুমা একথায় কোন রাগতো দেখালোই না,একটু মুচকি হেসে সজলকে চমকে দিয়ে হঠাৎ করে তাকে জড়িয়ে ধরেছিল। তড়াক করে সজল শারীরিক উষ্ণতা অনুভব করলেও তার ঘাড়ে যখন রেহনুমার উষ্ণ অশ্রুবিন্দুর অস্তিত্ব টের পেল তখন সে শীতল ও ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছিল ।
রিক্সায় উঠতে গিয়ে রেহনুমা বলেছিল, ভাল থাকিস। চিটাগাং পৌঁছে চিঠি দেবো; তাতে আমার ঠিকানা থাকবে।
চার
রুকু দরজা খুলেই বসের মতো প্রশ্ন করলো, টিউটরের খোঁজ পেয়েছ?
এখন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা। অফিসের কাজ শেষ করে মোহাম্মদপুরের ডাইরেক্ট বাসে দেড়ঘন্টা বসে থেকে ছোবড়া হয়ে বাসায় ফিরেছে সজল । রুকুর এরকম অভ্যর্থনায় সে অভ্যস্থ। তাই তার কথার তাৎক্ষণিক উত্তর না দিয়েই সোজা ঘরে ঢুকে অফিসের ব্যাগটা টেবিলের উপর রাখলো।
-ফোন ধরোনি কেন? তিনবার কল দিয়েছি!
-একটু দম ফেলতে দাও।সজল শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে জবাব দিলো।তখনই সজীব একটা খাতা হাতে ‘বাবা, বাবা’ বলতে বলতে রুমে ঢুকলে তাকেও সে হাতের ইশারায় বুঝালো, থামো, পরে কথা হবে।
সজীব চলে গেলে রুকু আবার শুরু করলো, রোজ রোজ রিক্সাওলার মতো হাঁপাতে হাঁপাতে ঘরে ফেরো। এটা তোমার দুঃখবিলাস। গাড়ি কেনার মতো কি পয়সা নেই তোমার? বেতন কি কম পাও? নজরটাতো আর বড় হলো না।
সজল এসব কথা আর কানে তোলে না। টাকাপয়সার খবর রুকু অর্থাৎ রুকাইয়া সব জানে। আদাবরের ফ্ল্যাটের জন্য ডাউনপেমেন্ট দশলাখ টাকা দেওয়ার পর প্রতিমাসে বড় অংকের কিস্তি দিয়ে যাচ্ছে সে। সবকিছু ঠিক থাকলে ফ্ল্যাটে উঠতে এখনো একবছর লাগবে। আর উঠে গেলেইতো হবে না। ওটার অঙ্গসজ্জা করতে আরোও তিনচারলাখ টাকা লাগবে। তাছাড়া ঢাকা শহরের নামিদামি স্কুলে বাচ্চা দুটোকে পড়িয়ে প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় সকল আব্দার মিটিয়ে মোটামুটি সচ্ছল জীবনযাপন করতে কত খরচ হয় সেটাও রুকুর জানবার কথা। কিন্তু জানলে কী হবে? তার বদ্ধমূল ধারনা সজল ইচ্ছে করেই তাকে, তার ছেলেমেয়েকে বঞ্চিত করছে। সে লুকিয়েছাপিয়ে কাড়িকাড়ি টাকা ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট করে রেখেছে, গোপনে ভাইবোনদেরও দিয়ে যাচ্ছে। অথচ তাদের বেলায় যত হিসাবনিকাশ। রুকু মনে করে হিসাবনিকাশ একটা ভাওতাবাজি। তার বুবুর কত সুন্দর নতুন মডেলের একটি এ্যালিয়েন আছে, সজলের কি এরকম একটা গাড়ি থাকতে পারে না? তার খালাতোভাই উত্তরায় বাইশশ’ বর্গফুটের একটা ফ্ল্যাট কিনেছে আর উনি আদাবর বস্তিতে বারোশ’ বর্গফুটের বুকিং দিয়ে কী যেন করে ফেলেছেন! এরকম একটা মিসকিনের সংসারতো তার হওয়ার কথা ছিল না!
রুকুর গলাটিপেধরা সংসারে দম বন্ধ হয়ে এলেই শম্পার কথা মনে পড়ে সজলের। শম্পা ঠিকই বলেছিল, ইউ ডোন্ট ডিজার্ভ মি, ফিলথি ম্যান। চিড়েচ্যাপ্টাকরা হাউজওয়াইফই তোমাকে মানায়। গো টু হেল।
শম্পা কি অভিশাপ দিয়েছে সজলকে? দিতেই পারে। সম্পর্কের যে গভীরে তারা পৌঁছে গিয়েছিল সেখান থেকে ভদ্রলোকেরা সাধারণত ফিরে আসেনা। অনেক সন্ধ্যা সজল কাটিয়েছে শম্পাদের বাসায়। বাবা-মা সন্ধ্যাবেলা গুলশান লেকের পাড় দিয়ে হাঁটতে বেরোতো। কাজের বুয়াতো কাজের বুয়া। নীতিগতভাবে সে তার কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকতো। রুকু তাকে আদর করে; এটা ওটা দেয় সবসময়। আপার প্রতি বুয়া খুব অনুগত। আপা তার বন্ধু নিয়ে আসে; ঘরের ভেতর কী করে এসব নিয়ে তার কোন ঔৎসুক্য ছিল না। আর এ সমাজে এটা কোন আঁতকে ওঠার ব্যাপারও না। এছাড়া ম্যানিলার ট্রেনিংয়ের দিনগুলো? অবিস্মরণীয়। পুরোটাই হানিমুন। এতসবের পরেও যে কারণে সজল পিছিয়ে এসেছিল সেটা আজকালকার দুনিয়ায় খুব বড় কোন কারণ হিসেবে দেখা হয় না। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এটা একটা কালচার।
তাদের কর্মপরিবেশ বন্ধুভাবাপন্ন; বসিং তেমন একটা নেই। উর্ধতন কর্মকর্তারাও কাজের ফাঁকে হাসিঠাট্টা করে। মাঝে মাঝে অফিসে পার্টি হয়। তাতে হালকা নাচগানের ব্যবস্থাও থাকে। ড্রিংকস কোন ব্যাপারই না; সজলও পার্টিতে দুয়েকটা বিয়ার খায়। তবে শম্পা তার চেয়ে একটু বেশি যায়। পার্টিতে সে খুব প্রাণবন্ত । নাচেও ভাল। কিন্তু যেদিন নাচের ফাঁকে সে সবার সামনেই জ্যাকবকে চুমু খেলো সেদিনই সজলের ভেতো বাঙালি মানসজগৎ প্রচণ্ডরকম ঝাঁকি খেলো।জ্যাকব ইউএসের সুদর্শন তরুণ। প্রজেক্ট অফিসার। শম্পার কাছে এটা একটা সাধারণ ব্যাপার। তার কাছে এটা কোন প্রেমের বহিঃপ্রকাশ নয়; এটা সামাজিক কালচার। সজল আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কাজ করলেও সেতো আর আন্তর্জাতিক কালচার ধারণ করে না। শম্পার এ কাজটা তার হজম হলো না। তবে এ নিয়ে শম্পাকে কিছু বলেওনি সে। কিছুদিনের মধ্যেই নিজেকে সে চৌম্বকীয় বলয়ের বাইরে আবিষ্কার করলো। এই ফিরে আসার অধ্যায়টা ছিল ভীষণ কষ্টসাধ্য। তার এই চুপসে যাবার কারণ শম্পা বুঝে থাকলেও শেষমুহুর্ত পর্যন্ত সে সজলকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চেয়েছিল।
আরোও কিছুদিন পর রুকাইয়াকে ঘটা করে ঘরে তুলে অতীতের সব ছায়াচিত্র মনের পর্দা থেকে মুছে ফেলতে চেয়েছিল সজল । পারিবারিক পছন্দে বিয়ে করা বউ সবারই মন জুড়ে থাকবে এরকমই আশা করেছিল সবাই। তবে চাইলেই যে সব হয়না একথা সজলই শুধু নয়, সজলের মা-ভাই-বোন সবাই অল্পদিনে বুঝে গিয়েছিল।
সজলের ঘরে ঢুকেই রুকুর নাক সিটকানো শুরু হয়ে যায়। প্রথম সন্তান সজীবের জন্ম হওয়া অবধি তা সহনীয় মাত্রায় ছিল। কিন্তু এরপর থেকে তা ধীরে ধীরে ত্রাসের রূপ ধারণ করে। বাপের বাড়ির প্রাচুর্য্যের ভূত সারাক্ষণ তাকে তাড়া করে ফেরে। সজলের হিসেবি সংসারে এসে তার জীবন পানসে হয়ে যাওয়ার খেদ এক সময় বাপের বাড়ি, শ্বশুরবাড়ি কারোই অজানা রইল না।
পাঁচ
বাসার দরজা বন্ধ দেখে সজল চমকালো না। এমনটি আরোও বহুবার হয়েছে। বলা নেই কওয়া নেই হুট করে রুকু কখনো তার বুবুর বাসায় কখনো খালাতো ভাইয়ের বাসায় চলে যায়। কেন গেল, কখন আসবে এসব কিছু সজল এখন আর জিজ্ঞেস করেনা। বাসার একটা চাবি সজলের কাছে থাকে সবসময়। দরজা খুলে সে একটা স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেললো। যাক বাবা, অন্তত একটা দিন মাথাটা ফাঁকা থাকবে।
ঘরে ঢুকে রিল্যাক্সড হয়ে নিজহাতে এককাপ চা বানিয়ে সংবাদপত্রের হেডলাইনগুলো দেখতে দেখতে চায়ের কাপে আরাম করে চুমুক দিতে লাগলো সজল । কাল শুক্রবার । আজ একটা লম্বা ঘুম দেওয়া যাবে। এসব যাত্রায় খাবারদাবার রান্না করেই রেখে যায় রুকু। যে ক’দিন সে বাসায় ফিরবে না ততদিন ছুটাবুয়া আসবে না। এরকম ব্রেক এখন সজলের ভালই লাগে। নো হাউকাউ! চা খেতে খেতে রুটিন দায়িত্ব হিসেবে রুকুর কাছে ফোন দিয়ে তার অবস্থানটা জেনে নিলো সে। বাচ্চাদের কুশল জিজ্ঞেস করতেও ভুললো না। ভাবলো, যাক, উত্তরার খালাতোভাইয়ের বাসায় সময় ভালই কাটবে তাদের।
আজকে ল্যাপটপটা নিয়ে বসবে সজল । নিশ্চিন্তে ফেসবুক চালাবে যতক্ষণ ইচ্ছা। তার একটা ফেইক একাউন্ট আছে।সেটার মাধ্যমে অনেকের সাথে সে যোগাযোগ রাখে যাদের কথা রুকু জানলে লঙ্কাকাণ্ড হয়ে যাবে। টুম্পার সাথেও এই একাউন্ট থেকে ফ্রেণ্ডশিপ করেছে সে। প্রায়ই চ্যাটিং হয়। দুজনই দুজনের পারিবারিক খবরাখবর রাখে। সজল ভুলেও তাকে কোন বেফাঁস কথা বলে না, পাছে টুম্পার স্বামীর নজরে পড়ে যায়। চিনচিনে ব্যথাটা নিজের বুকের ভেতরেই ধরে রাখে সে। আগামি মাসে টুম্পা দেশে আসবে। একটা দেশি ভাল পাত্র পেয়েছে মেয়েটার জন্য। সজলের মতো টুম্পারও এক ছেলে এক মেয়ে। মেয়েটা বড়। দেশে এসে সজলকে মেয়ের বিয়ের দাওয়াত দিতে আসবে সে; তখন ভাবীর সাথেও পরিচয় করে যাবে। এতদিন পরেও টুম্পাকে দেখবার অনুক্ত উত্তেজনা সজল দমিয়ে রেখেছে সন্তর্পণে।
রেহনুমার সাথে প্রথমদিকে চিঠি চালাচালি ছিল সজলের। চট্টগ্রাম চলে যাওয়ার মাসছয়েক পরে এক প্রকৌশলীর সাথে তার বিয়ে হয়ে গেলে তা-ও বন্ধ হয়ে যায়। তবে বন্ধুদের কাছ থেকে মাঝে মাঝে তার কুশলাদি জানতে পারে সজল । স্বামী-সংসার নিয়ে খুব সুখেই আছে রেহনুমা। ফেসবুকে অনেক চেষ্টা করেও তাকে খুঁজে পায়নি সজল । হয়তো তার মতো রেহনুমারও কোন ফেইক একাউন্ট আছে অথবা ফেসবুক সে ব্যবহারই করে না।
রাতের খাওয়াদাওয়া সেরে ল্যাপটপ নিয়ে বিছানায় উঠলো সজল । যদিও স্মার্টফোন দিয়েই আজকাল সবকিছু করা যায় তবু নিরাপত্তার খাতিরেই সজল ফেসবুকসহ বিভিন্ন অ্যাপ্স ল্যাপটপে চালায়। ল্যাপটপে রুকুর কোন কাজও নেই, আগ্রহও নেই।
শম্পার সাথে সমাপ্তিটা মধুর হয়নি বলেই হয়তো সজলের ফ্রেণ্ড রিকোয়েস্ট সে অ্যাকসেপ্ট করে না। মেসেঞ্জার ইনবক্সে অনেকবার ইনিয়েবিনিয়ে মন গলাবার চেষ্টা করেছে সজল । কিন্তু শম্পা গলবে কোন দুঃখে। সে কোন সাড়া দেয়নি। সে ইচ্ছে করলে সজলকে ব্লক করতেও পারতো। কিন্তু কেন করলো না সেও এক জটিল প্রশ্ন সজলের কাছে। অষ্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশি এক অধ্যাপকের সাথে ঘর করছে শম্পা। দেশে হয়তো দুয়েকবার এসেছে, তবে ইউএসএইড ছেড়ে যাবার প্র সজলের সাথে তার আর দেখা হয়নি। প্রাক্তন সহকর্মি কয়েকজনের সাথে এখনো তার যোগাযোগ আছে। ওরা নিজ থেকে শম্পার কোন কথা জানালে সজল জানতে পারে। এখনো কোন সন্তানাদি নেই শম্পার। হয়নি নাকি নেয়নি তা কেউ বলতে পারে না। কোন চাকুরি না করলেও কোন একটা স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত আছে। মাঝেমাঝে নাকি কনসালটেন্সিও করে।
সজল ফেসবুকে লাইক-কমেন্টস-স্ট্যাটাস করতে করতে রাত তিনটা বেজে গেছে। হঠাৎ সে ভাবলো শম্পাকে একবার নক করা যাক। এখন সকাল হয়ে গেছে সিডনীতে; জবাব না দিক, জানবেতো সজল তাকে স্মরণ করছে। সে মেসেজে লিখলো, হাই, মিস্ ইউ। তারপর অন্যান্য ওয়েবসাইট থেকে এক্সিট করে ল্যাপটপ বন্ধ করার প্রস্তুতি নিলো । তক্ষুনি তাকে চমকে দিয়ে ল্যাপটপ বীপ করে উঠলো।
-আর কী চাওয়ার আছে আমার কাছে? কেন তুমি বিরক্ত কর? শম্পা জবাব দিয়েছে!
শম্পা রেসপণ্ড করবে সজল তা ভাবতেও পারেনি। তার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা টিকটিকি তরতর করে নেমে গেল। হাত দুটোও কাঁপছে। এখন সে কী বলবে? কীইবা বলার আছে? আর কিছু খুঁজে না পেয়ে লিখলো, তুমি ভাল আছো তো?
-তা জেনে তোমার কাজ কী? শম্পার পক্ষে এটা উপযুক্ত জবাব।
শম্পা যখন এত চেষ্টার পর মুখ খুলেছে তখন সজলের কথা বলে যেতেই হবে। সে লিখলো, আমাকে যা ইচ্ছে বলো শম্পা, বিশ্বাস করো তোমাকে বড় বেশি মনে পড়ছে।
-লুজারদের তাই হয়; আই নো ইউ আর নট হ্যাপি। আনহ্যাপি ইনসেইনগুলা এভাবেই অতীতমুখী হয়ে বর্তমানকে ভুলতে চায়।
-হয়তো তাই। আর আমি জানি অতীতে আমরা কেউই ফিরে যেতে পারবো না। সজলের সরল আত্মসমর্পণ।
-সে তো জানাকথা। তো এতরাতে জেগে আছ কেন? বউ কি পালিয়ে গেছে?
সজলের মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে। মেয়েদের কি তৃতীয় নয়ন আছে? তার বউতো পালিয়েই গেছে বলা যায়। যখনতখন ঘর ছেড়ে চলে যায়; তাকে বলারও প্রয়োজন মনে করে না। শম্পা কেমন করে এটা ধারণা করলো? সে শম্পার কাছে স্বীকার করলো, আসলেই বউ ঘরে নেই, বেড়াতে গেছে তার এক কাজিনের বাসায়। আর কালতো ছুটির দিন; তাই আমি ফেসবুকে ঘোরাঘুরি করছি।
-শোন সজল, প্রায়শ্চিত্ত তোমাকে করতেই হবে। পাস্ট ইস পাস্ট। যা হবার হয়ে গেছে; আমার কোন অনুশোচনা নেই। প্লিজ, তুমি আমাকে আর নক করবে না। উই আর ম্যাচুরড এনাফ এণ্ড আই অ্যাম হ্যাপি উইদ মাই প্রেজেন্ট লাইফ। আমি জাবরকাটা পছন্দ করি না। ঠিক আছে?
সজল জানে এমন কঠিন উত্তর তার প্রাপ্য, কিন্তু তা গ্রহন করা কষ্টকর। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে লিখলো, তুমি চাইলে তাই হবে। কিন্তু আমি আমার অতীতকে ভুলতে পারবো না। অতীতই আমার একমুঠো অক্সিজেন।
-ওকে; বাই। বলেই শম্পা অফলাইন হয়ে গেল।
সজল কিছুক্ষণ চুপ করে স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে থাকলো। তারপর ফেসবুক থেকে সাইন আউট হলো। ল্যাপটপ শাটডাউন করার আগে ফ্ল্যাটের ইনস্টলমেন্টের এক্সেল ফাইলটা খুলে দেখতে গিয়েও শেষপর্যন্ত খুললো না। এখন একটু ঘুমানো দরকার।