দুই রমণী

রমণী (ফেব্রুয়ারী ২০১৮)

বিশ্বরঞ্জন দত্তগুপ্ত
গল্প - রমণী ( ফেব্রুয়ারী ২০১৮ )

দুই রমণী

বিশ্বরঞ্জন দত্তগুপ্ত

" অ্যালবামটায় " ছবিগুলিকে এত সুন্দর ভাবে পর্যায়ক্রমে সাজিয়ে রাখা রয়েছে , ভালোভাবে দেখলে মনে হয় হয়তো কোন নাটকের দৃশ্যগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠছে । নাটকে সাধারণত যেমন থাকে । প্রথম অঙ্ক -- দ্বিতীয় অঙ্ক -- তৃতীয় অঙ্ক ---

প্রথম অঙ্ক ---

মল্লিকা যেদিন প্রথম রুদ্রশেখরের নববধূ হয়ে তাদের সংসারে প্রবেশ করলো , তখন তার বয়স মাত্র ১৮ বছর । সংসারে বাবা , মা ছাড়া পাঁচ ভাই আর দু বোনের মধ্যে রুদ্রশেখর সবার বড় । তাদের এই বড় পরিবারে ভিতরের অবস্থা অন্য কোন ভালো পরিবারের মতন নয় । বাবা সামান্য একটি চাকরি করতেন । অন্য ভাইরা কিছু করলেও পুরো সংসারটা চালানোর দায়িত্ব অলিখিত ভাবে রুদ্রশেখরের কাঁধেই বর্তানো ছিল । ভাইতে ভাইতে সদ্ভাব বলতে যেটা বোঝায় , সেটা এই সংসারে একেবারেই ছিলো না । বাড়ীতে প্রায় সবসময় অশান্তি আর ঝগড়া । অকারণে কথা কাটাকাটি লেগেই থাকতো । বাবা রাত্রে বাড়ীতে ফিরে রোজের এই অশান্তি দেখে মনে মনে খুব কষ্ট পেতেন । মার অবস্থা আরো কঠিন । সারাটা দিন তাঁর শুধু রান্নাঘরেই কেটে যেতো । অনেকের সংসারেই অভাব থাকে , কিন্তু সংসারে যদি শান্তি না থাকে তবে সেটা অভাবের থেকেও অনেক বেশি ভয়ঙ্কর ।

এইরকম এক অগোছাল , অশান্তির পরিবারে এল মল্লিকা । ক্রমে ক্রমে মল্লিকার সুন্দর স্বভাব গুনে , তার সর্বদা হাসিমুখের ব্যবহার এই অশান্তির সংসারটায় এক সুখের ভাব আসতে শুরু করল । ভাই - বোনেদের মধ্যে মল্লিকা এক সুন্দর মেলাবন্ধন তৈরি করতে সমর্থ হোল । ভাঙ্গা সংসারটা মল্লিকার জন্যই হয়ে উঠল এক পরিপূর্ণ আনন্দের ভরাট সংসার । একটা সময় এই সংসারে সে সকলের প্রিয় পাত্রী হয়ে উঠলো । বাবাও বুঝতে পারলেন -- বৌমা যখন বাড়ীতে আছে আর কোন অশান্তি কিংবা গন্ডগোল এই সংসারে আর হবে না । এখন মা কে পুরোপুরি বিশ্রাম দিয়ে মল্লিকাকে রান্নাঘরের যাবতীয় কাজ সামলাতে হয় । এতবড় সংসারটার সাথে মল্লিকার আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যাবার ফলে রুদ্রশেখর মল্লিকার জীবনের শখ আল্লাদ , তাকে নিয়ে একান্তে কোথায় কটা দিনের জন্য বেড়াতে যাওয়া কোনটাই আর হয়ে উঠলো না । আর এই নিয়ে মল্লিকার কোন দিন কোন অভিযোগও ছিল না ।

মল্লিকার গলাটি ছিল ভারি মিষ্টি । খুব সুন্দর ভাবে গাইতে পারতো রবীন্দ্রসঙ্গীত আর নজরুলগীতি আর সময় পেলে আবৃত্তি করতো তাঁদের কবিতা । রবীন্দ্রনাথের একটা গান প্রায়ই গুনগুন করে গাইতো ......

".........তখন কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি ।
সকল খেলায় করবে খেলা এই আমি- আহা,
নতুন নামে ডাকবে মোরে, বাঁধবে নতুন বাহু-ডোরে,
আসব যাব চিরদিনের সেই আমি ।
তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে,
তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাইবা আমায় ডাকলে ।
যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে ......"

গানটা শুনে রুদ্রশেখর বলত -- তুমি এই গানটা বারে বারে কেন গাও ? মল্লিকা মুখে কিছু বলত না , শুধু আকাশের দিকে তাকিয়ে ছোট এক অজানা হাসি দিত । এক মাঘি পূর্ণিমার রাতে বাড়ীর ছাদে আকাশে চাঁদ দেখতে দেখতে রুদ্রশেখর মল্লিকার থেকে জানতে পারলো তাদের সংসারে নতূন অতিথি আসছে । অবশেষে তাদের সংসারে এলো ফুটফুটে এক পুত্র সন্তান । একদিকে সন্তানকে যত্ন করা , লালনপালন করা অন্য দিকে হাসি মুখে পুরো সংসারটার দায়িত্ব সামলানো ।

...... একটা সময় রুদ্রশেখর আর মল্লিকার সন্তান বড় হল । বাড়ীতে এলো পুত্রবধূ । যথাসময়ে ঘর আলো করে সংসারে এল তাদের এক আদরের নাতি । এখন রুদ্রশেখর আর মল্লিকার বয়স হয়েছে । চুলগুলো অধিকাংশ সব সাদা হয়ে গেছে । সংসারে এরমধ্যে অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে । পরিবর্তন হয় নি শুধু মল্লিকার । সেই আগের মতোই হাসিমুখে সংসার সামলানো , নাতির সমস্ত দেখভাল করা । মল্লিকা সুলেখাকে নিজের মেয়ের মত ভালবাসত । কোন কাজই তাকে করতে দিত না । সবসময়ই বলতো -- বৌমা , তোমরা ঘোরফের , আনন্দ করো । আমিতো আছি , সব সামলে নেব । একদিন রুদ্রশেখর নিভৃতে মল্লিকাকে বললো -- তুমি সারাটা জীবনই আমাদের সংসারটাই দেখে গেলে তোমার শখ আল্লাদ বিসর্জন দিয়ে । এবার তুমি কয়েকদিনের জন্য বিশ্রাম নাও আর এখন বৌমাতো আছেই । মল্লিকা মুখে কিছু বলতো না , মুখে সেই আগের মতোই ভুবন ভোলান একগাল হাসি । এত খাটনি , অনিয়ম বোধহয় তার শরীর আর নিতে পারছিল না । এক দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত হয়ে একদিন সে বিশ্রাম নিল এই সংসার থেকে । শুধু কয়েকদিনের জন্য নয় , চিরদিনের জন্য । মল্লিকার মৃত্যুর পর রুদ্রশেখর বুঝতে পারলো এই পৃথিবীতে সে বড়ই একা .....।

দ্বিতীয় অঙ্ক ---

সুলেখা ঝাঁঝাল গলায় চিৎকার করে বললো -- এখন সকাল আটটা বাজে । সেটা আপনার খেয়াল আছে ? চেয়ারে বসে আরাম করে শুধু চোখের জল ফেলে " আ্যলবামের " ছবিগুলি দেখলে চলবে ? আপনার বুড়ো বয়েসের এইসব ন্যাকামো আমার একদম ভাল লাগে না । তাড়াতাড়ি উঠে বাজারের বড় ব্যাগটা নিন । বাজার করবার আগে নাতিকে স্কুলে পৌঁছে দেবেন । সকালের চা আমি করতে পারব না , আমার এখন অনেক কাজ । রাস্তার কোন দোকান থেকে চা খেয়ে নেবেন । বাজার থেকে মাছটা ভাল করে দেখে আনবেন , আজকে আমার বাপের বাড়ীর লোকজনকে আমাদের বাড়িতে নেমন্তন্ন করা হয়েছে । আর একটা কথা -- বাজারে যা যা জিনিস কিনবেন , সব কিছুর দাম একটা স্লিপে লিখে নিয়ে আসবেন । আজকাল যা দিনকাল , সব কিছুর হিসাব না রাখলে কি চলে ? রুদ্রশেখর হতবাক হয়ে কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলেন না । শুধু বললেন -- বৌমা , আজ আমার শরীরটা ভাল নেই , এই বৃদ্ধ বয়সে আমি আর খাটতে পারি না । আর একটা কথা , তুমি তো জান - আজ তোমার শ্বাশুড়ী মার মৃত্যু দিবস তাই আমার মনটাও ভাল নেই । একটু আমতা আমতা করে বললো -- বৌমা , তুমিতো আমাকে গোনাগুনতি টাকা দিয়েছ বাজার করবার জন্য । আমি বলছিলাম যদি আর কয়েকটা টাকা দাও আজকের দিনটিতে তোমার শ্বাশুড়ী মার ফটোতে একটা মালা কেনবার জন্য ...। সুলেখা তাচ্ছিলের ভঙ্গিতে বললো -- যে মারা গেছে তাকে নিয়ে অত চিন্তা করবেন না । আর তাছাড়া এখন মাসের শেষ , মালা কেনবার টাকা আমি দিতে পারব না । শুনুন , আপনার ছেলের কাল প্রায় সারারাত ধরে অফিসের ক্লায়েন্টদের নিয়ে একটা পার্টি ছিল । ভোর রাতে বাড়ীতে ফিরে এখন ঘুমাচ্ছে । ঘুম থেকে উঠে যদি দেখে আপনি এখনও বাজারে যান নি , তাহলে তুলকালাম করবে । আপনাকে একটা পরিষ্কার কথা বলি -- এ বাড়ীতে খেয়ে-পরে থাকতে হলে আপনাকে বাড়ীর কাজ করতে হবে । ওই সব শরীর খারাপের কথা বলে অভিনয় করা এ বাড়ীতে চলবে না । রুদ্রশেখর বললো -- বৌমা , আমার শরীরটা সত্যিই খুব খারাপ , আমি হাঁটতে পারছি না । সুলেখা এক বিকট চিৎকার করে ধমক দিয়ে বললো -- আমি আপনার কোন কথাই শুনতে চাই না । আর এখন মাসের শেষ , আপনাকে আমরা ডাক্তার দেখাতে পারব না । এক অসহায় করুণ দৃষ্টি দিয়ে বাজারের বড় ব্যাগটা হাতে নিয়ে কোনোরকমে লাঠিতে ভর দিয়ে বাড়ী থেকে বেরলেন ।

তৃতীয় অঙ্ক ---

বাড়ীতে বিরাট হৈ হুল্লোড় । বিকট আওয়াজে নাচের মিউজিক চালিয়ে সুলেখা তার বন্ধু বান্ধবীদের নিয়ে রাত্রিবেলায় পার্টি নিয়ে মেতে রয়েছে । বিরাট ফ্লাটটায় ছোট একটা ঘরে সারা শরীরে একরাশ যন্ত্রনা নিয়ে রুদ্রশেখর মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন । একটা সময় অস্পস্ট ক্ষীণ স্বরে কোনক্রমে বললেন -- খোকা , বৌমা আমাকে একটু জল দাও -- একটু জল দাও । সুলেখা বা ছেলের কানে কথাটা আর পৌঁছাল না , তারা তখন অন্য " লাল জল " খেতে ব্যস্ত । একটা সময় রুদ্রশেখরের সারা শরীরটা অবস হয়ে তিনি যেন ধীরে ধীরে দূরের আকাশে হারিয়ে যাচ্ছিলেন । আবছা অন্ধকারে মল্লিকা যেন তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলছে -- চলে এসো আমার কাছে এই সংসার থেকে , আমি যে তোমাকে নিতে এসেছি । সংসার থেকে চিরতরে বিদায় নেবার আগে ওদেরকে প্রাণ ভরে আশীর্বাদ করে এস -- ওরা যেন সুখে থাকে , শান্তিতে থাকে । মনে হোল , মল্লিকা রবীন্দ্রনাথের লেখা তার খুব পছন্দের প্রিয় কবিতাটি আগের মত আবারও আবৃত্তি করছে ...... ।

" তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি
শত রূপে শত বার
জনমে জনমে , যুগে যুগে অনিবার ।
চিরকাল ধরে মুগ্ধ হৃদয়
গাঁথিয়াছে গীতহার ,
কত রূপ ধরে পরেছ গলায় ,
নিয়েছ সে উপহার
জনমে জনমে , যুগে যুগে অনিবার । "







আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মৌরি হক দোলা প্রথমে শ্বশুরবাড়িতে এসে বড় এক সংসারের দায়িত্ব মল্লিকা নিজের ঘাড়ে তুলে নিল... নিজের শখ আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে সংসারের সমস্ত কাজ একা হাতে সামলানোর চেষ্টা করল... ভাঙ্গা সংসারকে নতুন করে সাজিয়ে তুলল... এরপরে যখন ছেলে বিয়ে করল তখন নিজের অবসরের কথা চিন্তা না করে তাদেরকে তাদের মত করে বাঁচতে দিতে চাইল... কিন্তু সে তার প্রাপ্য মর্যাদাটুকু পেল না... তবুও মৃত্যুর পরেও সে তাদের সুখশান্তি কামনা করে... সত্যি মল্লিকা একজন আদর্শ স্ত্রী, আদর্শ মা , আদর্শ শাশুড়ি, সব মিলিয়ে একজন আদর্শ রমণী.... অনেক অনেক ভালোলাগা রইল....
ভালো লাগেনি ২৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮
মিঠুন মণ্ডল বেশ ভাল হয়েছে...
ভালো লাগেনি ১৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮
মোঃ নুরেআলম সিদ্দিকী দারুণ একটি গল্প। পৃথিবীতে কেউ আছেন, অন্যের সুখ ও শান্তির জন্য নিজেকে বিসর্জন দেন তবু নিজের চিন্তা করেন না। এই গল্পে তেমনি একজন হলেন মল্লিকা। ১ম অংশে যদিও মল্লিকার মৃত্যু হয়েছে, ২য় অংশে রুপ ধারণ করে শেখরকে নিতে এসেছিলেন..... শেষে বলবো চমৎকার একটি গল্প। শুভকামনা নিরন্তর।
ভালো লাগেনি ৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮
মোঃ মোখলেছুর রহমান দাদা ভাল লাগল গল্প, সাথে ভাল লাগা রইল।
ভালো লাগেনি ৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮
সুমন আফ্রী দুই প্রজন্মের চিরায়ত রুপ... ভালো লাগলো। শুভকামনা আপনার জন্য...
ভালো লাগেনি ৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮

১২ আগষ্ট - ২০১৭ গল্প/কবিতা: ৪৭ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪