এই কাহিনীর সময়কাল দেশ স্বাধীনতা লাভ করবার অনেক পূর্বের ..............
অপূর্ব সৌন্দর্যে বেষ্টিত দক্ষিণ ভারতে অবস্থিত একটি প্রাচীন গ্রাম । চারিদিকে সবুজ গাছের সমারহ আর বারোমাস গাছগুলিতে নানা ধরনের পাখিদের কলরব । একটু দূরে তাকালে চোখে পড়ে ঢেউ খেলানো উঁচুনিচু পাহাড়ের সারি । বর্তমানে সরকারি উদ্যোগে গ্রামের রাস্তাগুলি আগের তুলনায় এখন কিছুটা উন্নত । রাস্তাগুলি এঁকেবেঁকে গ্রামের মধ্যে দিয়ে দূরের পাহাড়ের পাশ দিয়ে চলে গিয়ে মিলিত হয়েছে বড় সড়কের সঙ্গে । এই বড় সড়কের পথ ধরে বেশ খানিকটা চলার পর পৌঁছে যাওয়া যায় সাগরের বিস্তীর্ণ সৈকতে । একদিকে পাহাড় , অন্য প্রান্তে সাগরের বেলাভূমি - প্রকৃতি যেন তার সৌন্দর্য্যের ভান্ডার একেবারে উজাড় করে দিয়েছে এখানে ।
এই গ্রামটিতে বেশিরভাগ লোক অত্যন্ত গরিব আর নিম্নবিত্ত সম্প্রদায়ের । একেবারে সরল সাদাসিধে জীবনযাত্রা কিন্তু এখানকার বেশিরভাগ পরিবার বংশানুক্রমে কুসংস্কার গ্রস্ত । নানা বিধ কাজে নানা ধরনের নিয়ম । এই কুসংস্কারের সুযোগের সুবিধা ব্যবহার করে একশ্রেণীর উচ্চবৃত্ত সম্প্রদায়ের অসৎ লোক কুসংস্কারের ভয়ভীতি দেখিয়ে এসমস্ত অসহায় লোকেদের আর কুসংস্কারের গভীরে নিক্ষেপ করে , সর্বদা লোলুপ দৃষ্টি দিয়ে খুঁজতে থাকে এদের অসহায় আর দুর্বল জায়গাগুলি । গ্রামের মধ্যে বিশাল এক চত্বর জুড়ে বিরাট একটি মন্দির । গ্রামের উচ্চবৃত্ত লোকেরা এটিকে পরিচালনা করে । গ্রামবাসীদের ধারনা স্বয়ং ভগবান মন্দিরের বিগ্রহগুলিতে বিরাজ করেন । মন্দিরের প্রধান পুরোহিতের কথাই হচ্ছে স্বয়ং ভগবানের আদেশ । খুব ভোরে প্রায় প্রত্যেক গ্রামবাসী মন্দিরের দেবতাদের উদ্দেশে ভক্তিভরে প্রণাম জানিয়ে তাঁদের দৈনন্দিন জীবনের কাজকর্ম শুরু করে ।
এই গ্রামে কিছুদিন আগে সরকারের তরফ থেকে গ্রামের উন্নতি দেখভাল করবার জন্য নতুন পোস্টিং নিয়ে এসেছেন শৌভিক সেন । শান্ত , সৌম্য , ভদ্র , শৌভিক সেনের বয়স প্রায় ৫০ এর কাছাকাছি । এর আগে বিভিন্ন গ্রামে কাজ করবার সুবাদে গ্রামের জীবনযাত্রা , তাঁদের মানসিকতা সম্পর্কে তিনি অনেকটাই পরিচিত । সাধারণত গ্রামগুলিতে হত দরিদ্র পরিবারদের উপর নিরক্ষরতার সুযোগ নিয়ে এক শ্রেণীর লোক কুসংস্কারের ভয় দেখিয়ে নানা ভাবে শোষণ , নিপীড়ন করে , সেটা তিঁনি জানেন । কিছু প্রচলিত কুপ্রথার কথা তিনি আগেই শুনেছিলাম আর এই গ্রামে এসে প্রত্যক্ষ ভাবে দেখলেন দারিদ্র্য আর অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে এক অশ্লীল বর্বর প্রথার অত্যাচার কুমারী মেয়েদের উপর হয়ে চলেছে ।
প্রায় প্রতিদিন ভোরবেলা প্রাতঃভ্রমনের সময় শৌভিক সেন দেখতে পান একজন অপরূপ সুন্দরী মহিলা পরিষ্কার সাদা থান পরে হাতে ফুলের ডালা নিয়ে গ্রামের মন্দিরে যেতে । বয়স আনুমানিক ২৭/২৮ বছর । তার সারা শরীরটায় যৌবনের ঝলকানি । মনে হয় স্বর্গ থেকে কোন অপ্সরা নেমে এসে উদ্দাম যৌবনের পরশ ছড়িয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছে মন্দিরের দিকে । শরীরের প্রতিটি ভাঁজে ভাঁজে উপচে পরা যৌবনের মাদকতার ছোঁয়া ।
প্রায় প্রতিদিন ভোরে এই দৃশ্য দেখে কিছুটা কৌতূহল বশত একদিন শৌভিক সেন এই গ্রামের বহু পুরনো লোক বর্তমানে গ্রাম্য প্রধানকে এই ঘটনার কথা উল্লেখ করতে , গ্রাম্য প্রধান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন -- সে এক করুন কাহিনী ........ কয়েকপুরুষ ধরে এই মেয়েটির পরিবার এই গ্রামে বসবাস করছে । এদের পরিবার এই গ্রামে খুবই দরিদ্র আর তথাকথিত সমাজের নিয়ম অনুসারে খুবই নিম্নজাতের আর এদের হাতে গ্রামের অনেক লোকজন জল পর্যন্ত খায় না । ভগবান যখন রূপ দেন তখন জাত বিচার করেন না । খুব ছোট থেকেই মেয়েটি খুব সুন্দরী । আর এটাই হলো তার সর্বনাশ । চরম দারিদ্র্য আর অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে কিছু উচ্চ বর্ণের লোকের লালসার শিকার হয়ে মেয়েটি পরিণত হল মন্দিরের একজন " দেবদাসী " রূপে । মেয়েটির নাম -- সাজবাতি ।
বহু পুরোনো এই " দেবদাসী " প্রথার সঙ্গে জড়িত ছিল সমাজের চরম দারিদ্র্য , জাতিভেদ আর কিছু স্বার্থান্বেষী লোকেদের মদত । সমাজে নিচু জাতের অসহায় পরিবার গুলির দারিদ্রের সুযোগ নিয়ে উচ্চ বর্ণের লোকজন তাদের দুষ্ট চক্রের মাধ্যমে খুঁজে বেড়াত এই সমস্ত দারিদ্র্য পরিবারের সুন্দরী কুমারী মেয়েদের । এদেরকে ধর্মের ভয় আর অর্থের লোভ দেখিয়ে নিয়ে আসা হত মন্দিরে । একটা সময় মন্দিরের প্রধান পুরোহিত উৎসর্গ করার নামে মন্দিরের বিগ্রহের সঙ্গে কুমারী মেয়েটিকে বিয়ে দিয়ে দিতেন । এর পর অন্য কোন পুরুষ ওই মেয়েটির স্বামী হতে পারত না । মন্দিরের কাজকর্ম করে খাওয়া-থাকার বিনিময়ে মন্দিরে থেকেই তাদের সারাটা জীবন কেটে যেত দেবদাসী হয়ে । করতে হত অমানুষিক পরিশ্রমের কাজ । উৎসর্গের পর দেবদাসীকে ভোগ করার প্রথম অধিকার থাকত মন্দিরের প্রধান পুরোহিতের । এরপরে মন্দিরের অন্য পুরুষদের যৌন লালসার শিকার হতে হতো ।
সাজবাতি যখন এই মন্দিরে দেবদাসী হয়ে দেবতার উদ্দেশ্যে উৎসর্গিত হল তখন তার অল্প বয়েস , এই অল্প বয়সেই তার সারা শরীর থেকে যৌবন একেবারে উপচে পড়ছে । অশ্লীল প্রথা অনুযায়ী এক ঝড়-জলের রাতে তার বাবার থেকেও বয়সে অনেক বড় মন্দিরের প্রধান পুরোহিত সাজবাতির শরীরটাকে হিংস্র পশুর মত খুবলে খেয়ে যৌন চাহিদা পূরণ করল । সাজবাতির বয়স তখন ১৫ আর মন্দিরের প্রধান পুরোহিতের বয়স প্রায় ৬০ এর কাছাকাছি । এর কিছুদিন পর জানা গেল সাজবাতি অন্তঃসত্ত্বা , ৬০ বছর বয়সের প্রধান পুরোহিতের লালসার শিকার হয়ে । সেইসময় সমাজের নিয়ম অনুযায়ী প্রধান পুরোহিত কিংবা উচ্চ সম্প্রদায়ের লোকেদের বিরুদ্ধে নিচু জাতের অসহায় মানুষদের বলার কোন অধিকার ছিল না । ক্রমে এল সেই ভয়ংকর দিনটি । লালসার শিকার হয়ে অল্প বয়সী সাজবাতি প্রসব করল এক পুত্র সন্তানের । কিন্তু সন্তানের জন্মাবার কিছুক্ষণ পরে দুজনের শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকলো আর একটা সময় সাজবাতি সুস্থ হয়ে উঠলেও তার সন্তানটিকে বাঁচানো গেল না ।
গ্রামের এই সমস্ত অসহায় দারিদ্র পরিবার গুলিকে কুসংস্কার আর ধর্মের ভয় এমন ভাবে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় যাতে তারা শত বিপদের সময় এই চক্র থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না । সাজবাতির ক্ষেত্রে ও ঘটল সেই একই ঘটনা । তার এই অল্প বয়সের ভরা যৌবনের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তথাকথিত উচ্চ সম্প্রদায়ের অনেক লোক এই অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে অনেক রকম কুপ্রস্তাব দিতে লাগল । সদা ছটপটে বালিকা সাজবাতি এই ঘটনা ঘটার পর হঠাৎ করে যেন বড় হয়ে গেল । সদা ছটপটে ভাবটা উধাও হয়ে এখন সে শান্ত , গম্ভীর আর চাল-চলনে ও অনেকটা পরিবর্তন এনে দিলেও ধর্মের ভয়ে কুসংস্কারের জীবন থেকে বেরিয়ে আসতে পারলো না ।
যে লোকটার লালসার শিকার হয়ে একটা সময় সে গর্ভবতী হয়ে পরে , সেই বৃদ্ধ পুরোহিতকে সে মনে মনে স্বামী হিসেবে মেনে নেয় । একটা সময় বয়েসের ভারে সেই পুরোহিত মারা যায় । আর সাজবাতি দেবতা জ্ঞানে সেই লোকটাকে স্বামীর আসনে বসিয়ে রোজ সকালবেলায় স্নান করে শুদ্ধ মনে বাগান থেকে ফুল তুলে মালা গেঁথে মন্দিরে গিয়ে সেই পুরোহিতের ফটোটায় পরিয়ে দিয়ে ভক্তি ভরে প্রণাম নিবেদন করে ।
গ্রাম্য প্রধানের থেকে সাজবাতির এই কাহিনী শোনার পর শৌভিক সেন ভাবছিলেন গ্রামের এই নিচু জাতের দরিদ্র পরিবারগুলি কতটা অসহায় আর ধর্মের , কুসংস্কারের ভয় দেখিয়ে এদের প্রতিনিয়ত শোষণ করে চলেছে এই সমাজের এক শ্রেণীর লোক । কবে এই দেবদাসী প্রথার বিলোপ হয়ে উদয় হবে এক নতুন সূর্য্য নতুন আলো ছড়িয়ে ............
সমাজের অসহায় লোকেদের নিয়ে এই কাহিনী লিখবার প্রয়াস ।