আততায়িতা

গ্রাম-বাংলা (নভেম্বর ২০১১)

তমসা অরণ্য
  • ৬১
  • 0
(১)

বেলায়েত করিম ঝোলে মাখা হাতের আঙ্গুলগুলো আয়েশীভঙ্গিতে চাটতে চাটতে হঠাৎ হোটেলের বাইরের দিকটায় চোখ পড়ল।

“কি রে, খাবি?”

সাগ্রহে কিশোরী মেয়েটি ড্যাবড্যাবে চোখ তুলে সজোরে উপর-নিচে “হ্যাঁ-সূচক” মাথা নাড়ল। মেয়েটিকে ভেতরে আসার জন্যে হাত নেড়ে ইশারা করেই হোটেলের পিচ্চিটাকে ভাতের অর্ডার দিলেন।

“কি দিয়া খাবি? সবজি, মাছ না.. ক, কঅঅ...”

মেয়েটি নানা রকম ভঙ্গি করে এ এয়াও টাইপ অদ্ভুত গোঁঙ্গানী তুলে যা বলল তার অর্থ দাঁড়াল, সে মাছ দিয়ে খেতে চায়। করিম বুঝলেন, মেয়েটা বোবা। তিনি আবার সজোরে চেঁচিয়ে পিচ্চিটাকে মাছ তরকারি দিতে বললেন। পিচ্চিটা টেবিলে খাবার লাগাতে না লাগাতেই মেয়েটি হাত ধোওয়ার বালাই না করেই গপাগপ খেতে শুরু করল। করিম তৃপ্তির সাথে এমন বিরল দৃশ্যের অবতারণা হতে দেখে সবিস্ময়ে হেসে বলে উঠলেন,

“করোছ কি ছেমড়ি? আস্তে খা.. গলায় ঠেকব তো!”

মেয়েটি হঠাৎ আদুরে সুরের আলতো ধমক খেয়ে খাওয়া থামিয়ে ঢোক গিলতে নিতেই হেঁচকি শুরু হয়ে গেল --

“হেঁচুক, হিঁইইচুক...”
“হুর ছেমড়ি, হুঁশ কইরা খাবি তা না.. হইল তো?”

পানির গ্লাস এগিয়ে বললেন,

“নে পানি খা.. সোয়াস্তি পাবি।”

মেয়েটি ঝোলে-ভাতে মাখা হাতেই তড়িঘড়ি ঢকঢক করে সবটুকু পানি খেতে নিতেই এবার কড়া একটা ধমক খেল। গ্লাসটা টং শব্দ করে টেবিলটায় নামিয়ে রেখে হলুদ দাঁত বের করে করিমের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি একটা হাসি দিল।

“মা-বাপ কেউ আছে?”

মেয়েটি মুহুর্তেই ছলছল চোখে বিষন্নভাবে নেতিবাচক মাথা নাড়ল।

“থাকস কই? কার লগে?”

মামীর গরম পানি ঢালা ফোস্কা পরা পা’টা টেবিলের নিচে আলতো করে সরিয়ে ব্যথাটা হজম করে দূরের বস্তিটার দিকে হাত উঁচু করে ধরল। করিম তার মায়ের কুলখানিতে জনা-চারেক এতিম বাল-বাচ্চা খাওয়ানোর কথা মনে পড়তেই বলে উঠলেন,

“যাবি আমার লগে?”

মেয়েটি ডান দিকে ঘাড়টা ঈষৎ হেলিয়ে সম্মতি জানাল। করিম কিছুক্ষণ কি যেন ভাবলেন। তারপর প্রসন্ন মুখে বললেন,

“ল’ যাই.. আমার বাড়ি থাকবি, খাবি, কাম করবি... লহ..”

বাসন্তি; আমাদের গল্পের সেই মেয়ে। মামা-মামীর সংসারে ছেঁড়া চটির মতই এক কোণে পড়ে থাকা অবহেলিত কিশোরী। বিল দেয়া হলে উস্কখুস্ক চুলের তেলচিটে জামার বাসন্তি চলল নতুন আশ্রয়ে বেলাপুর থেকে ছ’-সাত গ্রাম পরের মাঝবয়েসী করিমের হাত ধরে।



(২)

“নিয়া আসলাম। এতিম।
দুইদিন বাদে আম্মার কুলখানি হের লাইগা...
তোমার কামে আইব, রহিমের মাও।”

জগতে নারী জাতটার তিন ধরন। কেউ লোহার চেয়েও কঠিন; হাল্কা ঠোঁকাতেই আমাদের মুখ-মাথা চ্যাপ্টা হওয়ার জোগার। কেউ বরফগলা পানি; একবার গলতে শুরু করলে আমাদের প্রশান্তির সীমা থাকে না। আর কেউ কেউ আবার আগুনজ্বালী মোম; নিজেকে নিঃশেষ করে ঘরে ঘরে আলোক উদ্ভাস তুলে ধরেন। করিম গিন্নী দূর্ভাগ্যবশত প্রথম সারির। তাই দরজা খুলে যেতেই অবাক হয়ে ভ্রুকুটি দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা গিন্নীকে এভাবেই চিরায়ত কৌশলে বশ করেন করিম। এরপর বাইরের ঘরে বাসন্তিকে রেখে শোবার ঘরে ঢুকে যুক্তি চলে স্বামী-স্ত্রীতে। স্বামীকে লুঙ্গি-গামছা ধরিয়ে ধুরন্ধর মহাজনী টাইপ চিপা হাসি ঝুলিয়ে করিম গিন্নী বাসন্তির কাছে চলে আসেন।

“নাম কি রে তোর?
এ আল্লা, তর তো জবান বন্দ!
আইচ্ছা, আইজ থিকা তর নাম... ‘বুবি’, হইল?”

বাসন্তি নতুন ঘর, নতুন নাম পেয়ে নিরাপদ সুখী দিনের আভাসে গদগদ হয়ে চকচকে চোখ তুলে হাসি দিল।

“আয়, তরে ঘর-বাইর ঘুইরা দেহাই।”



(৩)

সুখ নামের শুকপাখিটা যে কতটুকু স্থায়ী ক’দিন বাদেই বাসন্তি টের পেয়ে গেল। নতুন আশ্রয় তার কাছে যতীনের ঠাকুমার কাছে শোনা পুন্নামের চেয়েও ভয়ঙ্কর! এখানে দিন যেন ২৪ সহস্র বছর, রাত কয়েকটা মুহূর্ত মাত্র! বাইরের মানুষের কাছে করিম সাহেবের খাতির আরো কয়েক কদম বেড়ে গেছে বাসন্তির মত বোবা অসহায়াকে আশ্রয় দেয়ায়। গাঁয়ের স্কুল বা কোন অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি, ওয়াজ-মাহফিলে বিশিষ্ট বক্তা ইত্যাদি হবার সৌভাগ্যে তার সিজদা দেয়া কপালের দাগটা আরও প্রাজ্জ্বল, আরো গদগদে টাইপ দগদগে হয়ে উঠেছে। পাড়ার গিন্নীমহলেও করিম গিন্নীর বেশ নাম-ডাক। হাভাতে লোকের ঘরে.. পাত ছেড়ে ভাত দাঁড়াতেই... বিশ্বাসের প্রদীপ নিভু নিভু। আর তাই মামীর বঞ্চনাপীড়িত পোড়াকপালী হয়ত.. ঈশ্বরের উপর বিশ্বাস না রাখতে পেরেই স্বেচ্ছায় পা বাড়িয়ে ছিল নতুন আশ্রয়ের খোঁজে। ঘটনাক্রমে আজ তাই কর্মফলের হিসেব মেলাতেই বেলায়েত করিমের এই ঠিকানায় তার হাজতবাস।



(৪)

দু’দিনের বাসি ক্ষুধায় বাসন্তির পেটের ভেতর যেন খিদের ঘায়ে কুত্তা পাগল অবস্থার ইঁদুরগুলো গোল পাকাচ্ছে। মেহমানকে চা-বিস্কুট দিতে এসে হঠাৎ তার মনে পড়ল, প্রায়ই খালাম্মা না থাকলে করিম খালু তাঁকে ভাত-তরকারির লোভ দেখিয়ে আদর করে; বুকে-পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়। মাঝে-সাঝে বুক খামচে ধরা, ঠোঁটে টকাস করে চুমু দিয়ে বসা রহিম ভাই সেদিন রাতে হঠাৎ রান্নাঘরে ওকে জড়িয়ে ধরে নিচে ফেলে কয়েক ঘন্টা কি গা ঘিনঘিনে কারবারটাই না করল! ব্যথায় নিন্মাঙ্গটা জ্বলে-পুড়ে যাচ্ছিল। কিন্তু কাউকে বলেনি। সে বুঝে গেছে.. বললে এদের দেয়া ভাতের সহৃদয় পাটটুকুও চলে যাবে। তাই মনকে বলেছে ভুলে যা, চোখকে বলেছে বন্ধ থাক, শরীরকে বলেছে সয়ে যা। আজ সেই টেকনিকটাই খাটানোর চেষ্টা করল বেঢপ রকমভাবে জেগে ওঠা বনসাঁই বুকের উপর জামাটা তুলে ধরে। ওর নগ্ন বুক দেখে রহিমের বোনের শ্বশুরবাড়ির লোকটা থতমত খেয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন। করিম গিন্নী ছুটে এসে রকম-সকম দেখে লোকটার হাত-পা ধরে সাত-সতেরো বুঝিয়ে ঘটনা চাপা দিলেন। এরপর রাতে কয়েক প্রস্থ চলল বাসন্তির নরকবাসের পুরাতন পাঠ। মরা কুকুর তড়িঘড়ি আলগা মাটিতে চাপা দিতে গেলে ক’দিন পর মাটি উঁচু হয়ে ভেঙ্গে পড়ে দূর্গন্ধ ছড়ায়। বাসন্তির সেই ঘটনাও তার শেকড় ছড়াতে শুরু করেছিল। এর ক’দিন পর পর অভুক্ত বাসন্তির সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনার ফল দাঁড়াল, চক্ষুলজ্জার গায়ে পেচ্ছাব ঢেলে থোড়াই কেয়ার করা টাইপ ক্রমশ বেড়ে চলা পেট। করিম গিন্নীর গঞ্জনার ভাষায় “পেট বাজানো”। অতঃপর গাঁয়ের পঞ্চায়েতে ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের দলের যাকে-তাকে যখন-তখন বুক দেখানো, জড়িয়ে ধরা, নিন্মাঙ্গের স্পর্শ করানো, বিশেষ ইশারা করা ইত্যাদি ইত্যাদি সব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার দায়ে পাগল সাব্যস্ত করে দোররা মেরে করিম পরিবার থেকে তাড়িয়ে দেয়া হল। বাসন্তি সেদিন বাতাস ভারি করা তীব্রতায় আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার করে যতই করিম খালু, রহিম ভাই আর.. সেই যুধিষ্ঠিরদের দেখিয়ে তাঁদের বোল খুলে দিতে চেয়েছে, ততই সবাই তাঁকে পাগলি ভেবে আরো প্রচন্ডতায় দুষেছে। তারপর তার ঠাঁই অন্য কোথাও, অন্য কোনখানে।

(৫)

গ্রাম ছাড়া হয়ে হাট-মাঠ পেড়িয়ে কতজনের কাছে চেয়ে-পেতে ভাত খেয়েছে বাসন্তি! বোকাটে ভঙ্গিতে দু’পা ছড়িয়ে ছড়িয়ে হেঁটে বাড়িয়ে তুলেছে পেটের আকৃতি। যখন যেখানে গেছে সেখানেই আলোতে কিংবা অন্ধকারে টের পেয়েছে লোলুপ চকচকে ভীষণ সব দৃষ্টির গুপ্ত অনুসরণ। আজ হাঁটতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। যেন.. যেন... পেটটার ওজন দ্বিগুণ-তিনগুণ হয়ে গেছে। কিংবা কোন ছোট্ট-খাট্ট হাতি ঢুকে পড়েছে চামড়া ঘেরা সেই বিশাল গরাদখানায়। কিন্তু পৃথিবীতে ক্ষুধাই সম্ভবত একমাত্র ব্যাপার যার জন্যে গরিবের মরারও সময় থাকে না। আর এ তো সামান্য হাতিপোষা ব্যথা! নদী পাড়ের গাছতলায় একপাশ হয়ে শুয়ে থাকা বাসন্তি বটগাছটার মোটা শেকড় ধরে ক্ষুধার প্রচন্ডতায় উঠে দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছিল। সারাজীবনে এই একটা জিনিসের উপরে ওর কোন সহ্য ক্ষমতা নাই। ক্ষুধা লাগলে আন্ধারী লাগে, চোখের সামনে সাদাটে ভাতের সোনামুখই ভাসে কেবল। তখনই দে ছুট বাজারের দিকে। তারপর এ-ওর কাছে হাত পাতে। দয়াপরবশ হয়ে হয়ত কোন কোন ক্রেতা দু’চার টাকা দেয়, কোন বিক্রেতা পাশের হোটেলে ভাত খাইয়ে বিলটা দিয়ে দেয়। এভাবে কোনদিন দু’বেলা জোটে, আর কোনদিন একবেলাই জোটানো দায় হয়ে পড়ে। রোজ রোজ একই মুখের ফকিন্নীকে কোনরকম সুবিধাপ্রাপ্তি ছাড়া কে আর বল লাই দিতে চায়? কিন্তু কেন যেন.. মাঝে-সাঝে ভেতরে নাড়া দিয়ে যাওয়া পেটটার প্রতি তার সব মনোযোগ। তাই সহজে আর সেই পুরনো পথে ঘেঁষে না। বাজারের কাছাকাছি আসতেই হঠাৎ পেটটা তীব্রভাবে ব্যথা করতে থাকে। বাসন্তি ব্যথার চোটেও ক্ষুধার কথা ভোলে না। আরও দ্রুত হাঁটার চেষ্টা করতেই হাত-পা ছড়িয়ে রাস্তায় শুয়ে পড়ে। ভ্যানে করে পাশ দিয়ে যাওয়া এক বুড়ি মহিলা সঙ্গের লোকটাকে ভ্যান থামাতে বলে। এরপর নেমে এসে বাসন্তির রকম-সকম দেখে লোকটাকে চিৎকার করে ডাকে,

“সখিনার বাপ, এদিক আহেন।
ছেমড়ির বেদনা উডছে।
গঞ্জের হাসপাতালে নেওন লাগব.. শিগগির আহেন...”

ততক্ষণে বাসন্তির পানি ভাঙ্গতে শুরু করেছে। সখিনার বাপ মাথার টুপিটা ভাল করে মাথায় চেপে ভ্যানচালককে নিয়ে টেনে-টুনে কোন রকমে বাসন্তিকে ভ্যানের পাটাতনে শুইয়ে দিয়েই পড়ি কি মরি দে ছুট। পৌনে একঘন্টার দীর্ঘ পথ পেড়িয়ে তারা হাসপাতালে পৌঁছল। ডাক্তাররা বয়স অনুযায়ী একটু বেশিই সিরিয়াস কেস দেখে দ্রুত ওটির পাশের রুমটাতে সিফট করলেন। তারপর সেদিন চিৎকারে আকাশের সবটুকু মেঘের জল ঝরিয়ে বাসন্তি জন্ম দিল এক চাঁন-সফেদী ছোট্ট ছোট্ট হাত-পাওয়ালা মাংসপিন্ডের। ডাক্তাররা যখন বাচ্চাটাকে ওর পাশে শুইয়ে দিল তখন এক বেহেস্তী হাসির ঝলক ওর চোখে-মুখে ঝিকিয়ে উঠেই মুহূর্তে ধারাল তলোয়ারের মত তীব্র এক জান্তব ছাপ তা পালটে দিল। মাংসপিন্ডটার প্রতিটি নড়াচড়া লক্ষ করতে করতে হঠাৎ দেখল, মুখটা যেন ক্রমেই একবার করিম খালু, একবার রহিম ভাই, এভাবে বারবার একেকজনের মুখাবয়বে পালটে যেতে থাকল! ঘেন্নায় বাসন্তির গা গুলিয়ে আসতে চাইল। হঠাৎ বাচ্চাটার গলা দু’হাতে ভীষণ করে চেপে ধরে ভয়ঙ্কর রকম গুঙ্গিয়ে উঠল সে। পাশের বেডের মহিলাগুলো কান্ড দেখে চিৎকার করতেই ডাক্তার-নার্স ছুটে এসে বাসন্তির পাশবিকতায় মুহূর্তখানেক থমকে দাঁড়াল। তারপর দ্রুত ছুটে এসে বাচ্চাটাকে ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু বাসন্তি যেন মরণপণ করে বসে আছে, সে তার হাতকে আরও দৃঢ় করল। একসময় বাচ্চাটাকে ছুটিয়ে নিলেও ততক্ষণে পাখি খাঁচাছাড়া হয়েছে। ডাক্তার দেখলেন, রক্তশুন্য ছোট্ট সফেদ দেহটা যেন আরও সফেদ হয়ে উঠেছে। আর গলায় অবাধ্যরকমভাবে পড়ে আছে বাসন্তির দশ আঙ্গুলের দগদগে দাগ! ভোজবাজির মত হঠাৎ যে বাসন্তির কি হল! ডাক্তারের হাত থেকে বাচ্চাটাকে ছিনিয়ে নিয়ে চোখে-মুখে গাড় করে চুমু খেল। তারপর এ এয়াও টাইপ বিচিত্র সব শব্দে আদুরে ভঙ্গিতে কি যেন সব বলতে লাগল। নার্সরা বাচ্চাটাকে ছিনিয়ে নেয়ার জন্য এগুতেই ডাক্তারের ইশারায় থেমে গেল। ভয়ে-আতঙ্কে সবাই দেখতে লাগল, বাসন্তি কামিজটা উঁচিয়ে ধরে দুধে ভারি হয়ে আসা অপুষ্ট স্তনটা বাচ্চার মুখে পুরে দেয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু কিছুতেই পারছে না। শেষে মুখের উপরে স্তনের বোঁটাটা ছুঁয়ে রাখতেই দরদর করে হলুদাভ দুধের স্রোত বয়ে যেতে লাগল শিশুটির ঠোঁটের কোণ বেয়ে বেয়ে। কোন এক রোগিনীর শয্যাপাশে ভাত খেতে থাকা তার বুড়ো এক সঙ্গিনী হঠাৎ এমন আজব দৃশ্যে চমকে উঠে “আল্লা গো” বলে চিৎকার করেই মুর্ছা গেলেন। ডাক্তার সচকিত হয়ে মহিলাকে সরিয়ে নেয়ার জন্যে নার্সদের ইশারা করলেন। চিৎকারের আকস্মিকতায় বাসন্তি তাকিয়ে দেখল, একথালা ভাত! তখনই বাচ্চা ফেলে ওদিকটায় ছুটে গিয়ে থালাটা সজোরে ছুঁড়ে মারল। এবার ডাক্তার কি যেন ভেবে মুহূর্তে দু’চারজঙ্কে নিয়ে বাসন্তিকে ধরে ফেললেন। তারপর ওকে লেবার রুমে নিয়ে যেতে বলে দ্রুত নিজের রুমে গিয়ে মোবাইলে বিপ বিপ শব্দ তুলে নাম্বার ডায়াল করতে লাগলেন। তখন তার কপালে একরাশ ঘামের উদয়, টুপটাপ তা আবার ঝরেও পরছে।


(৬)

“তোমার ভাত..”

দু’হাঁটূর মাঝে গুঁজে রাখা মুখ তুলে নিষ্প্রভ চোখে বাসন্তি মহিলার চলে যাওয়া দেখে নিল। পায়ের কাছে কিছুটা সভয় দূরত্ব রেখে ভাতের প্লেটটা রাখা। বাসন্তির মুখে অবজ্ঞার একটা হাসি খেলে গেল।

“হেরা আমারে ডরায়!
পাগল? বাসন্তি পাগল..?
হহ, পিরথিমীর হগলতে জানুক.. হেগর বুবি পাগল...”

বাসন্তির পেটে তখন অনশনরত অসংখ্য বুবুক্ষের অন্নপ্রাসনের প্রস্তুতি চলছে। তাই সে দেয়ালটা ধরে ব্যথাতুর শরীরটা টেনে তোলে। তারপর ধীরে ধীরে পা টেনে টেনে কদম দুই হেঁটে প্লেটের কাছটায় এসে বসে। ডান হাতের তর্জনী আঙ্গুলটা টলটলে ডালে ভাসা ভাতের ভেতরটায় গুঁজে দিয়ে ঘোটা দিতে দিতে হঠাৎ নাড়ি ছেঁড়া ধনটার কথা মনে পড়তেই বুকের ভেতরটা ভীষণ রকম বিষিয়ে ওঠল। ততক্ষণে বুকের ভেতরের প্রতিটি গ্রন্থি দুলে উঠে হলুদাভ স্রোতস্বিনীর প্রবাহে ফুলে উঠেছে। স্তন দু’টি দুধে ভার হয়ে বোঁটার বাইরে স্রোতটাকে ঠেলে দিল। বাসন্তির সদ্যপ্রয়াত মাতৃহৃদয় পুনুরুত্থানের ইঙ্গিত পেল যেনবা! দু’টো সাদা ভাত ক্ষুধার প্রবল গ্রাসে এভাবে সম্ভ্রম আর সন্তান দু’টোই কেড়ে নেবে জানলে, পাত থেকে ভাত ছুঁড়ে ফেলে বিধাতার হাত থেকে ঠিক ওদের বাঁচিয়ে আনত বাসন্তি। বাসন্তি চিৎকার করে মেঝেতে আছড়ে পড়ল। দু’হাতের সমস্ত শক্তি দিয়ে মেঝেতে আঘাত করে খোদার আরশ কাঁপিয়েই দেবে যেনবা! প্রবল আক্রোশে বনবাসী স্বজনহারা শেয়ালের মত চিৎকার করে উঠল। ওর একটানা বোবাটে গোঁঙ্গানীময় আহাজারীতে মুখের ভেতর থেকে গলগল করে টকটকে রক্ত ছলকে পড়ছে, ওদিকে বুক সেই কখন ভিজে গেছে শাল দুধের কাল-অভিশাপে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
তমসা অরণ্য আবু ওয়াফা মোঃ মুফতি@ ধন্যবাদ!
তমসা অরণ্য তৌহিদ উল্লাহ শাকিল@ হুম, ভাই! আছেন কেমন? ধন্যবাদ!
আবু ওয়াফা মোঃ মুফতি গল্পের হাত দারুন! খুব ভাল লাগল |
sakil বাসন্তির মত কষ্টের পরিনতি দেখতে বেশ কষ্ট লাগে . অনেক সময় এসব নিজেকে ও বিব্রত হতে হয় . অসাধারণ
তমসা অরণ্য বিষণ্ণ সুমন@ আপনার সুচিন্তিত মন্তব্যের জন্যেও ধন্যবাদ, বন্ধু!
বিষণ্ন সুমন অসাধারণ গল্প । বর্ণনাভঙ্গিতে পরিপক্কতার ছাপ সুস্পষ্ট । মন ভিজিয়ে দিল নিমেষেই । গল্পকারকে আন্তরিক ধন্যবাদ ।
আশা এক গল্পের মাঝে যেন হাজারো বাসন্তীর করুণ পরিণতি চোখের সামনে ভেসে উঠল। সমাজের ঐসব বদের হাড্ডির পতন হবেই একদিন। তাতে আপনার লেখনিশক্তি যাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে সেই কামনা করছি। আপনার লেখনি অত্যন্ত চমৎকার। শুভকামনা রেখে গেলাম আপনার জন্য।
ঝরা অনেক অনেক ভালো লাগলো

০৯ ফেব্রুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ১৫ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪