চারিদিকে একটা সাজ সাজ রব । আনন্দ উৎসবে প্লাবিত গোটা দেশ । চতুর্দিকে দেশার্তবোদক গান । নেতানেত্রীদের ভিড় আর তাঁদের নানাধরনের ভাষণ । আপামর জনসাধারন আনন্দ সহকারে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আজকের দিনটিকে স্মরণ করছে । অনেক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে এই দিনটিতে দেশ স্বাধীনতা লাভ করেছিল । বিপ্লবীরা আর পরাধীন দেশের মানুষজনেরা সবাই মনে প্রানে চেয়েছিলেন দেশের সমস্ত লোক পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন দেশে স্বাধীন ভাবে শোষণ মুক্ত হয়ে দাসত্বহীন জীবন নিয়ে যাতে ঠিকমত বাঁচতে পারে । সুন্দর এই আনন্দের দিনটিতে তবুও কোথায় যেন এক অদৃশ্য বিষাদের সুর ভেসে ওঠে ।
শহরের কেন্দ্রবিন্দুতে রেলওয়ে স্টেশনের চত্বর জুড়ে হাজার রকমের দোকানপাট , বাজারহাট , কোর্ট-কাছারি , স্কুল-কলেজ , হাসপাতাল আর তার ফলে প্রচুর লোকের জনসমাগম । এককথায় একেবারে জমজমাট স্টেশন এলাকাটি । স্টেশন চত্বর লাগোয়া বহু বছরের পুরনো এই হোটেলটি । হোটেলের সাইনবোর্ডে বড় বড় করে লেখা -- " ৭৫ বছর জনগণের সেবায় - রাখালদার গ্র্যান্ড হোটেল - সুস্বাদু খাবার পরিবেশনার একমাত্র বিশস্থ প্রতিষ্ঠান " স্বাধীনতা লাভের আগে থেকেই যখন হোটেলটি শুরু হয় তখন এখনকার মত এত রমরমা ব্যবসা ছিল না । হাতে গোনা গুটিকয়েক খরিদ্দার । ডাকাডাকি করে খরিদ্দার জোগাড় করতে হতো । বংশানুক্রমে চালানো হোটেলটি এখন আর পূর্বের মত অবস্থায় নেই । এখন দিবারাত্রি খরিদ্দারে একেবারে ভরপুর ।
ভোর পাঁচটার মধ্যে চা , ব্রেকফাস্ট দিয়ে শুরু হয়ে রাত প্রায় বারোটা অবধি রাতের খাবার পরিবেশন করে খরিদ্দার সামলাতে হয় । তারপর বাসন-কোসন , চেয়ার-টেবিল পরিষ্কার করে হোটেলটি বন্ধ হতে রাত প্রায় একটা বেজে যায় । সারাটা দিন অমানুষিক পরিশ্রম করে আর হোটেল মালিকের গালিগালাজ শুনে হোটেলে কাজ করা অল্প বয়সের ছোটছোট ছেলেগুলো এরপরে কিছুটা বিশ্রাম বা ঘুমোনোর সময় পায় হোটেলের টেবিলে বা বেঞ্চিতে ।
সকাল ১০ টা । হোটেলের ভিতরে প্রচুর খদ্দের । হোটেলের মালিক একটা উঁচু চেয়ারে বসে খদ্দের আপ্যায়নে ব্যস্ত । কর্কশ গলায় চিৎকার করে বললেন -- এই মন্টু , তুই টিভির দিকে তাকিয়ে কি দেখছিস ? ওটা তোদের দেখবার জন্য নয় । টিভিটা দেওয়ালে লাগানো হয়েছে খদ্দেরদের দেখবার জন্য । কাজ না করে টিভির দিকে তাকানো , তোকে দেখছি কয়েক ঘা না মারলে তোর শিক্ষা হবে না । মন দিয়ে শোন -- একনম্বর টেবিলে চারটে লিকার চা আর আট পিস ব্রেড অমলেট , তিন নম্বরে দু প্লেট ঘুঘনি আর চার নম্বরে দুটো মাছের মিল । নে , নে তাড়াতাড়ি কর । এত ঢিমে তালে কাজ করলে চলবে ? বেলা বাড়লে আর খরিদ্দারের ভিড় বাড়তে থাকবে । অল্প বয়সের মন্টু মালিকের ধমক খেয়ে কিছু না বুঝে আবার তার নিজের কাজে মন দিল ।
মন্টুর বাবা অখিল ছিলেন এই হোটেলের একজন কর্মী । অত্যন্ত সৎ , কর্মঠ আর পরিশ্রমী । উদয়অস্থ পরিশ্রম করতেন এই হোটেলের কাজে । দুবেলা আধপেটা খাবার আর মাসের শেষে হাতে পেতেন সামান্য কয়েকটা টাকা । একান্ত নিরুপায় হয়ে এই হোটেলে কাজ করে খুব কষ্ট করে সংসারটাকে টেনে নিয়ে যাবার চেষ্টা করতেন । পরিশ্রম অনুপাতে মাসের মাহিনা ছিল অতি নগন্য । একটাই আশা ছেলেকে ভালভাবে পড়াশুনা শিখিয়ে মানুষ করে তুলবেন । একটা সময় বাধ্য হয়ে স্ত্রীর এক কঠিন অসুখের চিকিৎসার জন্য মালিকের থেকে বেশ কিছু টাকা ধার করেছিলেন । এমনই দুর্ভাগ্য , কাজ করে টাকাটা শোধ দেবার আগেই এক ভয়ংকর পথ দুর্ঘটনায় শরীর থেকে দুটো পা বাদ দিতে হয় । অবশেষে আর কাজ না করতে পারার দরুন ধারের টাকাটা না দিতে পেরে মালিকের চাপে পরে ছোট আদরের ছেলেটাকে বাধ্য হয়ে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন মালিকের হোটেলে গতরে খেটে ধারের টাকা পুষিয়ে দেবে , এই প্রতিশ্রুতিতে । যে সময় ছোট ছেলেরা খেলাধুলা করে , স্কুলে যায় পড়াশুনা শিখবার জন্য সেই সময় অখিলের ছোট ছেলে মন্টুকে যেতে হয়েছিল হোটেলে কাজ করতে তার বাবার ঋণ করা টাকা শোধ করবার জন্য ।
বাবার ধার করা টাকা শোধ করতে না পারার দরুন ছোট মন্টুকে অমানুষিক পরিশ্রম করে কাজ করতে হয় । বিনিময়ে দুবেলা আধপেটা বাসী খাবার আর হোটেলের টেবিল , বেঞ্চিতে কিছু সময়ের জন্য রাতের বিশ্রাম । আসলে মন্টু একজন ক্রীতদাস । পরিষ্কার করে বলতে গেলে স্বাধীন দেশের আধুনিক ক্রীতদাস , " মর্ডান স্লেভ " ।
ফিবছর দুর্গাপুজোর সময় মন্টুর বয়েসী ছেলে-মেয়েরা বাবা-মার হাত ধরে নতুন নতুন জামা পরে সুস্বাদু খাবার খেয়ে মনের আনন্দে বিভিন্ন মন্ডপে ঠাকুর দেখে বেড়ায় । মন্টুকে তখন হোটেল মালিকের ধমক খেয়ে পুরনো ছেঁড়া জামা পরে অর্ডার অনুযায়ী খাবারের থালা হাতে নিয়ে খদ্দের সামলাতে হয় অথবা কারি-কারি এঠো বাসনগুলি মাঝতে হয় । তার জীবনে আনন্দের ছিটেফোঁটা নেই , আছে শুধু মালিকের গঞ্জনা আর অকারনে ক্রীতদাসের মত অত্যাচার ।
হোটেলটির পাশে একটি ঘরে সপ্তাহে দুদিন করে এক সেচ্ছাসেবী সংস্থার উদ্যোগে পথ ছেলে-মেয়েদের জোগাড় করে পড়াশুনা শেখানো হয় । মন্টুর খুব ইচ্ছে করে পড়াশুনা করতে । মালিকের কাছে এই বিষয়ে ইচ্ছা প্রকাশ করলে , মালিক ধমক দিয়ে তাকে বোঝায় পড়াশুনা করাটা মন্টুর মত ছেলেদের জন্য নয় , তার থেকে মন দিয়ে হোটেলের কাজ কর । তুই একটা কথা ভুলে যাস না তোর বাবা কিন্তু তার ঋণ শোধ করে নি । তোকেই গতরে খেটে সেই ঋণ শোধ করতে হবে । মন্টু ছেলেমানুষ অতশত মালিকের কথা বুঝতে পারে না । এইটুকু বুঝতে পারে এই হোটেলের অমানুষিক পরিশ্রম থেকে তার নিস্তার নেই । হয়ত এই ঋণ শোধ করতে তাকে আজীবন এখানে মালিকের অত্যাচারের মধ্য দিয়ে বেগার খেটে যেতে হবে । যদিও এতদিন তার বেগার খেটে পরিশ্রম করে তার বাবার ঋণ করা টাকাটা অনেক আগেই শোধ হয়ে যাবার কথা । আসলে স্বাধীনতা লাভের এত যুগ পরেও পরোক্ষভাবে মন্টু হোটেলের মালিকের কাছে এ যুগের একজন আধুনিক ক্রীতদাস ।
একটা সময় সেচ্ছাসেবী সংস্থার চাপে পরে পথ ছেলে-মেয়েদের নির্ধারিত স্কুলে মন্টুও যায় পড়াশুনা শিখবার জন্য । পড়াশোনা শিখবার ক্ষেত্রে মন্টুর আগ্রহ মাস্টারদের ভাল লাগে । মাস্টাররা ছেলে-মেয়েদের পড়াশুনা শেখাবার ফাঁকে ফাঁকে দেশ বিদেশের মহান লোকেদের জীবনের গল্প শোনায় । শোনায় তাঁদের বীরত্বের কাহিনী , দেশের প্রতি আত্মত্যাগের গল্প । দেশের নিপীড়িত , নির্যাতিত , শোষণের বিরুদ্ধে এই সমস্ত মহান লোকেদের গর্জে ওঠার কাহিনী । এই সমস্ত মহান লোকেদের জীবন কাহিনী শুনে এই পথ ছেলে-মেয়েদের নতুন করে ভাবতে শেখায় , নতুন করে তারা তাদের জীবনের অনেক স্বপ্ন দেখা শুরু করে ।
এইরকম ভাবে একদিন তারা তাদের মাস্টারদের থেকে জানতে পারে আর এক মহান ব্যাক্তিত্বের জীবন কথা । পৃথিবীর ইতিহাসে যে কয়েকজন মানবদরদী রাষ্ট্রনায়ক মানুষের স্বাধীন ভাবে অধিকার রক্ষার্থে আন্দোলনের মাধ্যমে নিপীড়িত , নির্যাতিত মানুষদের জন্য গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করেছেন , আমেরিকার আব্রাহাম লিংকন তাঁদের মধ্যে অন্যতম একজন । মাত্র ১৯ বছর বয়সে নিউ অর্লিয়েন্সে লিংকন প্রথম দেখেন নিগ্রো শিশু , পুরুষ , নারীদের মোটা শেকল দিয়ে বেঁধে রেখে দাস হিসাবে দরদাম করে বিক্রি করা হচ্ছে । বেয়াদপি দেখলে শুনতে হচ্ছে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ আর সারা গায়ে চাবুকের ঘা । তারপর বিক্রিত ক্রীতদাসদের দিয়ে করান হচ্ছে নিষ্ঠুর অমানবিক কাজ আর দিবারাত্রি পরিশ্রম । এই দৃশ্য দেখে তিনি স্থির থাকতে পারেন নি । তিনি ছিলেন ক্রীতদাস প্রথার ঘোরতর বিরোধী । তিনি মনে মনে সংকল্প করেছিলেন এই ক্রীতদাস প্রথার বিরুদ্ধে চরম আন্দোলন করে এই প্রথাকে একেবারে নির্মূল করবেন । তারপর তাঁর নেতৃত্বে কঠিন আন্দোলনের মাধ্যমে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১৮৬৩ সালের ১লা জানুয়ারীর এক সুন্দর সকালে মুক্তি ঘোষণার মাধ্যমে ক্রীতদাস প্রথার অবসান ঘটিয়ে ক্রীতদাসের মুক্ত করে দেন ।
মাস্টারদের থেকে এই কাহিনী শুনে মন্টু আর তার সহপাঠীরা ক্রীতদাস প্রথার সঠিক মানে না বুঝলেও এইটুকু বুঝতে পারে আজ স্বাধীন দেশের স্বাধীনতা দিবসে যেখানে সবার ঠিকমত অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকবার কথা , অথচ তাদেরকে এখনও ক্রীতদাসের মত বেগার খেটে সামান্য বাবার ঋণ করা টাকা শোধ করতে হচ্ছে । মন্টুও স্বপ্ন দেখে সেই স্বাধীনতা দিনের সুন্দর এক সকালের যেদিন আসবে এক নতুন ভোর আর এই ক্রীতদাসের মত বেগার খাটার শৃঙ্খল থেকে মুক্তি ।
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
দেশ আমাদের স্বাধীন হয়েছে । অথচ দেখা যায় দেশের বেশ কিছু সংখ্যক লোকজন পরাধীনতার গ্লানি নিয়ে জীবন ধারন করছেন । এই গল্পতে " মন্টুকে " সামনে রেখে সেই সমস্ত লোকজনদের কথা বলবার চেষ্টা করেছি ।
১২ আগষ্ট - ২০১৭
গল্প/কবিতা:
৪৯ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ মে,২০২৫