নন্দিতা

ভালবাসি তোমায় (ফেব্রুয়ারী ২০২১)

বিশ্বরঞ্জন দত্তগুপ্ত
  • ৩৭
  " তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি    
শত রূপে শত বার    
জনমে জনমে , যুগে যুগে অনিবার .... "

" ভালবাসি তোমায় " - এই কথাটা তাকে বলতেই পারলাম না , মনের কথাটা মনেই রয়ে গেল । একটা অজানা দ্বিধা কিংবা লোকলজ্জার ভয়ে মনের কথাটা তাকে জানাতেই পারলাম না । আর কথাটা তাকে বলতে না পারার দরুন আজও সেই পুরোনো স্মৃতি মনের মধ্যে ঘুরেফিরে সবসময় মনে করিয়ে দেয় সেইসব দিনগুলির কথা । আজও তাকে ছাড়া অন্য কারুর কথা আমি ভাবতেই পারি না । হয়ত , সেও কোন এক লাজ লজ্জার ভয়ে তার মনের কথাটা আমাকে বলতে পারে নি । কিন্তু যতদিন আমরা একসঙ্গে থেকে কাজ করেছিলাম - এটা অনুভব করতাম সে হয়তো আমাকে কিছু বলতে চায় , কিংবা আমিও যে তাকে কিছু বলতে চাই , এটা হয়ত সে বুঝতে পারত  .... । একটা সময় সবকিছু ওলটপালট হয়ে দুজনে দুদিকে ছিটকে পরলাম মনের কথাটা মনে রেখেই ।

মাস্টার্স শেষ করে চাকরির চেষ্টা করছি । আর নাটক করাটাও পুরোদমে চালিয়ে যাচ্ছি । প্রায় রোজ সন্ধেবেলা থেকে আমাদের পাড়ায় এক প্রাথমিক স্কুলের ঘরে মোমবাতি জ্বালিয়ে আমাদের নাটকের মহড়া চলতো । বিভিন্ন জায়গায় নাটকের কম্পিটিশানে অংশ নেওয়া আর " কলশো " - এগুলি প্রায় সারাবছর ধরেই হতো । বিশেষ করে শীতকালে চাপটা একটু বেশি থাকত । পাড়ার গ্রূপে নাটক করতে করতে সেইসময় কলকাতার এক নামি নাটকের গ্রূপে অভিনয় করবার সুযোগ ঘটে গেল । নাটককে ভালবেসে অভিনয় সম্পর্কে অনেক খুটিনাটি বিষয় জানবার , শিখবার সৌভাগ্য হয়েছিল গুণীজনদের থেকে । নাটকের সঙ্গে সঙ্গে গান , আবৃত্তি এগুলিও ভালভাবে চর্চা করতাম । ক্রমে গ্রূপের নাটকগুলিতে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করবার সুযোগ পেতে থাকলাম । 

আমাদের নাটকের গ্রূপে " মেকআপ ম্যান " / " ম্যানেজার " ছিলেন - " হরি দা " । ভারি অমায়িক আর নাটক পাগল লোক । হরি দাকে সেইসময়  অভিনয় জগতের প্রায় সবাই চিনত আর খুব ভালবাসতো । হরি দাই একদিন খবরটা আমাকে দিল । মহড়া শেষ হবার পর ভারের চায়ে চুমুক দিয়ে হরি দা বললো -- এখনও তো চাকরি-বাকরি কিছু পাস নি ! অভিনয়টা ও ভালোই করিস , গানের গলাটাও ভাল , বেশ লম্বা-চওড়া আর দেখতেও সুন্দর । আমি বলছিলাম -- একটা " সিজিন " যাত্রা করে আয় । যাত্রা কোম্পানীর " পেমেন্ট " ও খুব ভাল । আর তাছাড়া হাজার হাজার লোকের সামনে অভিনয় করা -- এটাও অভিনয় করার ক্ষেত্রে একটা বিরাট অভিজ্ঞতা । আর একটা কথা মন দিয়ে শুনে রাখ -- বড় বড় যাত্রা কোম্পানীগুলিতে " ডিসিপ্লিন " হচ্ছে সবার আগে , সেটা সবসময় তোমাকে মাথায় রাখতে হবে । সিগারেটে এক লম্বা টান দিয়ে একরাশ ধুয়ো ছড়িয়ে বললো -- এবার তুই চিন্তা করে আমাকে বলিস , আমি সব ব্যবস্থা করে দেব । 

শুরু হলো এক নতুন ধরনের অভিনয়ের জগৎ । " পালাতে " আমার সহনায়কের চরিত্র । সারা শীতকাল ধরে অভিনয় । আজ বর্ধমান তো কাল পুরুলিয়া , পরশু নদীয়া তারপরেই আবার মালদহ , শিলিগুড়ি ......। এমনি করে রাতের পর রাত বিভিন্ন গ্রাম - শহরের মাঠে - ময়দানে হাজার হাজার লোকের সামনে অভিনয় করা । প্রায় আড়াই ঘণ্টা ধরে অভিনয় , নাচ-গান , কৌতুক ...সব মিলিয়ে এক জমজমাট উপভোগ্য যাত্রা পালা । 

প্রায় শেষের দিকে একটা দৃশ্যে ঘটনা বিন্যাস অনুযায়ী - কোন এক শ্রাবণের রাতে নায়িকার পছন্দ করা ভালবাসার পাত্রের বদলে অন্য আরেক অচেনা পাত্রের সঙ্গে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে ......, সেই সময় পরিচালক এক সুন্দর বিষাদের পরিবেশ তৈরি করে আমার গলায় একটি গান দিয়েছিলেন গাইবার জন্য , কাজী নজরুল ইসলামের সেই বিখ্যাত গানটি .......

" শাওনো রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে  
বাহিরে ঝড় বহে নয়নে বারি ঝরে 
ভুলিও স্মৃতি মম নিশিথ স্বপন সম 
আঁচলের গাথা মালা ফেলিও পথ পরে ....."

এখনো মনে পরে ওই দৃশ্যে যখন আমি খুব আবেগ দিয়ে দরাজ গলায় গানটা গাইতাম , সমস্ত দর্শক একেবারে চুপ হয়ে দৃশ্যের সঙ্গে একেবারে একাত্ম হয়ে গানটা শুনতো আবার অনেকেরই চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরতো । ..... এই পালাতে রাতের পর রাত একসঙ্গে অভিনয় করতে করতে আমি নিজের অজান্তেই একটা সময় নন্দিতাকে ( নাম পরিবর্তিত । যিনি এই পালাতে নায়িকার চরিত্রে অভিনয় করতেন ) মনে মনে ভালবেসে তার প্রেমে পরে গেলাম । কিন্তু মুখ ফুটে কোন এক অজানা লাজের ভয়ে আমার মনের কথাটা তাকে বলতে পারলাম না বা জানতেও পারলাম না নন্দিতার মনের ভাবটা । মনে পড়লো হরিদার কথা -- " " একটা কথা সবসময় মনে রাখবে -- যাত্রা কোম্পানির ডিসিপ্লিন অত্যন্ত কড়া , এমন কোন কাজ করবে না , যাতে তোমার বা আমার সম্মানহানি হয় " " । একটা সময় যাত্রা কোম্পানির সঙ্গে বছরের চুক্তি শেষ হয়ে গেল । নন্দিতাও এই যাত্রা কোম্পানি ছেড়ে দিল । লোকমুখে পরে শুনেছিলাম তার এখন অভিনয় বা যাত্রা জগতের সঙ্গে কোনরকম যোগাযোগ নেই । তাদের দেশের বাড়ীর কাছে কোন একটা স্কুলে শিক্ষকতা করে ।   

বছর চারেক পরের কথা ...। চাকরি সূত্রে আমি তখন বোম্বেতে পোস্টেড । প্রায় রোজ রাত্রিবেলা কলকাতা থেকে মা এর ট্রাংকল আর যথারীতি এক কথা -- কবে কলকাতায় আসছিস ? আমি তোর বিয়ের জন্য কয়েকটা মেয়ের ছবি পছন্দ করে রেখেছি । তুই একবারের জন্য এসে ফটোর পছন্দ মত মেয়েটিকে দেখে যা । এখন শ্রাবণ মাস । আমাদের ইচ্ছে আছে সামনের মাঘে তোর বিয়েটা ধরবার । মাকে কি করে বোঝাই , আমার পক্ষে অন্য কোন মেয়েকে বিয়ে করা একেবারেই অসম্ভব কারন আজও নন্দিতার মুখটা আমি ভুলতে পারিনি , আমি যে এখনও তাকে খুব ভালবাসি । যত মাকে বোঝাচ্ছি এখন আমি ছুটি নিতে পারব না , আর তাছাড়া আমিতো বলেইছি এই মুহুর্তে আমার পক্ষে বিয়ে করা সম্ভব নয় , মা ততই নাছোড়বান্দা । অবশেষে মাকে বললাম -- আমি অফিসে খোঁজ নিয়ে দেখছি , যদি ছুটির ব্যবস্হা করতে পারি , তবে আমি আসার চেষ্টা করব । মা শুনে খুব খুশি তার সঙ্গে আর একটা সুখবর আমাকে দিল , এই শ্রাবণের একেবারে শেষে তোর মামাতো ভাইয়ের বিয়ে । তুই তাহলে চলে আয় মামাতো ভাইয়ের বিয়েতে ও থাকতে পারবি ।   

শ্রাবণ মাস । কলকাতায় সেদিন সারা দিন - রাত ধরে বৃষ্টি হয়েই চলছে । সেদিন বোম্বের ট্রেন প্রায় ৮ ঘন্টা লেট করে বিকেলবেলা কলকাতায় এসে পৌছালো । কোন রকমে বাড়ীতে পোশাক পাল্টে একেবারে সোজা মামা বাড়ীতে পৌঁছে গেলাম । আজই আমার মামাতো ভাইয়ের বিয়ে । বরযাত্রী হয়ে যখন কনে বাড়ীতে পৌছালাম , তখনও শ্রাবণের ধারা হয়েই চলেছে । তারই মধ্যে আলোয় আলোয় বিয়ে বাড়ীটা ঝলমল করছে । ভেসে আসছে সুন্দর সানাইয়ের সুর । চারিদিকে এক আনন্দের পরিবেশ । একটা সময় শঙ্খ আর উলুধ্বনির মধ্যে দিয়ে মুখ ঢাকা অবস্থায় কনেকে বিবাহ আসরে নিয়ে আসা হোল । মুখটাকে ঢেকে রেখেছে কিন্তু ঠোঁটের কোণায় মিটিমিটি লাজুক হাসি । আমি আমার মামাতো ভাইয়ের পাশেই রয়েছি । কনের মুখের ঢাকনাটা সরাতেই নিজের অজান্তেই চমকে উঠে মুখ থেকে বেরিয়ে এল --- নন্দিতা !!!  নন্দিতার সঙ্গে চোখে চোখ পরতে লক্ষ করলাম -- নন্দিতার মুখের হাসি - হাসি ভাবটা মূহুর্তের মধ্যে যেন মিলিয়ে গেল ..... । কাউকে কিছু না জানিয়ে চুপিসারে বিবাহ আসর থেকে সরে এসে জানালার ধারে একটা চেয়ার নিয়ে বসলাম । বাহিরে তখনও বৃষ্টি হয়েই চলেছে সঙ্গে মেঘের গর্জন । মনে পরলো  -- নন্দিতার সঙ্গে যাত্রাপালায় সেই দৃশ্যের কথা .... আমি গাইছি কাজী নজরুলের সেই বিখ্যাত গানটি -- 

শাওনো রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে 
বাহিরে ঝড় বহে নয়নে বারি ঝরে ........ 

সমস্ত দর্শকের তখন চোখে জল । ...... হটাৎ অনুভব করলাম আজ এত বছর পর আমারই দুগাল বেয়ে ঝরে চলেছে যেন শ্রাবণের অশ্রু ধারা .....উপলব্ধি করলাম , সেদিন সমস্ত সংকোচ আর লোকলজ্জার ভয়কে দূরে সরিয়ে আমার মনের সত্যি কথাটা নন্দিতাকে যদি বলতে পারতাম , তাহলে হয়তো ....আজকের রাতের এই অনুষ্ঠানের সাক্ষী হতাম না । 
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মোঃ মাইদুল সরকার গল্পটা সত্যিই মনে রাখার মত।
ভালো লাগেনি ২২ ফেব্রুয়ারী, ২০২১
juham ভালো লাগল গল্প খানি পড়ে। ভোট রাখলাম। আমার পাতায় নেমন্তন্ন রইল। দয়া করে ভোট রাখবেন।
ভালো লাগেনি ১৯ ফেব্রুয়ারী, ২০২১
অনেক ধন্যবাদ ।
ভালো লাগেনি ২০ ফেব্রুয়ারী, ২০২১
ফয়জুল মহী খুব সুন্দর অনুভূতির নিখুঁত কাব্য নির্মাণ, মুগ্ধতায় ছুঁয়ে গেলো মন। ভালোলাগা আকাশসম। শুভকামনা নিরন্তর
ভালো লাগেনি ৬ ফেব্রুয়ারী, ২০২১
অনেক ধন্যবাদ
ভালো লাগেনি ৬ ফেব্রুয়ারী, ২০২১

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

পুরোনো এক ভালবাসার স্মৃতিকে নিয়ে আজকের এই গল্পটি ।

১২ আগষ্ট - ২০১৭ গল্প/কবিতা: ৪৮ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪