সমগ্র ঘটনাটি গভীর ভাবে বিশ্লেষণ করে পুলিশের তদন্তকারী দলটির আর বিশিষ্ট মনোবিদদের সুচিন্তিত অভিমত , রোশনলাল যাদব জীবনের অনেকটা সময় যে পেশাতে নিযুক্ত থেকে কাজগুলি করেছিল এটি সেই কাজের তীব্র অনুশোচনার প্রতিফলন । তানাহলে , এভাবে ভীষণ কষ্টদায়ক স্বেচ্ছা মৃত্যুকে বেছে নেয়া ভাবাই যায় না .....। তাঁদের আরো অভিমত , রোশনলাল অনেকদিন থেকেই বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডার , সিজোফ্রেনিয়া রোগে ভুগছিল । তার পেশাজনিত পূর্বের করা ভয়ংকর কাজগুলির কথা সে দিনরাত চিন্তা করতে করতে মানসিক ভাবে মনের দিক থেকে ভীষণ ভাবে ভেঙ্গে পরে আর এর ফলে পরিস্থিতি দিনদিন আরো খারাপ হতে থাকে আর মনেমনে ভাবে এর থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় নিজেকে মেরে ফেলা । এই চিন্তায় তাড়িত হয়ে অবশেষে সে একান্ত নিরুপায় হয়ে আত্মহত্যার পথকে বেছে নেয় । মনোসমীক্ষণের জনক সিগমুন্ড ফ্রয়েডের মতে - " যখন মানুষের নিজ কৃতকর্মের প্রতি সৃষ্ট তীব্র রাগ ও আক্রমণাত্মক মনোভাব নিজের প্রতি ধাবিত হয় , তখন মানুষ আত্মহত্যা করে । "
রোশনলাল যাদবের মৃত্যুর আগে লেখা শেষ চিঠিটা বিশ্লেষণ করলে প্রমান করে সে দীর্ঘদিন ধরে নিজেই নিজের জীবনের সঙ্গে সংঘাত আর যুদ্ধ করে গেছে । পারিবারিক লোকজনের সঙ্গে মনোবিদরা বিভিন্ন ভাবে কথা বলে জানতে পেরেছেন রোশনলাল দীর্ঘদিন ধরে অবসাদে ভুগছিল । খাওয়া দাওয়া কম করতো । বাড়ির লোকজনের সঙ্গে প্রয়োজন ছাড়া বিশেষ কথা বলতো না । প্রকৃত কারনের কথা জিজ্ঞেস করলে প্রায়শই এড়িয়ে যেত । দিনরাত ব্যাস্ত থাকতো নিজের কাজ নিয়ে । পূর্বের পেশার কাজ ছাড়ার পর নিজের বাড়িতে একটা বড় ঘরে একা একা তৈরী করতো নানা ধরনের " কফিন বাক্স " । কোনটা সাধারন , কোনটা দামি আবার কোনটা অনেক দামি । মহাজনদের চাহিদা মত এই " কফিন বাক্স " গুলি দেশের বিভিন্ন স্থানে চালান হতো । মৃত মানুষদের " দাফন " করবার কাজে ।
রোশনলালের বয়স এখন আনুমানিক ৭০ এর কাছাকাছি । প্রকৃত সঠিক বয়স কারুর জানা নেই এমনকি নিজেও জানে না । আগের চেহারার সঙ্গে এখনকার চেহারার আকাশ পাতাল তফাত । আগের সেই দশাসই কাল দৈত্যের মত ঘন দাড়ি বেষ্টিত এক ক্রোধযুক্ত ভয়ংকর মুখ । চোখদুটি জবাফুলের মত লাল । শুধু তাকে দেখলেই লোকে ভয়ে কাঁপতে থাকত । যখন এই লৌহ মানব বজ্রমুষ্টি হাতে তার পূর্বের পেশার কাজ করতো , তখনই লোক তাকে দেখেই প্রায় অর্ধ মৃত হয়ে যেত । এই কাজ করতে তার হাত একেবারেই কাঁপতো না । শরীরের দয়া মায়া বস্তুটি কোন সময় উদয় হতো না । তখনকার সময় আড়ালে লোকেরা তাকে বলতো - " পিশাচ জল্লাদ " । ব্রিটিশ শাসক তার কাজের গুনে তারিফ করে আদর সহকারে ডাকতো --" Dear Hangman " । এই ফাঁসি দেবার কাজের জন্য তার মত গুণধর (!!!!!) , পারদর্শী জল্লাদকে সরকারের তরফ থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাঠনো হতো । রোশনলালের বাবা , দাদু তারাও ছিল ব্রিটিশ সরকারের নামকরা ফাঁসুরে বা জল্লাদ । এদের হাত দিয়ে বহু মানুষকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছে । বাপ , দাদুর কাজের ধারাবাহিকতা মেনে রোশনলাল এই কাজকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়ে কত লোককে যে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছে তার হিসাব এখন সে নিজেই জানে না ।
১৯৩৪ সালের কোন একটা সময় । রোশনলাল ব্রিটিশদের থেকে জানতে পারলো একজন কুখ্যাত ( ব্রিটিশদের ভাষায় ) বিপ্লবীর ফাঁসি হবে , সে যেন প্রস্তুত থাকে । সাধারণত ব্রিটিশ আইন মোতাবেক ফাঁসুরে আগে থেকে জানতে পারত না ফাঁসির আসামির নাম , পরিচয় । রোশনলালের কাছে কোন লোককে ফাঁসিতে ঝোলানো কোন ব্যাপারই নয় , কত লোককেই সে ফাঁসি দিয়েছে । ফাঁসির আয়োজন সব ঠিকঠাক করে নির্দিষ্ট দিনে , নির্দিষ্ট সময়ে ফাঁসির মঞ্চে হাজির হয়েছে কাজ সিদ্ধি করবার জন্য । আজকের ফাঁসির ব্যাপারটা তার একটু অন্যরকম লাগল । প্রচুর পুলিশ চতুর্দিকে মোতায়েন করা হয়েছে । জেলের বাহিরে থেকে অনেক জনতার একটা তীব্র কোলাহল কানে আসছে । একটা সময়ে ফাঁসির স্থানে উচ্চপদস্থ আধিকারিকরা সবাই উপস্থিত । চারজন সেপাই পিছন করে হাত বাঁধা অবস্থায় ফাঁসির আসামিকে ধরে নিয়ে এসে ফাঁসির মঞ্চে ফাঁসুরের হাতে তুলে দিল । সময় এগিয়ে আসছে । রোশনলাল একেবারে আসামির মুখের সামনে গিয়ে প্রথা অনুযায়ী গলা অবধি নেমে আসা কালো টুপিটা পরাতে গিয়ে হটাৎ আসামির তেজস্বীপূর্ণ চেনা মুখটা দেখে আৎকে উঠে তার হাত দুটো কেঁপে উঠলো , যেটা তার ফাঁসি কার্যকর করার সময় কোন সময় হয়নি । যে হাত দিয়ে কপিকলের লিভারে টান দেবে , সেটা যেন অবস হয়ে আসছিল । ব্রিটিশ শাষকদের তাড়নায় কোনরকমে কালো টুপিটা আসামির মুখে পরিয়ে দিয়ে হাতজোড় করে ভক্তি সহকারে তাঁকে বললো --- আমার এই পাপ কাজের জন্য আমাকে ক্ষমা করে দেবেন । আমি শুধু সরকারি ডিউটি করছি মাত্র । মুখ ঢাকা অবস্থায় এক বলিষ্ঠ স্বরে তিঁনি বললেন --- আমি জানি তোমার কোন দোষ নেই । ভগবান তোমার মঙ্গল করুক । আমি প্রস্তুত । আর তারপরেই সব শেষ .....। এই প্রথম " পিশাচ জল্লাদের " চোখ থেকে অঝোরে জলের ধারা নেমে এলো । তার মনে একটা কথা বিদ্ধ করল এতদিন ব্রিটিশ সরকারের মিথ্যে মামলায় জড়ানো নিরাপরাধ ভাল ভাল মানুষগুলিকে মৃত্যু যন্ত্রনার পৈচাশিক কষ্ট দিয়ে সে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছে । আর সেদিনই মনেমনে শপথ করে এটাই হলো তার জীবনের শেষ ফাঁসি দেওয়া । কোনদিনও এই জল্লাদের কাজ আর করবে না ।
জল্লাদের কাজ ছেড়ে দেবার পর রোশনলাল যাদবের জীবন ধারাটাই পুরোপুরি বদলে গেল । নিজের মনে মাঝে মাঝে বিড়বিড় করে । আগের সেই ভয় পাওয়া কালো দৈত্যের মতন চেহারাটা আর নেই । এখন রোগা শীর্ণকায় চেহারা । শুভ্র কেশ , মুখে একগাল পাকা দাড়ি । চোখে হাই পাওয়ারের চশমা । বয়েসের ভারে একটু বেঁকে গেছে । লাঠির উপর ভর দিয়ে কোনরকমে চলাফেরা করে । পরনে ময়লা কুর্তি-পায়জামা । প্রায় সারাদিন একমনে চশমাটা নাকের ডগায় নামিয়ে কফিন বাক্স তৈরী করছে পেরেক ঠুকে ঠুকে । বাড়ীর লোকেরা তার সঙ্গে কথাবার্তার মাধ্যমে জানতে পেরেছে সে এখন একটা বিশেষ ধরনের কফিন বাক্স তৈরিতে ব্যস্ত আছে যেটা হবে তার জীবনে তৈরি করা শ্রেষ্ঠ কফিন বাক্স । প্রতিদিন সারারাত ধরে কফিন বাক্স তৈরিতে পেরেক পোতার ঠুকঠুক আওয়াজ পাওয়া যায় ।
বেশ কিছুদিনের পর একদিন মাঝ রাতের পর থেকে বাড়ীর লোকেরা আর কফিন বাক্স তৈরি করার শব্দ শুনতে পায় না । ভাবলো , হয়তো কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে রোশনলাল ঘুমিয়ে পরেছে । রাত শেষ হয়ে সকাল হোল তবুও রোশনলালের ঘরের দরজা বন্ধ । একটু বেলা হতে দরজা ধাক্কিয়ে না খোলাতে , লোকজন আর পুলিশ ডেকে দরজা ভেঙ্গে ঘরে ঢোকা হলো । বড় ঘরটায় কফিন বাক্স সব তৈরি করে সাজানো রয়েছে । সামনে একটা কারুকার্য করা কফিন বাক্স রাখা রয়েছে যেটা সে অনেকদিন ধরে নিজের মনের মতো করে বানিয়েছে । কিন্তু ঘরের ভেতরে কোথাও রোশনলালকে দেখতে পাওয়া গেল না । পুলিশের লোকজন খোঁজাখুঁজি করে না পেয়ে সন্দেহবশত সুসজ্জিত নতুন কফিন বাক্সটি সরাতে গিয়ে ভার ভার ঠেকলো । বাক্সের দরজাটা খুলতে গিয়ে দেখা গেল ভিতর থেকে লক করা রয়েছে । কফিন বাক্সের পাল্লাটি ভেঙ্গে ফেলা হোল , কফিন বাক্সের মধ্য দেখা গেল রক্তাক্ত অবস্থায় সারা শরীরে ছুঁচোল পেরেক বিদ্ধিত রোশনলাল যাদবের মৃতদেহ । ভাল করে পরীক্ষা করে দেখা গেল সারা কফিনের বাক্সের ভিতরে ধারালো ফলার মত বড়ো বড়ো পেরেক বসানো । লকটা এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে ভিতরে ঢুকে পাল্লাটা টানলেই অটোমেটিক লক হয়ে যাবে । সারা শরীরে বড়ো বড়ো ধারালো পেরেক ঢুকে অনেক সময় নিয়ে তীব্র যন্ত্রনায় ছটফট করে রোশনলালের মৃত্যু হয়েছে । কফিন বাক্সের মধ্যে তারই হাতে লেখা একটি চিঠি ------
আমি যাদের ফাঁসিতে ঝুলিয়েছি তাঁদের আত্মাদের উদ্দেশ্যে ,
জীবনে অনেক নিরঅপরাধ লোককে মৃত্যু যন্ত্রনা সহকারে আমি ফাঁসিতে ঝুলিয়েছি । এখন এই প্রৌঢ় বয়েসে এসে উপলব্ধি করি বাপ , ঠাকুরদার পেশাতে এসে আমি ঠিক কাজ করি নি । একাজ আমার জন্য নয় । এই অনুশোচনা আমাকে দিনরাত তাড়িত করতো । দেশপ্রেমি , অসহায় , বিপ্লবী , নিরঅপরাধ লোকেদের ভয়ংকর মৃত্যু যন্ত্রনা সহকারে ফাঁসি দিয়ে আমি শুধু অপরাধই করি নি , এখন মনে হয় আমি তাঁদের নিজ হাতে পিশাচের মত হত্যা করেছি । এক অজানা ভয়ে আমি সবসময় ভীত হয়ে থাকি , বিশেষকরে রাত হলেই আমাকে এসে গ্রাস করে আমার হাত দিয়ে ফাঁসিতে ঝোলানো সেই করুন , অসহায় মুখগুলোর কথা । রাতে আমি ঘুমোতে পারি না । মনে হয় মৃত লোকগুলির আত্মারা চিৎকার করে আমাকে বলে --- " বড় কষ্ট , বড় কষ্ট ......" । সবাই আড়ালে আমাকে " পিশাচ জল্লাদ " বলে ঘৃনা করত । নিজের মনের সঙ্গে অনেক যুদ্ধ করে আমি ঠিক করেছি এই পাপের প্রায়চিত্ত করতে চাই । কিন্তু কি ভাবে করব সেটাই ভেবে উঠতে পারতাম না । অবশেষে সিদ্ধান্ত নিই আমি যে ভাবে লোকেদের মৃত্যু যন্ত্রনা দিয়ে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছি , আমিও সেই ভাবে কষ্ট পেয়ে মৃত্যুবরণ করতে চাই । তাই এই ভাবে মৃত্যুকে বেছে নিলাম । মহান আল্লাহ , ভগবান , প্রভু যীশুর কাছে আমার এই কর্মের জন্য ক্ষমা চাইছি । আমি বিশ্বাস করি মহান করুণাময়ের কাছে ক্ষমা চাইলে তাঁরা আমাকে ক্ষমা করে দেবেন ।
ইতি -- রোশনলাল যাদব
পুনশ্চঃ আমার এই মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয় ।
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
হটাৎ করেই লেখাটির ভাবনা মাথায় আসে । একটি ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয় । এবারের সংখ্যার বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে লেখাটিকে নতুনভাবে পরিমার্জিত করে লিখবার চেষ্টা করছি ।
১২ আগষ্ট - ২০১৭
গল্প/কবিতা:
৪৮ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ জানুয়ারী,২০২৫