বন্যা আর সাবরিনা দুজন মোল্লাহাট গার্লস কলেজের ছাত্রী । তারা একসাথে সাইকেলে আসা যাওয়া করে । রাস্তার পাশে মাঠে সরিষার খেত। এবার সরিষার ফলন ভাল হয়েছে, আজকে কলেজ না থাকলে সরিষার ফুল তুলতো ওরা বন্যা মনে মনে ভাবল মা যা মজার সরিষা ফুলের বড়া বানায়। বন্যার আব্বা এই কলেজেরই বাংলার শিক্ষক আর সাবরিনার আব্বা বাগেরহাটের ডাচ বাংলা ব্যাংকের ম্যানেজার হয়ে এসেছেন আজকে প্রায় চার বছর ।
সাবরিনার আব্বার ট্রান্সফার হলে ওদের এই বন্ধুত্ব কি নষ্ট হয়ে যাবে ? ওরা চায় ওদের বন্ধুত্ব সারা জীবন থাকুক । বন্যার আব্বা যদি বন্যাকে কলেজের পর আর না পড়িয়ে বিয়ে দিয়ে দেন ? বন্যার ইচ্ছা ও কাস্টমস অফিসার হবে ও জানে সাবরিনার ইচ্ছা বিদেশে পড়ার । বন্যার কলেজের অন্য মেয়েরা ওদের বন্ধুত্ব দেখে হিংসে করে মনে মনে । পাপিয়া তো একদিন বলেই ফেললো , ' বন্যার আর সাবরিনার যদি একই ফ্যামিলির দুই ছেলের সঙ্গে বিয়ে হয় তাহলে কি মজা হবে না ? দুই বান্ধবী আবার দুই জা হি হি । ''
কথাটা সাবরিনা সহজ ভাবেই নিল । উত্তর দিল ,' তোর মুখে ফুল চন্দন পড়ুক পাপিয়া । তবে কি জানিস জন্ম , মৃত্যু বিবাহ এই তিনটা জিনিস আমাদের ইচ্ছা মতন হয় না । আল্লাহ যা চান তাই হবে বন্ধু । তুই না হয় এই দোয়াটা করতে থাক যেন তোর কথাই সত্যি হয় রে ।"
পাপিয়া মুখে কিছু না বলে অন্যদিকে চলে গেল সেদিন আর দুই বান্ধবী হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে।
আজকে ওদের কলেজের একটা বিশেষ দিন । ইংরেজীর শিক্ষক শ্রাবনী ইসলাম ম্যাডাম চাকরী থেকে অবসরে যাচ্ছেন সেইজন্য ছাত্রীরা ওনার বিদায়ী সংবধর্না দেবে আজকে কলেজে ।
সাবরিনা বন্যাকে জিজ্ঞাসা করল , ' আমাদের কলেজের ইংরেজীর নতুন শিক্ষক কি কেউ এসেছেন?
বন্যাকে একটু চিন্তিত মনে হল , ' কি জানি , আজকে তো শনিবার । সোমবার হয়ত আসবেন কেউ । '
' শ্রাবনী ম্যাডাম তোর পরিচিত । তা উনার স্বামী কি করেন ? সন্তানরা কোথায় আছে জানিস ?"
বন্যা হঠাৎ আবেগপ্রবন হয়ে বলল ," উনি বিয়ে করেন নি । মুক্তিযুদ্ধের সময় উনার ১৪ বছর বয়স ছিল । আমি যতদূর জানি , উনি যাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন তিনিও একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন । মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী সৈন্যদের মর্টারের আঘাতে আবীর রহমান মারা যান । তাই শ্রাবনী ইসলাম ম্যাডাম ও আর বিয়ে করেন নি । ''
সাবরিনা বন্যাকে বলল , '' ওনার আব্বা- আম্মা , ভাই বোন কেউ নেই ? ''
'' ওনার আব্বা ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে । ওনাদের বাড়িতে পাকিস্তানী সৈন্যদের আর রাজাকারদের আসা যাওয়া ছিল । '' বন্যা বলল ,'' ফলে ওদের সঙ্গে শ্রাবনী ম্যাডামের দেখা হতো। স্হানীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডর রফিকুল ইসলাম এই সুযোগটা কাজে লাগান । তিনিই , শ্রাবনী ম্যাডামকে পাকসেনাদের বাঙালীদের উপর অত্যাচার ,নির্যাতন ,হত্যাকান্ডের কথা বোঝান। শ্রাবনী ম্যাডাম নিজের আব্বার কার্যকলাপ দেখে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করতে থাকেন। তিনি পাকসেনাদের ও রাজাকারদের খবর মুক্তিযোদ্ধাদের পৌঁছে দিতেন । কখনও তিনি ভিখারি কখনও পাগলি সেজে পাক সেনাদের শিবিরে যেতেন । খাবার চাইতেন । কুখ্যাত নৃশংস খুনি রাজাকার রজব আলি ছিল পাকিস্তানী সৈন্যদের প্রধান সহযোগী । শ্রাবনী ম্যাডাম মুক্তিযোদ্ধাদের রজব আলি কোন সময় বের হয় আর কোন সময় বাসায় ফিরে এসব তথ্য দেয়ার পর মুক্তিযোদ্ধারা তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে সুইসাইড স্কোয়াড গঠন করে । রজব আলি গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় আর শ্রাবনী ম্যাডাম পালিয়ে চলে মুক্তিযোদ্ধা শিবিরে । কারন তার আব্বা সন্দেহ করেছিলেন যে এই মেয়ে ছাড়া এসব খবর আর কেউ জানতে পারে না । '' বন্যা আরো বলল '' যুদ্ধপরাধী মামলায় শ্রাবনী ম্যাডামের বাবার যাবজ্জীবন কারাদন্ডের শাস্তি হয় উনার বয়স বেশি হওয়ার কারনে । শ্রাবনী ম্যাডামের আম্মা উনার সাথে থাকেন উনাদের পৈত্রিক বাড়িতে ।
''অনেক নারীই মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার দিয়েছেন নিজেরা না খেয়ে , আশ্রয় দিয়েছেন, অস্ত্র বহন করেছেন, সেবা করেছেন, লুকিয়ে রেখেছেন, গোপন সংবাদ আনা নেয়া করেছেন । অনেক নারীই মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধ করেছেন, অস্ত্র চালনা করেছেন, গ্রেনেড চার্জ করে পাকিস্তানী সৈন্যদের গান বোট ধ্বংস করে দিয়েছেন । নাম না জানা এমন অনেক নারী আছেন যারা নিজের স্বামী, সন্তানদের জীবন দেশের স্বার্থে কোরবানি করেছেন । অথচ এদের অবদানের মূল্যায়ন হয়নি ,বীরপ্রতীক খেতাব পাওয়ার মতন যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তারা সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছ থেকে স্বীকৃতি পান নি । এগিয়ে গেছেন পুরুষরা । মুক্তিযুদ্ধে গিয়ে পুরুষরা পেয়েছেন বীরের সন্মান আর বেশিরভাগ মেয়ের কপালে জুটেছে ' খারাপ মেয়ের' তকমা ।'' সাবরিনা খুব দুঃখের সঙ্গে বলে কথাগুলো ।
'' শ্রাবনী ম্যাডাম কেন বিয়ে করেন নি জানিস , উনি যাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন ,সেই রাফিউর রহমান পাকিস্তানী সৈন্যদের মর্টারের আঘাতে মারা যান । শ্রাবনী ম্যাডাম অস্ত্র চালানোর ট্রেনিং নিয়েছিলেন। জানিস সাবরিনা , কলকাতা পার্ক সার্কাস ও পদ্মপুকুরের মাঝে গোবরা নামের এক জায়গায় শুধু নারী যোদ্ধাদের প্রশিক্ষন দেয়ার জন্য একটা ক্যাম্প বানানো হয়। ওই ক্যাম্পটা পরিচালনা করতেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দা সাজেদা চৌধুরি । এই ক্যাম্পে নারীদের ট্রেনিং দেয়া হতো ৩ রকমের।
১.সিভিল ডিফেন্স
২.নার্সিং
৩.অস্ত্র চালনা ও গেরিলা আক্রমন।
স্বাধীনতা যুদ্ধে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন অনেক নারী, যেমন - কাঁকন বিবি, তারামন বিবি , ক্যাপ্টন সেতারা,শিরিন বানু , আশালতা,রওশন আরা । এই
মুহূর্তে বন্যাকে দেখে সাবরিনার মনে হলো ১৯৭১ সালে বন্যার জন্ম হলে সে ঠিক অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করতো ।
সাবরিনারা গল্প করতে করতে ভুলেই গেছিল শ্রাবনী ইসলাম ম্যাডামের বিদায়ী সংবর্ধনার কথা । দুজনে দৌড়ে অডিটোরিয়ামে গিয়ে ঢুকলো ।
মঞ্চে ওরা দেখে শ্রাবনী ম্যাডাম, কলেজের অধ্যক্ষ কামাল আহমেদ স্যার, উপধ্যক্ষ দবিরউল্লাহ স্যার বসে আছেন। শ্রাবনী ম্যাডাম একটা কমলা রঙের আর কাল পাড় টাঙ্গাইলের শাড়ি পরেছেন । এই বয়সেও ওনাকে মোটেও বয়স্ক লাগছে না , অবশ্য উনি সবসময়ই সুন্দর ভাবে সাবরিনা। আসলে ,মানুষের এক একটা বয়সের একটা সৌন্দর্য থাকে । বাচ্চারা এক রকম সুন্দর আবার বয়স হলে মানুষের আরেকরকম সৌন্দর্য হয় । তাছাড়া , সাবরিনার নিজস্ব ধারনা এটা ,যে মানুষের মনের পবিত্রতা তার চেহারায় ফুটে উঠে । যেমন , কাউকে কাউকে দেখলেই মনে হয় যেন মূর্তিমান শয়তান।
প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন অধ্যক্ষ কামাল আহমেদ। উপাধ্যক্ষ দবিরউল্লাহ খানের সভাপত্তিতে ও শিক্ষক সমিতির সাধারন সম্পাদক সাইদুল জামানের পরিচালনায় শিক্ষকদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন
সোনিয়া পারভিন, মিনার হোসেন ও মিনতি রানী পাল । শিক্ষার্থীদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন সাদিয়া আফরিন ও লামিয়া নুসরাত । শ্রাবনী ইসলামের মানপত্র পাঠ করে দশম শ্রেনীর মায়মুনা খাতুন।
অধ্যক্ষ কামাল আহমেদ তার বক্তব্যে বলেন, শ্রাবনী ইসলাম আমাদের কলেজের গর্ব । আমাদের কলেজে তিনি তার কর্মদক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন ।তিনি তার দীর্ঘ কর্মজীবনে এই কলেজের জন্য অনেক কিছু করেছেন, আপনার জন্য আমাদের মাঝে সব সময় একটা শূন্যতা রয়ে যাবে । আপনার সুখী ও সুস্হ জীবন প্রত্যাশা করছি ।কলেজের শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্য করে অধ্যক্ষ কামাল আহমেদ বলেন, উনি কলেজের শিক্ষক না থাকুন তোমাদের সাথে ওনার দেখা হলে সালাম দিবে এবং সন্মান করবে । তোমরা মানুষের মত মানুষ হয়ে দেশের সেবা করবে , এভাবেই একদিন তোমরা আমাদের দেশের মাথা উঁচু করবে বিশ্বের মাঝে ।
শ্রাবনী ইসলাম বিদায়ী বক্তব্যে বলেন, '' আজকে আমাকে যেভাবে সন্মান জানিয়ে বিদায় জানানো হলো তাতে আমি অভিভূত। আপনাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ । শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্য শ্রাবনী ইসলাম বললেন , আজ তোমাদের বলছি এটা ইতিহাসের শিক্ষা যে স্বাধীনতার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ জাতির জন্য কোন বাঁধাই বাঁধা নয় । স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার সংগ্রামে নিয়োজিত বীর মুক্তিযোদ্ধারা খাদ্য,বস্ত্র, ঔষধের অভাবে কি নিদারুন কষ্টে যুদ্ধ করেছেন তা কি তোমরা জান ? তোমরা কি জান ডিসেম্বর মাসে নদীর চরে , বনে জঙ্গলে না খেয়ে শীতের মধ্যে কাক ভোরে ঠক ঠক করে কাঁপতে কাঁপতে তারা শত্রুদের গুলি করেছেন আর নিজের জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করে গেছেন । তোমরা আমার কথাটা মনে রেখ , স্বাধীনতা এত সহজে কিন্তু আসেনি , লড়াই করে জীবনবাজি রেখে রক্তের বিনিময়ে আমরা একটা স্বাধীন দেশ আর পতাকা পেয়েছি । তাই তোমাদেরকে বলছি কখনও হাল ছেড়ে দিও না !এখনকার এই দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করা কষ্টগুলো তোমাকে বিজয়ীর খেতাব দেবে সারাজীবনের জন্য । আর ভাল করে পড়াশুনা করবে তোমরা । মনে রাখবে ,'' Education is for improving the life of others and for leaving your community and world better than you found it ." এই বলে শ্রাবনী ম্যাডাম তার বক্তব্য শেষ করেন । অধ্যক্ষ কামাল আহমেদ তার হাতে ফুলের তোড়া আর উপহার তুলে দেন ।
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
নারীদের শিক্ষিত হতে হবে দেশের জন্য ,নিজের সন্তানদের মানুষ করার জন্য । নারী একাধারে মমতাময়ী মা ,স্নেহময়ী বোন , প্রেরনাদায়ী প্রেমিকা ও সেই নারীই ।আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় পুরুষের পাশাপাশি নারীর অংশগ্রহন ছিল তার জীবনবাজি রাখার ঘটনা । তারপরও নারীমুক্তিযোদ্ধা বলে সে স্বীকৃতি পায় না , পায় বীরাঙ্গনার খেতাব ।এই গল্পের নায়িকা শ্রাবনী ইসলাম জীবন যুদ্ধে একাই লড়েছে । নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন নিজের যোগ্যতায় । এই গল্পের এইটাই বুঝানো হয়েছে নিজের লড়াই নিজেকেই লড়তে হয় । আর পড়াশুনা করলে যোগ্যতা বাড়ানো যায় , নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা যায় । শ্রাবনী ইসলাম শিক্ষিত হয়েছিলেন বলেই কলেজের ইংরেজীর শিক্ষক হয়ে নিজেকে সন্মানজনক অবস্হানে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন। দেশের জন্য যুদ্ধ করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছেন আর ব্যক্তি জীবনও নিজের স্বাধীন সত্তাকে টিকিয়ে রেখেছেন ।
১১ অক্টোবর - ২০১৭
গল্প/কবিতা:
২৭ টি
সমন্বিত স্কোর
৫.১৬
বিচারক স্কোরঃ ৩.৩৬ / ৭.০
পাঠক স্কোরঃ ১.৮ / ৩.০
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪