ভয়

ভয় (সেপ্টেম্বর ২০২১)

বিশ্বরঞ্জন দত্তগুপ্ত
  • 0
  • ১৪
আমার দাদু ছিলেন ব্রিটিশ আমলে একজন নামকরা পুলিশ ইন্সপেক্টর । তদানীন্তন সময়ে " মাধব ঘোষালকে " সবাই এক ডাকে চিনত । অত্যন্ত কড়া প্রকৃতি আর বেশ মেজাজি মানুষ ছিলেন । জীবনে অন্যায়ের সঙ্গে কখনো আপস করেননি । " ভয় " বলে কোন বস্তু তাঁর জানা ছিল না । অত্যন্ত দাপটের সঙ্গে দীর্ঘদিন পুলিশে চাকরি করেছেন । এই চাকরির সূত্রে তাঁর স্মৃতির ঝুলিতে ভরে রয়েছে অসংখ্য হারহিম করা লোমহর্ষক অনেক ঘটনা । সেইসময় একদিন আমরা সবাই মিলে দাদুর কাছে আবদার করলাম তাঁর স্মৃতির ঝুলি থেকে কোন বিস্ময়কর বা ভয়ের কিংবা কোন অলৌকিক ঘটনার কথা আমাদের কে শোনাতে । দাদু কিছুক্ষণ চোখবুজে কিছু চিন্তা করলেন তারপর শুরু করলেন তাঁর জীবনে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার কথা ............

সালটা ১৯৩৭ । তখন আমার অল্প বয়েস । সবে পুলিশের চাকরিটা পেয়েছি । ট্রেনিং শেষ হবার পর প্রথম প্রথম আমাকে এমন কতগুলি জায়গায় নাইট ডিউটি দেওয়া হোল , যেখানে সাধারণত ডিউটি করতে লোকে ভয় পায় । শহরের থেকে কিছুটা দূরে এক নির্জন জায়গায় লাশকাটা বা মর্গের ঘরের সামনে । আশেপাশে কোন জনবসতি নেই । একটা টিমটিমে আলো আর বন্ধ ঘরের থেকে পচা গলা বেওরিশ লাশের বিকট গন্ধ । মাঝে মাঝে রাতের নিস্তব্ধতাকে ভঙ্গ করে কুকুর কিংবা শেয়ালের ডাক । আবার কখনও হাইকোর্টের যে ঘরে মার্ডার হওয়া লোকেদের রক্তমাখা জামাকাপড় গুলি রাখা থাকত এভিডেন্স হিসাবে বিচারের সময় কেসের প্রয়োজনে , সেই ঘরের সামনে একটা টুলে বসে রাতের ডিউটি করা । সামনে বিশাল লম্বা-চওড়া ফাঁকা বারান্দা । হটাৎ করে মনে হতো কোন একটা ছায়ামূর্তি বারান্দা দিয়ে নিঃশব্দে চলাফেরা করছে । তোমরা জান দাদুভাই , " ভয় " বলে আমার জীবনে কোন শব্দ ছিল না । তবে হ্যাঁ , জীবনে আমি একবারই ভীষণ ভয় পেয়ে ছিলাম - আজ সেই ঘটনাটাই তোমাদের সামনে বলছি ......

দিঘা যাবার পথে " নন্দকুমার " বলে একটি গ্রাম । সেখানে ছোট একটি থানা । থানার পাশেই জাতীয় সড়ক । তখন এই সড়কটি এতটা চওড়া ছিল না । গাড়ি-ঘোড়ার চলাচল ছিল অনেক কম । রাস্তার দুপাশে বড় বড় গাছ । থানার নামটা আজ আমার ঠিক মনে নেই । তবে এখনকার মত জায়গাটা এতটা জমজমাট ছিল না । চারিদিকে ছোট ছোট গ্রাম আর ধানক্ষেত আর অধিকাংশ সব কাঁচা বাড়ি । অন্যান্য থানার তুলনায় এখানে কাজের চাপটা তুলনামূলক কম । এই থানায় আমি মেজবাবু হিসাবে কাজ করছি । ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময় । হারহিম করা ঠান্ডা । আজ আবার ঠান্ডাটা আগের দিনের তুলনায় অনেকটাই বেশি । এখন রাত প্রায় গভীর । বড়বাবু সেইসময় থানায় ছিলেন না । থানায় আমি আর একজন সেপাই ডিউটিতে রয়েছি । আপাদমস্তক মোটা কম্বল জড়িয়ে চেয়ারে বসে একটু ঝিমুনি মত এসেছিল । হটাৎ এক মহিলার একটু অন্য রকম গলার আওয়াজের করুণ এক আর্তনাদে তাকিয়ে দেখি দূরে দরজার বাহিরে একজন মহিলা দাঁড়িয়ে রয়েছেন । প্রথম দর্শনে একটু অস্বাভিকতা মনে হোল । বাহিরে আলোর তীব্রতা কম থাকায় , তাঁকে ভিতরে আসতে বলায় তিনি ভিতরে না এসে দরজার বাহিরেই দাঁড়িয়ে রইলেন । তার অগোছাল কথাবার্তায় এইটুকু বুঝলাম মহিলা খুব বিপদে পরে থানায় এসেছেন । মহিলার চুলগুলো খোলা । পরনে একটা কালো রঙের শাড়ি । গলায় একটা বড় স্টোনের মালা আর বাহাতে ধরা একটা লাল রঙের ভেনিটি ব্যাগ । কপাল ফেটে রক্ত বেরোচ্ছে । ঠিকমত ভাবে কথা বলতে পারছিলেন না । কথা বলার সময় জিভটা বের হয়ে আসছিল । তার কথায় মোটামুটি আন্দাজ করতে পারলাম এই গভীর রাতে গাড়ি চালাবার সময় তাদের গাড়িটি একটি গাছের সঙ্গে প্রবল ভাবে ধাক্কা খেয়েছে । আর জায়গাটা ও মোটামুটি চিহ্নিত করতে পারলাম , আমাদের থানার কাছেই জাতীয় সড়কে । মহিলার আকুল মিনতি - গাড়ি চালাচ্ছিলেন তার স্বামী আর গাড়িতে ছিলেন তিনি আর তাঁদের ছোট একটি মেয়ে । তার স্বামী আর তাদের কন্যার আঘাত খুবই গুরুতর , তাদের যেন এখুনি আমরা এই অন্ধকার রাতে উদ্ধার করে কিছু একটা ব্যবস্থা করি ........ । সব কিছু শুনে আমি মহিলাটিকে বললাম -- আপনি একদম চিন্তা করবেন না , আমাদের তরফ থেকে সব ব্যবস্থা নেয়া হবে । আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে এই দুর্ঘটনায় আপনিও আঘাত পেয়েছেন । আপনার স্বামী আর মেয়েকে যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি উদ্ধার করে আমরা আপনাদের সবাইকে হাসপাতালে পাঠাবার ব্যবস্থা করব চিকিৎসার জন্য । আপনি এত ঠান্ডায় বাহিরে দাঁড়িয়ে না থেকে ভেতরে এসে বসুন । আর আমাকে যে কথাগুলো বললেন সেটা আমাদের থানায় লিপিবদ্ধ করান । সেপাইকে ডেকে বললাম -- আমি ডিউটিতে বেরোচ্ছি । থানাটা সামলে নিও । বড়বাবু থানায় এলে তাঁকে সমস্ত ঘটনাটা জানিও । সেই সময় অধিকাংশ থানাতে জীপ গাড়ির ব্যবস্থা ছিল না , সাইকেল চড়ে কিংবা পায়ে হেঁটে অনুসন্ধানের কাজে যেতে হতো । সাইকেলে চড়ে সেই শীতের অন্ধকার রাতে অনুসন্ধানে বেরোলাম ।

পাওয়ারফুল টর্চের আলো দিয়ে দেখলাম গাড়িটি একটি বড় গাছের সঙ্গে ভয়ংকর ভাবে ধাক্কা খেয়েছে । গাড়ির সামনের বাদিকটা ভীষণ ভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত । গাড়ির পেছনের দিকের একটা দরজা খোলা , হয়ত , দুর্ঘটনার কবলে পরে দরজাটি খুলে গিয়েছে । আর তার থেকে একটু দূরে একটি ফুটফুটে বাচ্চা মেয়ে মাটিতে বসে অঝোরে কেঁদে যাচ্ছে । প্রাথমিক ভাবে দেখে মনে হলো মেয়েটির আঘাত অতটা গুরুতর নয় । মেয়েটিকে কোলে তুলে নিতে , সে বারে বারে গাড়িটি দেখিয়ে মা , বাবা বলে চিৎকার করে কাঁদছিল । গাড়িটির স্টিয়ারিংএর আসনে বসা ভদ্রলোকের আঘাত গুরুতর হলেও , তিঁনি বেঁচে আছেন , কথা বলার শক্তি হারিয়ে তিনি একেবারে বেহুশ । আর তাঁর পাশের আসনে বসা কালো রঙের শাড়ি আর গলায় একটা বড় স্টোনের মালা পরা মহিলাটিকে দেখে আমি ভীষণ ভয়ে একেবারে আৎকে উঠলাম আর নিজের মনে মনে ভাবলাম এটা কি করে সম্ভব !!! আর মুহূর্তের মধ্যে ভয়েতে আমার সারা শরীর একেবারে হিম হয়ে এলো । দেখলাম এই ভয়ংকর দুর্ঘটনায় মহিলাটির আঘাত অত্যন্ত গুরুতর । সামনের গাড়ির কাঁচ তার সারা শরীরে বিদ্ধ হয়ে গাড়ির সঙ্গে একেবারে লেপ্টে রয়েছেন । দেখেই বোঝা যাচ্ছে মহিলাটি আর বেঁচে নেই । অথচ এই মহিলা কিছুক্ষন আগে থানায় এসে তার মেয়ে আর তার স্বামীকে উদ্ধারের কথা বললো আর আমি তাকে থানায় অপেক্ষা করতে বলে এখানে এসেছি । ভাল করে টর্চের আলো ফেলে দেখলাম - ভয়ংকর এক্সিডেন্টের দরুন গাড়ির ইঞ্জিনটা দুমড়েমুচড়ে তার গায়ের সঙ্গে আটকে রয়েছে । চারিদিকটা রক্তে ভেসে যাচ্ছে । জিভটা অনেক খানি বেরিয়ে রয়েছে , কপাল ফেটে রক্ত বেরোচ্ছে আর চোখদুটি ঠিকরে বেরিয়ে এসেছে । একটা লাল রঙের ভেনিটি ব্যাগ বাহাতের আঙুলের ফাকে আটকে রয়েছে । এই দৃশ্য দেখে প্রচন্ড ভয়ে আমি থরথর করে কাঁপছি । বাচ্চা মেয়েটিকে উদ্ধার করে তাড়াতাড়ি থানায় ফিরলাম । খবর পেয়ে বড়বাবু থানায় চলে এসেছেন । ব্যবস্থা করা হোল ওনাদের তাড়াতাড়ি ওখান থেকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠাবার । থানায় ফিরে সেই মহিলাটিকে কোথাও খুঁজে পেলাম না , পাবই বা কি করে , আমি নিজে দেখে এসেছি এই দুর্ঘটনায় তিনি আর বেঁচে নেই । বড়বাবুকে সমস্ত ঘটনার কথা রিপোর্ট করে লিপিবদ্ধ করলাম । ঘটনার তদন্ত শুরু হলো ........

সেদিনের রাতের ঘটনা আজও আমার স্মৃতির পাতায় জ্বল জ্বল করে আছে । আমি ভূত বা কোন অশরীরির আত্মার কথা কোনদিন বিশ্বাস করি নি আর আজও করি না । কিন্তু যখনই সেদিনের ঘটনার কথা ভাবি , আমি কোন কুলকিনারা করতে পারি না । কখনো কখনো মনে হয় সেদিনের ঘটনাটি কি স্বপ্ন ছিল !!! কিন্তু দাদুভাই , সেদিনের রাতের ঘটনাটিকে ভৌতিকই বলো কিংবা অলৌকিকই বলো , ঘটনাটা কিন্তু আমার জীবনে ঘটেছিল । আসলে জীবনে এমন অনেক ঘটনা ঘটে , যেটা অনেকসময় লোকজন বিশ্বাস করতে চায় না কিংবা অনেকক্ষেত্রে যেটা বিজ্ঞান দিয়ে প্রমাণ করা যায় না ।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মোঃ মাইদুল সরকার ভালো লাগলো। ভোট রাখলাম।
ভালো লাগেনি ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২১
ফয়জুল মহী অত্যাধিক সুন্দরf প্রকাশ।
ভালো লাগেনি ২ সেপ্টেম্বর, ২০২১
অনেক ধন্যবাদ ।
ভালো লাগেনি ২ সেপ্টেম্বর, ২০২১

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

জীবনে অনেক সময় অনেক রকমের ঘটনা ঘটে যায় , যেটা অনেক ক্ষেত্রে বিজ্ঞান দ্বারা প্রমাণ করা যায় না ।

১২ আগষ্ট - ২০১৭ গল্প/কবিতা: ৪৮ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪