যুগেশ দেব

কোমল (এপ্রিল ২০১৮)

মুজাহিদ অনিক
  • ২০
অলকা চৌধুরী নামের একজন মেয়ে তখন বি,এ ক্লাসেই পড়তো। অসম্ভব সুন্দরী সে মেয়ের বাড়ি ক্যালকাতাতেই। গ্রামোফোনে গান শুনতে নাকি সে খুব পছন্দ করতো।ক্যালকাতা শহরে ঘুরে বেড়াতেও খুব পটু ছিলেন। ক্যালকাতা শহরের সেসময়ের উঠতি অভিজাতরা যেভাবে ঘুরে বেড়াতেন, আড্ডা মারতেন তেমন টাইপের। ক্যালকাতা শহরে যুগেশ বাবু গিয়ে বি,এ ক্লাসের পড়ালেখা শুরুর মাস দেড়েকের মধ্যে অলকা দেবীর সংগে তার পরিচয়। যুগেশ বাবু তার দিদির বাড়িতে থেকে পড়ালেখা করতেন যেসময় সেসময়ে ক্যালকাতার বিভিন্ন থিয়েটার দেখে আর সিনেমা দেখে দেখে অলকা দেবীর সংগে তার পরিচয় গাঢ় হয়। ক্যালকাতায় এমন মুক্ত স্বাধীন মেয়ে যুগেশ বাবুকে রোমাঞ্চিত করেছিলো ভীষণ। বাংলা সিনেমার নায়িকা সুপ্রিয়া দেবীর মতো করে ভাজ করা গলায় কথা বলতো সে মেয়েটি। যুগেশ বাবু তখন সুপ্রিয়া দেবীর উত্তম উঠেছেন মোটামুটিভাবে। এই রমনীর লাস্যময়ী আহবান যেন যুগেশ বাবুকে বেধে ফেলেছিলো। কথার ভাজে যেন এক নিয়ত আকর্ষণ হয়ে আটকে রেখেছিলো তাকে। ক্যালকাতা যেন এই প্রনয়জোড়ার আধিখ্যেতায় জমে উঠেছিলো। ক্যালকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকানোর পর তাদের বিয়ের আয়োজন করতে যুগেশ বাবু ততদিনে বাড়ি ফিরেছেন। একদিন স্যার বলেছিলেন সে অলকার কথা-
‘কিন্তু সৈয়দ জামান আমি কলকাতায় ফিরে ওদের বাড়ির ঠিকানায় গিয়ে খুজলাম। কলকাতায় একটা জৈন মন্দির ছিলো সে মন্দিরের আশেপাশেই ওদের বাসা। আমার একজন রাজনীতিক বন্ধু ছিলেন। স্বদেশী আন্দোলনের অনুসারী সেসময়ে। ওর নাম বিভাস। আমার কলকাতা পৌছার পরদিন বিকেলে আমার জামাইবাবুর ডিস্পেনসারিতে ওর সাথে দেখা। ওর কাছে শুনলাম, অলকা বিয়ে করেছে। ওর বিয়েতে ও নিমন্ত্রণও খেয়ে এসেছে’।
‘শুনলাম, অলকার স্বামী একজন শল্য চিকিৎসক। দুজনেরই বিলেত যাবার আয়োজন চলে যাবে’।
বিভাস কোন এক সময়ে অলকাকে জিজ্ঞেস করেছিলো, ‘যুগেশের সঙ্গে বিয়ের কথা না কি ছিলো?’
সে কথার উত্তরে অলকা দেবী কি বলেছিলো তা আর যুগেশ দেব’র কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে নি।
তবে এই একটি প্রণয় তাকে এভাবে কিছুটা পৃথিবীবিমুখ করেছে। বেদনার আতিশয্যে নিরন্ন হয়েছিলো ভালবাসা। তরুন তরুনীর প্রনয়ের প্রারম্ভে কিংবা মাঝের রোমাঞ্চের পর এরূপ প্রত্যাখ্যানে যুগেশ দেব ব্যাথিত হয়েছিলেন। ভেবেছিলেন এর থেকে বড় বেদনা আর নাই বুঝি। এমন আঘাতের মতো বেদনা আর হয় না বুঝি। সে থেকে যুগেশ দেব ক্যালকাতা ছেড়ে পাকাপাকিভাবে চলে আসেন। আর কোনদিন কারো সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক কিংবা কোন বিপরীত লৈঙ্গিক কারো সাথে সম্পর্কে জড়ান নি যুগেশ চন্দ্র দেব।
তবে পরে যুগেশ দেব অনেকবার বলেছিলেন, ‘মানুষের নরনারীর যে প্রনয় তা ক্ষুদ্র। আমায় আমার প্রজারা হৃদয়ে তুলে রাখে। রমনীর প্রনয় আমাকে বঞ্চিত করতো। আমি ভাগ্যবান আমি ঐ প্রনয়ে আবদ্ধ হই নি। হলে এ প্রণয়ের সাথে আমার বাৎচিত হতো না রে। হয় বিলেতবাসী নয়তো পাক্কা কলিকাতাবাসী হয়ে যেতাম’।

সারমারা স্কুলে যুগেশ চন্দ্র দেব আমার ওস্তাদ ছিলেন। ক্যালকাতা থেকে ফিরে এসে তিনি আর ওদিকে ফিরেও তাকান নি। সারমারা স্কুলে আমাদের শিক্ষক হয়ে তিনি তখন আমাদের পড়ান। সারমারাতে এখন যেখানে বাজার দেখা যায় সেখান থেকে একদম দক্ষিণ দিকে সূর্য্যনগর হাটের দিকে এগিয়ে গেলে চোখে দেখা স্পষ্ট দূরত্বে একটা বিরাট আমগাছ। ঐ আমগাছটি যুগেশ দেবের বাগানবাড়ি। আমার অনুমানের হিসাবে সে বাগানটি দশ বিঘা জমির কম নয়। বাগানের অধিকাংশ গাছ আম আর কাঁঠালের। বাগানের মাঝে যে একটা ছোট্ট খুপড়ি ঘরের মতো আছে সেখানে একটা ইজি চেয়ার পাতা থাকে; চেয়ারটা দেখলে মনে হয় ভিনদেশী। চেয়ারটি ক্যালকাতা থেকে তিনি এনেছিলেন যখন তিনি ক্যালকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বি,এ ক্লাসে পরতেন। চেয়ারটি যুগেশ বাবুর শখের। আবার এক সঙ্গী গোছেরও হয়ে উঠেছিলো। এই জগতের নিভৃত বনাঞ্চলের মতো বাগানের মধ্যকার একাকী সময়গুলো যুগেশ দেবের খুব প্রিয়। নিজের বাগান যেন বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হয়ে উঠে তার কাছে! নিশ্চয়ই উপভোগ্য দ্বীপ!

আমি তখন প্রাইমারি শেষ করেছি। প্রাইমারি স্কুলের আমার ওস্তাদ আবুল হোসেন আমাকে স্লিপ দিয়ে পাঠালেন সারমারা মাইনার স্কুলে। আমি সারমারা মাইনার স্কুল যখন শেষ করি তখন সালটা ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ। আজ যেমন প্রাইমারির পর হাইস্কুল, তখন তেমন ছিলো না। প্রাইমারি শেষের পর ফাইভ,সিক্স মাইনার স্কুল।সারমারা মাইনার স্কুলেই তখন হাইস্কুল খুলে। আমার বাড়ি ভিটাকান্দী থেকে সারমারা পায়ে হেটে আসতেই ২-৩ ঘন্টা লাগতো কাজেই এর থেকে দূরের কোন হাইস্কুলে ভর্তি হবার পরিকল্পনা করা মানে হলো আমার লেখাপড়া সেযাত্রায় সেখানেই ইস্তফা কারন ওভাবে বিদেশবিভূইয়ে যাওয়া মানে আবার লজিং খোজা,আবার অনিশ্চয়তা। আবার বাবা বলছিলো, ‘শ্যাষ! আরো কত ল্যাহাপুড়া’।
ভালো কোন হাইস্কুলের পড়ার ইচ্ছে তখন সেখানে মাড়িয়ে গেলাম। সারমারা মাইনার স্কুলে পড়ার সময়ে যে কিশোর ছিলাম তা যেন ধীরে ধীরে জীবনে আর রইলো না। মাইনার স্কুলে ভর্তির আগে কাফি,ফম আর আমাদের বাড়ির গরুর রাখাল বাসুল্লাকে রেখে আমি সারমারা আসলাম। ওরাই আমার বন্ধু। হুজুগে গ্রামগ্রামান্তরে পালা শুনতে কিংবা ভরাজ্যোস্নার রাতে গোল্লাছুট খেলাতে যতি টেনে সারমারা আমার কাছে এক বিরান ফাকা মাঠ মনে হচ্ছিলো সেসময়, যেখানে কেউ নেই-এমন মনে হয়। কিন্তু না, ততদিনে এক অন্য কিছু যেন আবেশিত করে ফেলে আমাকে। আমার লজিং বাড়ির সামনের কাছারি ঘরটাতে আমি থাকতাম, আমার সাথে আমার চকপাড়ার এক বন্ধু থাকতো। কাছারি বাড়ির পাশের জুলু, ময়নাল আরো অনেকে তখন বন্ধু হয়েছে। আর আমাদের বাড়ির রাখাল ছিলো বাসুল্লা। এখানে এসে লজিং বাড়ির রাখাল জুটেছে। সেও আমার বন্ধু হয়ে উঠেছে। নিস্তব্ধ প্রকৃতির আয়োজন ভেঙ্গে যখন আধার চিড়ে ভোরবেলাতে আমার লজিং বাড়ির রাখাল গরুর হাল নিয়ে যেত তখন গরুকে গোয়াল থেকে বের করার হাক-ডাক আমার ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিতো। ফজরের আজান দেবার সাথে সাথে সেই হ্যাঠ-হ্যাঠ, ঠ্যাঠ ঠ্যাঠ করে গরুর পালকে পথনির্দেশ করার শব্দটা আমার এখনো কানে বাজে। গরুর পাল বেধে লাঙ্গল-জোয়াল গোছাতে গোছাতে আমাকে ডাকতো, ‘এহে সৈদ জামাল’।
আমার নাম ছিলো সৈয়দ জামান, কিন্তু উনি এভাবেই ডাকতেন। বিহানবেলায় চারদিকে সিঁথিতে সিঁদুরের এলোমেলো বিন্যাসে রমণীরা পুজো দিতো। লেপটে থাকা সিঁদুরে ওদের পূজা কি দেবভক্তি অধিক হয় কি না জানি না! ঐ সিদুরমাখা রমনীদের এখন আর অতো দেখা যায় না সারমারাতে। আর ঐসময় মসজিদের আজানের ধ্বনি আবার ঘুম ভাঙ্গার সাথে সাথে রমণীদের উলু ধ্বনি আর ঘন্টাধ্বনির আওয়াজ ভেসে আসতো-ঠিক যেন পরম্পরায় বেজে উঠতো। তখনো সনাতন ধর্মের লোকগুলো একে একে দলবেধে চলে যাবার আয়োজন যেন ফুরোয় নি। আর আজ যে সারমারা দেখো সেখানে যা হিন্দুবসতি ছিলো তার সিকিভাগও এখন নেই।
আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে তখন প্রমত্তা নদী বহমান। এখন তোরা যে পশ্চিমের দিকে খাল দেখিস সেটা তখন বহতা নদী। আমাদের বাড়ির চারদিক তখন নদী ভাঙ্গনে ধরেছে। অবশ্য তখনো আমার জন্ম হয় নি, আমার বাবা গল্প করতো আমাদের বাড়ি ছিলো আরো পশ্চিমে। নদীতে ভাঙতে ভাঙতে এখন এখানে। সে কারনে সারমারার মানুষজন আমাদের এ অঞ্চলের মানুষজনকে ‘চইর‍্যা’ বলতো। যুগেশ বাবু আমাকে খুব নজর রাখতেন। শুনেছি, আমাকে দেখে তিনি নাকি বলতেন, ‘চরের থেকে যখন এসেছে এতোদূর, তাহলে ও পড়ালেখা করতেই এসেছে। সাধে তো আর আসে নি। স্বভাব চরিত্রও তাই বলে’।
আমরা যখন ক্লাস সেভেন পড়ছি তখনো যুগেশ বাবুকে ক্লাসে পাই নি। শুধু দূর থেকে স্যারকে দেখতাম। স্কুল জুড়ে স্যারের অনেক কথা। সকলের যত আগ্রহ ততো যেন সমীহ, এ যেন ভয় নয় তবে এক অন্য গোছের সম্মান। আমাদের স্কুলের যে মকবুল হোসেন, যিনি স্কুলের হেডমাস্টার; তিনিও নাকি স্যারের ছাত্র। আমরা দেখতাম যুগেশ বাবু আমাদের হেডস্যারকে ডাকতেন- ‘মকবুল.........মকবুল’।
এখন তিনি বসেন এসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টারের চেয়ারে আর তারই ছাত্র বসেন হেডমাস্টারের চেয়ারে। ক্যালকাতা ভার্সিটি থেকে বি,এ পাস করে তিনি এসেছেন এই অন্ধকার পল্লীতে, এখন এখানেই থাকেন। শুনেছিলাম স্যার বি,এ পাস করার পরপরই ব্রিটিশের ঐ সময়ে ম্যাজিস্ট্রেসির চাকরিও পেয়েছিলেন কিন্তু কোন এক অজ্ঞাত কারনে তিনি তা করেন নি। স্যার ক্যালকাতাতেই থাকতেন ছোট থেকেই। সারমারা আসতেন তবে থাকা বলতে যা বোঝায় তা ঐ ক্যালকাতাতেই। মাঝেমাঝে সারমারাতে আসতেন। এখানে তার বিরাট জুতদারি ছিলো।মাহারাজা প্রদৎকুমার ঠাকুরের নিযুক্ত জোয়ার্দার ছিলেন। সারমারা ,সূর্য্যনগর, বকশীগঞ্জ পর্যন্ত স্যারের বাবার জায়গাজমি ছিলো। এই বিশাল অঞ্চলের খাজনাপাতি সংগ্রহ আর দেখভাল যুগেশ দেবের বাবা করতেন। বাবা যখন মারা যান তখন স্যার ক্যালকাতা ভার্সিটিতে সবে ভর্তি হয়েছেন। অনেক আত্নীয় স্বজনের অনেকেই তখনি ক্যালকাতা শহরে থাকতেন। আত্নীয় স্বজনেরা চেয়েছিলেন তখনি স্যার সেখানে থেকে যাক কিন্তু তিনি তা চান নি। স্যারের মুখে পরে অনেকবার শুনেছি, ‘আমি এখানে যেমন নিঃশ্বাস নেই, অন্য কোথাও কী তা পাবো?’
সে জন্যই বোধহয়, বাবা মারা যাবার পর পড়াশোনা আর এখানকার জুতদারি দেখাশোনার ভার নেন। প্রজাদের কাছ থেকে খাজনাপাতি সংগ্রহের মতো কায়কারবার তিনি দেখাশোনা শুরু করেন। চিরকুমার যুগেশ দেব’র নিঃসঙ্গ জীবনের সঙ্গী ঐ বাগানটা। বাগানটির কথা বলছিলাম সেই বাগান তার শখেরও বটে। অনেক আদর করে জারুল গাছ,পাহাড়ি কুল,আম ,লিচু,পেয়ারা আরো বহু প্রজাতির ফল আর ফুলের সমাহারে ভরিয়ে তুলেছিলেন স্যার একে। এখানে না এলে যেন তার দিনটাই বৃথা থেকে যায়। এখানে যেন পরিপুষ্ট নিঃশ্বাস খুঁজে নেন তিনি। ভরাজোস্নার রাতে ঐ ছোট্ট ঘরের মাঝে ইজি চেয়ার পেতে বসে থাকেন তিনি। খড়ের চালা দেয়া চারকোণা ঘড়টা একদম বাগানের মাঝে। চেয়ারটা ওখানেই পাতা । কোন অবসরের সময় কিংবা কোন আলোকিত জোস্নার রাতে যুগেশ বাবু বসে থাকেন চেয়ারে। উষ্ণ দিনের পর যখন রাতের জ্যোস্না ঝিকিমিকি করে তখন এভাবে ইজি চেয়ার পেতে বসতে খুব ভালো লাগে যুগেশ বাবু’র। এমন রাতের দৈর্ঘ্য বাড়ার সাথে সাথে যখন হিম বাতাস বইতে শুরু করে যুগেশ বাবু তখন আর টিকতে পারেন না। মগ্ন হয়ে থাকার আয়োজনকে তখন ক্লান্তি আর নিদ্রা ছিনতাই করে নিয়ে যায়। তবুও অতিবাহিত করেন অনেকটা সময়। কারন, অনেক রাত হয়ে মানুষের আনাগোনা ফুরিয়ে যায়, সারমারা বাজারের হাটুরেরা ফিরে গিয়ে দোকানিরাও দলবেধে বাক্সপেটরা নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়,কোহাহল থেমে যায়; কিছুক্ষনের বিরতিতে তখনি মনে হয় যুগেশ দেব তার একাকিত্বটা অনুভব করেন পরম তৃপ্তিতে । পূর্ব উত্তরদিকে ফাঁকা মাঠ চিড়ে দৃষ্টি দিলে যেখানে সদ্য হিন্দস্থানি পাহাড় দেখা যায় সেখানের আধারমিশ্রিত কালো পাহাড় তার দৃষ্টিকে টেনে নেয়। গাঢ় নীল হয়ে যেন আভা ছড়ায় বেদনার মতো করে। আসর ভাঙ্গার অতৃপ্তি যেন সদ্য হিন্দুস্থানের পাহাড়ে পাহাড়ে। অবশেষজুড়ে ভাবনার ক্লেশ যেন রাতের সমানুপাতে ম্রিয়মান হয় নিয়ম করে, ব্রহ্মাণ্ডে নতুন আলো ফোটে। সারমারার মানুষও ছুটতে শুরু করে পুনরায়, যুগেশ বাবু অপেক্ষায় থাকেন আরেকটা রাতের।

……………
মেঠো পথের একদিকে যখন রাস্তা বাক নিয়ে হারিয়ে যায়, দূরের একপ্রান্তে দাড়িয়ে তখন তাকিয়ে থাকতাম। বাড়ি থেকে ফেরার পথগুলো আমার কাছে তখন ব্যাকুল এক প্রত্যাশা তৈরি করে দিতো-ইশ থাকি না আর কয়েকটা দিন। পথের দুধারের কাশবনগুলো যেন আরো দেয়াল তুলে দিতো এই ব্যাকুলতায়। আমি ফিরে ফিরে চাইতাম।
সেসময়ে নিয়্যা ভাই, আমি পড়াশোনা করেছি বহুকষ্টে। নিজের বলে বলছি না, আমি কষ্টে পড়েছি ভাই। আমি যেমন আমার ছেলেমেয়েদের পড়িয়েছি তখন কি আর আমার বাবা আমাকে এভাবে পড়তে দিতে চাইতো, আমিই না মনের জোরে দূরদেশে থেকে পড়েছি। বাবার হালের গরু বান্ধা আর গৃহস্থের দেখভাল করা- সে’ই হতো জীবনের দায়। তাই আমার ম্যাট্রিকুলেশন পাসের সাধনা মুখের কথা না দাদুভাই।
কিন্তু কাশবন পেড়িয়ে যখন লজিং বাড়ি, সারমারা স্কুল আমাকে ভুলিয়ে রাখতো সব কিছু। যুগেশ বাবু যেন আমার সেসব ভোলার এক উপলক্ষ্য ছিলো। তিনি আমাদের এইট পর্যন্ত কোন ক্লাস নিতেন না। কিন্তু নাইন-টেন এ যখন উঠি বিশ্বাস করো দাদু, আমাকে যুগেশ বাবু’র ক্লাসই টেনে আনতো বাড়ি থেকে। কখন যেন সে মানুষের একটা ক্লাস পাবো। স্কুলের সামনের যে বিস্তীর্ণ আঙ্গিনা সেখানে যারা খেলছে হয়তো তিনি তাদের সাথে কথা বলতেন, কোন ক্লাসে কারা কি ক্লাস নিচ্ছেন সেসব খোজ নিতেন,ছাত্রদের ডেকে গল্প করতেন আবার নিজের ক্লাস নিতেন। সেই ফাকে যদি কোন শিক্ষক অনুপস্থিত থাকতেন সেখানে ঢুকে পরতেন যুগেশ বাবু। ক্যালকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রঙিন জীবনের একেকটি অভিজ্ঞতা যখন বলতেন, যেন অন্য এক জগতের উপাখ্যান শোনাচ্ছেন যুগেশ বাবু। যুগেশ বাবু কোন রাজনীতি করতেন কি না জানা নাই কিন্তু কংগ্রেস গান্ধী, জিন্নাহ মুসলিম লীগ, নেহেরু প্রভৃতি তিনি ছাত্রদের শোনাতেন। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কি?- তখন আমরা কিচ্ছু জানতাম না কিন্তু ভাবতে পারতাম যে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা নেয়া হয় ক্যালিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে, আর আমাদের ওস্তাদ সে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সেসব শোনা অপেক্ষা মোহ’ই যেন ঋদ্ধ করতো আমাদের বেশি।
পশ্চিমের সূর্যটা যখন হেলে পড়বার আয়োজন করতো সেসময়ে জগতের সকল দুঃখের আর অভিযোগের একরাশ আশার প্রতীক হয়ে এই স্থানে লোকসমাগমের আশ্রয় হতো এই জুতদারির জোয়ার্দার। এই বিকেলটায় ঐ ঘরটাকে কাশবনের কাইশ্যাছড়ার ঝাড়ু দিয়ে নিবির যত্নে ধুলিমুক্ত করে পাশে থাকা বাঁশের চাটাইটা নিজে বিছিয়ে দেয় প্রজা যাতে বসতে পারে। প্রতিদিনকার নানা পদের ফলফলাদি সংগ্রহ করে একটি ডালাতে রেখে দেয় যাতে কেউ আসলে খালি হাতে কিংবা খালি মুখে যেতে না পারে। নিত্যদিনের মানুষের মাঝে দিনের শেষটা তার এমন চিরন্তন-যার ব্যাত্যয় নেই।
তখন ভাড় দেবার রীতি ছিলো। কোন একদিন এক গৃহবধূ এসেছিলো।
যুগেশ দেবের কাছে তার অনুযোগ, ‘মাইয়ের বাড়িত ভাড় দিমু, বাবু। ক্ষেমতা নাই’।
সেসময়ে মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে আম কাঠাল আরো মৌসুমি ফল দিয়ে ডালি ভর্তি করে পাঠানো হতো। লোকে বলতো ভাড় দিতো।
যুগেশ বাবু বলতো, ‘কয় ভাড় দিবি বেটি?............’।
যুগেশ বাবু চিরকুমার ছিলেন। এই বিশাল বাড়ির মধ্যে তিনি এক অর্থে একাকী দিনযাপন করতেন। যুগেশ বাবুর একমাত্র বড় দিদি দুটি সন্তান রেখে মারা যান। অল্প কিছুদিনের মধ্যে আবার ভাগ্নেরা পিতৃহারা যান। সেসময়ে ক্যালকাতা শহরে এক বিখ্যাত হোমিপ্যাথি ডাক্তার ছিলেন যুগেশবাবুর জামাইবাবু। ভাগ্নেদের এই দুঃসময়ে তিনি তাদের আগলে রাখেন। দুই ভাগ্নে প্রায় কাছাকাছি হবার কারনে দুজনকে একইসাথে ডাক্তারি পড়াশোনা করান। ডাক্তার বানিয়ে তাদের বিয়েও তিনি করান। আমরা দেখেছি সেই দুই ভাগ্নে বউ আর ভাগ্নে মিলেই তার সংসার। ভাগ্নে বউয়েরাই তাকে দেখাশোনা করতো। ভাগ্নে বউয়েরা তাকে বাবা বলে সম্বোধন করতো। স্যারের অন্য আরেকটি পেশা ছিলো। তিনি ভূমি রেজিস্ট্রি অফিসের হেডক্লার্ক ছিলেন। ভূমি সংক্রান্ত কোন মোকদ্দমা হলে এই মহকুমায় যেসব বিচারকার্য হয় তার বিচারকই হেডক্লার্ক। তখনকার ভূমি ব্যাবস্থাপনায় জমিদারি প্রথার রদ ঘটে নি। আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল আর কি। কিন্তু মহারাজা মানে জমিদারি শাসনে ভূমি মধ্যস্বত্বভোগী নানা অংশ থাকতো।যুগেশ দেব এবং তার বাবাও সেই মধ্যস্বত্ব শ্রেণী। স্কুলের শিক্ষক হবার বদৌলতে এবং ভালো ইংরেজি জানার কারণে যুগেশ দেবকে ইংরেজ সরকার মহকুমার হেডক্লার্ক করেছে। জমিদার আর প্রজার মাঝের মধ্যস্বত্বভোগী পাটোয়ারী, তরফদার, মণ্ডলদের গোষ্ঠী কিংবা পারিবারিক জমিসংক্রান্ত মোকদ্দমায় অন্যায় সুবিধা আদায়ে রেজিস্ট্রি অফিসের কাগজপাতি ওলটপালট,ভুয়া ডিক্রি, দাখিলা,দলিলপাতি তৈয়ারের কাজকর্ম অহরহ ঘটতো। লোকে যুগেশ দেবের মারফতেও এমন ফন্দিফিকির আশা করতো।
তরফদারেরা যার মধ্যে দাড়িয়ে খাজনা খায় সেসব পেশা যুগেশ দেবেরও এবং এখনো তা তার উত্তরাধিকারী পেশা। কিন্তু প্রজাসকলের তাবৎ জানে ওসব খাজনাপাতি যুগেশ দেব তুলতেন পাতিলাদহ পরগণার জমিদারের তুষ্টির জন্যই, নিজের জন্য নয়। যতটা না তুললেই নয়। কিন্তু একেবারে শেষদিকে যখন জমিদারির তালুক খসে পড়বে পড়বে বলে রব উঠছিলো তখন যুগেশ বাবু ওসব তোলা ছেড়েই দিয়েছিলেন। শুধুমাত্র নিজের জমিজমার ফসলাদি ঘরে তুলতেন। এসময়েই হেডক্লার্ক যখন ছিলেন ইচ্ছে করলে যুগেশ দেব নিজের জোয়ার্দারির সীমা এপার ওপার ছড়িয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু যেহেতু তিনি তা করেন নি তাই বকশীগঞ্জের পাটোয়ারীদের কাছে কিংবা নুকাইরচরের নয়া গেরস্থ যাই বলি সকলের কাছে যুগেশ দেব একজন পাক্কা বোকা লোক। কিন্তু যুগেশ যে হেতুতে ওসবে চোখ তুলতেন না সেসব তাদের কাচ্ছে নির্জ্ঞান থেকে যাবার দরুন তারা তার চারপাশে ঘুরতো আর চিন্তা করতো যদি কিছুতে বাগে আনা যায়। ওসব নির্জ্ঞানীর কাছে এসবের মানে হইলো, ‘মাস্টর হিংসা করে। জুতদারির হিংসা করে। তা না হলে আর কি’।
জলমহালের বড় বড় বোয়াল-চিতল মাছ, মৌসুমের প্রথম আউশ ধান,পুকুরের বড় মাগুর মাছ,বড় দানার খৈ- প্রভৃতি নিয়ে মন্ডল,তরফদার আর পাটোয়ারীরা হাজির হতেন।
যুগেশ বাবু যখন বাড়ি থাকতেন না তখন ভাগ্নে বউদের কাছে এসব নিয়ে হাজির তারা। ভাগ্নে বউরা তখন বলে দিয়েছে,, ‘বাবা এসব পছন্দ করেন না, বাপু। নিয়ে যান। আর আসবেন না’।
..................

ক্লাস নাইনে তখন স্যার আমাদের নিয়মিত ক্লাস নেন। যুগেশ দেব আমাদের ইংরেজি পড়াতেন। আমাদের ক্লাসে ঢুকেই তিনি আমাকে খুঁজে নিতেন। আমি ক্লাসের কোন কোনায় বসেছি আমাকে খুঁজে নিতেন। যেসময়টা দেশভাগের একদম দুই বা তিন বছর পরের কথা হবে। মানুষের ওপারে ছুটে যাওয়া চলছিলোই। স্যার আমাদের মাঝে মাঝে আক্ষেপ করে বলতেন, ‘দুই ভাই দুইদেশে কেমন দুইভাগ হয়ে গেলো রে। আমাদের দেশের কথা বলছি। এটা কেমনে হয় রে, জানি না’।
সেসময়টা স্যারের সাথে আমার অন্তরঙ্গতা বেড়ে যায়। স্যার আমাদের নাইন-টেনের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে যেতেন বেশিরভাগ। ঐ যে তার বাগানের কথা বলছিলাম না দাদু সেই বাগানে নিয়ে যাওয়ার কথা বলছি। আমরা বন্ধুরা যখন যেতাম স্যার আমাদের নিজ হাতে আম, জাম, লিচু ছিড়ে দিতেন। আর আমাকে মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করতেন, ‘সৈয়দ জামান তোর বাড়িতে কে কে আছে?’
আর কামালপুরের লতিফকে দেখলে বলতেন, ‘ক্যা রে, তোর বাপ তো ঘোড়া দিয়ে আসে। আমাকে বলে তোরে পাস করাইতে। আমি কেমনে পাস করাই? ঘোড়াওয়ালা বাপের ব্যাটা তুই। পাস করবি না মনে হয়, মেট্রিক পাস সাধনার। ঘোড়া দাবড়াইলেই হয় না’।
কামালপুরে লতিফের বাড়ি ছিলো। অনেক জমিজমা। এখন দেশভাগের পর অনেক জমি ওপারে পরলেও এখনো অনেক। ওর বাবা এসে শুধু স্যারকে বলতো, ‘যুগেশ বাবু, কত টাকা লাইগবো খালি কন। আমার ছেলেডা’ক মেট্রিক পাস করানে লাইগবো’।
টিফিন শেষ হলে স্যার আমাকে পরে আসতে বলতো মাঝেমাঝেই। স্যার সিন্দুকের চাবি দিয়ে আমাকে কাগজপত্র আনতে বলতেন। দরকারি বিভিন্ন কাগজপত্র তিনি বাকি সময়ে স্কুলে বসেই ঠিক করতেন। মাঝে মাঝে আমাকেও ডেকে নিতেন ওসব লিখতে, ঠিক করতে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জমিজমা সংক্রান্ত কাগজপত্রই থাকতো।
আমার বাড়ির পাশের কতশত হিন্দুকে দেখেছি মুসলমানের ছায়া মারলেও নাকি ওদের জাত যায়। আসাম, উপর আসাম থেকে জান নিয়ে ঝাকে ঝাকে মানুষ এপারে এসেছে। পথের মধ্যে কত মানুষকে এই কয়েক বছরে দেখলাম হাতের পাঁচ নিয়ে রওনা হয়েছে সদ্য পাকিস্থানে। আবার ওপারে সম্ভ্রান্ত কেউ ঝুলি ভর্তি জমির কাগজপত্র নিয়ে চোখে পানি নিয়ে এসেছে এই আশায় যদি কোনদিন ওপারে ফিরি তবে জমিগুলো যদি পাওয়া যায়। আবার দেখেছি এপারের ছবিগুলোও। মানুষকে কচুকাটা করে পুতে ফেলা হয়েছে। মুসলমানের হাতে রক্ত লেগে যেন কালো হয়ে গেছে এদিক ওদিক। নাপিতের হাট, রামরামপুরের বাড়িঘরে আগুন দিয়ে রামরামপুরকে ‘বগারচর’ বানিয়ে দেয়া হয়েছে। কেউ কারো চেয়ে কম নয়। আমাদের কত সহপাঠী ছিল হিন্দু। দেশ ছাড়তে ছাড়তে ছিলো মোটে ৩ জন। অথচ আমাদের ৩৭ জনের মধ্যে ১৪ জনই হিন্দু ছিলো। কেউ রাতের আধারে,কেউ ভয়ে ভয়ে একটুখানি দেখা-সাক্ষাৎ করে কিংবা বড়লোক হলে মোটামুটি গুছিয়েগাছিয়ে- সে যেমনি হোক এ মাটিতে আর থাকে নি। আর যুগেশ বাবু ক্লাসে ঢুকে আক্ষেপমাখা হাসিতে বলতেন, ‘ক্যারে আর কেডা কেডা গেলো রে!’ এ যে কোন অভিব্যাক্তির কথা সে কি বুঝি না? দেশহীনতার অভিব্যাক্তি।

আমাদের সময়ে আমদের এরাবিক কম্পোলসারি একটা সাবজেক্ট ছিলো। ছাত্ররা খুব ফেইল করতো। সে সাব্জেক্টে আমাদের অনেক সূরা আয়াত পড়তে হতো। যদি কখনো মৌলোভি না আসতো স্যার ঢুকে পরতেন। যেদিন প্রথম স্যার এমন করে ঢুকে পরেন সেদিন এসে কড়া নাড়ছিলেন, ‘তোদের কি ক্লাস রে? কেউ নাই যে ক্লাসে?’
আমাদের মধ্যে ফার্স্ট বয় ছিলেন চান মিয়া। ঐ বললো ‘স্যার, আরবি ক্লাস। আপনি তো নিবেন না’।
স্যার কোন কথা না বলে ঢুকে আমাদের কাছ থেকে কুরান নিয়ে পড়া শুরু করলেন। দরাজ কন্ঠে যে মানুষটি এমন সুরেলা কন্ঠে পড়ছে তিনি জাতিতে কায়স্থ হিন্দু। আমি সেদিন কিছু যেন ভাবতে গিয়ে দেখছি আমি জড়বস্তু হচ্ছি। যুগেশ বাবুর কি তবে জাতকুল নাই? আমাদের পাশের গ্রামের বংশীপাড়ার ব্রাহ্মনদের তো কথায় কথায় জাত যায়। একদিন স্যার আমাকে তার বাগানের ঐ ছাপড়া ঘরে বসে সূরা আর রাহমান শুনিয়েছিলেন। আর আমাদের যেসব হিন্দু সহপাঠী ছিলো তাদেরও সংস্কৃত বেদ গীতা পড়াতে হতো। ওরাও ফেইল করতো এতে। ওদের ক্লাস পার্মানেন্টলি স্যারই নিতেন।
............
আমার টেস্ট পরীক্ষা হয়ে গিয়েছে। ফল বের হয়েছে। মোটের উপর আমরা ২৭ জন পরীক্ষা দিয়েছেছিলাম। পরীক্ষা শুরুর আগে রেওয়াজ বা বিশ্বাস যা বলি সবাই স্যারের কাছে যেতো। আমাদের মকবুল স্যার টেস্টে এলাউ হওয়া মেট্রিক পরীক্ষার্থী ২৭ জনকে ডেকে যুগেশ স্যারের কাছে বলছিলেন, ‘স্যার এইবার এই এরা দেবে। আপনি কিছু একটা কন স্যার’।
যুগেশ স্যার বলছে, ‘আমি কি কমু। আমি কইলে তো তোগো মন খারাপ হইবো’।
আমরা সমস্বরে বললাম, ‘না, স্যার বলতেই হবে’।
স্যার আমাদের জোড়াজুড়িতে ৮ জনকে নাম ধরে ডেকে ডেকে বললেন যে, এই ৮ জন পাস করবে।
সেই ৮ জনের মধ্যে আমিও ছিলাম শুনে আশ্বস্ত হলাম আর স্যারকে সেলাম করলাম সেদিন।
টেস্ট পরীক্ষার আমার স্কুল নেই। সারাদিন পরছি। আমার বংশে আমি মেট্রিক পরীক্ষা দিচ্ছি দ্বিতীয়। আমার এক জ্যাঠা ছিলেন তারপর আমি দিচ্ছি। আমার লজিং বাড়িতে আমাকে দেখতে আসছে অনেকে। আমি মেট্রিক পরীক্ষা দিচ্ছি। আমি সন্ধ্যার পর সারমারা বাজারে গেলাম একদিন। আমার একদিকে যেমন পুলকে আচ্ছাদিত ভেতরটা আবার এক ভয় ভয় ভাব। সামনে পরীক্ষা। শীতের পরশ একবারে শেষ হয় নি। আমি ভেবেছিলাম হয়তো বাড়িতে যাবো। বাবাকে দেখে আসবো,দুআ নিয়ে আসবো। পকেটে কিছু পয়সাও তুলে আনবো বাবার তরফে। লজিং বাড়ি থেকে সেদিন বের হয়েছি। ধুতিটাকে কসিয়ে রওনা হয়েছি বিকেল নাগাদ। পথে চানের সাথে দেখা করে বলে এসেছি দিন কয়েকের মধ্যে এডমিট আসলে ও যেন তুলে নেয়। এতো তাড়াতাড়ি না আসাটাই স্বাভাবিক তবু বলে এসেছি। কিন্তু আমি সারমারা বাজারে যাবার পথেই স্যারের ছোট ভাগ্নে আমাকে দেখে হাক ছাড়লো, ‘এ হে সৈয়দ জামান...’।
আমি হাক শুনে এগুতেই বলছে, ‘মামা তোমাক যেতে বলেছে’।
আমি আমার ওস্তাদের পয়গাম কি ফেলতে পারি। চান,ফনি,আসমত,মজা ওদের সাথে একটু দেখা সাক্ষাৎ করে আমি সন্ধ্যার বেশ খানিকটা পর স্যারের ওখানে গেলাম।
আমি যেতেই স্যার ভাগ্নে বউদের বলে দিয়েছে, আজ তিনি আমার সাথে খাবেন। আমার আর স্যারের জন্য খাবার তৈয়ার করতে বললেন তাড়াতাড়ি।
ছলছল করে সবুজ পাতাজুড়ে কুয়াশা টপটপ করে পরবার উপক্রম হয় কিন্তু পরে না আজ আমার ওস্তাদের চোখগুলো তেমন। ধীরে ধীরে হেটে হেটে বাগানে ঢুকছিলো আর আমাকে দেখাচ্ছিলো, ‘জানিস আমি এ গাছটা কলিকাতা থেকে এনেছি। আজ কত বড়’।
আবার পাহাড়ে জন্মানো কুল গাছ দেখিয়ে বলছিলো, ‘দেখিস এই গাছের কুল দেখতে কত সুন্দর হয় কিন্তু খেতে টক’।
বলতে বলতে জিজ্ঞেস করেছিলো স্যার, ‘এর পর কি লেখাপড়া করবি না রে সৈয়দ জামান?’
- স্যার, আমি তো চাইই। আমার বাবা চাইলে করা হবেই।
-হুম, না না। করতে হবে তো। বুঝাবি বাবাকে।
স্যার ইজি চেয়ারে বসে আমাকে সেই বাগানের ঘরের মাঝে উচু পিড়িতে বসতে বললেন।
স্যার আমাকে বললেন, ‘সৈয়দ জামান আমি তো তোর মেট্রিক’র রেজাল্ট দেখে যেতে পারবো না রে’।
আমি এ কথার মর্মার্থ বুঝেছিলাম। তবু আমি স্যারকে জিজ্ঞেস করলাম কেন স্যার?
- ‘আমি আর থাকছি না। আমি তোদের পরীক্ষার কয়েকটা দিনই আছি। তোদের বিশেষ করে তোর রেজাল্ট দেখে যেতে পারবো না। ব্যাপারটা গোলোমেলে হচ্ছে যে’।
-‘আপনি না বলতেন এই ভিটেমাটি আপনার?’
-‘কিন্তু আমি তো এখন হিন্দু, মানুষ না। এসব নাকি হিন্দুদের ভিটেমাটি আর নয়। পাকিস্থান হবার পর কি আর সে ভিটেমাটির কথা মুখে আনা যায়’।
যে মানুষটি মানুষের বিচার করে। এক নিভৃত পল্লীর বুকে আগুন জ্বালায় নিকষ অন্ধকারের গর্তে। সারমারাতে যার পৌরুষ আর সুঠাম দেহসদৃশ গৌরবে কিংবা বিদ্যে-ধনের আভিজাত্যে অপরের মাথা নুইয়ে যেতে বাধ্য সে মানুষটি তার প্রস্থানের মার্সিয়া শোনাচ্ছেন এক সাধারণ যুবক শিষ্যের কাছে। বটবৃক্ষকে মাতাল বায়ুও না টলাতে পেরে পরাভব মানে যুগেশ বাবুও কি পারতেন না সেই ঝড়ের গতিকে পরাস্ত করতে? যে জোয়ার্দারির প্রতাপ মাইলের পর মাইল সে জোয়ার্দারি কি এতো পলকা? হ্যা এখন আর সে জোয়ার্দারি নাই কিন্তু এ বৈভব কি কমে? যুগেশ বাবুর বৈভব কি কমে?
যুগেশ বাবু বলছিলেন, ‘আমার ইজ্জত এ ধনে নয়,বৈভবে নয় তা তুই জানিস। আমার ইজ্জত অন্য কিছু। এই অন্য কিছুই আমাকে এখানে থাকতে দিবে না’।
স্যার?
-‘তোদের আর দেখবো না। আমি কলিকাতায় কি করবো? জানি না রে কী করবো’।
আমার স্কুলটা উঠিয়ে নেয়া গেলে ইশ কি ভালো হতো। কিন্তু না। আমি একটা পাঠাগার করতাম। রবি,নজরুল,জীবনানন্দ পরতি তোরা। তারাশঙ্কর পরতি। তোরা বাইবেল পরতি,কুরান পরতি,গীতা পরতি। তা আর হবে না। তাই না?
-স্যার!
নিঝুম রাতের এই গল্পখানা হয়তো এখন তামাদি। এক ফ্যাকাশে ইতিহাস বারে বারে উগরে দেয় অনেকে। কিন্তু এই ব্যাথা এই প্রস্থানের জ্বালা আমি আজন্ম ধরে রেখেছি দাদু। আমার ওস্তাদের চোখের পানি সেদিন আমার হাতে পরেছে। তোমার ওস্তাদের চোখের পানি তুমি দেখো নি, তোমার হাতেও পরে নি। তুমি জানো না,আমি জানি।
...............
যুগেশ বাবু মেট্রিকুলেশনে ৮ জনের পাশ করার কথা বলেছিলেন। আমরা ৭ জন পাশ করেছিলাম। আমি মেট্রিক পাস করার ১ বছর পর কুমিল্লায় স্যানিটেশন ইন্সপেক্টার হিসাবে জয়েন করেছি। কিন্তু চাকরি ভালো না লাগায় আমি বাড়ির পথ ধরেছিলাম। এসে গ্রামেই প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টার হয়ে গেলাম। সারমারা বাজার হয়ে সূর্য্যনগর হাটে যাচ্ছিলাম। তখন ১৯৬০ সালের বন্যা। বন্যায় নাও দিয়ে যাবার বেলায় সারমারা বাজারের পাশে নদীর কাছে নোঙ্গর করলে আমার কাছারি বাড়ির পাশের এক বন্ধুর সাথে দেখা। বলছিলেন, ‘গত পরশু দিন যুগেশ চন্দ্র দেব কলিকাতায় মারা গেছেন’।
দিনটির কথা আজ আর মনে নেই













আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মোঃ নুরেআলম সিদ্দিকী গল্পের থিম ও চারিত্রিত বর্ননা অনেক মনোমুগ্ধকর। শুভকামনা কবি
কাজল গল্পটি বেশ ভাল লাগল। ভোট রইল। আসবেন আমার কবিতাটি পড়তে।
সালসাবিলা নকি প্লট খুব ভালো লেগেছে। বর্ণনায় কিছুটা একঘেয়েমী ছিল। যেমন শুরুর দিকে পরপর তিন লাইনের প্রথমেই 'ক্যালকাতা শহরে' শব্দদুটি লিখেছেন। পড়তে ভালো লাগে না এমন হলে। তবে লেখার হাত আপনার ভালই। পছন্দ ও ভোট রইল। আমার গল্পে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি
পরবর্তীতে ভুল শুধরে নিব। ধন্যবাদ
সাদিক ইসলাম ক্যালকাতা কেন? কলকাতা বলা হয় এখন। শুভ কামনা। গল্পে আমন্ত্রণ। শুভ কামনা ও ভোট রইলো।
যার ভাষ্যে লেখা উনি ক্যালকাতাই বলতেন
মৌরি হক দোলা পাক-ভারত বিভক্তিটা ‍নিজে নিশ্চয়ই দেখেন নি ? তবুও কি সুন্দর বর্ণনা দিলেন! হিন্দু আর মুসলিম-যেই ধর্মেরই হোক না কেন,এদেশের মাটি সবার। সেই নিজের দেশের মাটি, নিজের দেশমাতা কে ছেড়ে যেতে কত কষ্ট! আপনার লেখায় যেন তা বারবার ফুটে উঠছিল। সত্যি অসাধারণ! অনেক অনেক ভালোলাগা ও শুভকামনা রইল.....

৩০ সেপ্টেম্বর - ২০১৭ গল্প/কবিতা: ৬ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“এপ্রিল ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ এপ্রিল, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী