সময় টা ১৯৬৫, বাংলাদেশর কোন এক নাম না জানা গ্রামের। ফাতেমার বয়স আট কি নয়, গ্রামে তো আর মানুষ ঠিক ভাবে বয়স মনে রাখে না, তাই সেও জানে না। তার বয়সী অন্য সবার চেয়ে সে একটু পাতলা, রোগা মত কিন্তু যথেষ্ট লম্বা। মা-বাব আর ফাতেমা। আরেকজন আছে, কিন্তু এখনো পৃথিবীর আলো দেখে নি সে। বড় চৌচালা ঘর, তার সামনে সামনে বড় বারান্দা, আর এক পাশে ছোট আরেকটা বারান্দা। সামনের বারান্দায় বসে ফাতেমা একমনে পুকুরের উপড়ে পরা পড়ন্ত রোদ দেখছে, আর ভাবছে কি হলে ভাল হয়, ফুটফুটে চাঁদমুখ একটা বোন না কি একটা রাজপুত্রের মত ভাই। ভাবছে, আর ভাবছে। ভিতর এর ঘর থেকে মা এর চিৎকার শুনা যাচ্ছে, আরও কয়েক জন মহিলার গলার আওয়াজ ও ভেসে আসছে, কিন্তু তারা কি বলছে বুঝা যাচ্ছে না। বাবা কোথায় যেন গেছিল, এখন এসে বারান্দায় হাঁটছে । সব কিছু এক ঝলক দেখে ফাতেমা আবার মনোযোগ দিয়ে পুকুরের পানি দেখতে লাগল, পুকুরের হালকা সবুজ পানিতে বিকালের লালা সূর্যের আভা তার কাছে বেশ লাগছে। কিছুক্ষণ পর ঘর থেকে একটা মহিলা কোলে একটা বাচ্চা নিয়ে বেড়িয়েছে, সে মহিলা টা কে চিনে, রহিমা নাম। তার বাবার দিকে এগিয়ে বাচ্চা টা কোলে দিয়ে বলে, “পোলা হইছে”। ফাতেমার ইচ্ছা করে সারা গাঁ-ময় চেঁচিয়ে বলে বেড়ায় তার ভাই হয়েছে। মনে মনে দুই একবার চেঁচিয়েও উঠে কিন্তু গলা দিয়ে কোন আওয়াজ বের হয় না। আসলে সে তো অন্য সবার মত কথা বলতে পারে না, আনন্দে ভুলেই গিয়েছিল। এবার ফাতেমা বসা থেকে উঠে দাড়ায়, বাবার কাছে যেতেই বাবা কিছুটা নিচু হয়ে বাচ্চা টার মুখ দেখায় তাকে, সত্যি রাজপুত্র। বাবা ধীরে-ধীরে ঘরে ঢুকে, ফাতেমাও যায়। খাটের যে পাশে তার বাবা বসেছে তার অন্য পাশে গিয়ে ফাতেমা মায়ের সাথে লেগে বসে, বসে না ঠিক, পা দুটি ঝুলিয়ে দিয়ে এক রকম শুয়ে আছে মা কে জড়িয়ে ধরে।
কি মা? মা জিজ্ঞাস করার মাথা ঝাঁকিয়ে ফাতেমা বুঝিয়ে দিল যে কিছু হয়নি।
কিছুক্ষণ পর বাবা উঠে গেলে ফাতেমা খাটের এ পাশ থেকে বাবা যে পাশে বসে ছিল সে পাশে গিয়ে ভাইয়ের কাছে বসল। লাল মুখ ঠিক লাল গোলাপ এর একেবারে নিচের পাপড়ি গুলর মত, লালা-সাদার মিশেল। হাত পা ছুড়ছে, আর হাঁ-করে আছে, ফাতেমা তার ছোট্ট নাক টা হাত দিয়ে ছুঁতেই খেঁক করে কেঁদে উঠল। মা তাড়াতাড়ি করে দুধ মুখে দিতেই কান্না থেমে গেল। ফাতেমা আবার উঠে বারান্দায় গিয়ে বসে, সূর্যটা পুকুরের পশ্চিম দিকের বাগানের নিচে নেমে যাওয়ায় এখন আর পুকুর টা কে আগের মত উজ্জ্বল দেখা যাচ্ছে না। তাই সে উঠানের আমড়া গাছ টার দিকে তাকিয়ে আছে, সেখানে এসে দুইটা টিয়া বসেছে। কি সুন্দর দেখতে; লালচে রঙ এর ঠোট আর সবুজ রঙের পালক। সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। বাবা ফিরে এসেছে, হাতে কিছু হাড়ি, সে জানে এগুলো তে মিষ্টি আছে। বাবার পিছে-পিছেই আবার ঘরে ঢুকে, বাবা বুঝতে পেরে বলে, এখন না, পরে নিবি। একটা হাড়ি মা যে ঘরে সুয়ে ছিল সে ঘরে এনে রাখে। বাবা চলে গেলে সে হাড়ির সামনে ঘুর-ঘুর করতে শুরু করে।
খাবি?
ফাতেমা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ে।
নিয়ে খা, দেখিস ফেলিস না যেন।
ফাতেমা পাসের-ঘর থেকে একটা বাটি এনে তাতে কয়েক টা মিষ্টি তুলে নেয়, তার পর খাটে এসে মা এর পাশে বসে খেতে শুরু করে। মাকেও সাধে। ছোট ভাই টি কেও সাধে। মা বাধা দেয়। খেয়ে হাত ধুয়ে সে আবার ভাইয়ের পাশে বসে, বাবা এলে উঠে পরে। কিছুক্ষণ এ ঘর ও ঘর ঘুরে এসে বাবার কোলে বসে। কত ক্ষণ ধরে বসে আসে সে তা জানে না, কিন্তু রাত যে অনেক হয়েছে তা ঝিঝি পোকার ডাক শুনে বুঝা যাচ্ছে। সে ঘড়ি পড়তে পারে কিন্তু, ঘরের ঘড়িটা দু দিন ধরেই বন্ধ হয়ে আছে। তার কিছুটা খিদা পেয়েছে, তাই বাবার জামা ধরে টানছে।
যাও, ওরে কিছু খাইতে দাও। মা বলল।
বাবা উঠে তাকে খাবার বেড়ে দিল, জমিলা ফুফু রেঁধে রেখে গেছে সন্ধ্যায়। জমিলা তার কিছুই হয় না, কিন্তু সে তাকে খুব আদর করে বলে তাকে সে ফুফু বলে ডাকে। রাত্রে খাবার শেষ হলে মা কয়েক বার তাকে শুতে ডাকে। সে কয়েকবার মা ঘরে যায়, কিন্তু পরে পাশের ঘরে এসে খাটের উপর শুয়ে থাকে। খুব ভোরে পাখির ডাকে তার ঘুম ভাঙ্গে, অন্য দিন হলে সে এখন আদর্শ লিপি নিয়ে বসত, কিন্তু আজ ভাল লাগছে না। ঘুম ভাঙলেও সে শুয়েই থাকে, মোরগ টা কর্কশ গলায় একটানা ডাকতে শুরু করে। সে জানে অন্তত মিনিট পাঁচ এর আগে থামবে না। অন্য কোন দিন হলে সে বিরক্ত হোতো, কিন্তু আজ হচ্ছে না। কাল থেকেই তার মন খুব ভাল। পাশের ঘর থেকে ভাইয়ের কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে, সে তবুও শুয়ে আছে; আসলে সে ঐ ঘরের দরজা খোলার জন্য অপেক্ষা করছে।
ফাতেমা, ও ফাতেমা মা, একটু পানি নিয়ে আয় দেখি, বাবা বলে উঠল। ফাতেমা লাফ দিয়ে খাট থেকে উঠে পRE কল পারে চলে যায়, পানির জন্য তাকে কল চাপতে হয় না, বালতিতেই রাখা ছিল। বাবা অজু করে নামাজ পরতে বসে। হঠাৎ ফাতেমার মনে পরে সে আজ মকতবে এ যায় নি, কাল হুজুর খুব করে বকবে। সে উঠে গিয়ে মা এর ঘরে ঢুকে, সকালে কেঁদে এখন নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। ফাতেমা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ভাই এর দিকে, দেখতে ঠিক কেমন লাগছে তা সে ভেবে পাচ্ছে না। সে মনে মনে নাম ভাবছে, কি নাম দেয়া যায়, একটা সুন্দর নাম দিতে হবে। সে তাকিয়ে আছে আর ভেবেই চলছে, ভেবেই চলছে কি নাম দিবে। রহিম, না। জামিল, না এইটাও না। এমন নাম দিতে হবে যা অনেক সুন্দর। রহিম, করিম, জামিল, সামিম এগুলতে চলবে না। তার ভাই এর নাম হবে সবচেয়ে সুন্দর। কি নাম হবে? ফাতেমা ভেবেই চলছে। কিন্তু কোন নামই মনে পড়ছে না। নিজের উপর তার বিরক্ত লাগছে। হঠাৎ করে তার মনে পড়ল তার স্কুলের এক দিদি খুব বই পরে, সে নিশ্চয়ই ভাল নাম দিতে পারবে। কিন্তু আজ তো আর যাওয়া হবে না। কালকে গিয়েই তাকে জিজ্ঞাস করতে হবে। মনে মনে সে ভাবল দিদির বাসায় গেলে কেমন হয়। মন্দ না, নিজে নিজেই উত্তর দিল নিজেকে। কিন্তু সে তো বাসা চিনে না। সে অধৈর্য হয়ে পরে, এক ছুটে ঘর থেকে বাহির হয়ে বারান্দা থেকে লাফ দিয়ে নেমে পুকুর পারে গিয়ে বসে। পানিতে পা এর তলা লাগিয়ে দোলাতে থাকে আর আদর্শলিপির পড়া গুন গুন করে পরতে থাকে। ‘অ তে অজগর, অজগর টি আসছে তেরে। আ তে আম, আম টি আমি খাব পেরে।’ এমনি আরও অনেক কিছু। সে এসব বলছে কিন্তু শুনা যাচ্ছে না, তার তো আর গলায় শব্দ নেই। হঠাৎ সে পিছনে ঘুরে দেখে উঠান থেকে জমিলা ফুফু তাকে ডাকছে। সে দৌড়ে যায়, হাত নারায়, আসলে সে জিজ্ঞাস করছে কি হয়েছে। পুকুর বেশি দূরে নয়, বাসার কাছেই, উঠান থেকে ডাকলেই শুনা যায়। তবুও সে কিছুটা হাঁপাচ্ছে। ঘর থেকে মায়ের চিৎকার ভেসে আসছে। জমিলা ফুফু তাকে বলে, “যাইয়া বাজার তন তর বাপরে ডাইকা আন। কইছ যে মা ইয়ের শরীর খান ভালা না, আর মজিদ ডাক্তার রেও আনতে কইছ।” ফাতেমা তার বাবার দোকান চিনে, বাজারের পশ্চিম পাশে তার বাবার চালের দোকান। সে এক ছুটে বাজারে চলে যায়, গিয়ে আগে কিছুক্ষণ হাঁপিয়ে নেয়। তার পর একটুকরো কাগজ নিয়ে সব লিখে দেয়। তার সাথেই ডাক্তার নিয়ে বাড়ি আসে জমিল ইসলাম। মজিদ রুগী কে দেখে বলে ভাব গতিক ভাল না। সে দিন রাত্রেই মারা যায় ফাতেমার মা আমেনা বানু। মারা যাবার আগে ফাতেমা কে ডেকে তার দুই দিন বয়সী ভাই কে দিয়ে যায় তার কোলে। পরের দিন ফজর নামায়ের পরই জানাজা হয় আমেনা বানুর। অবশ্য সেদিন ফাতেমা মা জানত না যে তার মা আর কোন দিন আসবে না, লোকেরা বলাবলি করছিল, কিন্তু সে কিছুই বুঝে নি। তার মনে হয়ে ছিল যে তার মা কিছু দিন পরেই আসবে, কিন্তু যখন মাস পেরিয়ে আসলো না তখন সে বুঝল আসলে তার মা আর আসবে না। আগে যখন তার মা মারা মারা গেছিল তখন সে ব্যাপারটা বুঝে নি, তাই কষ্ট পায় নি। কিন্তু এখন মাঝে মাঝে মা এর কথা মনে পড়লে কাঁদে ফাতেমা। মা মারা জবার পর আর স্কুলে যায় নি ফাতেমা, যদিও বাবা ভাই কে দেখার জন্য একটা লোক রেখেছে। বাবা তার জন্য একটা মাস্টার ও রেখেছে বাসায় পড়ার জন্য। সেই মাস্টার থেকেই ভাইয়ের নাম রেখেছে, ‘অপূর্ব’। সত্যি খুব সুন্দর নাম।
(২)
এখনো মাঝে মাঝে বিকালের সূর্যের আভায় লাল হয়ে যাওয়া পুকুরের পানির দিকে তাকিয়ে এসব কথা ভাবে ফাতেমা, যদিও এ সবিই পাঁচ-ছয় বছর আগের কথা। এখন তার ভাইও তার সাথে কথা পড়ে, সে তার মত না, কথাও বলতে পারে। কত বায়না করে ঘুমের সময় দি, গল্প বল, কিন্তু ফাতেমা পারে না। মাঝে মাঝে খুব কষ্ট পায় ফাতেমা, কিন্তু কি করবে, তার তো কিছুই করার নেই। ভাই এখন ঘুমিয়ে আছে, তাই একমনে ভেবে চলছে ফাতেমা, এখন মা এর কথা মনে পড়লে আগের মত খারাপ লাগে না, মানিয়ে নিয়েছে সে। বাবা, ভাই, আর সে, তের বৎসর এর ফাতেমার সুখের সংসার; সেই কর্তী। তবে ইদানীং খুব ভাল যাচ্ছে না, শহরে নাকি যুদ্ধ হচ্ছে, গ্রামের অনেকেই চলে যাচ্ছে। তার মাস্টার মশাইও চলে গেছে, ভাইকে এখন নিজেই শেখায় ফাতেমা। বাবা মাঝে মাঝে রেডিও তে কান দিয়ে কি যেন শুনে, ফাতেমাও শুনে সেই সাথে। বাব এসেছে দেখে ফাতেমা উঠে যায়, ভাত বেড়ে দেয় ফাতেমা, জমিলা ফুফু রান্না করে রেখে গেছে। ভাত খেতে খেতে বাবা যা বলতে থাকে তার কিছুই ফাতেমা বুঝে না। “মা খেয়াল রাখিস, নিজের, ভাইটারও। আমি মনে হয় বেশি দিন থাকতে পার-মু না। দেশ যে আমায় ডাকছে। আমারে যাইতে হবে।” দুই দিন পর বাবা যখন চলে যাবার জন্য তৈরি হয় তখন ফাতেমা বুঝতে পারে। অনেক বার বাধা দেয়, তার তো ভাষা নেই, তাই মুখে বলতে পারে না, কিন্তু আকারে অনেক বার বারণ করে। বাবা শুনল না। যাবার আগে বলে গেল, “মা, চিন্তা করিস না, আল্লাহ্ দেইখা রাখব। তোর আর তোর ভাইয়ের জন্য পতাকা লইয়াই ফিরব। চিন্তা করিস না সব ঠিক হইয়া যাইবে।”
কত দিন হয়ে গেল বাবাও ফিরল না। গ্রামের প্রায় সবাই এখন গ্রাম থেকে চলে গেছে। জমিলা ফুফুও চলে গেছে। এখন সে নিজেই রান্না করে। আগুনের ছেঁকায় হাতটা একটু পুরে গেছে, সে পোরাতে হাত বুলাতে বুলাতে সে ভাবছে তার বাবার চলে যাওয়া, মার চলে যাওয়া, গ্রামের সব মানুষের চলে যাওয়ার কথা। সন্ধ্যা হয়ে এলে সে বারান্দা থেকে উঠে ভিতরে যায়, আলো জ্বালে, ভাই কে ঘুম থেকে তুলে। ভাত খওয়া শেষ হলে ভাই তাকে জিজ্ঞাস করে, “দি, বাপ কি আর আসবো না।” ফাতেমা মাথা নাড়ে, এমন করে নাড়ে যার মানে হয় তাকে কেন বলছ, বাপ কে বল। মাঝে মাঝে বাবার কথা মনে পড়লে রাগ হয়, মাঝে মাঝে ভাবে বাবা নিশ্চয় কোন জরুরী কাজে গেছে। যুদ্ধ সে বুঝে না, মাঝ রাত্রে মাঝে মাঝে সে বিকট শব্দ শুনে; পোড়া গন্ধ পায়; কখন বা সকাল বেলা দেখে কোথায়ও আগুন জ্বলছে; এর মানেই কি যুদ্ধ সে ভাবে। এসব ভাবতে ভাবতে সে ফাতেমা ঘুমিয়ে পরে। “ফাতেমা, ও ফাতেমা। ও ফাতু, দরজাটা খুল।”- মাঝ রাত্রে ডাকা ডাকিতে ঘুম ভাঙ্গে ফাতেমার। সে উঠে দরজা খুলে দেয়, চার-পাঁচ জন লোক ঢুকে ঘরে। এদের ফাতেমা চিনে। আগে চিনত না, কিন্তু এখন সে চিনে। বাবা যাওয়ার কয়েক দিন পরে যখন ঐ হলুদ জামা পরা লোকেরা এলো, যারা গ্রামের সব ধ্বংস করছে তার কিছুদিন পরই এরা এসেছিল ফাতেমাদের বাসায়। প্রথম দিন ভয় পেয়েছিল, তার পর যখন ওর বাবার নাম করল, তখন থেকে আর বেশি ভয় পায় না। এখন তো নিত্য দিনের ব্যাপার। প্রায় প্রতি রাত্রে আসে, কিছু খায়, আবার ভোরে পাখিরা জাগার আগেই বেড়িয়ে চলে যায়। গ্রামের কেউ জানে না এ কথা, ওরাই জানাতে না করেছে, তাই ফাতেমাও কিছু বলে না। এমন কি অপূর্বও জানে না।
একদিন দুপুরে রান্না শেষ করে ভাই কে গোসল করিয়েছে, এবার নিজে গোসল করে তারপর ভাই কে নিয়ে খাবে। এমন সময় করিম উল্লাহ্ মাতব্বর এসে তার উঠানে দাঁড়ায়। লোকটা কে আগেই গ্রামের সবাই ভয় পেত, ইদানিং আরও বেশি ভয় পায়। রহমত মাস্টার, রাত্রিরে যারা আসে তাদের একজন, তাকে বলেছে যে সে নাকি রাজাকার। এর মানে সে জানত না, মাস্টারই তাকে বলেছে যে রাজাকার রা নাকি আমাদের শত্রু দের সাহায্য করছে। তাই মাতব্বর কে দেখে কিছুটা ভয় পায় ফাতেমা। মাতব্বর একলা নয়, সাথে আরো কয়েক জন আছে, হলুদ পোশাক পরা লোকও আছে আবার তাদের সাথে বন্দুক ও আছে। ফাতেমা এই বন্দুক আগে রহমত মাস্টার আর তার সাথের লোকদের কাছে দেখেছে, কিন্তু এগুলো দেখতে তার কাছে বেশি ভয়ংকর লাগছে। মাতব্বর যেন ঐ লোক গুলকে কি বলল, ফাতেমা তার কিছুই বুঝল না। কিছুক্ষণ পর হলুদ জামা পরা একজন তাকে টানতে শুরু করল, সে ছুটার জন্য হাত পা ছুড়তে শুরু করল, কিন্তু পাড়ল না। মিনতির ভঙ্গি করল, ইশারায় তাকে ছেড়ে দিতে বলল, কিন্তু ছাড়ল না। সে বুঝাতে চাইল সে গেলে তার ভাইয়ের কি হবে, কে দেখবে তার ভাই কে, একটা কিছু সে মাটিতে লিখতে চাইল, পাড়ল না। অপূর্ব চীৎকার করছে দি, দি বলে। দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে ধরেছে ফাতেমা কে, ফাতেমাও ধরেছে তাকে। হলুদ জামা পড়া লোকটা তাকে টেনেই চলছে, আরেকটা হলুদ জামা পড়া লোক এসে অপূর্ব কে ছিটকে ফেলে দিয়েছে। হঠাৎ একটা বিকট শব্দ আর সব কিছু নীরব হয়ে গেল, অপূর্ব নীরব হয়ে গেল; গাছের পাখিরা নীরবে উড়ে চলে গেল; যে সব মাছ পানির উপড়ে উঠে ছিল তারাও পানিরে অতলে মিলিয়ে গেল; ফাতেমাও নীরব হয়ে গেল। লাল রঙ এ ছেয়ে গেল উঠান। তার পর ফাতেমার আর কিছু মনে নেই। ঘুম ভাঙলে দেখতে পায় সে একটা প্রায় অন্ধকার ঘরে। আরো কয়েক জন মহিলা আছে, কেউ বা ওর বয়সী, কেউ বা বড়।এক জন বউ এর সাজেও ছিল, সে বুঝতে পারে না সবাই এখানে কি করছে। তার পর সপ্তা-খানেক সে ঐখানেই ছিল, কি করেছে তারা তা সে ভাল করে জানে না। জানে শুধু প্রায় বস্ত্রহীন ভাবে, না খেয়ে ছিল। সব সময় ঐ ঘরেই ছিল তা না নয়, ভিন্ন ভিন্ন ঘরে ছিল সে। কিন্তু ঐ ঘর ছাড়া সব ঘরেই তার সাথে ছিল ঐসব হলুদ জামা পরা লোকেরা।
তারপর একদিন, সে বেরিয়ে আসে, পিছু থেকে গুলিও করে কিন্তু তার গাঁ এ লাগে না। তার পিছু নেয় নি। সে দৌড়ে বাসায় আসে, সেখানে আর ঘর নেই, পোড়া কিছু কাঠের থাম পরে আছে। সেখান থেকে একটা আধ পোড়া জামা পরে ফাতেমা আসে যে যায়গায় তার ভাই এর লাশ পরে ছিল সেখানে। লাশ টা এখন আর নেই, জানে কোথায় গেছে, রক্তের দাগও ধুয়ে গেছে গত দুই দিনের বৃষটিতে। সেইখানে একটা পোড়া কাঠ মাটির মধ্যে পুরে দেয় ফাতেমা, তার পর কিছু জংলি ফুল দিয়ে দেয় সেই মাটির উপর। ক্লান্তি, অবসাদ যেন ঘিরে ধরে তাকে। সেই ফুল গুলর পাশেই হাতের উপর মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে পরে ফাতেমা। বৃষ্টির ফোঁটা চোখে পরায় ঘুম ভাঙ্গে ফাতেমার। সে উঠে না, আকাশের দিকে তাকিয়ে শুয়ে থাকে, আকাশ টা কালো হয়ে আছে, মাঝে মাঝে বিজলির ঝলকানিতে চিরে যাচ্ছে আকাশ। সে সেই ঝড় বৃষ্টিতে শুয়েই থাকে, তার মনে হয় এত দিনের সব নোংরা স্পর্শ যা তা শরীর জুড়ে ছিল তা আজ ধুয়ে যাচ্ছে। সে পরেই থাকে। ঘণ্টা দেড় কি দুই পরে বৃষ্টি থামলে সে উঠে পাকা করা উঠান টা তে শোয়, গ্রাম টা যেন থেমে আছে, বোধ হয় একটা লোক ও নেই গ্রামে, এমনকি রাস্তার কুকুর গুল পর্যন্ত ডাকছে না। মা, বাবা আর ভাই এর কথা ভাবতে ভাবতে আবার ঘুমিয়ে পরে ফাতেমা। জ্বরে যে তার শরীর কাঁপছে তা যেন সে টেরই পাচ্ছে না। সেই ভেজা জামা পরেই শুয়ে পরে ফাতেমা।
সকাল বেলা যখন ঘুম ভাঙ্গে তখন এই কদিনে সে প্রথম অনুভব করে তার খিদে লেগেছে। এ কদিন তো সে অত্যাচার থেকে বাঁচা ছাড়া আর অন্যকিছু ভাবতেই পারে নি। সে উঠে বাজারের দিকে যায়, সব দোকান বন্ধ, কত গুল আবার পোড়া। তার মনে হয় পুর গ্রামে সে একলাই আছে, আর কেউ নেই। একটা পোড়া দোকানে ঢুকে সে কিছু খাবার খায়, প্রায় পচে আছে, কিন্তু কি করবে খেতে তো হবে। কিছুক্ষণ পএ একটা কুকুর কোথা থেকে যেন এসে তার পাশে বসে। এমন করে বসে যেন তাকে কতদিন ধরে চিনে। সে ছাড়াও যে গ্রামে আরো কোন জীব আছে জেনে তার ভাল লাগে, কিছু খাবার সে কুকুর টার দিকেও আগিয়ে দেয়। তারপর এ দোকান, ও দোকান ঘুরে কিছু ডাল-চাল নিয়ে বাসায় ফিরে, সঙ্গে কুকুর-টাকেও নিয়ে আসে। বাসা বলতে কেবল কিছু পোড়া থাম। তার পর খিচুড়ি রান্না করে সে খায়, কুকুর টাকেও দেয়।
এমনি করে কয়দিন কাটল তা সে জানে না। সে আসলে রহমত মাস্টার এর অপেক্ষায় ছিল, কিন্তু তাদের কেঁউই আসে নি দেখে তার খুব খারাপ লাগল। সে ঠিক করল সে নিজেই যাবে তাদের কাছে। কিন্তু তারা কথায় থাকে সে তো তা ঠিক করে জানে না। শুনেছিল তারা নাকি নদীর যে ধারে জঙ্গল সে ধারে নাকি তারা থাকে। সে যাবে, কুকুরটা কেও নিবে।
পরদিন সকালে উঠে রওনা হোল ফাতেমা। গ্রামের বেশিভাগ বাড়িই পোড়া, মনে হয় না কোন বাড়ি তে কেউ থাকে। কোন একটা বাড়ি থেকে একটা বাচ্চার কান্নার শব্দে তার ভুল ভাঙল। আসলে গ্রামের কিছু লোক আছে কিন্তু তারা মৃতের মত আছে। দূর থেকে মাতব্বর কে দেখে সে গ্রামের রাস্তার থেকে নেমে নদীর ধার দিয়ে চলতে শুরু করে। নদী তে ভেসে যাচ্ছে শত সহস্র লাশ, দেখে আঁতকে উঠে ফাতেমা। সে আবার নদীর ধাঁর ছেঁড়ে রাস্তায় উঠে পরে। হাটতে হাটতে যখন জঙ্গল এর ধারে এসে পৌছায় তখন প্রায় সন্ধ্যায়। সেই রাত্রেই ফাতেমা জঙ্গল এর মধ্য হাটতে শুরু করে। সারাদিন না খাওয়ায় শরীর ক্লান্ত, তাই শরীরের বিপরীতে গিয়েই এগিয়ে চলছে। হঠৎ করে তার কুকুর টি দৌড়াতে শুরু করে, সেও তার পিছু দৌড়ায়। যদিও অন্ধকারে দৌড়াতে তার কষ্ট হয়, তবুও সে দৌড়ে চলে। কিছুক্ষণ দৌড়ানোর পর সে একটা ছাউনি মত জায়গায় এসে জ্ঞান হারায়। চোখ খুলতে দেখে একটা লোক তার মাথায় পানি পট্টি দিচ্ছে, রহমত মাস্টার সে চিনতে পারে। কিন্তু উঠে বস্তে পারে না। সারা রাত সে আধ ঘুম আর জাগরণে কাটাল।
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙলে ফাতেমা বুঝতে পারে যে তার পা না-না জায়গায় কেটে গেছে। উঠে হাটতে চেষ্টা করে কিন্তু পারে না। মনে হয় যেন তার পা আর তার সাথে নেই। রহমত মাষ্টার তাকে শুয়ে থাকতে বলে। সে শুয়ে থাকে আর পাশেই বসে থাকে কুকুর টা। দুপুরে রহমত মাষ্টার তাকে খিচুড়ি খেতে দেয়, তার কিছুটা ফাতেমা দেয় কুকুর টা কে, কিছুটা নিজে খায়। প্রায় সপ্তা খানেক এমনেই কেটে যায় তার।
তারপর একদিন তাদের কম্পে হামলা হয়, দুজন মারাও যায়, আর কয়েক জন আহত হয়। ফাতেমা তত দিনে কিছুটা সুস্থ, সে আহতদের সেবা করে। রহমত মাস্টার বলে তাদের জায়গা পরিবর্তন করতে হবে, এই জাগায় থাকাটা নিরাপদ না। সেইদিন সন্ধ্যা বেলায়ই তারা রওনা হয়, জঙ্গল এর অন্যদিকটাতে যাবার জন্য। যে দুজন মারা গেছিল, তাদের লাশ ঐ খানেই কোনরকম মাটি চাঁপা দেয়া হয়।
তারা জঙ্গলের একদম শেষ-মাথায় গিয়ে আস্তানা বসালেন, এ দিক থেকে নদী অনেক কাছে, তাই লাশের একটা গন্ধ আসছে। সেই গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসছে ফাতেমার। সন্ধ্যার সূর্যের লাল আলো আর মানুষের রক্তের রঙ এই দুই মিলে নদীর পানি একটা বিশ্রী রঙ ধারণ করছে। ফাতেমার তা দেখতে অসহ্য লাগছে। রহমত মাস্টার আর তার দলের লোকেরা বসে আলোচনা করছে কি হবে তাদের পরবর্তী পদক্ষেপ। একটু দূরে দাঁড়িয়ে ফাতেমা শুনছে তাদের কথা। রহমত মাস্টার বলছে সে তাদের জয় এর একমাত্র পথ হচ্ছে হানাদার দের ঘাটিতে সরাসরি হামলা করা। আর তা একমাত্র গেরিলা হামলা করেই সম্ভব। কিন্তু কে যাবে, এ কাজে মৃত্যু হবার সম্ভাবনাই বেশি। সবাই বলে উঠল যে মরতে তো হবেই, তা নিয়ে কোন চিন্তা নেই, আপনি প্লান বলুন। রহমত মাস্টার আবার বলতে শুরু করল। প্লান বলতে আমাদের একজন একটা বোমা নিয়ে যাবে, কোন ভাবে হানাদার দের ক্যাম্পের যত কাছে যাওয়া যায় তত কাছে যাবে, তার পর বোমা টা মারবে। বোমা আজ রাত্রেই এসে পরবে। কিন্তু কাজ টা খুব সাবধানে করতে হবে। তো কে কে জেতে চায়। প্রায় সবাই হাত তুলল।
রহমত মাস্টার এক জনের নাম বলবে তার আগেই ফাতেমা তার জামা ধরে টান দিল। রহমত মাস্টার কি জিজ্ঞাস করতে ফাতেমা একটা কাঠের টুকরো দিয়ে কাদা মাটিতে লিখতে শুরু করল। আমি যাব। তুই যাবি, রহমত মাস্টার জিজ্ঞাস করল। হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল ফাতেমা। কোথায়? ফাতেমা আবার লেখতে শুরু করল ‘অপারেশনে’, ফাতেমা লিখল। সবাই অবাক হয়ে গেল। কেও যেতে দিতে রাজি নয়, এতটুক একটা মেয়ে, তার উপর যদি সব ঠিক না হয়। কিন্তু ফাতেমা অনড় আমি যাব, সে লিখল যে তাকে যেতে না দিলে সে নিজেকে মেরে ফেলবে। অনেক কথার পর ঠিক হোল তাকে যেতে দেয়া হবে। ফাতেমা মা কে কাল সকালে একজন জঙ্গল পার করে ছেড়ে আসবে, সে বাকিটা পথ একা গিয়ে হামলাটা করবে। অন্য একজন যাবে অন্য দিক-দিয়ে , সে যতটা কাছ থেকে সম্ভব ক্যাম্প টা কে নজরে রাখবে।
রাত্রে বোমের চালান এলো। আগের পরিকল্পনা মত ফাতেমা কে জঙ্গল টা পার করে দিয়ে এলো একজন। ফাতেমা যাবার আগে একটা কথা লেখে দিয়ে গেছে যে মাতব্বর কে যেন তারা না ছাড়ে। ফাতেমা সেখান থেকে ক্যাম্পে পৌঁছে গেল। অনায়াসেই সে ক্যাম্পের ভিতরে ঢুকল, কেউ বাধা দিল না। শিকার নিজে থেকে আসলে কেই বা বাধা দেয়, ফাতেমা ভিতরে ঢুকে ক্যাম্প এর ঠিক মাঝের একটা কামরায় পিন খুলে বোমটা রাখল। কিন্তু যত সহজে সে ঢুকেছে তত সহজে বেরতে পারল না। বেরোবার সময় গেটে থাকা রক্ষী তাকে বাধা দিল, টানা হেঁচড়া শুরু করল। সময় মত বোম টা বিস্ফোরিত হোল। ফাতেমার দেহটাও বমের আঘাতে রক্তাক্ত হয়ে গেল। তার চোখ দুটি বন্ধ হয়ে আসছে, সে দেখতে পেল অপূর্ব তার দিকে দি, দি বলে এগিয়ে আসছে। মুখ থেকে তার অজান্তেই বেরিয়ে এলো, ‘অপূর্ব’। তার পর সে যখন মাঠ ছেঁড়ে দূরে প্রান্তে তাকাল সে স্পষ্ট দেখতে পেল একটা গাছ থেকে একটা শকুন উড়ে চলে যাচ্ছে, তার বদলে দুটি লালা ঠোট ওয়ালা সবুজ টিয়ে এসে বসেছে সেখানে। তার চোখ দুটি ঝাপ্সা হয়ে আসছে, তার শরীর দিয়ে রক্ত পড়ছে, কিন্তু তার যেন কোন কষ্ট হচ্ছে না। কেবল তার কানে ভেসে আসছে দি, দি।
(৩)
মুক্তি, মা, কেমন লাগছে? ঘুম ভাংতেই মা এর প্রশ্ন। আমি হাসপাতালে কেন? মুক্তি মনে মনে নিজেকে জিজ্ঞাস করল। সে তো আর জোড়ে সবাই কে জিজ্ঞাস করতে পারবে না। তা হলে কি এতক্ষণ আমি স্বপ্ন দেখছিলাম? মুক্তি এতক্ষণে তার শরীরে নিচের দিকটায় ব্যথা অনুভব করল। নার্স মা কে বলছে বিরক্ত না করতে। শায়েলা দরজার বাহিরে তাকাতে দেখল পরিবারের সবাই দাঁড়িয় আছে, কেবিনের বাইরে। মা আবার জিজ্ঞাস করল, কোথায় ছিল কাল, কে তোকে নিয়ে গেছে তুলে?
সত্যি তো কোথায় ছিল সে কাল? তাকে কাল দুইটা লোক তুলে নিয়ে গেছিল, তার পর তো আর ভাল করে কিছু মনে পড়ছে না। তাহলে সে কি ফাতেমা; আর ঐ লোক দুইটা কি হানাদার, তাহলে কি আমরা স্বাধীনতার এত বছর পরও স্বাধীন নই। তার দাদুর মুখে এখন খুব মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনতে ইচ্ছে করছে। এসব ভাবতে ভাবতে সে তার হাতে একটা পিঁপড়ার কামড়ের মত কিছু অনুভব করল। তার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। শায়েলা দেখতে পারছে একটা ফাঁসির মঞ্চ আর তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে কালকের লোক দুট; আসামির পোশাকে। এটাইতো তার একান্ত কামনা, তাদের শাস্তি হবে।