আজ এই অচেনা শহরে প্রথম দিন। শহরটা একেবারেই অচেনা,অজানা।নিজের দেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরের একটি দেশ, যেখানে দাঁড়িয়ে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে ভাবা যায় না, এটা আমার দেশ, কিংবা যে আকাশের দিকে তাকালে এও মনে হয় না যে এটা আমার আকাশ। এখানকার অদ্ভুত পোশাক পরা মানুষগুলোকে দেখলে বুকের ভিতর নাড়া দিয়ে ওঠে, আমি আমার নিজের মানুষগুলোর কাছ থেকে বহু দূরে চলে এসেছি!
আজ এই নতুন শহরে নতুন জীবনের প্রথম দিন।অনেকক্ষণ হল এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে এসেছি। এখন একটা ট্রেনে বসে নতুন জগতের কর্মব্যস্ততা আগ্রহসহ লক্ষ্য করছি।আজ তাহলে আমার জীবনের নতুন একটি অধ্যায়ের সূচনা হল, না!
যে ট্রেনটায় বসে আছি, সেটা আমার দেশের ট্রেনের চাইতে ভিন্ন। আমাদের ট্রেনে বসলে নীল আকাশ দেখা যায়,পথের দু’পাশে লাগানো সারিসারি সবুজ গাছ দেখতে পাওয়া যায়।কিন্তু এখানে কাচের জানালার ভেতর থেকে বড়বড় দালান কিংবা দোকান ছাড়া এখন অবধি কিছুই দেখতে পেলাম না।আমাদের দেশের ট্রেনে বাদামওয়ালা, আচারওয়ালার কাঙ্খিত হাঁকাহাঁকি শুনতে পাওয়া যায়।কিন্তু এখানে সবই নিস্তব্ধ, শান্ত।সবাই চুপচাপ বসে আছে।ট্রেনে আধুনিকতার চিহ্নস্বরূপ এসি আছে। তাই না দেখতে পাই কারো হাতে তালের পাখা, না শুনতে পাই গ্রীষ্মের গরমে অস্থির কোনো শিশুর কান্নার আওয়াজ।
এই ট্রেনে যে মেয়েরা আছেন, তারা সবাই পাশ্চাত্য পোশাক পরা। কেবল মাত্র আমিই বাঙালি পোশাক পরে আছি- সিল্কের শাড়ি।কেন যেন সকল আধুনিকতার মধ্যে নিজেকে বড় সেকেলে মনে হচ্ছে ।তবুও মনের মাঝে আলাদা একটা শান্তির পরশ খুঁজে পাচ্ছি- নিজের দেশ থেকে হাজার মাইল দূরে থাকলেও নিজের সংস্কৃতিটুকু তো আমার শরীরের সাথে আষ্টপিষ্টে জড়িয়ে আছে !
আমার পাশের সিটে যে মেয়েটি বসে আছে, সেও ওই একই ধরনের অদ্ভুত পোশাক পরা।
তার চোখ মোবাইলের স্ক্রিনে।খুব সম্ভবত সে এখন ফেসবুকে ব্যস্ত।মাঝে মাঝে আমার দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে।আমি কাচের জানালাটার দিকে চোখ ঘুরিয়ে নিলাম। ট্রেন থেকে নেমেই মাকে কল করতে হবে।তারপর একবার ইউনিভার্সিটিতে যেতে হবে। কী জানি আর কত সময় লাগবে !
এখানে এসে একটা মেয়েদের হোস্টেলে উঠেছি। বিভিন্ন দেশ থেকে আসা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া মেয়েরাই এখানে থাকে।হয়তোবা এখানে কোনো বাঙালী মেয়েও থাকে।কিন্তু আসবার পর থেকে এখন অবধি চোখে পড়ে নি।পড়লে ভীষন ভালো হত। অন্তত নিজের মনটাকে তো স্বান্তনা দেওয়া যেত। রুমে আসবার পর থেকে আরও বেশি কষ্ট হচ্ছে।এ ব্যস্ত পৃথিবীতে নিজেকে বড় একা, বড় অসহায় মনে হচ্ছে। বড় একটা রুমে আমি একা। বাবা নেই, মা নেই, ছোট বোনটাও নেই।কোনো পরিচিত, অতি পরিচিত মানুষকেও দেখতে পাচ্ছি না। সমস্ত কিছু কেমন যেন স্বপ্ন স্বপ্ন মনে হচ্ছে।
যে আমি কখনও নিজের বাবা, মা, বোনকে ছাড়া একটা রাতের জন্যও দূরে থাকি নি, যে আমি নিজের বন্ধুদের ছেড়ে একা কোথাও ঘুরতে অবধি যাই নি, সেই আমি আজ নিজের দেশকে ছেড়ে এত দূরে ? নিজের মনই যেন নিজের অস্তিত্তটাকে বিশ্বাস করতে চায় না। তাহলে মানুষ সময়ের পরিবর্তনের সাথে সমস্ত কিছু মানিয়ে নিতে পারে, তাই না !
এখানে এসে জানতে পারলাম আমার রুমমেট একজন ইংরেজ মেয়ে। এখন অবধি তার সাথে আমার পরিচয় হয় নি। দু’জন পৃথিবীর দু’প্রান্তের মানুষ, ভিন্ন জাতি, ভিন্ন সংস্কৃতি, ভিন্ন্ ভাষা।সমস্ত কিছুতেই আমরা একে অপরের চাইতে আলাদা। তার সাথে মানিয়ে চলতে পারব কী ?
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে ক্লান্ত শরীরের দু’চোখে ঘুম জড়িয়ে আসতে লাগল। রুমের বাতিটা বন্ধ করা হয়নি। সে নীরবে আমার এই নতুন পৃথিবীর নতুন ঘরটাকে আলোকিত করার দায়িত্বটা পালন করে যাচ্ছে।
০০০
এদেশে আসবার পর একটা মাস কেটে গেল। এই অল্প সময়ে কিছুটা হলেও নিজেকে গুছিয়ে নিতে পেরেছি।দেশে বাবা, মা, বোন, বন্ধুবান্ধব অনেকের সাথেই যোগাযোগ হয়েছে। ভিডিও কলে আপন বাড়ি, আপন ঘর, আপন মানুষ সমস্ত কিছুই স্বচক্ষে দেখতে পেয়েছি। কিন্তু...
এতে কি আর নিজের মাকে জড়িয়ে ধরবার সাধটা মেটে ? নিজ দায়িত্বে কাছে থেকে বাবার যত্ন নেবার সাধটা মেটে ?না কি ছোট বোনটাকে কারণে অকারণে বকাবকি করবার মত সুযোগটা পাই ? ইশ্, কতদিন বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যাই না !
এখানে এসে প্রায়ই কিছু বাঙালীকে দেখতে পেয়েছি।তাদের চেহারা, শারীরিক গড়ন, চলাফেরা –এ সমস্ত কিছুই আমাকে বুঝতে সাহায্য করেছে যে এরা আমারই স্বজাতি।তখন মনের মাঝে একটু অন্যরকম ভালোলাগার আভাস পেয়েছি। কিন্তু, তাতে কেবলমাত্র চক্ষুক্ষুধাটুকুই দূর হয়েছে, মনটাকে শান্ত করতে পারি নি। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কারনে তাদের সাথে কথা বলতে গিয়েও বলতে পারি নি। ইশ্, কতদিন কারও সাথে নিজের ভাষায় প্রান খুলে কথা বলি নি! হোস্টেলে, ইউনিভার্সিটিতে তো সকলের সাথে ইংরেজীতেই কথা বলতে হয়।টিকিট কিংবা খাবার কিনবার সময়ও তাই। আর রুমে এলেও তো .....
প্রথম প্রথম ভীষণ অস্বস্তি হতো। ওর আর আমার সংস্কৃতি একেবারেই ভিন্ন। কিন্তু লক্ষ্য করলাম ওর কোনো আচরনই আমাকে তেমন বিব্রত করছে না।বরং মেয়েটিকে আমার ভালোই লেগেছে। অচেনা দেশের অচেনা মেয়ে হয়েও ও আমাকে বড় বেশি আপন করে নিয়েছে।মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, আমি যেন আমার বড় বোনের সাথেই আছি। যখন দেশের কথা খুব বেশি মনে হয়, বালিশে মুখ লুকিয়ে কাঁদবার চেষ্টা করি, তখন এ অচেনা জগতে আমার একমাত্র আপনজন ওই, যে কিনা আমার পিঠে স্বান্তনার হাত বুলিয়ে দিয়ে যায়।
০০০
এর আগে কখনও এ পথে আসি নি। আজ কোনো একটা দরকারি কাজে এ পথে আসতেই রেস্টুরেন্টটা চোখে পড়ল। “বাঙালী খাবার ঘর”।কি সুন্দর গোটা গোটা অক্ষরে নামটা লেখা!
ইশ্, নিশ্চয়ই আমি এখানে আমার সেই হারিয়ে ফেলা খাবার স্বাদটা আবার ফিরে পাব!
খাবারের অর্ডার দিয়ে বসে আছি। ক্লাসের নোটগুলো বের করে দেখছি। হঠাৎ কে যেন ডেকে উঠল, “কাহিনী!”
স্পষ্ট বাংলা উচ্চারণ।কতদিন পরে নিজের নামটা শুনতে পেলাম!এদেশে আসার পরে তো আমার আসল নামটা হারিয়েই ফেলেছি।এখানে পরিচিত, স্বল্প পরিচিত সকলেই আমায়
‘ক্যাহিনী’ বলে ডাকে।
তবে এ ব্যক্তি অবশ্যই বাঙালি।কিন্তু পুরুষ কন্ঠ! কে এই ব্যক্তি? আমার নাম জানলেন কীভাবে? যতদূর জানি, এখানে তো আমার পরিচিত কেউ থাকেন না।তবে ?
কিছুটা আনন্দ আর অনেকখানি বিস্ময় নিয়ে ফিরে তাকিয়ে দেখি, ইনি সেই ব্যক্তি যাকে আমি বেশ কিছু বছর আগে নিজের চাইতেও বেশি চিনতাম।যে আমার দু’চোখের স্বপ্ন, আর বাস্তবের সম্পূর্ণ অংশ ছিল।যাকে নিয়ে আমি হাজারো রঙিন স্বপ্ন দু’চোখের পাতায় এঁকেছিলাম। যাকে আমি কিছুটা ইচ্ছায় আর কিছুটা অনিচ্ছায় আমার জীবন হতে হারিয়ে ফেলেছিলাম।
সে এখানে? কবে এসেছে? কেনই বা এসেছে?
প্রশ্নগুলো নিজের মনের মাঝেই চাপা পড়ে গেল।জিজ্ঞেস করলাম না। সত্যি বলতে, করতে পারলাম না। আমি যেন এক অতল সাগরে ক্রমাগত তলিয়ে যাচ্ছি।
“কেমন আছো?”
প্রশ্নটা শুনেই আমার সম্বিত ফিরে এল।আমি নিঃশব্দে আমার হ্যান্ডব্যাগ আর নোটবুকটা তুলে নিয়ে ফিরে যাচ্ছি।পেছনে আমার অতীত আমাকে বারবার ডেকে যাচ্ছে। রেস্টুরেন্টের বয় তৈরীকৃত খাবারটা এনে দেখল টেবিল ফাঁকা,কেউ নেই। এদিকে আমার দুচোখের কোণে সেই পুরোনো জলটা ছলছল করছে। এ জলটা একান্ত আমার, আমার একান্ত কামনার দিনগুলোর স্মৃতিচিহ্ন !!!