উপজেলা থেকে কিছুটা দুরে, একপাশে।চারপাশ শান্ত, নিরিবিলি। লোকসমাগম নেই বললেই চলে।তবে কখনও কখনও কলেজ পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের এ পথে হেঁটে যেতে দেখা যায়।কখনও আবার বিচ্ছিন্নভাবে চলা পথচারীও চোখে পড়ে। কিন্তু তাতে কখনও এই সুন্দর প্রকৃতির নীরবতা ক্ষুণ্ণ হয় না। বরং চারপাশটাকে বড় বেশি সুন্দর লাগে।অন্যরকম, ছবির মত লাগে।
রাস্তার দু’পাশে বিভিন্ন নকশা করা ছোট-বড় দালান।কোনোটা দোতলা, কোনোটা একতলা, কোনোটার উপরে আবার টিনের ছাউনি।লোকালয় হতে কিছুটা দূরে, রাস্তার পাশেই একটা ঘাটলা বাঁধানো পুকুর।খুব ভোরে আর সন্ধ্যের নিকটে সেখানে বিরাজ করে নিস্তব্ধ নিরবতা।আর সেই নিরবতায় অংশ নেয় একটি মাত্র মানুষ, যাকে প্রায়শই ওই পুকুরের সিঁড়িতে দেখতে পাওয়া যায় একাকীত্বতায় নিঃশেষ হয়ে যাবার প্রক্রিয়ায়।
বয়স যেন তাকে বিদায়ের বার্তা বারবার দিয়ে যায়।তার মাথা ভর্তি সাদা-পাকা চুল বারবার জানান দিয়ে যায় যে তার সময় প্রায় শেষের পথে।পরনে সাদা, কিছুটা নকশা করা পানজাবি, তার উপরে একটা চাদর।চোখে বাদামী ফ্রেমের চশমা।আর তার পাশে পড়ে থাকে একটা ক্রাচ।
সিঁড়িতে বসে সে পুকুরের দিকে তাকিয়ে একমনে কী যেন একটা ভাবতে থাকে। কখনও আবার নিজের মনের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
সে আজও এসেছে।তবে অন্য দিনের মত কিছুক্ষণ পুকুরের দিকে তাকিয়ে থেকে, মনেরই অজান্তে ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেই বাড়ির পথে পা বাড়ায় নি।সন্ধ্যে পার হয়ে রাত হতে চলেছে। রাতের অন্ধকার গভীর হতে গভীরতম হচ্ছে। তবুও সে একাকী বসে আছে।বাড়িতে যাবার কথা একবারের জন্যও স্মরণ হচ্ছে না।সত্যি বলতে, আজ বাড়িতে যেতে মোটেও ইচ্ছে হচ্ছে না।অবশ্য বাড়িতে গিয়েই বা কি হবে? সেই তো বদ্ধ একটা ঘরেই নিজেকে আটকে রাখতে হবে।নিজের ঘর?হ্যাঁ!ঐ চার দেয়ালে ঘেরা,জেলখানার মত ঘরটাই তো তার নিজের ঘর।সেই ঘরে ফিরে, দরজাটাকে বন্ধ করে, এই সুন্দর পৃথিবী থেকে নিজেকে পৃথক
করে বসে থাকতে হবে।রাত্রি দশটার দিকে কাজের ছেলেটা ও ঘর থেকে দুটো রুটি আর আলুর তরকারি এনে দিয়ে যাবে।ক্ষুধা না মিটলেও নিঃশব্দে রুটি দুটো খেয়ে, বাতিটা নিভিয়ে শুয়ে পড়তে হবে।
এভবে একটা ঘর নামক জেলখানায় তার পড়ে থাকতে ভালো লাগে না।তবুও, কী আর করবে?করার তো আর কিছুই নেই। কয়েক বছর আগে যা একটু ছিল, দুর্ঘটনায় ডান
পা-টা হারাবার সাথে সাথে সে ক্ষমতাটুকুও তাকে হারাতে হয়েছে।
জীবনের শেষ অঙ্কে এসে সে আজ শূণ্য।আজ আর কিছুই নেই।সারাদিন শুধু কানের কাছে একটা শব্দই বারংবার বেজে ওঠে ‘বোঝা!’ ‘বোঝা!’ ‘বোঝা!’ কিন্তু নিজের অক্ষমতার কথা বারবার শুনতে তার আর ভালো লাগে না।এ কথাগুলো বারবার শোনার চাইতে নিজের ঘরে বন্দি হয়ে থাকা অনেক শান্তির।তবুও, মানুষ তো!চার দেয়ালের মাঝে কতক্ষনই বা নিজেকে আটকে রাখতে ইচ্ছে করে?তাই সুযোগ পেলেই এই নির্জন পুকুরের ধারে বসে মুক্ত আকাশটাকে দেখবার জন্য সে ছুটে আসে।নীল আকাশ, মেঘলা আকাশ,রাতের তারায় ভরা আকাশ,অন্ধকারে আচ্ছন্ন আকাশ-আকাশের এই ভিন্ন ভিন্ন রূপ সে অবাক দৃষ্টিতে দেখে আর নিজের মনকে জিগ্গেস করে, ‘আকাশও তবে রূপ বদলায়, না?’ সে এই রূপের পরিবর্তনের সাথে নিজের জীবনের অদৃশ্য মিল খুঁজে পায়।
কোনো এককালে সে যখন কর্মক্ষম ছিল, তখন কি কষ্টটাই না করেছে তার একমাত্র সন্তানের সুখের জন্য।মাথার ঘাম পায়ে ফেলে সে তার সমন্ত শখ, আবদার মেটানোর চেষ্টা করেছে।তাকে সুখে রাখবার কোনো চেষ্টাতেই সে কোনো ঘাটতি রাখে নি।সর্বস্ব দিয়ে সে চেষ্টা করেছে যেন তার ঘরের প্রদীপ সবসময় জ্বলজ্বল করে জ্বলতে থাকে।
কিন্তু, হায়রে নিয়তি!সেই সন্তান যখন আজ বড় হয়েছে, নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে, নিজের সংসার সাজিয়েছে, তখন এই বৃদ্ধ মানুষটা তার কাছে হয়ে পড়ল ‘বোঝা’, ‘সংসারে একজন অতিরিক্ত ব্যক্তি’ আর ‘বিরক্তিকর’।হ্যাঁ, বিরক্তিকর! আর মাঝে মাঝে ‘অসহ্য’।
শব্দগুলো পুনরায় মনে পড়তেই, তার চোখেমুখে একটু নিঃস্ব আর অনেকখানি হতাশায় জর্জরিত হাসির আভাস পাওয়া গেল।ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলতেই সে লক্ষ্য করল এই ঘন অন্ধকারে পুকুরের একপাশ আলোকিত হয়ে আছে।ধীরে ধীরে জোনাকিরা এসে সেখানে জড়ো হতে লাগল আর চারপাশ অন্ধকার কাটিয়ে অালোময় হয়ে উঠতে লাগল।
অনেকদিন পরে জোনাকির আলো দেখে, তার সমস্ত দুঃখ যেন এক নিমিষেই হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।হাজারো কষ্টের ভিড়ে এই জোনকির দল তাকে খুঁজে এনে দিল একটুখানি ভালোলাগার আভাস।সে তাদের দিকে স্থির দৃষ্টি রেখে বলে উঠল, ‘জীবনের শেষে আমি এক ঝাঁক জোনাকির কাছে ঋণী।’
২৮ এপ্রিল - ২০১৭
গল্প/কবিতা:
১৪ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪