- আম্মা,পায়ের শিকলটা খুলে দেন না । আর দরজার নিচ দিয়ে খাবার দেন কেন আম্মা?আম্মা অনেক দিন হল বাহিরে ঘুড়তে যাই না । নিয়ে যাবেন ?
- হুম বাবা,নিয়ে যাব ।
- আম্মা একটু কাছে আসেন না,আপনাকে ছুঁয়ে দেখি । ভয় পাইয়েন না । আমি কিছু করবো না ।
রহিমা বেগম,ছেলের কথায় প্রায় গলেই যায় । কিন্তু বাসার কাজের লোক শিলা দৌড়ে এসে বলে
- ঢুইকেন না । পরে আপনারে মেডিকেলে নিয়া যাইতে পারবো না কিন্তু । ঐ দরজার নিচ দিয়াই খাবার দেন । আর এতো গইলা যাইয়েন না । আপনি মইরা গেলে আপনার পোলারে দেখনের কেউ নাই । ৬\৭ দিনে মইরা যাইবো ,না হইলে মানুষ পিটায়য়া মাইরা ফেলবো ।
- তুমি কাজে যাও । আমি ঢুকবো না ।
রহিমা দরজার নিচ দিয়ে খাবার দেয় ছেলেকে । তিনটা শক্ত আটার রুটি আর সবজি,ডাল । দরজার এপারে ছেলে,ওপারে মা । দুইজনে মেঝেতে বসে দরজায় হেলান দিয়ে একে অপরের সাথে কথা বলে ।
- আম্মা ,তরকারি কি তুমি রান্না করেছ? খুব taste হয়েছে । কিন্তু গোশতো হইলে আরও টেস্ট হইতো, গুরুর গোশতো । ঝাল ঝাল করে লাল ভূনা । উপরে এক হাঁটু ঝোল । হি হি হি । ঐ রান্নাটা করেন না,আম্মা?
- না বাবা । এখন তো আর চোখে ভালোমতো দেখি না । কি দিতে কি দিব । আমি রান্না করি নাই,শিলা করছে ।
- আম্মা তোমার চোখের অবস্থা আরও খারাপ হয়ে গিয়েছে না ! সেদিন জানালা দিয়ে দেখলাম,তুমি বারান্দায় মাছ ধুচ্ছো ,খুব কষ্টে । চশমাটা তো ভাঙ্গা । বারবার পড়ে যাচ্ছে । তুমি একটা চশমা কিনতে পারো না ! কি সব কসটেপ,সুতা প্যাচায় রাখছো !
- কিনবো বাবা ।
- কেমনে কিনবে আম্মা! আমার তো মাথায় সমস্যা,কত ওষুধ কেনা লাগে । তবে আমার কি মনে হয় জানো, আমি এবার সত্যি ভালো হয়ে গিয়েছি । আর মাথা গরম হবে না । দেখ না ,এখন আমি কাপড় চোপড় পড়ি ,আর ন্যাংটা হয়ে থাকি না । সব সময় ফিটফাট থাকি । আম্মা, আমি না এবার চাকরী করবো । সরকারি চাকরী নিব । আব্বার মত । তারপর দেখবা,তোমার আর কোন কষ্ট নাই ।কিন্তু আম্মা,আমার মাথা গরম হলেও তুমি আমাকে দূরে পাঠায় দিও না । হাসপাতালে পাঠায় দিও না আম্মা । এইখানে,এই ঘরেই শিকল দিয়ে বাধেঁ রাখিও ।
- তুই ছাড়া তো আমার কেউ নাই । তোকে কোথায় পাঠাবো ।
- আম্মা,তোমার আগে আমিই মরে যাব । তুমি তো এইটা নিয়ে খুব চিন্তা করো,তুমি মারা গেলে আমার কি হবে ! চিন্তা নাই আম্মা, আমিই আগে মারা যাবো তাহলে তুমি নিশ্চিন্তে মরতে পারবে । আচ্ছা আব্বাও তো হুট করে পাগল হয়ে মরে গিয়েছিল না আম্মা! সেই সময় যদি বুঝতা ছেলে দুইটাও এমনে পাগল হবে, তাইলে তো আমাদেরও মেরে ফেলতে পারতা । এখন দেখ বড় হয়ে,বড় পাগল হয়ে গেছি । কত বড় বিপদ! আগেই মরবো আম্মা । তুমি চিন্তা করো না ।
- হুম তাই যেন হয় । না হলে আমার মরেও শান্তি নাই । কে তোকে টানবে !
- তবে আব্বা বেঁচে থাকলে তোমার চিন্তা ছিল না । তুমি ভালোমত বাঁচতে পারতে । আম্মা আমাকে একটু বাহিরে নিয়ে যাবে । বেশিদূর না ,বারান্দায় না হয় ছাদে নিয়ে যাবে? অনেক দিন দেখি না আকাশ বাতাস গাছপালা । আচ্ছা আম্মা তোমার রুমের চিলেকোঠায় একটা পাখি বাসা দিয়েছিল না,এটার বাচ্চা হইছে ? কয়টা হইছে? কি কি নাম দিছ ? ছেলে পাখি হইলে আরমান নাম দিও । না থাক দিও না ,তাহলে আবার আমার মত কাপড় ছাড়া ঘুড়বে,বিছানায় হাগু করবে । হা…হা….হা…। ও, বড় ভাই কেমন আছে ? ওকেও কি দরজার নিচ দিয়ে খাবার দাও ?
রহিমা বেগমের চোখ পানিতে ভিজে আসে । এতো খেয়ালি ছেলে তার,সুস্থ থাকলে মাকে মাথায় তুলে রাখতো । আর আজ ৬৫বছরে এসেও ৩৪ বছর বয়সি ছেলেকে কাপড় পড়িয়ে দিতে হচ্ছে । তার যদি অন্তত একটা ছেলে সুস্থ হত !
( সত্য ঘটনা অবলম্বনে ।“ডেইলি স্টারে” ছাপা হয়েছিল এক দুঃখী মায়ের কথা,যার দুই ছেলেই পাগল )
এখানে একজন মায়ের অসহায়ত্ব দেখানো হয়েছে । যে তার পরিবারের জেনেটিক্যাল রোগের কাছে হার মেনেছে।