বৃষ্টি ভেজা দিনে

বৃষ্টি ভেজা (জুলাই ২০১৯)

এলিজা রহমান
  • 0
  • ৮৪
Je T'aime -- French উচ্চারণ জ টেয়ম অর্থাৎ আমি তোমাকে ভালবাসি ৷ ভালবাসার জন্য বিখ্যাত শহর প্যারিস ৷ তানিয়া করিম ফ্রান্সে এসেছে ভালবাসা খুঁজতে নয় পড়াশুনা করতে ৷ তানিয়া প্রানি বিদ্যায় মাস্টার্স করেছে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৷ গবেষনার কাজ করার জন্য ফলোশিপ বৃত্তি দেয় ফ্রান্স সরকার , ফেলোদের আর্থিক বৃত্তি ,যাতায়াত খরচ প্রদানের পাশাপাশি স্বাস্হ্যবীমার ব্যবস্হা করেন তারা ৷ বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান ও মানবিক বিষয়ে গবেষকদের এ বৃত্তি দেয় ফ্রান্স সরকার ৷ তানিয়া প্রানি বিদ্যায় গবেষনা করার জন্য ফ্রান্সে এসেছে ৷ ওর ডর্মটা যদিও সেইন নদী থেকে বেশ দূরে তবু জানালা দিয়ে সেইন নদী দেখা যায় অনেকটাই ৷আজকে ওর ক্লাস নেই, ওর ভার্সিটিটা প্যারিসের বাইরে৷ পড়াশুনার পাশাপাশি সে একটা রেস্তরাঁয় কাজ করে সপ্তাহে ৪দিন , এই নদীর উপরে একটা ব্ীজ্র আছে , এই ব্রীজটাকে বলা হয় তালাচাবি ব্রীজ ৷ প্রেমিক প্রেমিকারা তালাচাবি কিনে আনে তারপর ব্রীজে উঠে ৷ তালার ভিতর প্রেমিক প্রেমিকার নাম লিখে তালাটা ব্রীজের রেলিং এর সাথে মেরে দেয় আর চাবিটা ছুড়ে ফেলে দেয় নদীতে ৷ নদীর পানিতে হারিয়ে যায় চাবিটা ৷ এর ফলে সারা জীবনের জন্য ভালবাসা এবং প্রেমের বাধনে বাঁধা পড়ে প্রেমিক প্রেমিকা ৷ এ বাধন সারা জীবনের এটা প্যারিস শহরের প্রেমিকা প্রেমিকাদের দৃঢ় বিশ্বাস ৷ এই ব্রীজের উপর দিয়ে তাকে রোজই হেটে আসতে হয় , এই শহরে অনেক দর্শনীয় জায়গা আছে ৷ একটা সুন্দর সাজান গোছান শহর ৷ প্যারিস এ ঢুকে ও অবাক হয়েছে দেখে রেলস্টেশন , এয়ারপোর্টে এ থাকা স্ট্রিট পিয়ানো দেখে , যে যার খুশিমত পিয়ানোতে কিছু বাজাতে পারে ৷ আইফেল টাওয়ারের নাম তো সবারই জানা ৷ তারপর আছে ল্যুভর মিউজিয়াম , নটর ডেম ক্যাথিড্রাল (যদিও সেটা এখন আগুনে পুড়ে গেছে ) ,নেপোলিয়ানের বিজয়োল্লাস খচিত তোরন 'আর্ক ডি ট্রাইয়াম্ভ '৷ আরেকটা আছে সীন নদীতে তৈরি করা কৃত্রিম দ্বীপে স্হাপিত স্ট্যাচু অফ লিবার্টি, পুরো ফ্রান্স জুড়ে স্ট্যাচু অফ লিবার্টির প্রায় নয়টা রেপ্লিকা রয়েছে ৷ আরেকটা আছে প্যারিসে ওয়াল অফ লাভ , বিশ্বের ৩১১টি ভাষায় একটা দেয়ালে লেখা আছে ,লে মুর ডেস জ টেয়ম (Le mur des je t'aime অর্থাৎ ভালবাসার দেয়াল ) লেখাগুলোর উদ্ভবক হলেন ফ্রেডরিক বেরন ৬১২টি লাভা টাইলসের উপরে চাইনীজ ক্যালিগ্রাফিতে লেখা হয়েছে কথা গুলি এবং রয়েছে ৪১৫ স্কয়ার ফুট ম্যুরালরূপে ৷ তানিয়া একবার গিয়ে দেখে এসেছে , অপূর্ব সুন্দর লাল ,নীল ,হলুদ রঙের বাহারি কারুকাজ , ভাল লেগেছে দেখতে ৷ আজকে কাজে যেতে হবে বিকেল ৪ টায় ৷ এখন বৃষ্টি না এলেই হয় ৷ তানিয়া বৃষ্টিতে ভিজতে ভালবাসে না একটুও৷ শশুর বাড়ি থেকে যেদিন সে বাবার বাসায় ফিরে আসে সেদিনও তানিয়াকে ছাতা মাথায় দিয়ে উবার থেকে নামতে হয়েছিল ৷ ফরহাদের সঙ্গে একসঙ্গে থাকা সম্ভব হয় নি ৷ বৃষ্টিতে ভিজেতে ওর একটুকুও ভাল লাগে না ৷ তাছাড়া এখনকার বৃষ্টি বাংলাদেশের মত না ৷ বৃষ্টি শুরু হলে প্রচুর ঠান্ডা বাতাস হাড় কাঁপিয়ে দেয় ৷ বাংলাদেশে থাকতে তানিয়া স্কুল -কলেজ থেকে ভিজতে ভিজতে বাড়ি ফিরে নাই ৷ শখ করে বৃষ্টিতে ভেজা নিয়ে তার মনে কোন রোমান্টিকতা নেই, সে তৈরি হয়ে নিল বাইরে যাওয়ার জন্য ৷ তাকে ছাতা , বর্ষাতি , ওভারকোট নিতে হতো শীতকাল হলে , এখন মাফলার আর সোয়েটার নিলেই চলবে ৷ এখানে এসেছে এক বছর হতে চলল এখানে ওর ৷ তানিয়া গ ড়পড়তা বাঙালী মেয়েদের তুলনায় লম্বা, শ্যামলা হলেও চেহারাটা খুব মিষ্টি , হাসলে চমৎকার লাগে ৷ তানিয়া বাবার খুব ন্যাওটা ছিলো ৷ আজকে বাবা বেঁচে থাকলে খুব খুশি হতেন যে নিজের যোগ্যতায় সে এতদূরে আসতে পেরেছে ৷ কাজ শেষ করে ডর্মে ফিরতে ফিরতে বৃষ্টি শুরু হলো ৷ আজকে সকাল থেকেই আকাশের মুখ গোমড়া ছিলো , দুপুরে রোদ উঠেছিল এখন আবার বৃষ্টি৷ এখনকার মানুষেরা ছাতা আর রেইনকোট নিয়ে ঘুরে বেড়ায় ধার ও দেয় সবাই সবাইকে ৷

তানিয়ার ঢাকার বাসার কথা মনে পড়ছে , মা আর ছোট ভাইটা কি ওর কথা ভাবছে এখন? বৃষ্টির দিনে মা এর হাতের খিচুড়ি আর ইলিশ মাছ খেতে কি ভালোই না লাগত৷! মায়ের রান্না করা খাবার ও খুব মিস করে এখন ৷ প্যারিসে এসে দেখেছে মেয়েরা কত স্বাধীন ৷ আইন খুব কঠোরভাবে মেনে চলে সবাই ৷ স্বামীর বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে স্ত্রী নালিশ করলেই তার জেল হবে ৷ সে অবাক হয়েছে মেট্রোতে , বাসে ,রাস্তায় মেয়েরা স্বাধীনভাবে চলতে পারে দেখে ৷ সন্ধ্যায় তানিয়ার ইচ্ছা করলে সেইন নদীর পাড়ে বসে থাকতে পারে একা কিন্তু কোন পুরুষ তাকে বিরক্ত করবে না ৷ ঢাকায় তো এটা ভাবাই যায় না ৷ জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় তার কেটেছে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় , উদ্বেগহীন, বাধনহারা পাখির ডানায় ভেসে দিন কাটিয়েছে সে তখন ৷ বাবা -মা আর ভায়ের সঙ্গে সময় কাটানো , রাতে খেতে বসে সারাদিনে কে কি করেছে সেই গল্প , ছুটির দিনে সবাই মিলে বেড়াই বেড়ানো , নাজিমার সঙ্গে ঘুরে বেড়ানো ,ক্লাসে ফঁাকি দিয়ে আড্ডা এসব করেই কেটেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলো , ' দিনগুলো মোর সোনার খাঁচায় রইল না , আমার নানা রঙের দিনগুলি কান্না -হাসির বাধন তারা সইল না , সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি ', গানটা মনে পড়ছে আজকে ৷ সত্যিই নানা রঙের সেই দিনগুলো আর ফিরে আসবে না ৷

নাজিমা সুখি হয়েছে জীবনে ৷ শুধু ওর কপালটাই খারাপ ,প্রেম- ভালবাসার কথা ও কোনদিনই ভাবে নি ৷
বাবা -মায়ের পছন্দই ওর পছন্দ ছিলো ৷ সব মেয়েদের মত তানিয়াও স্বামী সংসার করার কথা ভেবেছিল , কিন্তু ওর স্বামী ফরহাদ ছিলো একজন কামান্ধ ব্যক্তি ৷ তানিয়ার ভালবাসার কোন মূল্য সে দেয় নি তার উপর তার টাকার লোভ আর মাদকের নেশা ৷ ফরহাদের চরিত্রদোষ আর যৌতুকের দাবি মেনে নিতে পারেনি তানিয়া ৷ ফরহাদের সঙ্গে বিয়ে ,তারপর ডির্ভোস হলো এতে বাবা নিজেকে সবসময় অপরাধী মনে করতেন ৷ তানিয়ার দুর্ভাগ্যের কথা চিন্তা করে করে বাবা আর সুস্থ হলেন না , মারাই গেলেন ৷ তানিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবল , মানুষের জীবনে সুখের স্মৃতি যদিও বা দুঃখের স্মৃতির চেয়ে কম তবুও সুখের স্মৃতি মুছে যায় না মন থেকে ৷ সেই সুখের স্মৃতি গুলোকে আকড়ে ধরেই মানুষ বেঁচে থাকে ৷
অন্য মেয়েদের সাথে ফরহাদের অনৈতিক সম্পর্ক তানিয়া হয়তো বা মেনে নিতে পারত ,কিন্তু বাচ্চা মেয়েদের সঙ্গে যৌনতা সে মানতে পারেনি ৷ ফরহাদের বাবা -মা যদি ছোটবেলার থেকেই ফরহাদের চিকিৎসার ব্যবস্হা করতেন তাহলে হয়তো তার সমস্যা কিছুটা কমে আসতো৷ তারা সুন্দরী মেয়ের সাথে ছেলের বিয়ে দেয়াটাই সহজ সমাধান মনে করছেন ৷ অথচ পুরুষের কামুকতা যে একটা মেয়ের জন্য কি অভিশাপ তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ বুঝবে না ৷ যারা নিজেদের কামভাব নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না তারা তাদের নিজের জীবন যেমন ধ্বংস করে তেমনি এরা নিজেদের পরিবারকেও শেষ করে দেয় ৷ এরা সঠিক আর ভুলের বিচার করতে পারে না ৷

দেশে ফিরে তানিয়া দেশের পোল্ট্রি শিল্পের বিজ্ঞান সম্মত , স্বাস্থ্যকর ব্যবস্থা ,সঠিকভাবে রোগ বালাই নির্ণয় , চিকিৎসা এবং সুষ্ঠু নীতি প্রনয়নের লক্ষ্য কাজ করবে ৷ বাংলাদেশের পোল্ট্রি শিল্পকে সমৃদ্ধ করার জন্য কাজ করবে ৷ তানিয়ার এখানকার পড়াশোনাটা বাংলাদেশের মত তত্ত্বের উপর নয় , ব্যবহারিক ৷ সে ইংরেজিতেই পড়াশোনা করছে, তবে মোটামুটি কাজ চালানোর মত ফ্রেঞ্চ বলতে পারে ৷
মেট্রো রেলের টিকেট কিনেছে সে ক্যাম্পাসে যাওয়া আসা করার জন্য ৷ সে অবাক বিস্ময় নিয়ে দেখে এদেশের মানুষ বাসে ,ট্রেনে , মেট্রোতে সবখানে বই পড়ে ৷ বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ কথা বলতে পছন্দ করে বিশেষ করে নিম্ন শ্রেণীর মানুষের একমাত্র আনন্দের কাজ হলো কথা বলা ৷ বাংলাদেশে বই পড়ে এমন মানুষের সংখ্যা কমই বলতে হয় ৷ সবাই বলতে ব্যস্ত , পড়তে বা শুনতে নয় !!
রাত বাড়ছে ৷ তানিয়া ওর ডর্মের জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল দেখল , প্যারিস শহরের রাস্তায় রাস্তায় আলো জ্বলছে ৷ সেইন নদীর পানিতে আইফেল টাওয়ারের আলো পড়ে ঝলমল করছে
নদীর পানিতে আইফেল টাওয়ারের আলো পড়ে ঝলমল করছে , চোখ ধাধিয়ে দিচ্ছে ৷ আসলেই আলোর শহর প্যারিস ৷ ধীরে ধীরে মোহময়ী রূপে জেগে উঠছে প্যারিস শহর ৷

প্যারিসে আসার দুদিন পরে ওর পরিচয় হয় জুলিয়ার সাথে ৷
তানিয়া ডর্মের ডাইনিংয়ে ডিনার করে ৷ সে দেখে একটা মেয়ে আর একটা ছেলে বসে খাবার খাচ্ছে
মেয়েটা তানিয়াকে বলল , 'বো সোয়াখ ' (গুড ইভনিং)
তানিয়াও বললো তাকে শুভ সন্ধ্যা ফরাসী ভাষায় ৷ মেয়েটি তানিয়াকে জিজ্ঞাসা করল ,' ভু নে ভু ডা এশিয়ে (তুমি কি এশিয়ান ?)
তানিয়া উত্তর দিলো ,' উয়ি ল বাংলাদেশ (হ্যা আমি বাংলাদেশী ৷)
এরপর মেয়েটি তানিয়ার নাম জানতে চাইল ৷ ও বলল ওর নাম তানিয়া ৷
মেয়েটির নাম জিজ্ঞাসা করল তানিয়া ৷
' জু মা পেল জুলিয়া (আমার নাম জুলিয়া ৷)
মেয়েটি নিজেই বলল ,'জা সুই ভুয়া দে ইটালিয়ান (আমি ইটালিয়ান ৷)
তানিয়া ভেবেছিল তাকে ফ্রেঞ্চ !! মেয়েটির চেহারা খুবই সুন্দর আর খুব মিশুক , বন্ধুত্বপূর্ণ ৷
মেয়েটি বলল , ' অভে ভুয়া (আবার দেখা হবে )
তানিয়াও বলল ,'আভিয়ান্তো (আবার দেখা হবে , গুড বাই )
জুলিয়ার সাথে তানিয়ার কেনাকাটা ,ঘোরাঘুরি ,শপিং চলে ৷ প্যারিসের রাস্তায় রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করতে ভাল লাগে তানিয়ার ৷ মাঝে একদিন জুলিয়ার সাথে ফ্রান্সের একটা সুন্দর গ্রামে ঘুরে এলো ৷ একদিন জুলিয়ার আর ওর ছুটি ছিলো , সে তার বন্ধুদের সাথে ঘুরতে চলে গেলো ৷ তানিয়াও এখন মেট্রোতে সবখানে ঘুরে ৷ সে গেল ল্যুভ মিউজিয়ামে ৷ মোনালিসার হাসি দেখতে ৷ বিদেশী চিত্রকলার শ্রেষ্ঠ সংগ্রহ ল্যুভ মিউজিয়ামে ৷ ফ্রান্সের চিত্র কলার বিশাল ভান্ডার এই ল্যুভর মিউজিয়াম ৷ ল্যুভর মিউজিয়াম বিশ্বের সবচেয়ে বড় যাদুঘর , একদিনে এই মিউজিয়াম দেখে শেষ করা যায় না ৷ এই মিউজিয়ামে সবচেয়ে বেশি ভীড় মোনালিসার ছবির দেখার ৷ তানিয়ার ধারনা ছিল মোনালিসার ছবিটা অনেক বড় আকৃতির , কিন্তু বাস্তবে অনেক ছোট আকারের ৷ এই বিখ্যাত চিত্রকর্মটি দেখার জন্য ওর অনেক মানুষের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি করে এগুতে হলো ৷
সেদিন ছিল রবিবার জুলাই এর ১৪ তারিখ ,,,তাই এদিন ফ্রী মিউজিয়াম ঘুরে আসার সুযোগ আছে ৷ দীর্ঘ কিউ পার হয়ে তানিয়া মিউজিয়ামের ভিতরে ঢুকতে পারলো ৷ একজন মানুষ ছিলো যার সাহায্য ছাড়া একা বাঙালী তানিয়া বুঝতে পারছিল না কি করবে ৷ আজকে ভিড়ের কারন ছিলো ঝিরঝিরে বৃষ্টি আর ফ্রিতে টিকেট ছাড়াই মিউজিয়ামে ঢোকার সুযোগ পাওয়া ৷ সকাল থেকেই বৃষ্টি ঝরছে ৷ তানিয়া দেখলো , ওর পাশে দাঁড়িয়ে আছে দীর্ঘদেহী ,সুদর্শন পুরুষ ,বয়স তিরিশের বেশি হবে ৷
'বো জু মাদমোজেল ' , হতভম্ব তানিয়ার দিকে তাকিয়ে সে হাসিমুখে বলল ৷
' আমি সুনীল মন্ডল ,আপনাকে আমি দেখেছি বাংলাদেশ দূতাবাসের বর্ষবরন অনুষ্ঠানে ৷ এখন জিজ্ঞাসা করবেন নিশ্চয়ই সেখানে আমি কি করছিলাম , আপনার জ্ঞাতার্থে সবিনয়ে জানাচ্ছি আমি একজন সামান্য আর্টিস্ট ৷ এখানে ৩ বছর আছি ৷'

তানিয়া তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে লাগল ৷ সে লিওনার্দো দা ভিঞ্চির ছবি 'ভার্জিন এ্যান্ড চাইল্ড উইথ সেইন্ট এ্যানি ' দেখছিল , ছবিটা এতো জীবন্ত লাগছে যীশু আর তার মা ভার্জিন মেরিকে ৷ এই ছবিতে শিশুকালের যীশু একটা মেষশাবকের সাথে খেলছে ৷ হাটতে হাটতে সে দেখে বিভিন্ন বয়সি চিত্রকররা বসে ছবি আঁকছেন ক্যানভাসে ৷ তারা দক্ষতার সাথে হাতের ক্যানভাসে অবিকল ছবি এঁকে ফেলছেন ঝোলান ছবি দেখে দেখে এতটুকুও ভুল না করে ৷ এমন অনেক ছবি দেখল তানিয়া যেগুলো তাকে
কেউ বুঝিয়ে না দিলে সে বুঝতে পারতো না ৷ ' দ্য ওয়েডিং এট ক্যেনা ' , সাথে থাকা আর্টিস্ট বললো , 'ম্যাডাম ছবিটা বাইবেলের ঘটনা নিয়ে আঁকা বুঝলেন ৷' ফরাসি ,ইটালিয়ান গ্রীক এসব চিত্রকলা নিয়ে সে জ্ঞান গর্ভ আলোচনা করতে শুরু করল ৷ এদিকে দিনের আলো নিভে গিয়ে সন্ধ্যা নামছে ৷ শেষ বিকেলের আলোয় তানিয়াকে দেখতে লাগল সুনীল ৷ তানিয়ার দিকে তাকিয়ে সে ভাবছিল , আমার সামনে যে নারী মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে সে যেন জীবন্ত ভেনাস , মনে হচ্ছে অনেক দিনের পরিচয় তাদের৷ জন্ম জন্মান্তর ধরে সে যেন তানিয়াকে চেনে !!
তানিয়ার ডর্মে ফিরতে হবে ৷ ল্যুভর মিউজিয়াম থেকে একসাথে বের হলো দুজনেই ৷ একটু হাটতেই সেইন নদীতে লাভ লক ব্রীজ, তানিয়ার ইচ্ছা করছিল একটা তালা সেও লাগিয়ে রাখে ব্রীজে তারপর চাবিটা ছুড়ে
ফেলে নদীতে যাতে কেউ খুজে না পায় , ভালবাসার বন্ধন চির অটুট রাখার জন্য ৷ কিন্তু ওর কপালটাই খারাপ ৷ ওর কাছে কোন তালাও নেই , নেই কোন পুরুষ প্রেমিকও ৷ তানিয়া ভাবছিল এই স্মার্ট লোকটা কি বিবাহিত ? প্যারিসে কি একাই থাকে নাকি গার্লফ্রেন্ড আছে ? প্রথম পরিচয়েই তো আর তা জিজ্ঞাসা করা যায় না ৷
সূর্য ডুবে গেছে , সন্ধ্যা হয়ে আসছে ৷ তানিয়া বলল ,' একটা ট্যাক্সি বা উবার পেলে ভাল হতো আমার ডর্মে ফিরতে হবে ৷'
'কেন কেউ কি ওয়েট করছে আপনার জন্য ?' সুনীল মুচকি হেসে বলে ৷
'না কেউই নেই ৷'
'কি বলেন ? বয় ফ্রেন্ড কেউ নেই ??''
' না ,পড়াশুনা করতে এসেছি আমি , তারপর দেশে ফিরে গিয়ে আমার শিক্ষাকে কাজে লাগাবো দেশের পোল্ট্রি শিল্পকে সমৃদ্ধ করার জন্য ৷'
' হ্যাঁ , তা করবেন নিশ্চয়ই , বিয়েও করবেন ৷'
তানিয়া ওর কথার উত্তর দিলো না ৷ হাটতে শুরু করল ৷ সুনীল মন্ডলকে পিছনে রেখে ৷ হাটতে হাটতেই দেখল স্ট্রিট লাইটের আলো পড়ছে সেইন নদীর পানিতে , কিছু কিছু প্রমোদ তরী ভেসে যাচছিল নদীতে , স্প্যনিশ গান কানে এলো তানিয়ার ,বুঝে উঠার আগেই দেখল সুনীল মন্ডল গান গাইছে ৷
তানিয়া হেসে ফেলে , অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে , ' আপনি স্প্যানিশ ভাষা জানেন ?'
' জী হা পারি ,তবে ভাল নয় ৷ মোটমুটি ৷ আমার সাথে কিছু সময় কাটাবেন ? খুশি হতাম ৷'
তানিয়ার ইচ্ছা করছিল আরেকটু ভাল করে লোকটাকে জানতে ৷ কেন কে জানে ৷
হয়তো এটাই সত্যি প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে ,কে কোথায় ধরা পড়ে কে জানে ৷
ওরা একদৃষ্টে তাকিয়ে দেখছিল আলোর বিকিরণে সেইন নদীর স্রোতগুলো একেবেকে পাড়ের দিকে ভেঙ্গে ভেঙ্গে পড়েছিল ৷ ওরা অদ্ভুত ঘোর লাগা সময় কাটাচ্ছিল ৷ আচমকা দূরে হাজার জোনাকি যেন ঝিক্‌মিক্‌ করে উঠল ৷
সুনীল মন্ডল , 'আপনি দেখেছেন তানিয়া আইফেল টাওয়ারের আলো জ্বলে উঠেছে , তাকিয়ে দেখেন ৷'
তানিয়া চোখ ভরে দেখে ৷ তারপর বলে ,' আমাকে একটা ট্যাক্সি ডেকে দিলে ভাল হতো ৷'
সুনীল মন্ডল দেখল তানিয়া করিমকে আর আটকে রাখা সম্ভব নয় ৷ ওরা হাটছিল একটা ট্যাক্সির জন্য ,এমন সময়ই সুনীলের ফোন আসল , তানিয়া মনে ভাবল হয়তো ওর কোন গার্লফ্রেন্ড আছে , সেই কল দিয়েছে ৷ সুনীল কথা বলছে , তানিয়া শুনতে ইচ্ছা করছিল না ৷ সে নিজেই একটা ট্যাক্সি খুঁজতে লাগল এগিয়ে যেতে লাগল ৷ সুনীল দৌড়তে দৌড়তে এসে বলল , ' তানিয়া দাঁড়াও ,আমি আসছি ৷' সে তানিয়াকে তুমি করে বলা শুরু খেয়াল করে না ৷ কাছে এসে বলল , ' মা আমাকে ফোন করছিল , দেশের থেকে ৷ অনেকদিন বাইরে আছি তো ,তাই প্রতিদিনই ফোনে কথা বলতে হয় মা যতদিন বেঁচে থাকবেন ৷
তানিয়া কি নিশ্চিত বোধ করল না কি ? কথা বলতে বলতে সুনীল হাত তুলে একটা ট্যাক্সি ডাকলো ৷ সুনীলও উঠল ওর সাথে ৷ ফোন নাম্বার বিনিময় হলো , দুজনের ঠিকানা জানান হলো দুজনকে , তানিয়াকে ডর্মের সামনে নামিয়ে ট্যাক্সি নিয়ে চলে গেলো সুনীল মন্ডল ৷
তারপরে চললো দেখা করা , মেসেন্জারের কথায় রাত ভোর করা , সুনীলের সাথে আর্ট গ্যালারিতে ঘোরা
সুনীল এর আঁকা ছবির একজিবিশন করা , সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখা ৷ সুখের দিনগুলো যেন তাড়াতাড়ি কেটে গেল ৷ তানিয়ার ফেলোশিপ শেষ করে দেশে ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে ৷ সুনীল তানিয়াকে বাংলাদেশে ফিরতে দিতে চাচ্ছে না ৷ কিন্তু তানিয়াকে তো ফিরে যেতেই হবে ৷ দেশোর কাজে লাগাতে হবে নিজের শিক্ষাকে , মা র দায়িত্ব নিতে হবে ৷ ছোট ভাইটার পড়াশোনাটা শেষ হলে তানিয়া নিশ্চিত হতে পারতো ৷ আগামীকাল তানিয়ার ঢাকার ফ্লাইট , তানিয়াকে দাওয়াত করলো সুনীল ওর এ্যাপার্টমেন্টে ৷ তিনরূমের ফ্ল্যাটটা , তিন জন মিলে থাকে ৷ সুনীলের রূমটা দেখলে মনেই হয় না একজন পুরুষের ঘর ৷ কিচেন, বিছানা সব গুছানো ৷
'তোমার বাসা তো খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন সুনীল ৷'
'ম্যাকসি '
'ম্যাকসি কেন ?'
'দোষ না ধরার জন্য '
'কে করে তোমার ঘর পরিষ্কার ?'
'আমিই করি ৷'
'সত্যিই ? '
'বিশ্বাস হচ্ছে না ?'
'না '
'কি দেখছ ?'
'না ,এমনি '
'তুমি কি ভাবছ কোন মেয়ে আসে কি না কোনদিন ?'
তুমি তো বিয়ে করতে পারো , ফরাসী মেয়েরা এত সুন্দর ৷ তুমি তো আবার আর্টিস্ট , সুন্দরের পুজারি ৷ আবার দেশ থেকেও বিয়ে নিয়ে আসতে পারো ৷'
' তা পারি , হয়তো চলে যাব দেশে ৷ আমাকে মা কয়েকদিন ধরে যেতে বলছে ৷ তুমি ইলিশ মাছ ভাজি আর খিচুড়ি খাও ৷ তোমার জন্য রান্না করেছি ৷ খেয়ে বলো কেমন হয়েছে ৷'
তানিয়া খেতে শুরু করলো ৷ সুনীল অনেক ভালো রান্না করেছে ৷ খাওয়ার পর দুজনে মিলে প্লেট বাসন পরিষ্কার করলো , সব কিছু সুন্দর করে গুছিয়ে রেখে সুনীল তানিয়াকে ডর্মের সামনে নামিয়ে দিল,বলল ' 'সকালবেলায় এসে তোমাকে পৌছে দেবো এয়ারপোর্টে ,রেডি থেকো তুমি ৷'


তিনবছর পর ৷ তানিয়া করিম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার ৷ টিচার্স কোয়ার্টারে থাকেন মা এর সাথে ৷ ভাইটা সিলেট মেডিকেলে পড়ছে ৷ আজকে সারাদিন আকাশের মুখ গোমড়া হয়ে রয়েছে ৷ আজকে সকাল থেকেই বৃষ্টি পড়ছে ৷ আষাঢ় মাস ৷ বৃষ্টি পড়বে না ? তানিয়া জানালার পাশে বসে বিকেলের চা খাচ্ছিল ৷ কাজের মহিলাটির রান্নার হাত খুব ভাল ৷ বৃষ্টি পড়লেই সে গরম গরম পেয়াজু অার চা বানিয়ে তানিয়াকে আর মাকে দিলো ৷ বিজলি চমকাচ্ছিল এতক্ষণ ৷ বৃষ্টি টা এখন একটু ধরে এসেছে ৷ মেঘের ফঁাক দিয়ে সন্ধ্যার চাঁদের উদয় দেখল তানিয়া ৷ তবে কি আজকে আষাঢ়ে পূর্ণিমাতিথি ? তানিয়ার মন এখন চাঁদের আলোয় ভরে গেলো ৷ কাজের মহিলাটি এসে বলল , 'আপা আপনার সাথে একজন মানুষ আসছে দেখা করতে ৷'
তানিয়া বলল , 'কি নাম বলেছে ?'
'না ,শুধু বলছেন আপনারে ডাকতে ৷'
তানিয়া ভেবে পেল না এই সময় কে আসলো ৷ সে বলল ,' ওনাকে বসার ঘরে বসতে দাও ,আমি আসছি৷'
তানিয়া ঘরে ঢুকে দেখল সুনীল মন্ডল বসে আছে সাথে ওর মা ৷ তানিয়া বলল ,' সুনীল তুমি ? কবে এলে বাংলাদেশে ? আন্টি ঢাকায় কবে এলেন আপনি ?'
'এক সপ্তাহ হয়েছে , সিলেট হয়ে ঢাকায় এলাম তোমাদের বাসায় ৷ তুমি ভাল আছো ?'
'হ্যা, ভালো ৷ তোমার খবর কি ?'
'আমি এসেছি বিয়ে করতে ৷ '
'তাই নাকি ? খুব খুশির কথা ,মেয়ে দেখেছ ?'
'হ্যা , অনেকদিন ধরে চিনি , এবার মাকেও রাজি করিয়েছি ৷'
তানিয়ার তো খুশি হওয়ার কথা ,সুনীলের বিয়ের কথায় , কিন্তু ও কেন খুশী হতে পারছে কেন ? ফ্রান্সে ওর সুনীলের সাথে ঘুরতে কতো ভাল লাগত ৷
সুনীল মুচকি হেসে বলে ফেলে , 'মা তানিয়াকে কিছু বলবে না কিন্তু ৷' তানিয়ার মনে মনে ভাবছিলো সুনীল একটুও বদলায় নি , ওর সেই কথায় কথায় হাসির রোগটা আগের মতই আছে ৷ ওকে যে বিয়ে করবে সে অনেক সুখি হবে ৷ অসম্ভব কেয়ারিং একটা ছেলে হচ্ছে এই সুনীল ৷
তানিয়া বলে ,'হ্যাঁ ,মা বলেন না কি বলবে না আমাকে ?' চা ,নাস্তা নিয়ে ঘরে ঢুকেন তানিয়া মা , ওর মায়ের সঙ্গে সুনীলের মায়ের আলাপ করিয়ে দেয় ৷ সুনীলের মা তানিয়াকে বলেন ,' মা তোমাকে আমার ছেলেটা সেই ফ্রান্সে থাকার সময় থেকেই পছন্দ করতো, কিন্তু তোমাকে বলতে পারেনি ৷ এবছর সুনীলের আঁকা একটা ছবি আর্ট একজিবিশনে ইন্টারন্যাশনাল এ্যাওয়ার্ড পেয়েছে ৷ ও তোমাকে বিয়ে করতে চায় তুমি কি বলো তানিয়া ? '

তানিয়া কি বলবে ও শুধু দেখল সুনীলের চোখের ভালবাসায় আজকের বৃষ্টি ভেজা দিনটা রূপালী জোৎস্নার আলোয় ভেসে যাচ্ছে ৷
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
এলিজা রহমান কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ আপনাকে এত সুন্দর মন্তব্য করার জন্য ৷ শুভেচ্ছা রইল ৷
কাজী প্রিয়াংকা সিলমী বেশ প্যারিস ভ্রমণ হয়ে গেল :)
রঙ পেন্সিল বাহ! সুন্দর গল্প।

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

তানিয়া করিম ফ্রান্সে এসেছে ফ্রান্সের সরকারের একটা ফলোশিপ বৃত্তি নিয়ে ৷ সে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এবছর প্রাণী বিদ্যায় মাস্টার্স করেছে ৷ ফ্রান্স সরকার বিজ্ঞান , সামাজিক বিজ্ঞান মানবিক বিষয়ক গবেষণা কাজের জন্য ফেলোশিপ দেয়া হয় ৷ ফেলোদের আর্থিক বৃত্তি ,যাতায়াত খরচের পাশাপাশি স্বাস্থ্যবীমারও ব্যবস্থা করেন তারা ৷ তানিয়া ও ফরহাদেরর বিয়ে হয় পারিবারিকভাবে ৷ ফরহাদের চরিত্রদোষ আর যৌতুকের দাবি মেনে নিয়ে সংসার করতে পারে নি তানিয়া ৷ ফ্রান্স সরকারের এই ফেলোশিপ পাওয়াতে সে বেঁচে যায় , কারন ডির্ভোস হওয়ার পর সে মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়েছিল ৷ ল্যুভর মিউজিয়ামে ঘটনাচক্রে পরিচয় হয় একজন আর্টিস্টের সাথে ৷

১১ অক্টোবর - ২০১৭ গল্প/কবিতা: ২৭ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪