ছাতায় বিষ্টি দরে না, আব্বা!

ঈদ (আগষ্ট ২০১৩)

তমসা অরণ্য
  • 0
  • 0
  • ২৯
“হ্যালো, কোথায় তুমি?”
“আছি.. তোমার আশেপাশেই কোথাও।”
বিনোদ উৎসুক ভঙ্গিতে মূল গেটের চারদিকে বেশ ভাল করে দেখে নিল।
“কই, দেখছি না তো!”

“বিনোদ, রাইট?”
-- বলে একটা মেয়ে হাসিমুখে এগিয়ে এল, কানে মোবাইল সেট ধরে রাখা।
বাহ, কি যে সুন্দর!
অবাক হলে বিনোদের চোখ ছানাবড় হয়ে যায়, যেন.. রবারের পিংপং বল।
“হুঁ..” -- বলে অবাক হওয়া আকস্মিকতা কাটিয়ে বলল,
“আই সি.. কুসুমিতা, হুম?”
“রাইট য়্যু আর।”
-- এভাবেই মোটামুটি একটা বিস্ময়ের মধ্য দিয়ে ঘটনার শুরু। সংবাদপত্রে দেশীয় চলচ্চিত্রের হালচাল আর আবু ইসহাকের একটি অখ্যাত উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র তৈরির প্রস্তাবনাসম্বলিত চমৎকার একটা আর্টিকেল লেখার পর পত্রিকা অফিস থেকে বিনোদের ঠিকানা সংগ্রহ করে ২/১টা চিঠি চালাচালির মাধ্যমে কুসুমিতার সাথে পরিচয়। তারপর মাঝের হিসেব মোটামুটি সহজ। ঘ্যাঁতঘ্যাঁতে গল্প-উপন্যাস আর প্যাঁকপ্যাঁকে নাটক-সিনেমার মতই দু’জনের মধ্যে বাঙ্গালির সেই.. চিরায়ত প্রেমের সূত্রপাত। এদেশের ছেলে-বুড়ো কম-বেশি প্রায় সবাই-ই কখনো-সখনো গোত্র-বর্ণ-শ্রেণী নির্বিশেষে গেমকে প্রেম বলে অচিরেই ধোঁকা খায়। তসলিমা নাসরিনের একটা কথা বেশ মনে পড়ছে। অনেকটা এরকমই যেন বলেছিলেন, এদেশের ছেলে-মেয়েতে কখনো বন্ধুত্ব হয় না। হুম তা-ই। এদের যা হয়.. তার নাম হয় প্রেম; নয় গেম! বিনোদ সাথে থাকা বন্ধু দীপেনের সাথে কুসুমিতার পরিচয় করিয়ে দিল।

“ওহ হো.. ব্লু টি-শার্ট? মাই ফেভরিট! সো সুইট অফ ইউ, নদ।”

কুসুমিতার চমৎকার কন্ঠে সামনাসামনি হররোজ দিনে-রাতে মুঠোফোনে খলখলিয়ে হেসে-ভালবেসে ডেকে যাওয়া ওর দেয়া স্পেশাল ডাক নামটি শুনে বুকের ভেতর যেন.. লক্ষ পায়রা উড়াল দিল। বেশ স্মার্ট মেয়ে বটে। হাঁটতে হাঁটতে কত কথা হল! হিন্দি সিনেমা-সিরিয়াল, দেশ-রাজনীতি-বিশ্ব.. কোন কিছুই তালিকা থেকে বাদ পড়ল না। হাঁটার ক্লান্তি কমিয়ে নিতে স্মৃতিসৌধের পেছনের দিকের পুকুরের সামনে ঘাসের উপর বসল ওরা। কথার ফাঁকে ফাঁকে দীপেন আর কুসুমিতার চোখাচোখি, সদ্য পরিচিত যুগল চক্ষুদ্বয়ের তীব্র আকর্ষনে উদ্দিপ্ত দৃষ্টির স্মিত হাসিমুখো বিনিময়ের কিছুই এড়াল না বিনোদের। কেবল.. কোথাও যেন কি নেই, কি যেন কি অদ্ভুত এসব টাইপ অকারণ উদ্ভট-অশুভ কিছু একটা ভেতরে ভেতরে বোধ হচ্ছিল। শুরুর ভাল লাগাটুকু ভীষণ রকম খারাপ লাগায় পালটে যাচ্ছে। নিজেকে বড্ড অপাঙক্তেয় মনে হচ্ছে।

“দীপেন, আপনার চোখ দু’টো কিন্তু বেশ!”
“তাই নাকি! হুম্ম..?”
-- হয়ত কিছুই না, তবু.. ওদের হাবভাব চমকে দিয়েই চমক ভাঙ্গাল বিনোদের। ঐ খানিক দূরেই সরকারী ঘাস-কাটুনে কর্মচারীর দল বিশাল একহাত ধারাল রাম দা দিয়ে খ্যাঁচাখ্যাঁচ খ্যাঁচাখ্যাঁচ অবাধ্যরকম বেড়ে ওঠা ঘাস কাটছে। যদি ওদের কেউ এসে এক কোপে দীপেনের কল্লাটা বলীর পাঁঠার মত ঘ্যাঁচ করে দশহাত দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে যেত!

শহর-গ্রাম সব যখন মুঠোফোনের হাওয়ার ভেসে আসা কথা আর বার্তায় দুলছে, তখন এই যাই যাই ডাকবিভাগই বিনোদ-কুসুমিতার কিউপিডের কাজটুকু করে দিয়েছে। তবে মুঠোফোনের নম্বরটা পেতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি কারোই। মনের দরজায় যখন সবে মাত্র কড়া নাড়ার শব্দ হচ্ছে, তখন খুলে দিতে আপত্তি কি আর থাকে রাধা-কৃষ্ণের সামান্য ভক্তের? দিয়েছিল নির্দ্বিধায়। প্রথম প্রথম.. এ-ও সপ্তায়, তারপর দু’তিনদিন বাদে বাদে, তারও পর.. প্রতিদিন, তারও পর পর.. ঘন্টা দুই বাদেই। এভাবে কখন যে.. এধারের সূর্য ওধারে এগোল... সময় গড়াল, দূরত্ব নাই হতে হতে নৈকট্যের দাবিদার হয়ে উঠল! তাই আজ ঘটনার ঘনঘটায় অঘটনের এই পর্দা উঠল। এভাবে নিজেকে অচ্ছুত কোন ভাঁড়ের চরিত্রে অভিষেক হতে হবে, ঘন্টা চারেক আগে স্বপ্নেও ভাবেনি বিনোদ। অদৃশ্য পরিচালকের প্রতি বিষম রাগ হচ্ছে।

“ছার, ফুল নিবেন? আপা রে মানাইবো কইলাম..”

ময়লা হাফপ্যান্ট পরা খালি গায়ের পিচ্চিটা মুখের কাছে সারি সারি ঝুলিয়ে রাখা হাতের বকুল ফুলের মালা থেকে দু’টা বাড়িয়ে ধরতেই বকুলগন্ধী কড়া ঘ্রাণে সম্বিত ফেরে তাঁর। পরিচালকের বিরক্তিটা পিচ্চিটার উপর গিয়ে পড়ে বিনোদের। খুব কড়া করে ধমক দিয়ে একটা কিছু বলতে যাবে, আর..
“না রে, দু’টোয় হবে না। তিনটা দে..”
বিস্ময়ের চোটে শক্ত হয়ে আসা চোয়ালের দাঁতগুলো আস্তে আস্তে হাল্কা হয়ে আসে বিনোদের, কিন্তু পরক্ষণেই বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে যায়। কুসুমিতা ফুলগুলো হাতে নিয়ে নেড়ে-চেড়ে একটা দীপেনের হাতে জড়িয়ে দিল। বিনোদ না দেখার ভাণ করে পিচ্চিটাকে মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করে দিতে নিতেই, কুসুমিতা মানিব্যাগটা কেড়ে নিয়ে পার্স থেকে দু’টা কচকচে দশ টাকার নোট দিয়ে বলল,
“যা ভাগ..”
এরপর মানিব্যাগ ফিরিয়ে দিতে দিতে হাসতে হাসতে বলল,
“নিন সাহেব আপনার ওয়ালেট। মেয়েদের ফুল কিনে দেয়ার মত স্পর্ধা করেন.. সাহস তো মন্দ না!”
বিনোদ স্মিতমুখে খানিকটা হাসার চেষ্টা করে, কিন্তু দীপেনের নাকের কাছে হাত নিয়ে বিভোর হয়ে শুঁকতে থাকা মালাটা দেখে তৎক্ষনাৎ ফাঁটা ঠোঁটের হাসির মতই তা ফুরিয়ে গেল।

“টেক ইট, দিজ ওয়ান ফর য়্যু..”
অপ্রভিতভঙ্গিতে কুসুমিতার ছুঁড়ে দেয়া মালাটা কোলের কাছ থেকে তুলে নিল বিনোদ। রাস্তার কুকুরের চেয়ে খুব বেশি কিছু মনে হচ্ছে না নিজেকে। এতটা অবহেলা!

দীপেনকে আইসক্রীম আনার কথা বলে সরিয়ে বেশ স্মার্টলি কুসুমিতা অদ্ভুতুরে কথা পাড়ল,
“আআম.. নদ, একটা কথা। নেভার মাইন্ড, আমি কিন্তু কুসুমিতা না। আমি...”
থমকে গিয়ে পকেটে রাখা হাত বের করে ঘাড় ঘুরিয়ে ভ্রু কুঁচকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে পেছনে তাকাল বিনোদ।
“নয়!”
“হুঁম, আমি নীলা। কুসুমিতার ফ্রেন্ড।”
“তু-তুমি.. আইমিন আপনি আ-পনি.. কি বলছেন আপনি জানেন?”
“আই নো.. আই নো... ইটস রিয়েলি স্বকিং নিউজ ফর ইউ। বাট..”
“থামো সুমিতা, দ্যাটস ইনাফ! আমি জানি, এটা তুমিই.. কুসুমিতা; কোন নীলা-টিলা নও। তোমার ভয়েস চিনতে আমার খুব কি কষ্ট হবার কথা?”
“উম, দ্যাটস দা পয়েন্ট। বাট.. আমরা দু’জনেই কথা বলতাম। সামটাইমস ও, সামটাইমস...”
বিনোদ তাচ্ছেল্যের সুরে বলে ওঠে,
“আচ্ছা!”

“বিনোদ?” -- গাঢ় গলায় কুসুমিতা বিনোদের দিকে তাকাল। অন্যমনস্কভঙ্গিতে উত্তর,
“উঁ?”
“ডু ইউ হেল্প মি?”
“হোয়াট কাইন্ড অফ?”
“আই.. আই... আই লাইক হিম..”
বিনোদের চোখ দু’টো শানানো তলোয়ারের মত ঝিলিক দিয়ে উঠল। এই “হিম”-টা যে কে বুঝতে কোন অসুবিধাই হল না। এরই মধ্যে দীপেনও ফিরে এসেছে। খালি হাতে নয় একদম! হাতে তিন তিনটে ইগলু কোম্পানীর কোণ আইসক্রীম। শেষের কথাগুলো দীপেনের কান এড়ায়নি। চুপচাপ সবার হাতে পৌঁছে দিল আইসক্রীমগুলো। কারো মুখে কোন কথা নেই। কুসুমিতা আর দীপেন আইসক্রীম খাওয়ায় মনোযোগী হবার ভাণ করে নীরব পায়ে এগোয়। বিনোদ ওদের পেছনে ফেলে অনেকটাই এগিয়ে গেছে। গলে যাওয়া আইসক্রীমটা হাত থেকে ছুঁড়ে ফেলে থমথমে মুখে হঠাৎ প্রশ্ন করে,
“কুসুমি.. উম.. নীলা, তো.. কুসুমিতা এল না কেন?”
কুসুমিতা খাওয়া থামিয়ে নির্বিকারভঙ্গিতে উত্তর দেয়,
“এসেছিল। কিন্তু ভীষণ নার্ভাস ছিল তাই.. বোনের বাসায় চলে গেছে ধামরাইয়ে। অন্য কোনদিন দেখা করবে বলেছে। তাই তো আমি..”
বিনোদ “হুম”-সূচক শব্দ করে আবারও গম্ভীর হয়। এই অবসরে দীপেন-কুসুমিতার চোখাচোখি।
“চলো.. আইমিন চলুন, যাওয়া যাক।”
“ক-ক-কোথায়!”
“চমকাবার কী আছে, মিস. নীলা? যার যেখানে যাবার কথা সেখানে!”
--বলে বিনোদ দ্রুত ফেরার পথ ধরল।
“ওহ, হুম.. তাই তোহ! অনেক ঘোরাঘুরি হয়েছে, চলুন চলুন..”
গটগট করে একটানা নিঃশব্দে হেঁটে চলে বিনোদ। বিনোদ একা, প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে গভীর ভাবনায় ডুবে চলেছে। নাহ, হিসেব কিছুতেই মিলছে না! পেছনে কুসুমিতা ওরফে নীলা আর বন্ধু দীপেন পাশাপাশি, নিচু গলায় নিজেদের মধ্যে কিছু বলাবলি করছে আর কিছুক্ষণ পর পর যতটা চেপে পারা যায় হাসার চেষ্টা করছে। খুব ইচ্ছে করছে ঘাড় ফিরিয়ে দু’টোকে দেখে। কিন্তু অমন ইচ্ছের গায়ে পানি ঢেলে দিয়েই স্মৃতিসৌধের গেট দিয়ে বেরিয়ে আসে সে। তারপর বিনা বাক্য ব্যয়ে রাস্তাও পাড় হয়ে যায় সবাই। বাসের জন্য অপেক্ষা চলছে, এমন সময়ে দীপেন-নীলার পারস্পারিক চাহনীর লুকোচুরির চটক ভেঙ্গে দিয়ে বিনোদের কথা বলে ওঠা—
“কুসুমিতা? স্যরি, নীলা!”
“ইয়েস? ইটজ ওকে!”
আবারও নিরবতা, চট করে কিছু ভেবে নিচ্ছে বিনোদ।
“কিছু বলবে, ন.. বিনোদ?”
“হুম, আমি আপনার সাথে যাচ্ছি!”
“মান্নেহ?”
“মানে আমরা ধামরাই যাচ্ছি। আইমিন, আপনি আমায় নিয়ে যাবেন। আর দীপেন তুই হলে চলে যা!”
--কুসুমিতার চোখে বিস্ময় এবং আতঙ্ক দুই-ই। নিজের কানকে কিছুতেই যেন বিশ্বাস করতে পারছে না ও। দীপেনের চোখ নিজের পায়ের আঙ্গুল দেখছে, তার জন্যে বিনোদের কথা বিস্ময়কর হয়ে আসেনি। বরং চিরপরিচিত বন্ধুর ঐ সব মেনে চুপ মেরে যাওয়াটাই ভেতরে বিস্ময় জাগাচ্ছিল। এই একগুঁয়ে স্বভাবটাই তো বিনোদের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। তার মানে “সামথিং ইজ রং”-এর এই খটকাটা টের পেয়ে গেছে ও! তাই সত্য জানার স্বভাবসিদ্ধ আচরণের জানান দিচ্ছে।

“আই নো.. আই নো.. তোমার ভেতরে কি হচ্ছে, নদ। আকচুয়েলি.. আই ক্যান ফিল! বাট..”
“নো, নো.. ইউ কান্ট ফিল, মিস. নী-লা! ইয়েস, ইউ কান্ট..”
“স্ট্রেঞ্জ, ধামরাই যাবোটা কোথায়? আর কেনইবা?”
“হাহ হা হা.. হোয়াট আ জোক! এর মধ্যেই ভুলে গেলেন? আপনার বান্ধবী কু-সু-মি-তা ‘বোনের বাসায় চলে গেছে ধামরাইয়ে’ বললেন যে!”

নীলা অপ্রভিত হয়ে তাকিয়ে বিনোদের দিকে। এই ছেলে খেপলো নাকি? এতটা ভালবাসে! সবটা জেনেই ছাড়বে দেখছি, কী যন্ত্রণা!

“কি হল? চুপ খেয়ে গেলেন যেহ? ডোন্ট ওওরি, আমি সব ম্যানেজ করে নেবো। কাউকে কিছু বুঝতে দেবো না, জাস্ট ওর সাথে একান্তে কথা বলে জেনে নেবো—‘কেন সে এমন করল, কি তার ইচ্ছা কি এমন ঘটল যে দেখা না করেই চলে গেল’ এইসব আর কি!”
“নদ, ওর বোনের শ্বশুড়বাড়ি খুব কঞ্জারভেটিভ। এভাবে একজন ছেলেবন্ধুকে নিয়ে গেলে হাজার কথা উঠবে। ইউ আর আ স্মার্ট পার্সন, বুঝতে পারছেনই তো..”
--ড্যাবড্যাব চোখ মেলে নীলা বিনোদের দিকে তাকিয়ে দেখছিল, লাস্ট ওষুধে কাজ করে কিনা। চ
“হুম, বুঝলাম! আমার যা বোঝার আমি বুঝে গেছি। কথায় কথায় অনেক বাস মিস করেছি। এবার একটায় উঠি। চল দীপেন..
নিরব দর্শক দীপেনের বুকের ঢিপঢিপে ভাবটা হঠাতই কেটে গেল, না চাইতেও মুখের হাসি দাঁত বের করে নিজের উপস্থিতিটা জানান দিয়ে বসল। থতমত খেয়ে সাথে সাথে নীলার দিকে তাকাল, নীলাকে নিশ্চিন্ত আর ডিটারমাইন্ড দেখাচ্ছে। কী উপস্থিত বুদ্ধি যে ওর! ভেবে বেশ গর্ব হচ্ছে।
কাছে চলে আসা একটা বাসে কেউ-কারও দিকে না তাকিয়েই হুড়মুড় করে উঠে পড়ল ওরা। দীপেন আর বিনোদ ডানদিকের সারিতে, নীলা একা বাঁদিকের সারির সিটে। কেউ কোনো কথা বলছে না। যেন এই নিরবতাটা না হলেই নয়। অথচ গোটা বাসটা হঠাত আসা টিপটিপে বৃষ্টির আগমনের উদ্দেশ্য-পরবর্তী অবস্থা-পরিণতি নিয়ে আলাপচারিতায়, তর্কে-বিতর্কে সরগরম হয়ে আছে। ম্যাসেজের শব্দে বিনোদ দীপেনের হাতের দিকে তাকাল। ও অমন অস্বস্তিবোধ করছে কেন? ওকে রিল্যাক্স করতে নীলার দিকে চোখ ঘুড়িয়ে নিল। নীলার চোখও মোবাইলের স্ক্রীনে! হঠাত ম্যাসেজের শব্দে আর মোবাইল স্ক্রীনের লাইট জ্বলে ওঠার সাথে সাথে ওর ঠোঁটে ফুটে ওঠা কেমন মিষ্টি রকম এক দুষ্টু হাসি চোখ এড়াল না বিনোদের। কি মনে হল, হঠাত চট করে দীপেনের দিকে ঘাড় ঘোরাতেই হাতের মোবাইলটা তড়িঘড়ি লুকালো ও। কি যেন আবারো বোঝা হয়ে গেছে দৃষ্টি নিয়ে বিনোদ সোজা হয়ে বসল, ম্যাসেজ চালাচালি চলছে তো চলছেই। তবে এবার অনেক সতর্কতা নিয়ে, রিংটোন সাইলেন্ট করে। এক একটা ম্যাসেজ আসা-যাওয়া টের পায় আর বিনোদের ভেতরটা ছুড়ির আঘাত অনুভব করে। তবু আহত দৃষ্টিটাকে ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চলে তার ড্রাইভারের সামনের জলের ফোঁটাদার বিশাল কাঁচটায়। নাহ, এভাবে হয় না!

“এখানে রাখেন তো ভাই, নামবো!”
দীপেন হা করে তাকিয়ে।
“একটা কাজ করতে ভুলে গিয়েছিলাম। তোরা যা, আমি সেরে আসছি।”
নীলার স্পষ্ট খুশিটা চাপা দেয়ার ব্যর্থ ন্যাকামীটাও চোখ এড়ায় না বিনোদের।
“আসছি, নীলা। ভাল থেকো কুসুমিতা!”
-- বলে উত্তর শোনার অপেক্ষা না করেই নেমে পড়ল। নীলার খুশি দপ করে নিভে গিয়েছিল হঠাত, মিথ্যার গায়ে সত্যের চাবুক পড়ল কি!

মোবাইলটা একটানা চিতকার করে চলেছে বাস থেকে নামার পর থেকেই। কপাল কুঁচকে পকেট হাতড়ে রাগত হাতে চিতকারটা থামিয়ে দিল। এবার আর কোন কলই আসবে না। বড় বড় করে দু’বার করে শ্বাস নিল আর ছাড়ল। একটু রিল্যাক্সড হয়ে আবার হাঁটতে শুরু করতেই মুখের ভেতরটা কেমন বিস্বাদ বিস্বাদ ঠেকল। এবার সতর্কভঙ্গিতে হেঁটে একটা পানের দোকান থেকে মিষ্টি জর্দামাখা এক খিলি পান বেশ আয়েশীভাবে মুখে পুরে পা বাড়াতেই টিপটিপে বৃষ্টি থেকে মুষলধারীর সাথে বিনোদের এই বর্ষায় প্রথম আলাপ। ভিজে যাচ্ছে, অল্প থেকে পুরো ভিজে যাচ্ছে। ডেইরী ফার্মের ভেতরদিকটার রাস্তায় ঢুকে পড়ল সে। কত সাত-পাঁচ ভাবল, আজকের কথা, গতকাল পর্যন্ত কুসুমিতার সাথে যা যা হয়েছিল তার সবটা এক এক করে। ধরা পড়ে গিয়েছ নীলা, প্রতিদিনের অভ্যেস একদিনের সতর্কতার বাঁধ মানেনি। খুব ঠিকঠাক ধরা পড়ে গেলে— এইসব ভাবতে ভাবতেই আনমনে হেঁটে চলছিল সে।

“ছাতায় বিষ্টি দরে না, আব্বা!”
কথাটা কানে যেতেই ঘুরে দাঁড়ায় বিনোদ। সত্যি-ই তোহ ‘ছাতায় বৃষ্টি ধরল না ওর-ও’।

“ক্যারে ছ্যাঁরা, এত কইরা কইলাম কোলে ওড, কোলে ওড। হুনলি না। বোজ অহন!”
“ন্যাতাইন্না পুরান ছাতা, টুডা-ফুডা। আমার কি দোষ?”
“চুপ থাক, দিমু কেন্নু। জলদি ল..”

বাচ্চা ছেলেটা বাপের তাড়া আর ছেঁড়া ছাতায় ছিটকে পড়া বৃষ্টির বেপরোয়া ছিটে থেকে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে করতে আধ-ভিজে হয়ে হয়ে দৃষ্টির আড়াল হয়ে গেল। বিনোদের দৃষ্টি তবু কিছুক্ষণ ওখানেই দু’টো মানুষের সেই অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার পথেই আনমনে তাকিয়ে থাকল। ওর কাছে ছাতা ছিল না, প্রস্তুতই ছিল না ও এমন বৃষ্টির জন্যে। থাকলেও কি ব্যবহার করত ছাতাটা? পারত এমনভাবে ভিজে যাওয়া থেকে নিজেকে বাঁচাতে? নাহ, সব ছাতায় বৃষ্টি ধরে না। হয়তো.. সবার ছাতায় বৃষ্টি ধরে না...
পাশের গাছটার ধারে ধপ করে বসে পড়ল বিনোদ। তারপর হু হু করে কেঁদে উঠে গাছের গায়ে মাথার পেছনটা ঠুঁকে দিতে দিতে বিড়বিড় করে বলে উঠল—
“দরে নাই, আব্বা.. আইজও আমার ছাতায় বিষ্টি দরে নাই, আব্বা.. আইজও ধরাইতে পারলাম না.. খুব ভিজা গেছি, খুব ভিজতাছি...”
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন

০৯ ফেব্রুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ১৫ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪