কথা দিয়ে চলে যাওয়া

পিতৃত্ব (জুন ২০১৮)

মোঃ ফাহাদ আলী
  • 0
  • ২৬
অবশেষে জামালকে পত্রিকায় পাওয়া গেল। আজকাল জামালের কুমড়ো মুখে বুলি ফোটে না, কাজে হাত চলে তো চলে না, কিছু বলে তো বলে না, ঝিমায় আর ঝিমায়, অফিসের এক কোনায় ধুম মেরে বসে থাকে। "আই আই জিরো কি, গাই গাই গ্যারো" এই হল জামালের মোবাইলের রিংটোন, এগারোশ মডেলের নকিয়া ফোন, রাবার দিয়ে বাঁধা, পিছনের কেস খুলে পড়ে তাই কোনরকমে জোড়াতালি দিয়ে কাজ চালিয়ে নেয়। ফোনে কথা বললে অফিসের কোনায় রাখা গাছের পিছনে যেয়ে ফিস ফিস করে কথা বলে, কিন্তু গলা তো মশাল্লাহ লাউড স্পীকার, আর কেউ শুনুক না শুনুক আমাকে নিত্য শুনতে হয়, যেহেতু আমি রিসিপশণে কাজ করি। সে যে জোশওয়ালা খাঁটি বাঙ্গালী তা তার নাম্বার বলার সময়ই বুঝতে পেরেছি, কারণ হল ভুঁইফোঁড়, আর দাঁতে পোকা দেয়া বাঙ্গালীগুলোই পাকা বাংলায় কথা বলে, না হলে জোশওয়ালা খাঁটি বাঙ্গালী বলে জিরো, ওয়ান, সেভেন, বারো, বাহাত্তর, সতেরো। অফিসের সহকারী নয় মাস হল ঢাকায় এসেছে, অফিসের বসের গাঁয়ের ছেলে। খুব সুন্দর করে চা বানাতে পারে, অফিসের প্রথম দিনে ঢুকতেই কাঁচের সাথে ধাক্কা লেগে ভ্রু ফাটিয়েছিল, পরের দিন গায়ে জ্বর নিয়ে অফিসে হাজির, বললাম "নাম কি তোমার"? নতুন পরিচয়ে সংকোচ বোধ করে খুব দ্রুত বলল "জামাল", বলল "আনহের নাম কি"? বললাম "তরু"। বলল "এ তরু মানে তো গাছ, আংগরে পাড়ার লোকজন কয়, "তরু খায় গরু, মেয়েরা খায় ভ্রু"। হায় হায় অফিসের সবার সামনে ছেলে বলে কি? শুনেত সবাই হেসে উঠছে, আমি হাসব না কাশব বুঝতে পারলাম না। দুলাল স্যার ডেকে বলল চা দিতে। আমি তাকে কিচেনের ম্যাপ দেখিয়ে বললাম স্যারের জন্য চা বানিয়ে আনতে। যথারীতি স্যারের রুমে চা নিয়ে চলেও গেল। কিছুক্ষন পর স্যার আমাকে ডেকে বলল "তরু সাহেব, ছেলে তো একটা আনলাম, কিন্তু অতিরিক্ত সহজ সরল, চা বানাইতে চিনি ছাড়া পুরো লবন দিয়ে বানাইছে, আপনি একটু দেইখেন"। বললাম "জি স্যার আমি সব বলে দিব"। তারপরে আমি নিজ হাতে চা বানানো শিখালাম, ওমা দেখি আমার চা ও যা তা অবস্থা। এখন আর সে দিন নেই। যে মানুষ আগে সপ্তাহে এক কাপ খেতাম এখন ঘন্টায় খাই এক কাপ। যতদূর জানি তার মা ছাড়া পরিবারে আর কেউ নাই। সপ্তম শ্রেনি পর্যন্ত পড়াশুনা, কিন্তু চাকরী করছে অষ্টম শ্রেনি পাশের সার্টিফিকেট দিয়ে। কথা বলে বেশি তবে একেবারে মন্দ নয়, সত্য বলে। চোখে চোখ পড়লেই তার গলা শুকিয়ে যায়, ডাকলে সাপের মত মোচড়ায়। আজকাল মোবাইলে ফোন আসলে কেঁপে ওঠে, চোখে ভয় ভয়, মুখের উপর মেঘের ছায়া এসে ভর করে। একদিন ডেকে বললাম "জামাল তোমার কোন সমস্যা"। সে তড়িৎ উত্তর দিল "নাহ না স্যার কুনু সমস্যা নাই"। বললাম "তাহলে ফোন আসলে এত ভয় পাও কেন"? বলল "নাহ... স্যার কিছু না, ফোন আইলে কাইপা ওঠে"। বললাম "ফোনটা দাওতো দেখি"। আর কিছু না বলেই ফোন বের করে আমার হাতে দিল, দেখি ফোনের ভাইব্রেশন করা নাই। বললাম "ভাইব্রেশন করা নাই তো ফোনে, তাহলে কেঁপে ওঠ কেন, মিথ্যা বললে কেন? মিথ্যা ধরতে পেরেছি বুঝতে পেরে সে মাথা নিচু করে রইল, বলল "স্যার একমাস আগে ছুটিত বাড়ি গেছিলাম না, তখন আমার চাচাতো ভাইয়ের শালিকে বিয়ে করে হালাইছি"। বললাম "বল কি অফিসের কাউকে জানালে না, আর বিয়ের মিষ্টি কই"? বলল "স্যার মিষ্টি খাওয়ামু কেমনে, বাড়ি থেকে ঢাকায় আসার সময় টাহা ধার কইরা নিয়া আইছি, টাহাতো থাহন লাগবো"? জামাল দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলতে থাকে, "মেয়ে পক্ষ জানত আমি ভালোই টাহা পয়সা কামাই, এই জাইনা বিয়া দিছে", বাসর রাতে বউ জিগাইল "বেতন কত পাও"? আমি ঠাস করে কইয়া দিছি চার হাজার, সেদিন থাইকা বউ আমার উপর ক্ষ্যাপা। খালি কয় চার হাজার দিয়া তোমার থাকা খাওয়া আমারগোরে থাকা খাওয়া অইব? বুঝলাম বেচারা খুব কষ্টে আছে। বললাম "তাহলে অফিসের চা বানানোর চিনিই কি তুমি নিয়ে গিয়েছিলে"? এই জন্য স্যার আমাকে কত কথা শুনাইছে তুমি জানো? হাত ধরে বলল "স্যার আপনি কিছু কন নাই তো? বললাম "না কিছু বলি নাই তবে কাজটা ঠিক কর নাই আমাকে বলতে আমি টাকা দিয়ে দিতাম, তা টাকা পয়সার যখন এতো আকাল তাহলে হুট করে বিয়ে করার কি দরকার ছিল"? বলল "স্যার আমার মার খুব অসুখ, মার খুব শখ আছিল আমার বউ দেইখা মরার, খুব বুঝাইছিলাম কোন কথা হুনল না, বিয়া করাবুই, অগত্যা করা লাইগল"। খপ করে হাতদুটো জড়িয়ে ধরে বলল "স্যার আমার একটা উপকার করবেন"? বললাম "কি উপকার"? বলল "দুলাল স্যারকে কইয়া আমার বেতনটা বাড়াইয়া দেন না স্যার"? বিস্ময়ে বললাম "তোমার বেতন বাড়ানোর কথা আমি বলব কিভাবে"? অনেক পিড়াপীড়ি শুরু করল। কথার মাঝে দুলাল স্যারের ডাক পড়ে গেল। কোমর হেলেদুলে স্যারের রুমে চলে গেল। পরের দিন ও পিড়াপীড়ি। বললাম "জামাল তুমি স্যারকে বল, স্যার শুনবে"? সে নাছোড়বান্দা আমাকেই দিয়ে বলাবে, কিন্তু আমিই তো গত চার মাস ঘ্যানর ঘ্যানর প্যানর প্যানর করে আট থেক সাড়ে নয় পর্যন্ত নিয়েছি। এখন তার হয়ে বলতে গেলে ডাবল ঝাড়ি ছাড়া উপায় নাই। মাথা চুলকিয়ে বললাম "তুমি যদি নাই পারো, তোমার বউকে দিয়ে বলাও"। কিছুক্ষন দম ধরে বলল "ঠিক স্যার", বলেই ফোন বের করে বউকে ফোন দিল, সাথে দিল লাউড স্পীকার, বললাম "আরে তুমি একা একা বইল", বলল "না স্যার সমস্যা নাই স্যার", ফোন ধরেই বলল "জরিনা কেবা আছ"? ওপাড় থেকে বলতেছে "আমি কইছি না বেতন না বাড়াইয়া আমারে ফোন দিবি না, ফোন দিছছ ক্যা"? শুনে আমি ও জামাল হতবাক ভাবতেছি এক মাসেই স্টিম রোলার চালু হইছে। জামাল বলল "স্যার স্পীকার কমাইয়া দ্যান"। আমি তড়িঘড়ি করে স্পীকার অফ করে দিলাম। জামাল বাইরে গিয়ে কথা বলে এসে জানাল তার বউ স্যারের পা ধরে মিনতি করতে পারবে না স্পষ্ট বলে দিয়েছে। বললাম তোমার বলতে সমস্যা কোথায়? বলল "কইতে পারমু না স্যারকে খুব ভয় পাই"। বললাম তাইলে আর কি? স্যার একটা কিছু করেন, জামাল বলল। কলম কামড়িয়ে বললাম "আমার বাসায় যে কাজের বুয়া কাজ করে, তাকে যদি তোমার বউ বানিয়ে স্যারকে বলানো যায় কাজ হতে পারে", সে ভ্রু কুচিয়ে বলল "এটা কেমনে অয় স্যার"? বললাম আর কোন উপায় নাইত। তুমিও বলবে না তোমার বউকে দিয়েও বলাতে পারবে না, স্যার তো তোমার গাঁয়ের মানুষ তাই না। "বউয়ের কথা থাইক স্যার, বুয়াকে বউ বানালে কাজ অইব তো? বললাম হতে পারে বুয়া যে হারে কাজে ফাঁকি দেয় কথা বানিয়ে বানিয়ে তাতে না হওয়ার কোন কারণ দেখি না। তবে তাকে কিছু টাকা দিতে হবে। বলল "কত লাইগব স্যার"? পনেরো, দুই হাজারের মত, আমি বললাম। স্যার একহাজার টাহায় অইব না? আমার কাছেই আছে এক হাজার টাহা। বললাম কথা বলে জানাবো। সন্ধ্যায় বাসায় এসে বুয়াকে ঘটনা বলতেই বুয়া সাপের মত ফোঁসফোঁস করা শুরু করল। "আমার খাইয়া দাইয় কোন কাম নাই, স্বামী আছেই আবার আরেক জনের বউ হতে যামু কোন দুঃখে, আমাক কি কামের বান্দি মনে হয়ে, কোন কিছুর অভাব নাই, বুঝছেন" বুয়া মুড়ির মত খই ফুটিয়ে চলল। বললাম "সবার চেয়ে আমি আপনারে বেশি চিনি, আপনি যে অভিনয় করে ছুটি কাটান, তা আর কেউ ভালো জানে না আর তা ছাড়া নগদ টাকাও পাবেন"। বলার সাথে সাথে কালবৈশাখীর ঝড় থেমে গেল। "অ কত কেবা কি"? বললাম "তিন মিনিটের অভিনয় ৫০০ টাকা"। নাক সিটকিয়ে বলল "৫০০ টাহার জন্য এই কাম করা যাইব, না করমু না?" বললাম "ঠিক আছে ৮০০ দেব"। মুখে হাসির ঢেউ তুলে রাজি হয়ে গেল, শর্ত হল তার অভিনয়ের কথা ম্যাচের কেউ যেন না জানে সাথে তার স্বামীও। অভয় দিয়ে বললাম কেউ জানবেনা। মোবাইলে জালালের সাথে কথা বলে পরের দিন স্যারের কাছে বুয়াকে পাঠাব বলে ঠিক করলাম। বুয়াকে জালালের ছবি দেখিয়ে সব শিখিয়ে দিলাম। পরের দিন বুয়াকে সাথে নিয়ে অফিসের কাছে রেখে অফিসে ঠুকলাম। দেখি জালাল পায়েচারি করতেছে, আমাকে দেখেই বলল "স্যার আইছে"? চোখ টিপে চুপ থাকতে বললাম, বললাম চল কিচেন রুমে যাই। দুজনে কিচেন রুমে গিয়ে সব শিখিয়ে দিলাম, আর বলে দিলাম অফিসের নিচে বুয়া দাঁড়ায়ে আছে, কালো বোরকা পড়া, মাঝ বয়সী, তুমি গিয়ে নিয়ে আসো। হাত কচলিয়ে জালাল ইতস্ত করল, বললাম "তুমি না নিয়ে আসলে হবে না, আমার সাথে আসলে সবাই মাইন্ড করবে, যাও তুমি নিয়ে আস, আর সব শিখান আছে, স্যারের রুমে পাঠিয়ে দিলেই অভিনয় শুরু হয়ে যাবে"। তবুও তার আপত্তি, রাগে বললাম "নিচে গিয়ে নিয়ে আসো, না হলে আমি চলে যেতে বলব"? হাত ধরে বলল "না স্যার আমি যাইত্যাছি"। বলেই দ্রুত পায়ে নিচে চলে গেল। আমি ডেস্কে বসে অপেক্ষা করছি, আর ভাবছি ধরা খাইলে তো মান সন্মান সব শেষ সাথে চাকরীটাও, খুব টেনশন হচ্ছিল, বারবার ঘেমেও যাচ্ছিলাম, বুক ধড়ফড় করছিল মাঝপথে ভাবছিলাম বাদ দিয়ে দেই, জালাল পারলে বেতন বাড়াবে না হলে আর কি, সে তো আর আমার আপন কেউ না। হঠাৎ মনে পড়ে গেল একদিনের কথা, অফিসে কাজ থাকায় সেদিন অফিস থেকে বের হতে হতে রাত দশটা, আমি আর জালাল দুজন এক সাথেই বের হলাম অফিস থেকে। বাসা এক জাগায় হওয়ায় জালাল আমার জন্য অফিসে বসে ছিল রাত দশটা পর্যন্ত, ও আমার বাসার সামনের একটা পুরনো ঝুপড়ি ঘরে কয়েকজন মিলে অল্প টাকায় ভাড়া নিয়ে থাকে তাই অফিসের অনন্যদের চেয়ে আমি তার সম্পর্কে বেশি জানি। অমায়িক, বিনয়ী আর সরল একটা লোক। তো দুজনে রাস্তা দিয়ে হাটছি, বাসায় হেটে যেতে খুব বেশি সময় লাগে না, আরও দ্রুত যাওয়ার জন্য সংক্ষিপ্ত রাস্তায় হাটা শুরু করলাম, তার জন্য অফিস ঘেঁসে একটা চিকন গলি পার হলেই মূল রাস্তায় যাওয়া যায়, সেই রাস্তায় পনেরো মিনিট হাটলেই বাসা পাব। বেশ অন্ধকার মোবাইলের আলো দিয়ে দেখে দেখ গলি দিয়ে ঢুকে গলির শেষ মাথায় যেতেই কয়েকজন লোক সিগারেট খেতে খেতে ঘিরে ধরল, আমি আকস্মাত তাদের দেখে হতবিম্ব হয়ে গেল। আমি ভীতু ছিলাম তাছাড়া আগে ছিনতাইকারীদের সম্পর্কে বিভিন্ন সময় গল্প শুনেছি, কিন্তু বাস্তবে তাদের কব্জায় পড়ি নাই, আজ হয়ত আমার জন্য সেই শুভক্ষণ তাদেরকে কাছ থেকে দেখার, দেখি অবিকল আমাদের মতই মানুষ, সব ঠিকঠাক আছে শুধু ওরা গাঞ্জা কাচ্ছে আর আমরা দুজন কিছুই খাচ্ছি না। একজন এসে তার হাত এগিয়ে দিল, বুঝতে পারলাম না কি বলতে চাইছে, না বুঝে হাত বাড়ালাম না, সাথে সাথে আমার কলার চেপে ধরে বলল "বেয়াদবি করস ক্যান, বাপ মাও আদব শিখাই নাই"? বললাম "ভাই, আমি তো আপনাদের চিনিনা, তাছাড়া পথ আটকালেন কেন"? আরেকজন আমার গলা চেপে ধরে বলল "শালা যা আছে দে নইলে কিন্ত ফুটা কইরা দিমু" গলা দিয়ে কথা বের হচ্ছিল না জোর করে বললাম "ভাই ছাড়েন, যা আছে নিয়ে যান, তবুও কিছু কইরেন না"। পাশেই জালালের হাত শক্ত করে ধরে আছি, জালাল হেছকি টান দিয়ে হাত ছুটায়ে নিয়ে জোর দিয়ে ধাক্কা মারল দুজন পড়ল ড্রেনে, জালালের পিছনে দাঁড়ানো একজন তার পিঠে ব্লেড দিয়ে টান দিল। সাথে সাথে জালাল ও মা বলে চিৎকার দিল, আমাকেও দেয়ার চেষ্টা করল আমি ঘুরে দাঁড়ানই আমার হাতে সামান্য লাগল। দুজনের চিৎকার করাতে সবাই দৌড়ে পালাল। আমি জালালের দিকে তাকিয়ে দেখি পিঠ রক্তে ভিজে গেছে, অনেকখানি কেটে গেছে। এমন নির্বুদ্ধিতার জন্য কিছু বলব না তাকে কোথাও নেব চিন্তা করছি, কিছুক্ষন পর দেখি একজন রাতের গার্ড দৌড়ে এল, পরে তার সহায়তায় দুজনে মিলে জালালকে কাছের ফার্মেসিতে নিয়ে ব্যান্দিজ ও ওষুধপত্র নিলাম। বেচারা অনেক কষ্ট করে কয়েকদিন অফিস করেছে। সেই থেকে তার প্রতি একটা মায়া, হৃদয়ের হৃদ্যতা কাজ করত। যা হবার হবে স্যারকে ম্যানেজ করে তার কিছু উপকার হলে আমারও ভালো লাগবে। ভাবতে ভাবতে ওরা দুজন অফিসে ঢুকে পড়ল। অভিনয় শুরু প্রথমে আমাকে দেখিয়ে জালাল বলল "আমার তরু স্যার" বলতেও বুয়া সালাম দিল। আমিও উত্তর দিলাম, জালালকে বললাম "উনি কে"? জালাল ঘাড় থেকে মাথা উচু করে ধীরে বলল "স্যার, উনি আমার বউ", আমি ভাবছি খাইছেরে আমার মুখ দিয়ে হাসি বের না হলেই হয়। অফিসের অন্যরা বলা শুরু করল "কি জামাল লুইকা লুইকা বিয়ে করলে, কিছুই জানালে না, কখনো তো বললেও না"? জামাল ঘেমে জাচ্ছিল আর বুয়া ফাসুর ফুসুর করে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল। বললাম "তা বউকে কি অফিস দেখাইতে নিয়ে আসছ"। বুয়া মাঝখান থেকে বলে উঠল "না দুলাল স্যারের সাথে কথা কমু, স্যারের কাছে দরকার আছে, আপনি একটু ডাইকা দ্যান না"? মনে মনে বলি বুয়া আপনি থামেন। সব আগেই রেডি করা ছিল তাই কাউকে কথা বলতে দেয়ার আগেই স্যারের কাছে পাঠাতে হবে না হলে কখন কি বলে বসে। দেরি না করে স্যারকে ফোন দিয়ে সব বলে দেই স্যার পাঠিয়ে দিতে বললেন। জামালকে ইশারা দিতেই বুয়াকে নিয়ে সোজা স্যারের রুমে চলে গেলেন, দুই মিনিট পর হাউমাউ কান্নার আওয়াজ, অফিসের মধ্যে একরকম হইহই রব পড়ে গেল, কি হল কি হল? মনে মনে ভাবলাম এত জোরে চিল্লানি দেয়ার কোন মানে আছে। ধীর স্থিরভাবে একটু নাক বাঁকালেই হয়। পাঁচ মিনিট পর বুয়া চোখ মুছতে মুছতে স্যারের রুম থেকে বের হল, পিছনে জামাল। বুয়া সোজা আমার সামনে এসে দাঁড়াল, ধীরে ধীরে বলল "টাহাটা দ্যান না"? বললাম "তুমি বাইরে যাও আমি আসতেছি"। বুয়া জামাল বের হওয়ার কিছুক্ষন পর আমি বের হয়ে দেখি, ওরা গাছের তলে দাড়িয়ে আছে, গিয়ে বললাম "কেমন কি হল"? বুয়ার এক শ্বাসে উত্তর "যা ভিজানোর ভিজাইছি, কাজ অইব, স্যার কইছে বেতন বাড়াইব, কত বাড়াইব তা কই নাই, তয় কইছে স্যার দেখব"। জামাল বলল "স্যার দুই তিন হাজার কি বাড়াইব"? বললাম "দেখ কি হয়"? জামালের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বুয়াকে বিদায় করে দিলাম। পরের দিন স্যার আমাকে ডেকে পাঠাল, আমাকে বললেন আমি যেন জামালের ব্যাংক আকাউন্টের জন্য সব কাগজ স্যারকে রেডি করে দেই, জামালকে বলার সাথে সাথে সে খুশিতে আত্নহারা, প্রথমত তার এটাই হবে প্রথম ব্যাংক একাউন্ট, যা আগে কখনো করে নি, গরীব মানুষ আকাউন্ট দিয়ে কি করবে? দ্বিতীয়ত হয়ত ভেবেছে মোটামুটি ভালো বেতন বাড়াবে। আমি চারদিন পর বউকে নমিনি করতে তার বউয়ের ছবি ও ভোটার আইডি কার্ড সহ তার সকল ডকুমেন্ট নিয়ে স্যারের রুমে দিয়ে আসলাম এবং জেনে আসলাম জামালের পাঁচশ টাকা বেতন বাড়ানো হয়েছে, জামালকে বলতেই তার মনটা ভার হয়ে গেল, হাফ ছেড়ে দীর্ঘ শ্বাস নিল। বলতে বলতে জামালকে স্যার ডেকে নিল সাথে আমাকেও ভিতরে ঢুকতেই স্যার বলে উঠল "জামাল তোমার বউ কয়জন"? আমিতো জিহ্বায় কামড় দিলাম, আজ আর রক্ষা নেই, নমিনির ছবিতো তার আসল বউয়ের, আর সেদিন এসেছিল বাসার কাজের বুয়া। আমি এসির মধ্যেই ঘামতে লাগলাম। জামাল সুউচ্চে বলে উঠল "স্যার আমার তো একখান বউ"? স্যার ছবি দেখিয়ে বলল "ইনি কে আর গত দিন যে এসেছিল সে কে? জামাল আমতা আমতা করতে লাগল, মুখ চেপে আছে, স্যার ধীরে ধীরে গরম হচ্ছেন উত্তর না পেয়ে। স্যার রাগের স্বরে বলে উঠলেন "তরু সাহেব ঘটনাটা বুঝেছেন"? বললাম "না স্যার"? স্যার "কেন গতদিন জামালের সাথে আসা মহিলাকে দেখেননি"? ঢোঁক গিলে বললাম "জি স্যার দেখেছি"। স্যার " এই ছবি দেখেছেন"? আমি "জি স্যার"। তাহলে মিলাতে পারছেন না কেন? জামাল কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে উঠল "আটশ টেহা দিয়া বউ ভাড়া করছি, আর আপনি বেতন বাড়াইলেন মাত্র পাঁচশ টেহা"। স্যার বুঝলেন শহরেরটা নকল বউ গ্রামেরটা আসল। স্যার রেগে বললেন "জামাল তুমি আমার চোখের সামনে থেকে চলে যাও, আর তোমার বেতন আগামী মাস থেকে পঁয়ত্রিশ শ টাকা, থাকলে থাকো না থাকলে গ্রামে চলে যেত পার"। জামাল কিছু না বলে নিচু মাথায় বাইরে চলে গেল, আমিও বেরিয়ে আসলাম, তাকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করলাম আর বললাম স্যার অন্যায় কাজ সহ্য করতে পারেন না তাই এমন রাগ করেছেন, দুই একদিন পর দেখবা সব ঠিক হয়ে গেছে, সে আমার কথার গুরুত্ব না দিয়ে বাহিরে গিয়ে ফুটপাতের উপর দাড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। পরের দিন অফিসে এসে জামালকে খুজলাম দেখি কিচেন রুমে চেয়ারে বসে হেলান দিয়ে মারেফতের গান শুনতেছে, বললাম "মন খারাপ"। উঠে দাড়িয়ে বলল "জি স্যার মার শরীরটা নাকি খুব খারাপ, সকালে মার সাথে কথা কইছি, আমাক দেখতে চায়" বলেই কেঁদে দিল। বললাম মন খারাপ কর না, সামনের মাসে দুইদিনের ছুটি নিয়ে বাড়ি যেও। সারাদিন জামালের আর তেমন সাড়া শব্দ পেলাম না। সন্ধ্যায় আকাশে কালো মেঘের আনাগোনা, গুড়গুড় মেঘের গর্জন অফিসে কেউ নেই, সবাই চলে গেছে এখন বের হতে হবে, এমন সময় দেখি জামাল ভেজা গায়ে অফিসে ঢুকল। বললাম "শরীর ভেজা কেন"? বলল "বাইরে মোবাইলে লোড দিতে গেছিলাম, বউয়ের সাথে কথা কইলাম"। বললাম "এখন কেমন আছে"? বলতেই হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল আর বলল তার মায়ের অবস্থা নাকি খুবি খারাপ হাসপাতালে নিতে হবে, সে এখনি বাড়ি চলে যাবে। বললাম "এই ঝড় বাদলের রাতে যাওয়া ঠিক হবে কি"? সে বলল যাবেই বাড়িতে আর আমার হাত ধরে দুই হাজার টাকা ধার চাইল, বললাম আমার কাছেত অত টাকা নাই, হাজারখানেকের মত হবে। দিতেই না কিছু না বলে দৌড়ে বাহিরে চলে গেল, বলল "স্যার আমি আবার আসমু, চিন্তা কইরেন না দোয়া কইরেন"। শুধু বললাম জামাল দেখে শুনে ধীরে সুস্থে যেও, আর আমি স্যারকে সব বলব। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির দিন রুমে এসেও ভালো লাগছিল না, কেমন যেন ভ্যাপসা গরম লাগছিল, বাড়িতে মা বাবার সাথে বলতে ইচ্ছে হল ফোন দিয়ে কথাও হল। জামালকেও মাঝ রাতে বেশ কয়েকবার ফোন দিলাম, বারবার বন্ধ দেখাল। আজকের রাতটা কেমন যেন নির্ঘুম কাটল শান্তি পাচ্ছিলাম না, মনে মনে কি যেন সব চিন্তা এসে ঢেউ খেল। সকালে ফ্রেশ হয়ে অফিসে গেলাম, যেতে যেতে ভাবলাম জামালের বাড়ি যাওয়ার কথা স্যারকে অফিসে গিয়েই বলব। ব্যাগটা রেখে চেয়ারে হেলান দিয়ে ওয়ার্ড বয় মানিককে ডেকে বললাম "মানিক দেখত পেপার এসেছে কিনা"? মানিক পেপার ভাঁজ করে আমার টেবিলের উপর দিয়ে গেল, চেয়ারটা টেনে সামনে নিয়ে পেপারের ভাঁজ খুললাম, পৃষ্ঠা উল্টিয়ে দেখছি, হঠাৎ করে একটা শিরোনাম দেখে চোখ আটকে গেল, আমি কি ভুল দেখছি, জামাল হয়েছে মূল শিরোনামের মূল ছবি, বারবার চোখ ঢলছিলাম নাতো এতো বার ভুল তো হওয়ার কথা না, আমি ঘেমে যাচ্ছি মুখ থেকে কথা বের হচ্ছে না। স্যার ডাক দিলে আমি পেপারটা হাতে নিয়ে স্যারের রুমে ঢুকতেই স্যার বলল "পাগলটা কি অফিসে এসেছে, ডাকো ওকে, ওর বেতন দুইহাজার টাকা বাড়িয়ে দিয়েছি" বলেই হাসতে লাগল। আমি কিছু না বলে পেপারটা স্যারের টেবিলের উপরে রাখলাম, বলল "তরু সাহেব পেপার দিচ্ছেন কেন"? বললাম "স্যার এই খবরটা পড়েন"। স্যার খবরের ছবির দিকে তাকিয়ে, আবার আমার দিকে মুখতুলে তাকাল বলল "তরু সাহেব জামাল এক্সিডেন্টে মারা গেল কিভাবে"? আমি গতরাতের কথা বলতে বলতে চোখ থেকে ঝরঝর করে পানি গাল গড়িয়ে পড়তে লাগল, স্যারও চোখ মুছতে লাগল। মনে হল আমার আপন কাউকে হারালাম। অফিসের সবাই মুখ লুকিয়ে কান্না করতে লাগল। বারবার অফিসের কোনে রাখা গাছটার দিকে তাকালাম যেখানে জামাল নিজকে প্রায় লুকিয়ে রাখত, আর চোখে চোখ পড়লে মুচকি হাসি দিয়ে মাথা নিচু করত। আজ সেখানে জামালের ছায়া বসে আছে, আমি দেখতে পাচ্ছি।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন

১৮ অক্টোবর - ২০১৭ গল্প/কবিতা: ৭ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪