মা ফোন দিয়েছে, মনে হয় জরুরী কোন বিষয়। বাড়ির বড় ছেলে আমি, যেতেতো হবেই.....! বলল ফিরোজ পাশে বসে থাকা তার বান্ধবী শিখাকে।মেয়েটাকে তার বেশ ভালো লাগে কিন্তু তা কোনোদিন বলা হয়'নি।
ফিরোজ দেখতে ভীষন হ্যান্ডসাম,গায়ের রং ফর্সা। যেকোনো মেয়ে একবার দেখলে দ্বিতীয়বার চোখ ফিরে তাকাবে। কিন্তু ছেলেটা কোন বাহ্যিক চাকচিক্যতা দেখায় না।তার ভাষ্য মতে "ঢাকায় পড়তে এসেছি, ফ্যাশন নয়, জীবনে বড় কিছু করতে হবে যা বাবা-মায়ের স্বপ্ন।"
.
"তুই এসেছিস যাক কাপড়টা ছেড়ে'নে" বললেন রেহানা বেগম। "বাড়িতে এত মানুষ কেন মা....?" -অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল ফিরোজ।
রেহানা বেগম পরে আসছি এমন হাতের ইশারা দেখিয়ে চলে গেলেন।
কিছুখন পর ফিরোজ মায়ের ঘরে গেল শুনতে পেল তার বাবা বলছেন "ওমন ছোট লোকের মেয়ে আমার বাড়িতে আসবে....!" ফিরোজকে দেখে চুপ হয়ে গেল,আর তার বাবা ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলেন।
রেহানা বেগম ছেলের হাত চেপে ধরলো,বলল-বাবা আমি একটা ভুল করছি, আমি একজন রে কথা দিয়া ফেলছি তুমি চাইলে আমি হেগো না কইরা দেবো। (অবাক হয়ে শুনছে ফিরোজ)তুমার অগোচরে আমি তুমার বিয়ার ব্যবস্থা করছি।
"মা আমার বয়স'ই বা কতো .....!!এই সময় এমন সিদ্ধান্ত।" প্রায় রেগেই বলল ফিরোজ।
.
অনেকটা অনিচ্ছাকৃত ভাবেই বিয়ে করতে হল ফিরোজকে। কন্যা বিদায় কালে কন্যার মা বলল "বিয়াইন আপনার ঋন আমরা কোনদিনও শোধ করবার পারুম না।"
সম্পূর্ণ অদেখা অচেনা একটা মেয়েকে বিয়ে করতে হল ফিরোজকে,এমন কি মেয়েটার নামও সে জানে না। আধুনিক যুগে এমন ছেলে সত্যিই মেলা ভার।
.
বৈঠক খানায় ফিরোজের সাথে তার আত্মীয়রাও বসে আছে হঠাৎ পাশের বাড়ির এক বৃদ্ধ মহিলা এসে বলল "কি লো ফিরোজের মা লুলা মাইয়া আনলা, কত টাহা যৌতুক দেলো..?ফিরোজের বাপ বিয়াত যায় নাই কে...?"
"চাচি এইডা কি কও মাইয়া ভালা, এক টাহাও যৌতুক লই নাই"রেগে বললেন রেহানা বেগম।
কথাটা শুনা মাএই ফিরোজ দাঁড়িয়ে গেল তার হাত ধরে তার মা বসিয়ে দিল সোফায়, মূহুর্তেই ঘরে নিরবতা নেমে এল ।
রেহানা বেগম বলল "দেখ বাপ জীবনতো একটাই এই জীবনে না হয় একটা ভালা কাজ করি, মাইয়াডা ভালা, চেহারাও ভালা, খালি হাতে ইট্ট সমস্যা।"
মায়ের মহৎ বাণী শুনেও ফিরোজ শান্তি পাচ্ছে না,বড্ড অস্থির লাগছে। কিছুখন পর তার চাচার ছেলের বউ আসলেন, "কি ফিরোজ সাহেব আমার বইনেরেতো কইছিলা গাল বাহা ওহন তুমি কেমনে এই বিয়া করলা !মাইয়া কালা, দুই হাতের একটা আঙ্গুলও নাই খালি কব্জি আছে।"
ফিরোজ সেই রাতেই ঢাকা চলে এলো কাউকে কিছু না জানিয়ে।
.
রেহানা বেগম বউকে খুব আদর করেন বউয়ের বাবার বাড়ি নিজেই নিয়ে যান, আবার নিজেই গিয়ে নিয়ে আসেন। গ্রামের বাজারের দিকের আট বিঘা জমিও বউয়ের নামে লিখে দিয়েছেন তার ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে।এমন সিদ্ধান্তে প্রতিবাদের কেউ নেই, বাকি তিন ছেলে ছোট, স্বামী বাধা দিলেও রেহানা বেগম তা গ্রাহ্য করে'নি।
বউ লতা এমন শাশুড়ি পেয়ে খুব খুশি।যদিও বিয়ের এক বছরেও তার স্বামী একটি বারের জন্য বাড়িতে আসে'নি। তার বিশ্বাস একদিন তার স্বামী ঠিক ফিরে আসবে।
.
হঠাৎ বাড়ি থেকে ফোন আসলো বরকত মিয়া অসুস্থ । বাবার অসুস্থতার খবর পেয়ে ছুটে গেল ফিরোজ । হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল উঠোনে। সাদা চাদর দিয়ে ঢাকা খাটোয়ারা ।বুকের ভেতরটা ধুক করে উঠলো। চারদিকে বিলাপের সুর, ছোট ভাইটা দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো।
সাহস করে চাদরটা সরিয়ে দেখলো তার প্রিয় বাবা। বাকরুদ্ধ হয়ে গেল ফিরোজ।জানতে পারলো হার্ট অ্যাটাকে তার বাবা মারা গেছেন। স্বামীর মৃত্যুতে রেহানা বেগম বারবার অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছেন। তার মাথায় পানি ঢালছে ফিরোজের স্ত্রী।মেয়েটার খুব অদ্ভুত ভাবে পানির মগ ধরে পানি ঢালছে, তার হাতের প্রত্যেকটা আঙ্গুলের মাথা নেই।
.
এখন ফিরোজ লতার সাথে বসে গল্পও করে মেয়েটা সত্যিই খুব ভালো, তার মায়ের খুব যত্ন করে, ছেলে হিসেবে মায়ের জন্য এমন প্রাপ্য কয়জন ছেলেই বা পায়।দু মাস ধরে ফিরোজ বাড়িতে, তার শশুর প্রায়ই শশুর বাড়ি যেতে বলে, কিন্তু ফিরোজ যায় না, রেহানা বেগম'ই যায়। বড্ড ভালো সম্পর্ক বউ-শাশুড়ির মাঝে।দেখেই তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলে ফিরোজ মায়ের সুখের চেয়ে জীবনে আর কি'বা বড় ।
তাছাড়াও লতা এতোটা কালো নয়, উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ বেশ মায়া মায়া মুখ।এসএসসি তে গোল্ডেন পেয়েছে বাহ্যিক জ্ঞানও প্রখর। ফিরোজ একদিন বলল- "লতা তুমি লিখ কি করে..! সে কাগজ কালম নিয়ে বসে পরলো, আঙ্গুলের শেষের অংশটা দিয়ে চমৎকার করে লিখে দেখালো ফিরোজ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো মেয়েটার দিকে .....সে হাসছে।
.
সেদিন শ্বাশুড় বাড়ির পাশের গ্রামে গেল ফিরোজ,চায়ের দোকানে বসে আছে ।হঠাৎ এক মাঝবয়সী লোক এসে বলল -"তোমার বাপের কাছে দশহাজার টাহা পাই চাইলেও দেয় নাই, এহন ফোনো বন কইরা রাখছে।"
"আমার বাবা এখানে আসতেন ....!সে তো মারা গেছেন।"
"ও আল্লাহ কি কও...! তোমার বাপ তিন মাস আগে এহেনে আইতো, আমার ঘর ভাড়া লইছিলো, প্রায় পাঁচ বছর।"
"আপনি চেনেন কি করে আমার'ই বাবা....?"
"আমি তারে তোমার লগে এই দোহানে দুই মাস আগে দেখছি।"
"দুই মাস আগে .....!!"অবাক ফিরোজ।
.
দুদিন ধরে রেহানা বেগম খুব অসুস্থ।
মায়ের ঘরে গেল ফিরোজ,তাকে দেখে তরিঘরি করে কিছু একটা বালিশের নিচে রেখে উঠে বসলেন।"তোমার শরীর এখন কেমন ....!আর তুমি একা কেন মেডিকেলে গেলে যেখানে তুমি মাথাই তুলতে পারছো না ...আমাকে বলতে, আমি সঙ্গে যেতাম।"
"আগে থাইকা ভালো, শরীর দুর্বল, এ এমন কোন রোগ না, চিন্তা করিস না।
.
রাত একটা কোন একটা বিষয় নিয়ে ফিরোজ খুব অস্থির, পেছনে তাকিয়ে দেখলো লতা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। বাতিটা নিভানো জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ফিরোজ।
হঠাৎ চমকে উঠল....! মাথাটা কেমন যেন করছে, নিজেকে বিশ্বাস করাতে পারছে না সে।
"শু***বাচ্চা তোর এ ঘরে কি......??"বেদম মার মারলো ফিরোজ।
"ফিরোজ কি করতাছোস...?"
"চুপ করুন আপনাকে মা বলতেও আমার ঘৃণা হচ্ছে, পাঁচ বছর ধরে চরগন্জে ঘর ভাড়া করে থাকতে আপনাকে জর করা হয়েছে, আমার বাবা তিন মাস আগেই মারা গেছে,আপনার বালিশের নিচে গর্ভপাতের মেডিসিন থাকে কি করে,
আজ বুঝতে পারছি কেন লতার মত ওমন একটা মেয়েকে এনেছেন, কেন সবচেয়ে দামি জায়গা লতার নামে লিখে দিয়েছেন, কেন বাবা হঠাৎ হার্ট অ্যাটাক করেছেন ছি ...ছি!"
ঘরের চিরদিকে তাকিয়ে দেখে লোহার শাবল রাখা, তুলে নিয়ে আঘাত করবে, ওমনি লতা এসে পা জড়িয়ে ধরল বলল -"আপনার জেল হইলে আমার কি হইবো.... আব্বারে ছাইরা দেন।"
শবল দিয়ে মাটিতে আঘাত করল ফিরোজ।
"বাবা ফিরোজ তুমি ভুল করতাছো বাড়ির সম্মান ধূলার সাথে মিশাইও না।"
রক্ত চক্ষু করে শশুড়ের দিকে তাকায় ফিরোজ।কিছুখন পর ঘরে ফিরোজের মেঝো চাচা এলো অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল কি হইছে ভাবী...!ফিরোজা কি ফোন করছে আবার....!"অনাবরত কাঁদছে রেহানা বেগম।
.
"কি হয়েছে ফিরোজা আপার...?" অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল ফিরোজ।
ফিরোজা ফিরোজের সৎ বোন, ফিরোজের বাবার প্রথম স্ত্রীর মেয়ে।তার মা মারা যাওয়ার পর মামার বাড়িতেই থাকতো । ফিরোজের মা, এ বাড়িতে আসার পর বহুবার চেষ্টা করেছে মেয়েটিকে বাড়িতে আনার কিন্তু ওর মামারা আসতে দেয়'নি।মেয়েটি ফিরোজের থেকে এক বছরের বড় ছিল।এটা ফিরোজ জানতো।
"কি আর কমু,মাইয়াডার অসুখ, পাঁচ বছর আগে এই মাইয়া মামার বাড়ির থে এক মাস্টরের লগে একলা বিয়া করছে,তোর মা শুইনা খুঁইজা বাইর কইরা দেখছে পলাডা ভালা তাই চরগন্জে ঘর ভাড়া কইরা দিছে, চরগন্জের বাজারে জমি কিন্না দিছে,তোর বাপ-মা প্রায় দিনই দেখতে যাইতো,এহন বিয়াইসাব যায় লগে, নইলে আমি যাই। মাইয়াডার পরীক্ষা সামনে বাচ্চা হইবো শুইনা,কাউরে কিছু না কইয়া, ওষুধের দোকানথে বড়ি খাইয়া, এহন মরে মরে অবস্থা। ভাবীর রাইতে মেডিকেল থাকনের কথা,হেললাইগাইতো বিয়াই নিতে আইছে আমি হেরে এহেনে পাঠাইয়া মটর সাইকেল চালু করতাছিলাম এহন হইছেডা কি আমার থে'ক......!!"অনবরত বলল ফিরোজের চাচা।
বাকরুদ্ধ ফিরোজ মাটির দিকে তাকিয়ে রইলো।