গল্প - স্বপ্ন ভয়
বিশ্বরঞ্জন দত্তগুপ্ত
বহুকাল থেকেই " স্বপ্ন " কিংবা " স্বপ্ন দেখা " মানুষের মধ্যে একটি চর্চিত বিষয়। প্রাচীন কালে মানুষ বিশ্বাস করতেন দেবতাদের কিংবা মৃত মানুষজনের থেকে স্বপ্নের মাধ্যমে আসা বিশেষ এক ভবিষ্যতের বার্তা হিসাবে জানান দেওয়া। বহু আগে রাজ - রাজাদের দরবারে স্বপ্ন বিশারদ নিয়োগ করার প্রচলন ছিল। রাজ পরিবারের লোকজনের স্বপ্নে দেখা বিষয় নিয়ে গণনা করে তারা বিধান দিতেন। স্বপ্ন দেখার নির্দিষ্ট কোন বিষয় নেই। স্বপ্ন বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে , যেমন - ভৌতিক , ভয়ঙ্কর , ভয়ের , মর্মান্তিক , যৌন উত্তেজনা , প্রেম সংক্রান্ত কিংবা কোনো মধুর স্মৃতি ইত্যাদি নানা বিষয়ের। সাধারনত মানুষজন সুখের কিংবা আনন্দের স্বপ্ন দেখতে পছন্দ করেন। মনো সমীক্ষণের জনক সিগমুন্ড ফ্রয়েড ১৮৯৯ ক্রিষ্টাব্দে স্বপ্নের বিষয়ে " The Interpretation of Dreams " নামে একটি বই রচনা করেন। এই বইটিতে তিনি স্বপ্ন সম্পর্কে বিশদ ভাবে আলোচনা করেছেন। কিন্তু এখনও বর্তমান পৃথিবীতে স্বপ্ন সমন্ধে নানা মুনির নানা ধরনের মতবাদও রয়েছে।
কল্যান রায় একজন নামকরা ডাক্তার । নিজের ডাক্তারি বিষয় ছাড়াও তিনি অন্য বিষয়ের উপর বিশিষ্ট গুণীজনের লেখা পড়তে ভালবাসেন। বর্তমানে শুধু মাত্র জানার আগ্রহে তিঁনি " স্বপ্নের বিষয় " , এই নিয়ে চর্চা করছেন। যদিও ডাক্তার কল্যান রায়ের স্ত্রী সর্বানী এই " স্বপ্নের বিষয়ে " আগ্রহী নন। তিনি মনে করেন মানুষ ভাল স্বপ্ন দেখলে যেমন আনন্দ পায় ঠিক তেমনি খারাপ স্বপ্ন দেখলে মানুষের মন ভারাক্রান্ত হয়ে পরে আর অতি খারাপ স্বপ্নে আগামী দিনগুলিতে মানুষজন এই খারাপ স্বপ্নের প্রভাবে একেবারে দিশাহারা আর চিন্তিত হয়ে পরে। মানুষজন ঘুমের মধ্যে যে স্বপ্নটা দেখেন আর সেই স্বপ্নের বিষয়টি তার জীবনে প্রতিফলিত কিংবা ঘটবে কিনা সেটাও ঠিক নয়। আবার কখনওবা কাকতালীয় ভাবে হয়ত স্বপ্নে দেখা বিষয়টি মানুষের জীবনের সাথে কিছুটা মিল এসে যেতে পারে। সেইজন্য এই স্বপ্নের বিষয় নিয়ে চিন্তা ভাবনা না করাই ভাল। আর এই কথাটাই তিনি অনেকবার কল্যান রায়কে বলেছেন। ডাক্তার রায় সর্বানীর কথায় কোন আমল না দিয়ে এই " স্বপ্নের বিষয় " নিয়ে দেশ , বিদেশের নানা ধরনের পুস্তক , জার্নাল আর দেশ বিদেশে হওয়া বিভিন্ন সেমিনার রিপোর্টের কাগজপত্র যোগাড় করে অনেক রাত অবধি পড়াশুনা শুরু করেছেন। বিশ্বের বিখ্যাত লোকজন কিংবা সাধারন লোকজনের স্বপ্ন দেখার বিবরন , বর্ণনা গুলি মনোযোগ সহকারে পড়ে , বিশ্লেষণ করে তিঁনি সেই সম্পর্কে অনেক কিছু জানার চেষ্টা করেন । এখন রাত অনেকটাই হয়েছে । ডাক্তার কল্যান রায় খুবই মনোযোগ সহকারে পড়ছিলেন পৃথিবী বিখ্যাত একজন মানুষের মৃত্যুর কয়েকদিন আগে তার নিজের মৃতুকে স্বপ্নের মাধ্যমে দেখার বিবরনটি। তদানিন্তন সময়ে বহুল প্রচারিত এই স্বপ্ন দেখার বিবরনটি বিশ্বের মানুষজনের কাছে বিরাট এক আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠেছিল। সেদিনের স্বপ্নে দেখা নিজের মৃত্যুর ঘটনাটি পরের দিন সকালেই তিনি তাঁর একান্ত এক ঘনিষ্ট বন্ধুকে বলেছিলেন। সেই পৃথিবী বিখ্যাত লোকটির নিজের বর্ণনায় স্বপ্নটি ছিল ---
" ঘটনার দিন আমি খুব রাত করে শুতে যাই। আমি ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে দেখি আমার বিরাট অট্টালিকায় কান্নার আওয়াজ। কিন্তু কোন ঘর থেকে কান্নার আওয়াজ আসছে সেটা বুঝতে পারছি না। পুব দিকের একটা বড় ঘরে গিয়ে দেখলাম একটি শবাদারে একজনের মৃত দেহ শোয়ানো রয়েছে। অনেকটা আমার মত দেখতে। চারিদিকে অনেক লোকজন জড়ো হয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আমি একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম এই বিরাট অট্টালিকায় কে মারা গেছে ? লোকটি জবাব দিলেন - আমাদের অত্যন্ত প্রিয় এই অট্টালিকার প্রধান ব্যক্তি নির্মম এক আততায়ীর গুলিতে নিহত হয়েছেন। "
কাকতালীয় ভাবে এই স্বপ্ন দেখার ১২ দিন পর অট্টালিকার প্রধান ব্যক্তি সত্যি সত্যি করে নির্মম এক আততায়ীর গুলিতে নিহত হন। ডাঃ কল্যাণ রায় অনেক লোকের স্বপ্নের বিবরন পড়েছেন কিন্তু কেন যেন এই স্বপ্নের বিবরনটি তাকে বার বার পড়বার জন্য আকৃষ্ট করে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন রাত প্রায় ১১টা। বইপত্তর ঘুছিয়ে রেখে ঘরের আলো নিভিয়ে শোবার ঘরে এসে ডিম আলোতে দেখলেন সর্বানী গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। চোখে মুখে জল দিয়ে গায়ের চাদরটা টেনে নিয়ে শুয়ে পরলেন। যত সব সাত পাঁচ চিন্তা মাথায় এসে জড়ো হচ্ছে বিশেষ করে ছেলে অয়নের জন্য। দুদিন আগে অয়ন তার কয়েকজন কলেজের বন্ধু মিলে ডায়মন্ডহারবার বেড়াতে গেছে। আগামীকাল বিকেলে তাদের ফেরার কথা। নিজের শরীরটাও ক্লান্ত বোধ করায় একটা সময়ে ঘুমিয়ে পরলেন।
সবে সকাল হয়েছে। বিকট শব্দে দরজায় কলিং বেলটা বাজছে। কলিং বেলের শব্দে কল্যান , সর্বানীর ঘুমটা ভেঙ্গে গিয়ে ঘড়িতে দেখলেন সকাল ৭টা বাজে। অয়নেরতো এত সকালে আসবার কথা নয় , তারতো বিকেলবেলায় ফেরার কথা। দরজাটা খুলতেই দুজনে একেবারে চমকে উঠলেন। দরজার ওপারে দুজন পুলিশ দাড়িয়ে রয়েছেন। একজনের হাতে একটা ফাইল। কোন রকম ভনিতা না করে একজন পুলিশ বললেন -- আমরা লোকাল থানা থেকে আসছি আপনাদের ছেলে অয়নের ব্যপারে কিছু কথা বলবার জন্য। ছেলের কথা শুনে আতঙ্কে , ভয়ে একেবারে দিশাহারা হয়ে সর্বানী বললেন -- আপনারা ঘরের ভিতরে আসুন। অফিসার , আমাদের অয়নের কি হয়েছে ? সেতো বন্ধুদের সঙ্গে দুদিন আগে ডায়মন্ডহারবার বেড়াতে গিয়েছে... অফিসারটি বললেন -- আমরা সবই জানি। ডায়মন্ডহারবার থানা আমাদের সব কিছুই জানিয়েছে। আমরা এখন অবধি যেটা জানতে পেরেছি সেটা হচ্ছে গতকাল রাতে আপনার ছেলে অন্য বন্ধুদের সঙ্গে মদ খেয়ে কোন এক মেয়ে ঘটিত ব্যপারে নিজেদের মধ্যে বিবাদে জড়িয়ে পরে । এরমধ্যে আচমকাই তাদের এক বখাটে বন্ধু অয়নকে লক্ষ্য করে গুলি চালায় আর এর ফলে সে সংকট জনক অবস্থায় ডায়মন্ডহারবার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। আপনাদেরকে এখুনি আমাদের সঙ্গে ডায়মন্ডহারবার যেতে হবে। আর একটা কথা , যে আততায়ীর গুলিতে আপনার ছেলে আহত হয়েছে তাকে ডায়মন্ডহারবার পুলিশ সঙ্গে সঙ্গে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে এসেছে আর তাকে জেরা করা হচ্ছে। পুলিশের থেকে এই ঘটনা জানার পর সর্বানী একেবারে বাকরুদ্ধ হয়ে চলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন। ডাক্তার রায় নিজের বুক চাপড়ে চিৎকার করে বলছেন -- এ আমাদের কি সর্বনাশ হয়ে গেল। চিৎকার শুনে পাড়ার লোকজন সবাই জড়ো হয়েছেন। ছেলের এই অবস্থার কথা শুনে ডাক্তার রায় সমানে চিৎকার করে কেঁদেই চলেছেন......
ডাক্তার রায়ের চিৎকারের আর্তনাদে সর্বানীর ঘুমটা ভেঙ্গে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন -- তুমি কাদঁছো কেন ? তোমার কি হয়েছে ? তুমি দরদর করে ঘামছো কেন ? ডাক্তার রায়ের ঘুমের ঘোরটা তখনও ভাল করে কাটে নি । চারিদিক তাকিয়ে নিয়ে বললেন -- জানো সর্বানী , আমি একটা ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন দেখলাম। আমাদের অয়নকে একজন গুলি করেছে , মেরে ফেলবার জন্য। সর্বানী এবার রাগত স্বরে বললেন -- তোমাকে আমি বহুবার বলেছি গভীর রাত অবধি স্বপ্ন দেখার ঘটনা গুলি পড়বে না। যত সব স্বপ্ন বিষয়ক বই পড়বে আর তার প্রতিফলন ঘটাবে নিজের স্বপ্ন দেখার মধ্যে দিয়ে। সর্বানী , আমার কি রকম ভয় ভয় লাগছে আর খুব চিন্তা হচ্ছে অয়নের জন্যে। তুমি একবার অয়নের মোবাইলে ফোন করে দেখবে ও কেমন আছে ? সর্বানী বললেন -- আমিতো বলছি এই সকালবেলায় ফোন করার কোন দরকার নেই , আমাদের অয়ন ঠিক আছে আর তাছাড়া...... হটাৎ করে দরজায় কলিং বেলের শব্দ।
দরজাটা খুলতেই দেখা গেল অয়ন এসেছে। অয়ন ঘরে ঢুকে বললো -- আমি , মানে আমরা সবাই বেশ কিছুটা আগেই ডায়মন্ডহারবার থেকে রওনা দিয়েছি কার্যত আমারই উদ্যোগে। বলছি , তোমরা সবাই ভাল আছো তো ? মানে বলতে চাইছি বাবার শরীর ঠিক আছে তো ? সর্বানী বললেন -- আমি আর তোর বাবা খুব ভালই আছি। হটাৎ করে তুই তোর বাবার শরীরের খোঁজ করছিস কেন ? আসলে গতকাল রাতে স্বপ্নে দেখলাম বাবা ভীষন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে আর ঠিক সেই মুহূর্তে আমার ঘুমটা ভেঙ্গে যায় আর তখনই ঠিক করি কাল ভোর হলেই বেরিয়ে পরবো। সর্বানী বললেন -- শোন অয়ন , তোর বাবাও গতকাল রাতে তোকে নিয়ে একটা দুস্বপ্ন দেখেছে। একটা কথা তোকে আর তোর বাবাকে বলছি -- স্বপ্নের বিষয়ে আমার সেরকম কোন পড়াশুনা করা নেই কিংবা আমি স্বপ্ন বিশারদও নই। তবু বলছি সবসময় ভাল চিন্তা করো , ভালো থাকো , আনন্দে থাকো , দেখবে তোমরাও ভাল থাকবে আর এটাই তোমাদের জীবনযাত্রায় প্রতিফলিত হবে। আর একটা কথা মনে রেখ " স্বপ্ন " শুধুমাত্র স্বপ্নই এর সঙ্গে বাস্তব জীবনকে মিলিয়ে দিও না।
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
প্রত্যেক মানুষই ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখেন। আমার এই গল্পে স্বপ্ন কিংবা স্বপ্নের বিষয় নিয়ে লেখবার চেষ্টা করেছি
১২ আগষ্ট - ২০১৭
গল্প/কবিতা:
৪৭ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪