জমিদার - রাজশেখর রায় চৌধুরী

দাম্ভিক (জুলাই ২০১৮)

বিশ্বরঞ্জন দত্তগুপ্ত
  • ৪৭
এই গল্পের শুরুর সময়কাল বিংশ শতাব্দীর বিশের দশক । ক্ষুদিরাম , প্রফুল্ল চাকী , প্রমুখ মহান বিপ্লবীরা তখন শহীদ হয়েছেন । কুখ্যাত ব্রিটিশ বাহিনী ভারতবর্ষে বাণিজ্য করবার নামে এদেশের মানুষকে প্রায় ক্রীতদাসের মত ব্যবহার করে বহুদিন ধরে শোষণ , শাসন আর অত্যাচার করে চলেছে । এতবড় দেশটাকে শোষণ আর শাসন করতে গেলে শুধু তাদের নিজেদের দেশের লোকেদের দিয়ে সম্ভব নয় , এটা বুঝতে পেরে তারা নানা ধরনের কৌশল অবলম্বন করে । এই কৌশল গুলির মধ্যে একটি হল জমিদার প্রথা । ইতিহাস বলে , ভারত উপমহাদেশে মুঘলদের আমল থেকে এই জমিদারি প্রথার প্রচলন শুরু হয়ে ছিল । বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে একজনকে প্রধান করে রাখা হতো । তিনি হচ্ছেন সেই অঞ্চলের মালিক বা জমিদার কিংবা রাজা । প্রায় সমস্ত ধরনের ক্ষমতা এই সব জমিদারদের হাতে তুলে দেয়া হতো । তাঁর কথাই সেই অঞ্চলে প্রথম এবং শেষ কথা । জমিদাররা প্রজাদের সুখ সুবিধা গুলি দেখভাল করতেন আর তাঁদের পারিষদ , লাঠিয়াল , লোকজন দিয়ে প্রজাদের মাধ্যমে রাজস্ব আদায় করে নিয়মিত ভাবে বছর শেষে ব্রিটিশদের কোষাগারে বিপুল পরিমাণ অৰ্থ পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করতেন । সাধারণত উত্তরাধিকার সূত্রে এই জমিদারি প্রথা চলে আসতো । মুর্শিদাবাদের বিস্তীর্ণ এলাকার জমিদার ছিলেন বাবু রাজশেখর রায় চৌধুরী । প্রচলিত আছে -- " চৌধুরী " পদবীটা ব্রিটিশরাই ভালবেসে তাঁদের পূর্বপুরুষদের প্রদান করেছিলেন । আজকের গল্প -- জমিদার রাজশেখর রায় চৌধুরীকে নিয়ে -------

কথায় বলে , যারা বংশানুক্রমে জমিদার আর প্রচুর ধন-সম্পত্তির মালিক তাদেরই নাকি বেশি থাকে অহংকার আর দাম্ভিকতার দাপট । এসব থাকা সত্ত্বেও সাধারণত জমিদারকূল তাঁদের নিজের প্রজাদের সুখ সুবিধাগুলি সহানুভুতির সঙ্গে বিবেচনা করতে সচেষ্ট থাকতেন । কিন্তু , এই গল্পে অন্য জমিদারদের থেকে রাজশেখর রায় চৌধুরীর স্বভাব , রুচি সবকিছুই ছিল একটু অন্য ধরনের । একেই অল্প বয়স তারউপর রক্তে জমিদারির মেজাজ আর বনেদিয়ানার সামিয়ানা । জমিদারের দাম্ভিকতার দরুন তিনি সাধারন প্রজাদের মানুষ হিসেবে গন্য করতেন না । তাঁর সময় প্রজাদের উপর অত্যাচারের মাত্রা ছিল অনেক বেশি । ঘরে সুন্দরী বউ থাকলেও অধিকাংশ রাতে বিলিতি মদ আর নর্তকী , বাইজিদের নিয়ে সময় কাটাতে ভালবাসতেন । কোন নিচু জাতের প্রজাদের তাঁর দরবার সভায় ঢোকার অনুমতি ছিল না । তাঁর ধারণা ছিল কোন নিচু জাতের প্রজাদের সঙ্গে কথা বললে তাঁর মতো জমিদারের সম্মান হানি হয় । তাঁর এই অহংকার আর দাম্ভিকতার জন্য অধিকাংশ প্রজাই তাঁকে পছন্দ করতো না । রাতের বেলায় সাদা ফিনফিনে ধুতি পাঞ্জাবি পরে হাতে ব্রিটিশ সরকারের উপহার দেওয়া সোনা দিয়ে মোড়া দামি ছড়িটা নিয়ে সারা গায়ে বিদেশি আতর লাগিয়ে পারিষদদের সঙ্গে নিয়ে তিনি যখন দু-ঘোড়া টানা সুসজ্জিত গাড়ীতে চড়ে নৈশ প্রহরে বেড়োতেন -- প্রজারা সব আতঙ্কে থাকত , আজ হয়ত কারুর ঘরের সর্বনাশ হতে চলেছে । তিনি তাঁর পরিষদদের বলতেন -- আমি হচ্ছি এই বিশাল স্টেটের জমিদার , আমার পূর্ব পুরুষেরাও সবাই ছিল জমিদার । তাঁদের যেরকম আভিজাত্য ছিল সেটা তোমরা দেখনি , আমিও অবশ্য পুরোপুরি দেখিনি শুধু গল্প শুনেছি । আমার প্রপিতামহ ছিলেন স্বর্গীয় সূর্যশেখর রায় চৌধুরী । তিনি বাড়ীতে বাঘ পুষতেন । তাঁর আঙ্গুলি নির্দেশে বাঘে-গরুতে এক ঘাটে জল খেত । বংশ অহংকারতো আমার রক্তে থাকবেই । পারিষদগণ মদ খেয়ে টইটুম্বুর হয়ে জমিদারকে খুশি করবার জন্য তাঁর সব কথায় সায় দিয়ে যেত ।

আজ জমিদার বাবুর বিশাল বাড়ীটিতে সাজ সাজ রব । সন্ধে হবার আগেই সমগ্ৰ জমিদার বাড়ী যেন তার ঐতিহ্যবাহী দাম্ভিকতা নিয়ে অন্য রুপে সেজে উঠেছে । বেশ কয়েক বছর পর লাখনৌ থেকে আজ দুজন অতিব সুন্দরী নর্তকী / বাইজি আসছে । সারা রাত ধরে নাচ-গান , খানা-পিনার আসর চলবে । অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তিকে এই আসরে আমন্ত্রণ করা হয়েছে । ....... রাত যত বাড়ছে , আসরও জমে উঠেছে । হটাৎ বাহিরের দরজায় পাইক - লাঠিয়ালদের কোলাহল জমিদার বাবুর কানে যেতে , মদ্যপ অবস্থায় তিনি জিগ্যেস করলেন -- এই সুন্দর পরিবেশে বাহিরে এত গোলমাল কেন ? .... জানা গেল জমিদারের এক অত্যন্ত দরিদ্র প্রজা দুলু বাগদীর ছোট ছেলেটা খুব অসুস্হ , সে এখানে এসেছে ডাক্তারের খোঁজে কারন সে জানে জমিদারের স্নেহভাজন ডাক্তার এই ফুর্তির আসরে রয়েছে । এই কথা শুনে জমিদার রাজশেখর রাগে গজরাতে গজরাতে বললেন -- এত বড় সাহস ওই নিচু জাতের দুলু বাগদীর !! চাপকে আমি ওর পিঠের ছাল তুলে দেব । এখুনি লোকটাকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে কয়েক ঘা চাবুক চালিয়ে দাও । ডাক্তার এখন যেতে পারবে না । এতে যদি ওর ছেলেটা মরে যায় , তো যাবে !! লাঠিয়ালদের উদ্দেশ্যে বেশ বিরক্ত হয়ে বললেন -- তোরা কি করিস ? এত সুন্দর এক উপভোগ্য আসরে এইসব ভাগারে লোকগুলো কেন বিরক্ত করে ??

.......... দেখতে দেখতে অনেকগুলি বছর পার হয়ে গেছে । জমিদারির পূর্বের জৌলস অনেকখানি হারিয়ে গেছে । বয়স আর অসুস্থতার কারনে জমিদার রাজশেখর রায় চৌধুরীর জমিদারি মেজাজ আগের মত নেই । দীর্ঘকাল শরীরের উপর অত্যাচার আর অনিয়মের ফলে তাঁর শরীরটা এখন ভাল নয় । তাঁর একমাত্র ছেলে বেশ কয়েকদিন ধরে গুরুতর অসুস্থ | পারিবারিক ডাক্তারের পরামর্শে তাকে কলকাতায় সবচেয়ে নামি চিকিৎসা কেন্দ্রে নিয়ে আসা হয়েছে । আজ সন্ধ্যায় তাকে দেশ-বিদেশ খ্যাত সবথেকে বড় ডাক্তার পরীক্ষা করতে আসবেন । সন্ধেবেলা বড় ডাক্তারকে কাছে পেয়ে তাঁর হাতদুটি চেপে ধরে বললেন -- ডাক্তারবাবু আমার ছেলেটাকে বাঁচান , তার সারা শরীরে ভীষণ যন্ত্রণা । ডাক্তারবাবু ভালভাবে পরীক্ষা করে বললেন -- আপনি একদম চিন্তা করবেন না । আমি ওষুধ লিখে দিচ্ছি আর এও বলে দিয়ে যাচ্ছি আপনার ছেলে কিছুদিনের মধ্যেই একেবারে সুস্থ হয়ে যাবে । জমিদার ডাক্তারের হাত ধরে বললেন -- আপনি আমার থেকে বয়সে অনেক ছোট , প্রায় আমার ছেলেরই বয়সি তবু বলছি আপনার কথায় আমি অনেকটাই আশ্বস্ত হলাম । ডাক্তার একটুক্ষণ জমিদারবাবুর দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বললেন -- আপনি বোধহয় আমাকে চিনতে পারেননি । অবশ্য চেনবার কথাও নয় । আমি যখন খুব ছোট তখন একদিন রাতে ভীষণ ভাবে অসুস্থ হয়ে পরি । আমার বাবা গিয়েছিলেন আপনাদের বাড়ীতে ডাক্তারের খোঁজে । সেইরাতে আপনাদের বাড়ীতে লাখনৌর নর্তকী / বাইজিদের নিয়ে নাচ-গানের আসর চলছিল । আমার বাবা জানতেন আপনি নিচু জাতের লোকেদের সঙ্গে কথা বলা তো দুরের কথা , আপনি তাদের ছায়া পর্যন্ত মারন না । কিন্তু আমার বাবা সেরাতে নিরুপায় হয়েই আপনাদের ওখানে গিয়েছিলেন | সেদিন আপনার নির্দিশে আপনার পেয়ারের লোকেরা লাঠি আর চাবুক মেরে আমার বাবাকে গলা ধাক্কা দিয়ে বার করে দিয়ে বলেছিল -- " যদি তোর ছেলেটা চিকিৎসা না পেয়ে মরে যায় তো যাক , ডাক্তার এখন এই নাচ-গানের আসর ছেড়ে যেতে পারবে না " । ...... আমি সেই দুলু বাগদীর ছেলে নরেন বাগদী । .....যাক সেসমস্ত পুরনো কথা । আপনি একদম চিন্তা করবেন না । আমি কথা দিচ্ছি আপনার ছেলেকে আমি সুস্থ করে তুলবই ।

জমিদার রাজশেখর রায় চৌধুরীর পুরনো সব কথা মনে পরে গেল । -- ডাক্তার , আজ আমিও অসুস্থ । আমি আজ তোমার সুন্দর অহংকারহীন ব্যবহারে মুগ্ধ আর তুমি তোমার কর্মের মাধ্যমে আমার ভুলকে শুধরে দিয়ে ভালই করেছ । এখন অনুভব করি বংশের দাম্ভিকতা বা জমিদারি অহংকার নিয়ে আমি আমার প্রজাদের সঙ্গে যে ব্যবহার করেছি সেটা একেবারেই ঠিক করি নি । যার প্রায়শ্চিত্ত আজ আমাকে করতে হচ্ছে । এখন বুঝতে পারছি দাম্ভিকতা বা অহংকারের প্রতিফলনের জন্য অন্য মানুষের কিরকম অসম্ভব ক্ষতি হতে পারে !! তুমি আজ দেশ-বিদেশে পরিচিত একজন বিখ্যাত ডাক্তার । আজ এই বৃদ্ধ বয়সে এসে তোমার থেকে শিখতে পারলাম প্রকৃত দাম্ভিকতার অৰ্থ ....।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মিলন বনিক সুন্দর নীতিকথার গল্প...খুব ভালো লাগলো দাদা......
ধন্যবাদ ভাই । ভাল থাকবেন ।
নুরুন নাহার লিলিয়ান ভাল লিখেছেন । লেখকের জন্য শুভ কামনা রইল ।
মোঃ মোখলেছুর রহমান দাদা আমি সাধারনত কমেন্ট করার পর ভোট দিতে যাই আপনার ভোট-বাক্স যে বন্ধ সেটা পরে বুঝলাম।ভাল থাকবেন।
ভাই , প্রথমেই আপনাকে অনেক ধন্যবাদ গল্পটি ভাল লেগেছে বলে । আসলে এই গল্পের সময়কালে কিছু কিছু জমিদারের দাম্ভিক জীবনযাত্রা আর পরবর্তী সময়ে তাঁদের কৃতকর্মের জন্য দম্ভের কিংবা অহংকারের অনুশোচনাই এই গল্পে তুলে ধরবার চেষ্টা করেছি । অনেক শুভকামনা জানাই ।
মোঃ মোখলেছুর রহমান দাদা, এককথায় বলব অসাধারন! ইতিহাসের এ রত্নকথা, আমর জানা হয়নি তাই বলছিলাম গল্পটি কি ইতিহােস আশ্রিত;নাকি ইতিহাসই গল্পে আশ্রিত।অবশ্য দুটো ধারাই প্রচলিত।আমার ধারণা "কাবুলিওলা"র মত ইতিহাসই গল্পে আশ্রিত।ক্ষাম খেয়ালি মন্তব্যের জন্য সদয় দৃষ্টি কামনা করি।শুভকামনা ও ভোট রইল
উত্তম চক্রবর্তী অহংকারের দর্পচূর্ণ হবেই এটা চিরসত্য। খুব ভালো লাগলো গল্পটি। শুভকামনা রইলো। ভালো থাকবেন সবসময়!
ভাই , ধন্যবাদ । ভাল থাকবেন । পরবর্তী সংখ্যা গুলিতে ভাল গল্প / কবিতা পড়বার অপেক্ষায় রইলাম ।

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

প্রচুর অর্থ আর ক্ষমতার উত্তরাধিকারি হয়ে মানুষ অনেক সময় দাম্ভিকতা কিংবা অহংকারের দাপটে অন্য মানুষের ক্ষতি সাধন করে ফেলে। । কিন্তু একটা সময় বুঝতে পারে শুধু অর্থ কিংবা ক্ষমতা থাকলেই অহংকার করা যায় না । মানুষ তাঁর নিজ গুনে বা তাঁর কর্মের মাধ্যমেও দাম্ভিকতা বা অহংকার প্রদর্শন করতে পারে । কিন্তু এখনও এমন বহু মানুষের সন্ধান মেলে যাঁরা নিজেদের কর্মের বা গুনের প্রদর্শন না করে কিংবা কারুর প্রতি হিংসা , প্রতিশোধের কথা মাথায় না রেখে নিজের কর্ম দিয়ে মানুষকে ভালবাসে , শ্রদ্ধা করে ।

১২ আগষ্ট - ২০১৭ গল্প/কবিতা: ৪৭ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“নভেম্বর ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ নভেম্বর, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী