বোধ

কাঠখোট্টা (মে ২০১৮)

তালহা জুবাইর তৌহিদ
  • ৪০
স্টাডি রুমের দরজায় ধাক্কা দিয়ে নানু নানু বলে ডাকছে চার বছরের জারিফ। এই নাতিটাকে নিয়ে তিন দিন ধরে চরম বিপাকে পরেছেন আবিদ সাহেব। ছোট বাচ্চা গায়ে হিসু করে দিলে যতটা না রাগ হয় সেই বাচ্চা কাজের সময় বিরক্ত করলে তার চেয়ে ঢের বেশি রাগ হয়। একে সাহিত্যিক আবিদ সাহেব তার নতুন উপন্যাসের নায়িকার সাবেক প্রেমিকের চরিত্রটা ঠিক গুছিয়ে উঠতে পাচ্ছেন না তার উপর ছোট্ট নাতির প্যানপ্যানানি। তিন দিন হল আবিদ সাহেবের মেয়ে অন্তরা ছেলেকে নিয়ে বাপের বাড়ি এসেছে; আরও কয়েক দিন থাকবে। আবিদ সাহেব নাতির চেয়ে মেয়ের উপর বেশি বিরক্ত হয়েছেন তার কাণ্ডজ্ঞান দেখে। মেয়েটা এতো দিনেও বাচ্চা সামলানো শিখতে পারে নি উপরন্তু তিনি কেন তার নাতির সাথে সময় কাটাচ্ছেন না তা যেন সে বুঝতেই পারছে না। এতো বড় মেয়ে বকাও দেয়া যায় না, কি করবেন ঠিক বুঝে উঠতে পাচ্ছেন না। লেখার মুডটাও নষ্ট হয়ে গেছে, অগত্যা দরজা খুলে নাতিকে কোলে নিয়ে বাগানের দিকে গেলেন আবিদ সাহেব।
সামনের বই মেলায় আদিব হোসেনের একটা উপন্যাস আর একটা কবিতার বই বের হবে। প্রকাশকরা বার বার তারা দিচ্ছে। ডিসেম্বর এর মধ্যে লেখাগুলো দিতে হবে, হাতে আর মাত্র মাস খানেক সময় আছে। আবিদ সাহেব এখন প্রায় সারা দিনই লিখে কাটাচ্ছেন। আগে দুপুরে ভিজিটিং টাইম রাখতেন কিছুদিন হল তিনি কারও সাথে দেখাও করছেন না কিন্তু এই নাতিটার জ্বালায় শান্তি মত লেখাটাও হচ্ছে না।
এক সময় রাত জেগে সারা রাত ধরে লিখতেন আবিদ সাহেব তবে এখন আর পারেননা, বয়স হয়ে গেছে শরীর এখন আর কথা শোনে না। রাত এগারোটা বাজে, শোবার সময় হয়ে গেছে। করিম এরই মধ্যে বিছানা রেডি করে ফেলেছে। এশার নামাজটা পরে শুয়ে পরলেন, আগে শোবার পর ঘুম আসতে অনেক সময় লাগতো কিন্তু এখন আর সময় লাগে না। ব্যাপারটা ঠিক বুজে উঠতে পারেননা আবিদ সাহেব হয়তো বয়সের কারনেই এমনটা হয়েছে।
চোর চোর চোর ... চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেল আবিদ সাহেবের। বিছানা ছেড়ে উঠানে এলেন। উঠানে দেখলেন কয়েকজন মিলে একজনকে গাছের সাথে বাঁধছে। লোকটার কাছে একটা কালো পোটলা পাওয়া গেল; পোটলা ভেতরে আবিদ সাহেবের প্রয়াত স্ত্রীর কিছু গয়না, তার বাবার একটা হাত ঘড়ি আর কিছু বাসন-কসন। এসব জিনিসের আর্থিক মূল্য খুব বেশি কিছু নয় কিন্তু এই গয়না, এই ঘড়ির মূল্য যে ঠিক পয়সা দিয়ে মাপা যায় না। একেকটা জিনিস আবিদ সাহেবের কাছে একেকটা স্মৃতির ভাণ্ডার। রাগটা ঠিক সামলাতে পারলেন না লাঠিটা হাতে নিয়ে নিজেই কয়েক ঘা বসালেন চোরের গায়ে আর বলে গেলেন একে উচিৎ শিক্ষা দিতে। এরই মধ্যে কে একজন চোরটাকে চিনতে পারল। চোরটার নাম বল্টু মিয়া, সে পাশের গ্রামেই থাকে পেশায় তালার মিস্ত্রি তবে আজ বল্টু মিয়ার ওসব কোন পরিচয় নেই আজ তার একটাই পরিচয়- চোর। ইতোমধ্যে থানায় খবর চলে গেছে। ঘণ্টা খানেক বাদে পুলিশের আগমন হল কিন্তু ততক্ষণে বল্টু মিয়ার অবস্থা বেশ খারাপ। পুলিশ তাকে সরাসরি হাসপাতালে নিয়ে গেল। ডাক্তারদের অনেক চেষ্টার পরও সেই সকালেই বল্টু মারা গেল। পরদিন আবিদ সাহেবকে প্রধান আসামী করে আরও প্রায় বিশ জনের নামে একটা হত্যা মামলা দায়ের করে বল্টুর স্ত্রী খোদেযা বেগম। সারা জীবন প্রধান অতিথি হওয়া আবিদ হোসেন আজ হত্যা মামলার প্রধান আসামী হয়ে থানায় হাজিরা দিলেন। মিডিয়া বেশ ফলাও করেই প্রচার করলো- দেশের অন্যতম সেরা সাহিত্যিকের হত্যাকারী হয়ে ওঠার গল্প।
আবিদ সাহেবের আমেরিকা প্রবাসী একমাত্র ছেলে সাবিত হোসেন এর বন্ধু আহসানুল কবির এখন গাজিপুরের এস পি। সেই সুবাদে খুব একটা ঝামেলাই পরতে হয়নি কেবল এক বছর নিয়ম করে কোর্টে হাজিরা দিতে হয়েছে। কিন্তু এতো দিনেও বাদীপক্ষ কোর্টে তেমন কিছুই প্রমান করতে না পারায় আবিদ সাহেব সহ সকল অভিযুক্তই সসম্মানে মামলা থেকে রেহাই পেয়ে যায়।
ছয় বছর পরের কথা। আজ সাতই জানুয়ারি, আবিদ সাহেবের স্ত্রী লুতফন্নাহার বেগম এর তের তম মৃত্যু বার্ষিকী। প্রতিবারের মতো এবারও বাদ যোহর দোয়া মাহফিল, অথিতিদের জন্য বিশেষ আপ্যায়ন আর গরীবদের জন্য কাঙ্গালি ভোজের আয়োজন করা হয়েছে। বাদ আছর আবিদ সাহেব নিজ হাতে গরীবদের মাঝে ২৫০টি কম্বল বিতরণ করলেন।
কম্বল বিতরণ শেষ, সন্ধ্যা হয়ে আসছে। আবিদ সাহেব বাগানে চেয়ারে বসে পশ্চিমে ডুবতে থাকা লাল সূর্যটা দেখছিলেন। এমন সময় কে যেন স্যার স্যার বলে ডেকে উঠলো। আবিদ সাহেব পিছন ফিরে দেখলেন দশ-এগারো বছরের একটা ছেলে। পরনে ছেঁড়া গেঞ্জি আর প্যান্ট, উসকো খুসকো চুল, শুখনো মুখ তার উপর শীতে কেমন কুঁকড়ে গেছে। ছেলেটা আবার চিৎকার করে বলল, “স্যার একটা কম্বল দেননা স্যার’’। আবিদ সাহেব এগিয়ে এসে বললেন, “কম্বল দেয়াতো শেষ, তুমি তখন লাইন ধরনি কেন?’’
“লাইন ধরছিলাম স্যার কিন্তুক আমারে বাইর কইরা দিছে”।
কালাম কালাম বলে ডাক দিলেন আবিদ সাহেব। ডাক শুনে ছুটে এলো কালাম।
“এই ছেলেকে লাইন থেকে কে বের করে দিয়েছে?”
“স্যার আমি”।
“কেন?”
“স্যার ঐডাতো বল্টু চোরের বেটা। ওরে কি স্যার ..”
“তুমি যাও”।
আবিদ সাহেব ছেলেটার দিকে ভালো করে তাকালেন। ছেলেটা ভয়ে আর মুখ তুলল না। আবিদ সাহেব বললেন, “তুমি বল্টুর ছেলে?”
ছেলেটা মাথা নারিয়ে চলে যেতে লাগল। আবিদ সাহেব বললেন, “দাঁড়াও; তোমার নাম কি?”
“শরিফ”।
“থাকো কোথায়”।
“জেহানে জায়গা পাই সেহানেই থাকি”।
“মানে?”
“সারাদিন ঘুইরে বেড়াই আর রাইতে কহনও ইস্তিশনে কহনও হাটের চালার নিচে থাকি”।
“তোমাদের বাড়ি নাই?”
“ছিল, নদীত ভাঙ্গে গেছে”।
“তোমার মা কোথায়?”
“গত বছর ডেঙ্গুত মইরা গেছে”।
কি যেন একটা বলতে গিয়ে আটকে গেলেন আবিদ সাহেব শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তাঁর মুখ থেকে। নিজেকে বড্ড ছোট মনে হতে লাগল তার, শরিফের সামনে দাঁড়াবার শক্তিটাও যেন ঠিক পাচ্ছেন না শরীরে। কিছু না বলে নিজের গায়ের চাদরটা খুলে শরিফের দিকে এগিয়ে দিলেন তিনি। শরিফ ভীত হাতে চাদরটা নিয়ে ধীরে ধীরে চলে গেল। আবিদ সাহেব আকাশের দিকে তাকিয়ে আর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “হে আল্লাহ আমায় ক্ষমা কর”।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
সেলিনা ইসলাম গল্পের থিমটা অসাধারণ। চোর মারতে আমাদের সমাজের একশ্রেণীর মানুষেরা বেশ আনন্দ পায়। ওরা কেন চুরি করে বা ওদের দায়টা কোথায় কেউ দেখে না! বাস্তব চিত্র উঠে এসেছে গল্পে। তবে গল্পের প্রথম দিকে আরও একটু সময় দেয়া প্রয়োজন ছিল। আবিদ সাহেব নামটা একটু বেশিই এসেছে। শেষে বিবেকের দংশন গল্পকে আলোকিত করেছে অনেকখানি। আরও ভালো ভালো গল্প পড়ার প্রত্যশায় অনেক অনেক শুভকামনা।
মৌরি হক দোলা বর্তমান সমাজের চিত্র! খুব ভালো লাগা রইল.........শুভকামনা...

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

গল্পের প্রধান চরিত্র আবিদ হোসেন একজন বিখ্যাত লেখক। তার একদিনের এক মুহূর্তের কঠোরতায় বেশ কিছু মানুষের জীবনের বিরাট পরিবর্তন আসে। আবিদ সাহেবের সেই কঠোরতা আর উপলব্ধির গল্প হল "বোধ"।

২৩ সেপ্টেম্বর - ২০১৭ গল্প/কবিতা: ৪ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪