আতঙ্ক

নবান্ন (অক্টোবর ২০১৯)

বিশ্বরঞ্জন দত্তগুপ্ত
  • 0
  • ৭৫
ঘটনাটা সকলের কাছে একেবারেই অপ্রত্যাশিত । আজকের এই উৎসবের দিনে এইরকম যে ঘটতে পারে সেটা কেউ কল্পনাই করতে পারে নি । ঘটনাটা ঘটে যাবার পর ভয়ংকর ক্রোধে আর ততোধিক ভয়ে রুইদাশ একেবারে বাকরুদ্ধ , দিশেহারা । তাঁর সারা শরীর দিয়ে যেন আগুনের ঝলকা বেরোচ্ছে । একটা সময় শরীরের সমস্ত শক্তি হারিয়ে কাঁপতে কাঁপতে ধপ করে মাটিতে বসে পরলেন । একটুক্ষণ পর হাপুস নয়নে কাঁদতে কাঁদতে কোনক্রমে কাঁপাস্বরে গলার আওয়াজ বের করে বললেন -- গোবিন্দ , এ তুই কি করলি বাপ ? আজ যে আমাদের মহাউৎসব - " নবান্ন উৎসব " , আমাদের কাছে খুব পবিত্রের দিন । আমরা হচ্ছি বংশানুক্রমে কৃষক পরিবার । আজ " নবান্ন উৎসবে " সারা বাড়ী-ঘরে উৎসবের আয়োজন । সারা বছর ধরে এই দিনটার জন্য আমরা অপেক্ষা করে থাকি । আর আজকের এই রকম একটা শুভ দিনে তুই রাগ করে এইরকম একটা কান্ড করে বসলি বাপ ? বয়স আমার প্রায় চার কুড়ি পেরিয়ে গেছে । বয়েসের ভারে আজ আমি প্রায় অথর্ব । মৃত্যু আমার শিয়রের কাছে । ভেবেছিলাম তোরা সবাই সুখে থাকবি এটা জেনে আমি শেষ নিঃশ্বাসটা ফেলতে পারব , সেটা তুই আর হতে দিলি না বাপ । আমার ভীষণ ভয় হচ্ছে আবার যদি সেই ভয়ংকর অভিশাপ নেমে আসে আমার এই সাজানো সংসারে । যাদেরকে আমি এই সংসারে রেখে যাব , তাদের কি হবে ? কাঁপতে কাঁপতে হাতের লাঠিটার উপর কোনক্রমে ভর করে আপনমনে বিড়বিড় করে আওড়াতে লাগলেন - অভিশাপ , অভিশাপ - এখনো চোখ বন্ধ করলে আমার সামনে ভেসে ওঠে ভয়ংকর সেই অভিশাপের স্মৃতি -----

পশ্চিমবঙ্গের এক প্রত্যন্ত গ্রাম " হলুদপুর " । গ্রামে বিভিন্ন ধর্মালম্বীদের বাস । নেই কোন জাতিভেদ , নেই কোন জাগড়াঝাঁটি । পুরো গ্রামটাই যেন একটি বৃহৎ পরিবার । প্রধান জীবিকা বলতে চাষাবাদ । প্রকৃতির অবদানে এই গ্রামটিতে বিভিন্ন মরশুমে নানা ধরনের ফসলে ভরা থাকে । গ্রামে বংশানুক্রমে উচ্চবিত্ত কৃষক পরিবার হচ্ছে - " মাহাতো পরিবার " । গ্রামের প্রায় অধিকাংশ জমির মালিক হচ্ছে এই - মাহাতো পরিবার । গ্রামের উন্নতিকল্পে , গ্রামের লোকেদের আপদে-বিপদে এরাই সব সময় অগ্রনী ভূমিকা নিয়ে থাকে । পরিবারের কর্তা নিধিরাম মাহাতো । তাঁর দুই ছেলে রুইদাশ আর কানাইদাশ আর বউ , ছেলে-মেয়ে , নাতি-নাতনি নিয়ে একেবারে আনন্দের এক ভরা সংসার । রুইদাশ বিচক্ষন , ধীরস্থির সবসময় চিন্তা , ভাবনা কি ভাবে মাটিতে ভালভাবে ফসল ফলানো যায় আর এই জন্য সে প্রায় সবসময় জমির পিছনে অমানুষিক পরিশ্রম করে থাকে আর ততোধিক বিপরীত তার ভাই কানাইদাশ । জমির কাজে বিশেষ টান নেই , একটু রগচটা গোছের । হটাৎ হটাৎ রেগে যাওয়া , খেয়াল খুশি মত ভাবনা চিন্তা করা আর সন্ধেবেলা ইয়ারের বন্ধুদের নিয়ে মদ সহকারে জুয়ার আসরে বসা ।

কার্তিক মাসের শেষ , অগ্রায়নের শুরু । " হলুদপুর গ্রামটির " সারা গায়ে সোনার ছড়াছড়ি , সোনার ফসল দিয়ে গ্রামটি মোড়া । এবারের ফলন আগের বছরের তুলনায় অনেকটাই বেশি । এই সময়টায় শুরু হয় সোনা ঝরানো নতুন ধানগুলি কাটার মরশুম । একে উপলক্ষে করে গ্রামে শুরু হয়ে গিয়েছে নানা ধরনের উৎসব । নতুন ধান কাটা আর সেই সঙ্গে প্রথম ধানের অন্নকে দেবতাদের উৎসর্গ করে খাওয়াকে কেন্দ্র করে ঘরে ঘরে পালিত হচ্ছে - " নবান্ন উৎসব " । বিশেষ করে গ্রামের হিন্দুরা এই নবান্ন উৎসবে প্রচলিত প্রাচীন প্রথা অনুযায়ী ঘর-বাড়ী সব সুন্দর করে সাজিয়েছে আর কথিত আছে এই উৎসবের অঙ্গ হিসাবে ধান থেকে প্রস্তুত চালের প্রথম রান্না " কাকের " মাধ্যমে পিতৃপুরুষ , দেবতাদের উৎসর্গ করার নিয়ম ।

নবান্ন উপলক্ষে " মাহাতো পরিবারের " বড় বাড়ীটায় ধুমধাম সহকারে উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে । ঘর-বাড়ী , উঠোন সব সুন্দর আলপোনায় সুসজ্জিত । প্রত্যেক বারের মত এবারও জাতিভেদ নির্বিশেষে গ্রামের প্রত্যেকের বাড়ীতে উৎসবের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে । নিজেস্ব ঠাকুর দালানের বিশাল চাতালে পূজোর আয়োজন চলছে । নতুন চালের প্রথম রান্না করা অন্ন রাখা রয়েছে একটা বড় হাঁড়িতে । বাড়ীর কূল পুরোহিত অন্নের হাঁড়িকে প্রণাম জানিয়ে বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণ করে পূজোর কাজ শুরু করেছেন । বাড়ীর প্রত্যেকে নতুন জামাকাপড় পরে আনন্দ সহকারে পূজোর কাজে ব্যস্ত । বাড়ীর কর্তা নিধিরাম মাহাতো নতুন গরদের ধুতি পরে পূর্ব পুরুষদের দ্বারা প্রতিষ্টিত দেবতার বিগ্রহের সামনে জোর হস্থে সকলের মঙ্গল কামনা আর সামনের বছরে আরও বাড়বাড়ন্ত ফলনের জন্য মনে মনে প্রার্থনা করে চলেছেন । পূজোর এই ব্যস্ততার মাঝে নিধিরাম খেয়াল করলেন এই নবান্ন উৎসবের পূজোয় পরিবারের সবাই উপস্থিত একমাত্র তাঁর ছোট ছেলে কানাইদাশ অনুপস্থিত ।

বাইরে একটা কোলাহলের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে । একটুক্ষ পর কানাইদাশ মদে একেবারে বেহুশ হয়ে পূজোর সামনে এসে বেসামাল কথাবার্তা আর অপ্রকৃতিস্থ আচরণ শুরু করলো । সবাই মিলে তাকে অনেক বোঝাবার চেষ্টা করেও বিফল হলো । একটা সময়ে নিধিরামের সঙ্গে তুমুল তর্কাতর্কি করতে করতে আচমকাই কানাইদাশ এক কান্ড করে বসলো । নেশার ঘোরে পূজোর সামনে রাখা নতুন চালের প্রথম রান্নার অন্নের হাঁড়িটায় সজোড়ে এক লাথি মারতে সমস্ত ভাতগুলি মাটির মধ্যে চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরলো । আচমকা এই ঘটনায় উপস্থিত সকলে একেবারে বাকরুদ্ধ । নিমেষের মধ্যে খবরটা ঠাকুর দালান থেকে বাড়ীর অন্দরমহল আর ক্রমে বিদ্যুৎবেগে সারা গ্রামে ছড়িয়ে পরলো ....। ঘটনার পর প্রচন্ড অসুস্থ বোধ করায় সবাই মিলে ধরাধরি করে নিধিরামকে ঘরে এনে শুইয়ে দিয়েছে । হটাৎ করেই তাঁর সারা গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে । নিধিরাম ঘরের দেয়ালে রাখা পিতৃপুরুষদের ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে আপন মনে বলে চলেছেন -- আমরা বংশানুক্রমে কৃষক । জমি হচ্ছে আমাদের কাছে দেবতা আর জমির ফলন হচ্ছে দেবতার দান । বাপ , ঠাকুর্দার থেকে শুনেছি তাঁদের পিতামহ , প্রপিতামহরা এই " হলুদপুর " গ্রামের খরা , শুকনো , চারিদিকে ফেটে যাওয়া জমিতে কি অমানুষিক পরিশ্রম করে ফসল ফলিয়েছেন আর ক্রমে ক্রমে অগ্রায়নের শুরুতে আমাদের সেই জমির ফসল সোনা ঝরাতে শুরু করেছিল । আজ গ্রামের এই সোনার ফসল আমাদের তথা গ্রামবাসীদের কাছে এক বিরাট গর্ব । আজকের এই ফসলের মহা উৎসবে কানাইদাশ নতুন চালের ভাতগুলি লাথি মেরে সব ফেলে দিল । হটাৎ চিৎকার করে বললেন -- এযে ঘোরতর অনাচার , বংশের কূলদেবতা নিশ্চই এই অন্যায় , অবিচার সহ্য করবেন না । শাস্তি আমাদের পেতেই হবে ......জ্বরের ঘোরে বিড়বিড় করতে করতে একটা সময় গভীর ঘুমে আছন্ন হলেন ।

গভীর রাত । বাড়ীর সবাই ঘুমিয়ে পরেছে । আজকের এই ঘটনায় পুরো বাড়ীর পরিবেশটা বেশ থমথমে । এক অজানা আতঙ্কে সবাই ভয়ে জড়োসড়ো । হটাৎ নিধিরামের এক বিকট চিৎকারে বাড়ীর সবাই জেগে উঠে নিধিরামের ঘরে গিয়ে দেখলো -- নিধিরাম খাটে বসে এক অসম্ভব ভয় মিশ্রিত চাউনি দিয়ে ভীষণ হাঁপাচ্ছেন । মুখের থেকে কোন কথা বলতে পারছেন না । সবার চাপাচাপিতে একটু ধাতস্থ হয়ে নিধিরাম বললেন -- তিনি এক ভয়ংকর , অতি ভয়ংকর স্বপ্ন দেখলেন -- তাঁদের কূলদেবতা একটা ধোঁয়ার মধ্য থেকে আবির্ভাব হয়ে প্রচণ্ড ক্রোধে এক রণচন্ডী মূর্তি নিয়ে আমাদের পরিবারের সবার উদ্দেশ্যে বলছেন -- এই সোনার ফসলের প্রথম রান্না করা ভাতগুলিকে তোরা লাথি মেরেছিস । আমি অভিশাপ দিচ্ছি -- আগামি পাঁচ বছর যে জমিতে তোরা সোনা ফলাতিস , সেসব জমিতে আর ফসল ফলাতে পারবি না । এই পাঁচ বছর ধরে তোদের এই পাপের প্রায়শচিত্ত করতে হবে । এটাই আমার বিধান , এটাই আমার অভিশাপ ............

............. বৃদ্ধ রুইদাশ গোবিন্দকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললেন - এ তুই কি করলি বাপ ? রাগ করে আজ " নবান্ন " উৎসবের দিনে নতুন চালের রান্না করা অন্নের হাঁড়িটা ধাক্কা দিয়ে ভাতগুলি সব ফেলে দিলি !! পূর্বের সেই পাঁচ বছরের অভিশাপ কাঁধে নিয়ে বেড়িয়েছি । শত চেষ্টা করেও পরিবারের কূলদেবতার অভিশাপের দারুন আমরা জমিতে পাঁচ বছর কোন ফসল ফলাতে পারি নি । কিভাবে আমাদের সেদিনের দিনগুলো কেটেছিল , সেটা একমাত্র ভগবানই জানেন । এবার আমি কি করব বাপ ? আবার যদি সেই পুরোনো অভিশাপ আমাদের পরিবারের মাঝে বর্ষিত হয় । এই বলে চোখের জল মুছতে মুছতে মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ভাতগুলি যত্নসহকারে তুলতে লাগলেন ।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মোঃ মোখলেছুর রহমান দাদা বেশ সময় নিয়ে পড়লাম,আমার কাছে চমৎকার উপস্থাপন মনে হল। শুভ কামনা রইল।
রঙ পেন্সিল ভোট বন্ধ। আফসোস থেকে গেলো।

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

নবান্ন উৎসব উপলক্ষে একটু নতুন ভাবনা নিয়ে এই গল্পটি লেখার চেষ্টা করছি ।

১২ আগষ্ট - ২০১৭ গল্প/কবিতা: ৪৫ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪