স্মৃতি - কখনো খুব মধুর আবার বিষাদের। প্রত্যেক মানুষের জীবনের চলার পথে বিভিন্ন সময়ে অনেক ছোট , বড় ঘটনা ঘটে যায় কিন্তু কিছু কিছু ঘটনা মনের মধ্যে এমন ভাবে গেথেঁ থাকে যেটা কখনোই ভোলা যায় না। মাঝে মাঝেই মনের গভীর থেকে বেরিয়ে এসে চোখের সামনে ছবির মতন ভেসে ওঠে। আজ থেকে বহু বছর আগে রুদ্রশেখরের জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি আজও তিনি ভুলতে পারেন নি , হয়তো কোন দিন ভুলতেও পারবেন না আর কাকতালীয় ভাবে ঘটনাটির শুরু এক শীতের সকালে.....
রুদ্রশেখর যখন তার নির্দিষ্ট গন্তব্যে এসে পৌছালেন তখন সকালবেলা , চারিধার কুয়াশায় আছন্ন । সাধারনত শীতকালের এই সকালে বেশির ভাগ সময়টাই চারিদিকটা ঘন কুয়াশায় ঢেকে থাকার দরুন সূর্যের আলোকে সেই ভাবে দেখা যায় না। এই জায়গায় প্রথমবার আসবার আগে এখানকার প্রায় সব কিছুই তিনি মোটামুটি ভাবে জেনে নিয়েছিলেন। গাড়ি থেকে নামার পর টের পেলেন কি ভয়ঙ্কর ঠান্ডা এই জায়গাটায়। আগাম খবর অনুযায়ী সোম বাহাদুর অবশ্য তার আসার অপেক্ষায় এখানকার গাড়ির স্ট্যান্ডে হাজির ছিল। কুশল বিনিময়ের পর অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে সোম বাহাদুর রুদ্রশেখরকে বললো - আপনার থাকবার , খাবারের সব বাবস্থা আমি মাস খানেকের জন্য করে রেখেছি। আশা করছি এই সময়ের মধ্যে আমাদের কাজটা হয়ে যাবে আর যদি প্রয়োজন হয় তখন নাহয় আরো কয়েকদিন থেকে যাবেন। আর যে গাছের পাতাগুলি আপনি চিহ্নিত করে গেছেন , আমি লোকজন লাগিয়ে দিয়েছি সেই পাতাগুলি তোলার কাজে। আসলে এই গাছগুলো পাহাড়ের দুর্গম এলাকায় জন্মায় তাই একটু সময় লাগবে এই পাতাগুলি সংগ্রহ করতে। এই দেখুন , আপনি এই সকালবেলায় শীতের মধ্যে গাড়ি থেকে নামার পর আমি আপনার সঙ্গে বকবক করে যাচ্ছি। কথাবার্তা পরে হবে। শীতের মধ্যে দাঁড়িয়ে না থেকে ঘরে চলুন। আপনাকে ঘরে পৌঁছে দিয়ে আমি আপনার খাবারের ব্যবস্থা করছি।
পাহাড়ী অঞ্চলের সকালবেলায় বাহিরে ভীষন ঠান্ডায় না থেকে ঘরে ঢুকে রুদ্রশেখর বেশ আরাম বোধ করলেন। মনে পড়ে গেল তার স্কুল জীবনের গ্রাম বাংলার শীতকালের সময়টা । গ্রামের মহা উৎসব " নবান্নর " অনুষ্ঠানের তোড়জোড় চলছে। সারাটা গ্রাম সোনার ফসলে ভরে রয়েছে। সকালবেলায় ঘুম থেকে উঠে চারিদিকটা ভাল করে দেখলে মনে হত সারাটা গ্রামে যেন সোনা ছড়ানো রয়েছে। ভিনদেশী মরসুমি অসংখ্য পাখীর দল গ্রামের বড় দিঘীতে এসে জড়ো হয়ে সকাল থেকেই কলরব শুরু করে দিত। ভোর বেলা থেকেই লোকজন খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে বিশাল বিশাল কাঠের উনোনে গুর তৈরিতে ব্যস্ত থাকতো । ঘরে ঘরে লোকজনেরা আনন্দ সহকারে পিঠে - পায়েস তৈরির প্রস্তুতি নিতো। ভোরে শিশিরের বিন্দুগুলি গাছের পাতার উপর পরে থাকতো আর সকালের সূর্যের আলোতে দুর থেকে শিশিরের বিন্দুগুলিকে মনে হত গাছের পাতাগুলির উপর সাদা হীরে ছড়ানো রয়েছে।শীতকালে পাহাড়ী অঞ্চলে সকালবেলায় অন্য এক রূপ। চারিদিকটা ঘন কুয়াশার চাদরে মোড়া। সূর্যের আলোর দেখা পাওয়ার সময় বোঝা যায় না। চারিদিকটা মেঘলা আর সঙ্গে হাড় কাঁপানো শীত। এখানকার মানুষজন অবশ্য এই শীতের সকালের ঠান্ডার মধ্যেই তাদের দৈনন্দিন কাজ কর্ম শুরু করে দিয়েছেন।
পাহাড়ি অঞ্চলের এই গ্রামটির নাম হলো " মানা "। চীন - ভারত বর্ডারের এই গ্রামটি হচ্ছে ভারতের মাটিতে একেবারে শেষ গ্রাম। সমুদ্রপৃষ্ট থেকে প্রায় কুড়ি হাজার ফিট উচ্চতায় এই গ্রামটি। চারিদিকে পাহাড় ঘেরা অপরূপ সৌন্দর্যে বেষ্টিত গ্রামটি। হটাৎ করে দেখলে মনে হয় কোনো বিশ্ব বিখ্যাত শিল্পীর নিপুন তুলির টানে একটি অসাধারন কোনো ছবি। গ্রামের লোকজন অত্যন্ত অমায়িক , ভদ্র আর অতিথি সেবা পরায়ন। গ্রামের একটু পরে পাহাড়ের উপরে খুব ছোট এক সমতলে বরফের মত ঠান্ডা জায়গায় ভারতের সেনা ছাউনি আর সেখানে সেনারা সারা দিন - রাত দেশের নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত থাকেন। আমরা যখন এই শীতে বাড়িতে দরজা - জানালা বন্ধ করে গায়ে খান দুয়েক লেপ চাপিয়েও শীতে কাঁপতে থাকি তখন আমাদের সেনারা সারাটা বছর ধরে এমনকি ভয়ঙ্কর শীতে এই জমে যাওয়া ঠান্ডার মধ্যে সজাগ থেকে দেশকে বহিশত্রুর হাত থেকে রক্ষা করেন।
রুদ্রশেখর কলকাতায় থাকেন। বয়স ৫০ এর কাছাকাছি। এখানে এসেছেন ব্যবসার কাজে। বছর দুয়েক ধরে এখানকার সোম বাহাদুরের সঙ্গে যৌথ ভাবে রপ্তানির ব্যবসা করেন। এই পাহাড়ি অঞ্চলের কয়েকটি দুর্গম এলাকায় এক ধরনের গাছের পাতা সংগ্রহ করে সেগুলিকে কৃত্তিম উপায়ে পরিষ্কার করে বিদেশে চালান করা হয়। বিদেশে এই ধরনের গাছের পাতাগুলি দিয়ে নানা ধরনের জীবনদায়ী ঔষধ তৈরি করা হয়ে থাকে। সাধারনত শীতকালেই গাছগুলি থেকে প্রচুর পরিমানে কচি পাতা বের হয় আর এই কচি পাতাগুলি সংগ্রহ করতে হয় শীতকালে সকালবেলার মধ্যে। বেলা পরে গেলে পাতাগুলির গুণাগুণ ঠিক মতন থাকে না যে উদ্দেশ্যে এইগুলি সংগ্রহ করা হয়। রুদ্রশেখর এখানে এসেছেন পাতাগুলি ঠিক মতন ভাবে সংগ্রহ করবার কাজে।
রুদ্রশেখর প্রায় প্রতিদিন দীর্ঘ দিনের অভ্যাস মতো সকাল বেলায় ঘুম থেকে উঠে বাড়ির বাহিরে হাঁটাহাটি করেন। এখানে এসেও সেটার ব্যাতিক্রম হয়নি। সকালবেলায় গ্রামের বাজারের সামনে চায়ের দোকানে চা খেতে খেতে হটাৎ করেই এক বাঙালি যুবকের সঙ্গে পরিচয় হলো। ছেলেটির নাম অয়ন পাল। পরিচয়ের মাধ্যমে জানা গেলো ছেলেটি পশ্চিমবঙ্গে বাঁকুড়ায় থাকে। এখানকার সেনা ছাউনিতে দেশের নিরাপত্তার কাজে নিযুক্ত রয়েছে। গল্পের ফাঁকে অয়নের থেকে জানা গেল অল্প কয়েকদিন হোল তার বিয়ে হয়েছে। বর্ডারের ডিউটিতে ছুটি কম থাকায় বিয়ের দুদিন পরেই তাকে দেশের সুরক্ষার কাজে যোগ দিতে হয়েছে। ক্রমে অয়নের সঙ্গে রুদ্রশেখরের একটা সখ্যতা গড়ে উঠলো। প্রতিদিন এই শীতের সকালে অয়নের সঙ্গে তার বিভিন্ন বিষয়ে গল্প হতো চায়ের দোকানে বসে। অয়নের ছোট বয়স থেকে ইচ্ছে ছিল ফৌজিতে যোগদান করে দেশের সুরক্ষার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করা। আজ এই কাজের সঙ্গে যুক্ত হতে পেরে সে নিজেও খুব গর্বিত। বিয়ের পর মাত্র দুদিন বাড়িতে থেকে ডিউটিতে চলে আসতে হয়েছে। ভালো করে নতুন বৌয়ের সঙ্গে কথাই বলতে পারে নি। অয়ন বললো - যেদিন এই রকম এক শীতের সকালে ডিউটিতে আসার জন্য যখন সে বাড়ি থেকে বেরোল সেদিন তার নব বিবাহিত স্ত্রী দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে এক করুন দৃষ্টি মেলে অনেককিছু বলবার চেষ্টা করছিল কিন্তু মুখ থেকে একটি কথাও বলতে পারে নি। শুধু তার সুন্দর দুটি চোখ থেকে অঝোরে জলের ধারা পরে চলছিল। অয়ন হটাৎই রুদ্রশেখরের হাত দুটো চেপে ধরে বললো - দাদা , আপনিতো ব্যবসার কাজে আরো দিন সাতেক এখানে থাকবেন তাই বলছি আমার একটা উপকার করে দেবেন ? আমি এখানে আসার আগে শুনে এসেছি আমার বৌ এরমধ্যে কয়েকদিনের জন্য কলকাতায় ওর দিদির বাড়িতে এসে থাকবে। আপনিতো কলকাতায় থাকেন। আপনাকে আমি কালকে একটা প্যাকেট আর ওর দিদির কলকাতার বাড়ির ঠিকানাটা দিয়ে দেব। আপনি প্যাকেটটা আমার বৌকে ডেকে ওর হাতেই দেবেন আর বলবেন আমি ভালো আছি , আমার জন্য যেন চিন্তা না করে। আমি আমার মেজর সাহেবকে বলে আগামী মাসের শেষের দিকে এক সপ্তাহের জন্য ছুটি জোগাড় করেছি। পরের দিন সকালবেলায় অয়ন একটা সিল করা প্যাকেট রুদ্রশেখরের হাতে দিয়ে আবারও বললো - ওকে মনে করে বলবেন আমি ভালো আছি , আমার জন্য যেন একদম চিন্তা না করে আর আমি সামনের মাসে শেষের দিকে বাড়ীতে আসছি।
রুদ্রশেখরের এখানকার ব্যবসা সংক্রান্ত কাজ প্রায় সব হয়ে গেছে। আর তিন দিন পর কলকাতার উদ্দেশে রওনা হবেন। পরের দিন শীতের সকালে চায়ের দোকানে গিয়ে দেখলেন অয়ন আসে নি। ভাবলেন হয়তো পরে আসবে। কিন্তু অনেকক্ষন হয়ে গেলো অয়ন এলো না। রুদ্রশেখরের মনে পড়ল অয়ন কয়েকদিন ধরে বলছিল তার শরীরটা ভাল নেই। এই খোলা জায়গায় হিম শীতল পরিবেশে তার রাতের ডিউটি চলছে। মনে মনে ভাবলেন হয়ত অয়ন অসুস্থ হয়ে পরেছে। হটাৎ দেখলেন কয়েকজন সেনা অফিসার রাস্তা দিয়ে হনহন করে কোথায় যেন চলে গেলো। একটু পরে দেখা গেলো চার পাঁচ জন সেনা অয়নকে কাধে নিয়ে দৌড়ে কোথায় যেন নিয়ে যাচ্ছে। রুদ্রশেখর এই দৃশ্য দেখে কি রকম যেন হয়ে গিয়ে কিছু না বুঝেই তিনিও সেনাদের পিছন পিছন দৌড়াতে লাগলেন। এরপর সবাই গিয়ে এলাকার হাসপাতালে মিলিত হলেন। সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তার সেনাদের থেকে সব কিছু শুনে নিয়ে অয়নকে পরীক্ষা করে বললেন - একেই শীতকাল তার ওপর সারারাত খোলা জায়গায় মাইনাস টেম্পারেচারে ডিউটি করতে করতে উনি সংঘাতিক ভাবে নিমুনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পরেন। ডাক্তার একটুক্ষণ চুপ থেকে ধীরে ধীরে বললেন - গভীর দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি আমরা কিছু করতে পারছি না কারন উনি আর বেঁচে নেই।
একদিন এক শীতের সকালে মনের মধ্যে একরাশ আনন্দ নিয়ে রুদ্রশেখর এই পাহাড়ি গ্রামটায় এসেছিলেন ব্যবসায় কাজে আর আজ সেদিনের মত এই শীতের সকালে এই গ্রাম ছেড়ে কলকাতায় ফিরে যাচ্ছেন এক রাশ আনন্দের পরিবর্তে তার দ্বিগুন ভারাক্রান্ত মন নিয়ে। মাসখানেক এখানে থাকার সময় অয়নের সঙ্গে তার একটা সুন্দর দাদা ভাইয়ের সম্পৰ্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিলো। অয়ন তাকে বার বার বলে দিয়েছিলো কলকাতায় গিয়ে তার বৌএর হাতে সুদৃশ্য প্যাকেটটা তুলে দিয়ে বলতে যে অয়ন ভালো আছে আর সামনের মাসে সে আসছে। কলকাতায় ফেরার সময় তিনি একটা কথাই ভাবছিলেন কিভাবে অয়নের সদ্য বিবহিত বৌকে বলবেন যে অয়ন আর কোনো দিনও তার কাছে ফিরে আসবে না। এই ঘটনার পর অনেকগুলি বছর পার হয়ে গেছে। কালের নিয়মে প্রতি বছর গ্রীস্ম , বর্ষা , শরত , হেমন্ত পার হয়ে যখন শীত আসে আর এই শীতের প্রত্যেকটি সকালে রুদ্রশেখরের মনে পড়ে যায় সেই দিনটার বিভীষিকাময় ঘটনাটির কথা যেটা তিনি কোনদিনই ভুলতে পারবেন না।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
রবিউল ইসলাম
ইসসস আয়নের জন্য খারাপ লাগতেছে। সদ্য বিবাহিত ছেলেটির মৃত্যু সত্যিই কষ্টদায়ক।
লেখাটি চমৎকার বললেও ভুল হবে। অতুলনীয়।
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
এক মূল্যবান জীবনের দেশের প্রতি ভালোবাসার গল্প।
১২ আগষ্ট - ২০১৭
গল্প/কবিতা:
৪৭ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।