১. সেবার ভ্রমণের নেশাটা একেবারে পেয়ে বসেছিলো ৷ অবশ্য তার যথেষ্ট কারণও ছিলো ৷ বহুদিনের এই রুটিন বাঁধা একঘেয়েমী জীবন নিয়ে অতিমাত্রায় অতিষ্ট হয়ে উঠেছিলাম ৷ তখন সবে কলেজের গন্ডি পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র আমি ৷ রক্তের প্রবাহে অ্যাডভেঞ্চার করার প্রলোভনের বিন্দুমাত্র ঘাটতি নেই ৷ হঠাৎ হুজুগের বশে যে কোনো কাজ করার ব্যপারে বন্ধু মহলে আমি বেশ বিখ্যাত কিংবা কুখ্যাত ৷ তবে মোটেও অখ্যাত নই ৷ অন্তত এই খ্যাতির অবমাননা না করার খাতিরেই হোক বা একঘেয়েমী সময় দূর করবার প্রচেষ্টাতেই হোক, বেরিয়ে পড়লাম টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া ভ্রমণে ৷ এবং এই ভ্রমণপথেই আমাকে যে অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়েছিলো, তার শতভাগ অনুভূতি হয়তো বলে বা লিখে কখনোই বলে বোঝাতে পারবো না ৷ ভ্রমণ শুরুর সপ্তাহ তিনেক পরে, এক রাতে দিনাজপুরের এক মফস্বল শহরের বাস স্ট্যান্ড থেকে শেষ বাসটা মিস করলাম ৷ অগত্যা সে রাতে থেকে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় আমার কাছে ছিলো না ৷ আর তাছাড়া সারাদিন কান্তজীর মন্দির, স্বপ্নপুরী, রামসাগর উদ্যান ঘুরে বেড়িয়ে শরীর টাও যেন আর চলছিলো না ঠিকমতো ৷ তাই ভাবলাম থেকে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে ৷ কিন্তু থাকতে হলে থাকার জায়গাটাও যে প্রয়োজন, সেকথা মনে হতেই যেন শরীরের সমস্ত ক্লান্তি আহ্লাদে দ্বিগুন হয়ে গেলো ৷ মনেহলো যেন এ মাঝরাস্তাটাই এক বিশালাকার বিছানা ৷ শুয়ে পড়লেই শান্তির ঘুমে তলিয়ে যাবো ঘুমের চতুর্থ ও সর্বোচ্চ গভীর স্তরে ৷
২. শেষ পর্যন্ত এরকম অলস একটা চিন্তাকে বিন্দুমাত্র প্রশ্রয় না দিয়ে একটা সস্তার হোটেল খুঁজে বের করলাম ৷ সস্তার হোটেল হিসেবে ভেতরটা বেশ ঝকঝকে করে রাখা হয়েছে ৷ শুধুমাত্র বিল্ডিংটা একটু পুরাতন ৷ তবুও বিল্ডিংটা পাঁচতলা অব্দি যথেষ্ট সম্মানের সাথে সগর্বে উচ্চ শিরে দাঁড়িয়ে আছে ৷ হোটেল ম্যানেজারের কন্ঠটা যতটা মোলায়েম ও সুন্দর,তার চেহারাটা ততোটাই কর্কশ এবং বিদঘুটে ৷ চোখের নিচ থেকে ডান পাশের চোয়ালটা জুড়ে বিশাল এক কাটা দাগ ৷ বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না ৷ তাই সেখানে আর সময় বেশি ব্যয় না করে রুমে যেতে উদ্যত হলাম ৷ তিনি আমাকে আমার রুমটা দেখিয়ে দিয়ে চলে গেলেন ৷ তিন তলায় লম্বা একটা করিডরের একদম শেষ প্রান্তে আমার রুম ৷ করিডরটা বেশ সরু ৷ পাশাপাশি দুজন মানুষ হাঁটা মুশকিল ৷ তবে রুমে ঢুকে তো আমার চক্ষু চড়কগাছ ৷ এ তো রীতিমতন আলিসান ঘর! ঘরটা খুব সুন্দর করে সাজানো ৷ এক ঝলকে দেখে কোনো রাজা বা রাজকুমারের ঘর বললে ভুল হবে না ৷ এত সস্তা দামে এ ঘর পাওয়া, মনে কিছুটা সন্দেহের উদ্রেগ ঘটায় বটে ৷ তবে সে অবকাশ পাওয়ার আগেই আমার চোখ আটকে গেলো পূর্ব দেয়ালে টাঙানো একটা পোর্ট্রেইট এর ওপর ৷ এক জোড়া নীল চোখ ৷ এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে ৷ সে দৃষ্টি যথেষ্ট শান্ত এবং শীতল ৷
৩. ধীরে ধীরে ছবিটার কাছে এগিয়ে গেলাম ৷ তেলরঙে আঁকা খুব সম্ভবত ৷ কোনো এক ২৩ বা ২৪ বছর বয়সী রমনীর ছবি ৷ ঠোঁটে সামান্য ছলনার হাঁসি ৷ চোখজোড়া একদম নীল ৷ সে চোখে যেন সম্মোহনের শক্তি আছে ৷ আমিও মুহূর্তের ভেতর সম্মোহিত হয়ে গেলাম ৷ সেদিনকার ঘটনার প্রতিটা মুহূর্ত আমার এখনো মনে আছে ৷ আর এটুকুও মনে আছে, আমি যেন আর নিজের ইশারায় চলছিলাম না ৷ সারাদিনের সকল ক্লান্তির কথা এক নিমেষেই ভুলে গেলাম ৷ আমি ছবিটার আরও কাছে এগিয়ে গেলাম ৷ এত কাছ থেকে একবার ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে হলো ছবিটাকে ৷ আমি ডান হাতটা আস্তে আস্তে তুললাম ৷ আঙ্গুল দিয়ে ছবির রমনীর গাল স্পর্শ করতেই শরীরের মধ্যে যেন বিদ্যুত খেলে গেলে ৷ আঙ্গুলে অসহ্য যন্ত্রনার সৃষ্টি হলো ৷ মনে হলো এক ঝাঁক মৌমাছি একসাথে হুল ফুটিয়েছে ৷ আমি এক ঝটকায় হাতটা টান দিয়ে সরিয়ে নিলাম ৷ আঙ্গুলের দিকে তাকিয়ে দেখি, একটা কালো রঙের পোঁড়া চিহ্ন ৷ মনে হল যেন এইমাত্র স্বেচ্ছায় আমি আগুন ছুঁয়ে দিয়েছি ৷
৪. বিছানায় গিয়ে গা এলিয়ে দিতেই তন্দ্রা এসে গেলো ৷ আচমকা ঐ আঙ্গুলের ব্যাথায় শরীর কেঁপে জ্বর এসে গিয়েছিলো ৷ কোনোমতে হাতে মুখে একটু পানি দিয়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়েছিলাম ৷ আলো নিভিয়ে দেয়ার অবকাশ পাইনি ৷ মাথাটা প্রচন্ড ভারী লাগছিলো ৷ মনেহচ্ছিলো যেন এক বিশালাকার হাতুড়ি দিয়ে কেউ একজন ক্রমাগত মাথার ভেতর বাড়ি মেরে চলেছে ৷ ঘুম পুরোপুরি তখনো আসেনি ৷ আবছা আবছা জেগে আছে চেতনা ৷ হঠাৎই রুমের লাইট বন্ধ হয়ে গেলো আপনাআপনি ৷ খুব সম্ভবত লোডশেডিং ৷ ঘুমানোর প্রানপণ চেষ্টা করছি ৷ কিন্তু জ্বরের প্রকটতা যেনো হু হু করে বেড়েই চলেছে ৷ আঙ্গুলের ব্যাথাটাও আরো তীব্র হচ্ছে ৷ ঠিক সেই সময় নাকে এসে ধাক্কা দিলো এক হালকা সুবাস ৷ কোনো এক ফুলের সুবাস ৷ কিন্তু ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না ফুলের পরিচয়টা ৷ হঠাৎ খুব ধীরে হাটতে থাকা এক জোড়া পায়ের উপস্থিতি টের পেলাম ৷ হয়তো আমার ভয় পাওয়ার কথা ছিলো ৷ কিন্তু কেন জানি না ভয়ের অনুভূতি কাজ করছিলো না আমার ৷ মাথার ভেতরটা দপ দপ করছে ৷ ফুলের সুবাস আর পায়ের শব্দ সবকিছু তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে ৷ কপালে একটা নরম ঠান্ডা হাতের স্পর্শ পেলাম ৷ সাথে সাথে যেন শান্তির সাগরে ডুবে গেলাম আমি ৷ ঐ ঠান্ডা হাতের স্পর্শে আস্তে আস্তে কমতে লাগলো আমার মাথার ভেতরের চলমান হাতুড়ির বেগ ৷ অনেক কষ্টে চোখটা খুলতে চেষ্টা করলাম ৷ আবছা ভাবে দেখতে পেলাম একটা মুখ ৷ ঐ ছবিটা যেনো সশরীরে বেরিয়ে এসে আমার শিয়রের পাশে বসে আছে ৷ সেই নীল রঙের সম্মোহন শক্তির অধিকারী দুটো চোখ ৷ লালরঙা ঠোঁটজোড়া বাঁকিয়ে একটা প্রশ্রয়ের হাসি হাসলো সেই রমণী ৷ সেই হাসিতেই বোধহয় আমি অনেকটা নিশ্চিন্ত হলাম ৷ চোখদুটো আর খুলে রাখতে পারলাম না ৷ তলিয়ে গেলাম গভীর ঘুমে ৷
৫. সকালে ঘুম ভাঙলো গাড়ির শব্দে ৷ কোনোমতে আড়মোড়া ভেঙে চোখ খুললাম ৷ এবার আমার দ্বিগুণ অবাক হবার পালা ৷ নিজেকে আবিষ্কার করলাম এক গাছতলায় ৷ জ্বর টা কেটে গেছে ৷ অথবা হয়তো জ্বর আসেইনি ৷ হয়তো সব আমার মনের ভুল ছিলো ৷ ঐ হোটেল, ঐ ম্যানেজার, ঐ পোর্ট্রেইট আর ঐ শীতল হাতের ছোঁয়া সবই হয়তো আমার মনের ভুল ছিলো ৷ অতিরিক্ত ক্লান্তিতে বিভ্রম হয়েছে ৷ আমি একজন যুক্তিবাদী মানুষ হিসেবে যুক্তির বাইরে কোনো ঘটনা মেনে নিতে রাজি নই ৷ কিন্তু তবুও কোথায় যেন এক দোটানায় ভুগছিলাম ৷ কয়েকবছর পরেও আমি ঐ জায়গায় আরো দুইবার গিয়েছি ৷ কোনো হোটেল পাইনি ৷ লোকজনের কাছেও জিজ্ঞাসা করেছি ৷ ওখানে নাকি কোনোকালেই কোনো হোটেল বা কোনো বাড়ি ছিলো না ৷ দুটো গাছ আছে প্রায় তিন বা চার তলার সমান উঁচু ৷ এতোকিছুর পরে এটাকে মনের ভুল হিসেবে ধরে নেয়াটাই স্বাভাবিক ছিলো ৷ কিন্তু কখনো কখনো ঐ নীল চোখ দুটো আমি স্পষ্ট দেখতে পাই ৷ ঐ ঠান্ডা হাতের স্পর্শ এখনো অনুভব করতে পারি ৷ একটা কারনে কখনোই আমি পুরোপুরি ঐ ঘটনাকে বিভ্রম বলে ধরে নিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারি না ৷ কারন, হাতের আঙ্গুলের ঐ পোঁড়া দাগটা এখনো আমাকে ঐ রাতটার কথা মনে করিয়ে দেয় ৷
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
বিশ্বরঞ্জন দত্তগুপ্ত
গল্পটা পড়ে ভাল লাগল । শুভকামনা রইল । আমার গল্পের আর কবিতার পাতায় আমন্ত্রণ রইল ।
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।