অলৌকিক

ভৌতিক (ডিসেম্বর ২০১৮)

অমিতাভ সাহা
  • 0
  • ৬৩
বছর পাঁচেক আগেকার কথা। তখন সদ্য চাকরি পেয়েছি হাইস্কুলে। পোস্টিং দিয়েছে বাড়ি থেকে অনেক দূরে চাঁচলে। আট-ন’ঘন্টা ট্রেন জার্নি করে সামসী স্টেশনে নামতে হয়। সেখান থেকে বাস বা অটোতে আধঘণ্টামত। অনেক কষ্টে পাওয়া চাকরি, দুবার রিটেন ক্লিয়ার করেও ভাইভা’তে আটকে গেছিলাম। তাই তৃতীয়বার ক্লিক করার পর স্বভাবতই ভীষণ খুশি ছিলাম। পোস্টিং নিয়ে অত মাথা ঘামাইনি, সুন্দরবনে দিলেও যাবার জন্য তৈরি ছিলাম। স্কুলে জয়েন করে চাঁচলে একটা বাড়িভাড়া নিয়ে টানা দুমাস স্কুল করলাম। তারপর গ্রীষ্মের ছুটিতে বাড়ি এসেছিলাম। ছুটি শেষে আবার ফিরে যাচ্ছিলাম চাঁচলে।

ট্রেনে চেপে যাত্রা শুরু করলাম দুপুর সোয়া বারোটা নাগাদ। ট্রেনটা ভালোই যাচ্ছিল। ঘণ্টা চারেক যাবার পর বেলাকোবা স্টেশনে এসে দাঁড়ালো তো দাঁড়ালোই। আধঘন্টা হয়ে গেল, দাঁড়িয়েই আছে। বিরক্ত হয়ে প্ল্যাটফর্মে নেমে একে-ওকে জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছে? জানতে পারলাম, কিশনগঞ্জ স্টেশনে নাকি অবরোধ করেছে। ওখানে দীর্ঘদিন যাবত একটা ইউনিভার্সিটি খোলার জন্য আন্দোলন চলছিল। কিন্তু কর্তৃপক্ষ কর্ণপাত না করায় আন্দোলনকারীরা সেদিন “রেল রোকো” আন্দোলনে নামে। অবরোধ কখন উঠবে, কেউ জানে না। স্টেশনে অ্যানাউন্সমেন্ট হল, “গাড়ি ছাড়তে বিলম্ব হবে”। আমি একটা পত্রিকা পড়ে সময় কাটাচ্ছিলাম। একবার ভাবলাম, বাড়ি ফিরে যাই। কিন্তু দু’এক ঘণ্টার মধ্যে ফেরার কোন ট্রেন নেই। অগত্যা সিটে বসে রইলাম। পাক্কা আড়াইঘন্টা পর ট্রেন ছাড়ল। মনে মনে ভাবলাম, ট্রেনটা একটা বেখাপ্পা টাইমে সামসী গিয়ে পৌঁছবে। হলও তাই। রাত এগারোটা নাগাদ গিয়ে পৌঁছলাম। ছোট স্টেশন। দু’একজন লোক নেমে এদিকওদিক চলে গেল। এত রাতে চাঁচলে ফেরার কোন গাড়ি পাব না। তাই প্ল্যাটফর্মেই বসে রইলাম। ভোরবেলা অটো ধরে যাওয়া ছাড়া আর উপায় নেই।

আধঘণ্টা যেতে না যেতেই প্রচণ্ড খিদে পেল। আসলে সারাদিনে তেমন কিছু খাওয়া হয়নি। এনজেপি’তে ট্রেনটা এমন প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ালো, যে চা-বিস্কুট ছাড়া বিশেষ কিছু খাওয়া হল না। খিদেয় পেট চোঁ-চোঁ করছিল তাই স্টেশন থেকে বেরিয়ে এদিকওদিক দেখতে লাগলাম যদি কিছু খাবার পাওয়া যায়। কিন্তু দেখলাম এত রাতে সব দোকানই বন্ধ হয়ে গেছে। সঙ্গে লাগেজ বিশেষ কিছুই ছিল না একটা সাইডব্যাগ ছাড়া। এগোতে এগোতে অনেকদূর চলে গেলাম। নিঝুম নিশুতি রাত। শেষে রাস্তার ধারেই মাঠের প্রান্তে একটা কালীমন্দির দেখতে পেলাম। মন্দিরপ্রাঙ্গনে গিয়ে হাজির হলাম। মন্দিরের টিমটিমে বাল্বের আলোয় চোখে পড়ল, পুরুতঠাকুর মেঝেয় মাদুর পেতে শোবার যোগাড়যন্ত্র করছিলেন। আমাকে দেখতে পেয়ে অবাক হলেন।
এগিয়ে এসে বললেন, “তুমি এত রাতে কোত্থেকে আসছ বাবা?”

-“ট্রেনে এলাম, খুব লেট করল তো...আমি আসলে খাবারের দোকান খুঁজছিলাম”
-“এত রাতে দোকান খোলা পাবে! আমার কাছে মায়ের ভোগের প্রসাদ আছে। দেব?”
-“তাই দিন”।

উনি একটা থালায় খিচুড়ি, পাঁচমেশালি সব্জি ও বেগুনভাজা এনে দিলেন। আমি পাশের কল থেকে হাত ধুয়ে এসে মন্দিরের সামনের বারান্দায় বসে খেতে শুরু করলাম। প্রচণ্ড খিদের সময় প্রসাদ অমৃত মনে হচ্ছিল। ওনার আতিথেয়তায় আমি মুগ্ধ হলাম।

প্রসাদ দেবার সময় ওনাকে ভালো করে দেখতে পেলাম। সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি ও ধুতি পরনে। লম্বাটে গড়ন, বয়স ষাটের কাছাকাছি হবে।
খেতে খেতে পুরুতমশায়কে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি এত রাতে জেগে আছেন যে!”
উনি বললেন, “পাশের গাঁয়ে গেছিলাম। একটা যজ্ঞ ছিল। ওখান থেকে ফিরতে রাত হয়ে গেল”।
-“কিসের যজ্ঞ ঠাকুরমশায়?”

-“একটি বাচ্চা ছেলে দীর্ঘদিন যাবত জ্বরে ভুগছে। কিছুতেই কমছে না। ওকে সুস্থ করে তোলার জন্য যজ্ঞ অনুষ্ঠান করলাম আজ”।
-“যজ্ঞ করে কি রোগ সারে?”
-“নিশ্চয়ই সারে। তন্ত্রসাধনার জোর থাকলে অনেক কিছুই সম্ভব”।

ওনার সাথে তর্ক করলাম না। খাওয়া শেষে থালাটা রাখতে যাবার সময় মন্দিরঘরের এক কোণায় একটা মস্ত থালায় একটা মানুষের মাথার খুলি, কিছু হাড়গোড়, পোড়া কাঠের অবশিষ্টাংশ, ঘটিবাটি দেখে চমকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “এসব কিজন্য ঠাকুরমশায়?”

-“এসব মা ছিন্নমস্তার আরাধনার উপকরণ। প্রত্যেক অমাবস্যার রাতে মানিকচকে গঙ্গার ধারে শ্মশানঘাটে মায়ের পূজাঅর্চনা করে থাকি। দেবীর ভীষণা প্রকৃতি ও ক্রোধ। সঠিকভাবে পূজা না করলে দেবী পূজারির মস্তক ছিন্ন করে রক্তপান করেন, আমার গুরুর কাছে শোনা। তবে পূজায় সন্তুষ্ট হলে দেবী অনেক আধ্যাত্মিক ও অলৌকিক শক্তি বরস্বরূপ দান করে থাকেন”।
-“আপনি পেয়েছেন কোন অলৌকিক শক্তি?”
-“কেন বাবা, তোমার এত আগ্রহ কেন?”
-“না শুনেছি তন্ত্রসাধনায় সিদ্ধ ব্যক্তিরা মানুষের ভূত-ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারেন?”
-“নিশ্চয়ই পারেন”।
-“আপনি বলতে পারবেন আমার অতীত-ভবিষ্যত সম্বন্ধে?”
-“তুমি কি আমাকে পরীক্ষা করতে চাইছ?”
-“না না, ভীষণ কৌতূহল বোধ করছি...”
-“কি জানতে চাও বল?”

আমি ওনাকে আমার বাড়ির ঠিকানা, জন্মস্থান, আমি কি করি, ইত্যাদি জিজ্ঞেস করলাম। উনি সব প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিলেন। ওনার মধ্যে কোন দৈবিক শক্তি আছে, এমনটা আমার মনে হল। এ ধারণা আরও বদ্ধমূল হল, যখন উনি নিজে থেকেই এমন কিছু কথা বললেন, যা অন্য কারো জানার কথা নয়।

উনি বললেন, “তুমি খুব খুঁতখুঁতে স্বভাবের। তালা বন্ধ করে ঘর থেকে বেরনোর পরেও আবার ফিরে গিয়ে দেখো, তালাটা ঠিকঠাক লেগেছে কিনা, তাইনা?”
একদম সঠিক। আমি এরকম অনেকসময়েই করে থাকি।

আবার বললেন, “তোমার কপালে যে কাটা দাগটি আছে, সেটা ছোটবেলায় তোমার ছোট ভাইয়ের সাথে মারামারি করার ফল”। আন্দাজে ঢিল মেরে এত তথ্য সঠিকভাবে বলে দেওয়া সম্ভব নয়। তাই বিস্মিত হলাম। ওনার উপর আমার শ্রদ্ধা জন্মালো। পকেট থেকে ১০০ টাকা বের করে দক্ষিণাস্বরূপ দিলাম। উনি নিতে চাইছিলেন না। আমি জোর করেই দিলাম।
-“আমি তাহলে আসি বাবা। অনেক রাত হল। আপনাকে অনেক বিরক্ত করলাম”- বলে আমি ওঠার জন্য প্রস্তুত হলাম।
-“একটু দাঁড়াও বাবা। একটা কথা তোমাকে বলা দরকার যেহেতু এর সঙ্গে তোমার কল্যাণ-অকল্যাণ জড়িয়ে আছে”।
-“কি কথা?”
-“তোমার সামনে একটা ফাঁড়া আছে দেখতে পাচ্ছি”।

-“কিসের ফাঁড়া?”-দুশ্চিন্তার স্বরে বললাম।
-“তুমি যে বাড়িটিতে থাক, সেখানে একটি অশরীরী ছায়া আছে। তুমি ঐ বাড়িতে ঢোকার পর থেকে তোমার শরীর ভালো যাচ্ছে না, ঠিক কিনা বলো?”
-“হ্যাঁ, ঠিক”।
-“তুমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, বাড়িটা বদলে ফেল। নইলে কিছুদিনের মধ্যেই কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটবে”।

ঠাকুরমশায়কে প্রণাম করে বিদায় নিলাম। ভাড়াবাড়িতে আমি মোটে দু’মাস থেকেছি, কিন্তু তার মধ্যে বেশিরভাগ দিনই আমার শরীর ভালো ছিল না। কিছুদিন আমাশায় ভুগলাম, সেটা ঠিক হতে না হতেই প্রাণান্তকর কাশি। কাশির ঠেলায় রাতে ঘুমোতেই পারতাম না। বাড়িতে ছুটি কাটানোর পর একটু সুস্থ হয়েছিলাম। এত নিখুঁত প্রেডিকশন উনি কিভাবে করলেন, আমার কল্পনাতীত ছিল।

আমি যে বাড়িটাতে ভাড়া থাকতাম, সেখানে বাড়িওয়ালা সস্ত্রীক দোতলায় থাকতেন। আমি নীচতলায় যে দুটি ঘর নিয়ে ছিলাম, সেখানে আমি আসার আগে এক ভদ্রলোক তার পরিবার নিয়ে থাকতেন। ওনার স্ত্রী বছরখানেক আগে মারা যান। তারপর ভদ্রলোক বাড়ি ছেড়ে চলে যান। তারপর থেকে ঘরটা খালি পড়ে ছিল। এটা আমার বাড়িওয়ালার কাছে শোনা। কিন্তু ভদ্রমহিলা কিভাবে মারা যান, এর বৃত্তান্ত আমি কিছুই জানতাম না, জানতেও চাইনি। বাড়িটা মোটামুটি সস্তায় ভাড়া পেয়েছিলাম, তাই অন্যত্র ভাড়ার খোঁজ করিনি।
পুরুতঠাকুরের কাছে অতৃপ্ত আত্মার কথা শুনে আমার মনে হল ঐ ভদ্রমহিলার মৃত্যু স্বাভাবিকভাবে হয়নি। পরদিন এসে বাড়িওয়ালাকে বাড়ি ছেড়ে দেবার ইচ্ছে প্রকাশ করলাম। উনি বললেন, “কেন কি হল আবার?”

-“আমাকে একজন তান্ত্রিক বলেছেন, আমার ঘরটিতে অশরীরী ছায়া আছে”।
-“তুমি এত লেখাপড়া শিখে এসব ভূতপ্রেতে বিশ্বাস কর? এইসব তান্ত্রিকবাবারা বেশিরভাগই ঠগবাজ হয়। এদের কথা বিশ্বাস কোরোনা। এরকম দু’দিক খোলা আলোবাতাসযুক্ত ঘর তুমি এ তল্লাটে পাবে না। তবু যদি যেতে চাও, বাধা দেব না।”
-“আচ্ছা, আমার ঘরে আগে যে ভদ্রমহিলা থাকতেন, ওনার মৃত্যু কিভাবে হয়েছিল?”
-“ওর গ্যাস্ট্রিক আলসার হয়েছিল। কিন্তু ধরা পড়েছিল একবারে শেষ পর্যায়ে এসে। তখন আর ডাক্তাররা কিছু করতে পারেনি”।

আমার ঠিক বিশ্বাসযোগ্য মনে হলনা। আমি আর বেশি ঘাঁটালাম না। মনে মনে বাড়ি ছেড়ে দেবার জন্যে প্রস্তুত হলাম, অন্য বাড়ি সন্ধান করতে লাগলাম। দু’তিনটে বাড়ি দেখলাম, কিন্তু মনঃপুত হল না। কোথাও স্যাঁতস্যাঁতে দেওয়াল, কোথাও বাথরুম শোবার ঘর থেকে অনেকটা দূরে। একটা বাড়ি যদিও বা পছন্দ হল, ভাড়া চাইল অনেক বেশি। তাই আপাতত এই বাড়ি ছাড়তে পারলাম না। ভাবলাম, আর ক’টাদিন সময় নিয়ে খুঁজে দেখি। দিন পনেরো কেটে গেল। একদিন বাড়িওয়ালা এসে বললেন, “আমি পাঁচসাত দিনের জন্য দেশের বাড়ি যাব। তুমি এর মধ্যে বাড়ি যাবে না তো?”

আমার বাড়ি যাবার কোন পরিকল্পনা ছিল না, কারণ ছুটিছাটা তখন কিছু ছিল না। উনি দোতলায় তালা মেরে দেশের বাড়ি চলে গেলেন। নীচতলায় আমি একাই ছিলাম। পাড়াপ্রতিবেশীর সঙ্গে তখনও আমার খুব একটা আলাপ পরিচয় হয়নি। একদিন বিকেলবেলা স্কুল থেকে ফেরার সময় এক প্রতিবেশী ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা হল। ভদ্রলোক রিটায়ার্ড স্কুলটিচার। বাড়ির সামনে পায়চারি করছিলেন। আমাকে দেখে বললেন, “আপনি স্বপনবাবুর বাড়ি ভাড়া থাকেন, না?”
-“হ্যাঁ”।
-“আসেন না একটু। চা খেয়ে যান”।
ভদ্রলোকের বাড়ির উঠোনে চেয়ার পেতে বসে টুকটাক কথাবার্তা হতে লাগল। মাঝখানে উনি নিজেই উঠে গিয়ে চা করে আনলেন। ওনার স্ত্রী গত হয়েছেন। ছেলে বিদেশে থাকে। তাই বাড়িতে একাই। খুব নিঃসঙ্গ, তাই গল্প করার লোক খুঁজে বেড়ান। আমাকে পেয়ে ওনার কর্মজীবনের অজস্র গল্প শোনাতে লাগলেন। আমি কথাপ্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি এ পাড়ায় কত বছর আছেন?”

-“তা, বছর বিশেক তো হবেই। বাড়ি আমার বুলবুলচণ্ডীতে। স্কুল থেকে অনেক দূর হয় বলে আমি এখানে বাড়ি করেছিলাম”।
-“আচ্ছা, আমি আসার আগে স্বপনবাবুর বাড়িতে যে ভদ্রলোক ভাড়া ছিলেন, ওনার সাথে আপনার আলাপ হয়েছিল?”
-“হ্যাঁ, হয়েছিল বৈকি। তরুণবাবু। উনি গাড়ির ড্রাইভারি করতেন।”
-“ওনার স্ত্রী মারা গেলেন কিভাবে?”
-“আমি যতদূর জানি সন্তানশোকে। ওদের একটি মেয়ে ছিল। বছর চারেক বয়স হবে। মেয়েটা একদিন খেলতে খেলতে তোমাদের বাড়ির পাশে যে পুকুরটা আছে, ওখানে পড়ে যায়। কেউ খেয়ালও করেনি। তরুনবাবু তখন ডিউটিতে ছিলেন। ওনার স্ত্রী তো মেয়েকে খুঁজে খুঁজে হয়রান। শেষে একজন পুকুরে স্নান করতে এসে বাচ্চা মেয়েটাকে মৃত অবস্থায় পায়।”
-“তারপর?”
-“তারপর আর কি! একমাত্র মেয়েকে হারিয়ে তরুনবাবু ও তাঁর স্ত্রী একেবারে মুষড়ে পড়েন। খুব শোক পেয়েছিলেন। পাওয়াটাই স্বাভাবিক। তরুনবাবু মাসখানেক কাজেই যাননি। তারপর ধীরে ধীরে আবার ড্রাইভারি শুরু করলেন। উনি চলে গেলে ওনার স্ত্রী বাড়িতে একাই থাকতেন। ওদের বাড়িতে যে কাজের মাসী রান্না করত, তার কাছেই শোনা। ভদ্রমহিলা ঠিকঠাক খাওয়াদাওয়া করতেন না, কারো সাথে কথা বলতেন না। ধীরে ধীরে দুশ্চিন্তায় মানসিক অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েন। একদিন ঘরে অনেকগুলো ঘুমের ওষুধ খেয়ে পড়ে ছিলেন। কখন খেয়েছিলেন, কে জানে। তরুনবাবু রাতে বাড়ি ফিরে অচৈতন্য অবস্থায় পান। ডাক্তার ডেকে স্টমাক ওয়াশ করেও বাঁচানো যায়নি”।

এমন হৃদয়বিদারক কাহিনী শুনে আমার ভীষণ খারাপ লাগছিল। রাত্রিবেলা বাড়ি ফিরে ঐ কথাগুলো মাথায় ঘুরছিল। তার উপর পুরুতঠাকুরের কথাও মনে পড়ল। অশরীরী ছায়ার কথা ভেবে গা ছমছম করতে লাগল। বাড়িতে আমি একাই ছিলাম। রাত্রে ভীষণ ভয় করছিল। যদি ঐ ভদ্রমহিলার আত্মা এসে উপস্থিত হয়, সেই ভয়ে সারারাত ঘরে আলো জ্বালিয়ে রাখলাম। রাতে ঘুম হল না। পরদিন স্কুল থেকে ফেরার সময় আমার এক কলিগকে বললাম, “ভাই, আমি বাড়িতে একা আছি। বাড়িওয়ালা গেছে দেশের বাড়িতে। রাতে ভয়ভয় লাগে। তুই কি রাতে আমার সাথে থাকতে পারবি?”

ও বলল, “আমার বউ বাপের বাড়ি গেছে। আমিও একা আছি। নো প্রবলেম। চুটিয়ে আড্ডা মারা যাবে। তুই মাংসটাংস রান্না করে রাখিস। আমি রাতে চলে আসব”।

কলিগের সঙ্গে দু’তিনদিন রাতে বেশ ফুর্তি করে মাছমাংস খেয়ে কাটানো গেল। তারপর একদিন বিকেলবেলা স্কুল থেকে ফেরার পর আকাশে ভয়ানক মেঘ করল। চারিদিক কালো অন্ধকার করে এলো। সন্ধে সাতটা বাজতে না বাজতেই প্রবল বৃষ্টি আরম্ভ হল। দমকা বাতাসে সারাদিনের গুমোট গরম কেটে গিয়ে বেশ একটা ঠাণ্ডা মনোরম পরিবেশ সৃষ্টি হল। তারপর গ্রাম্য পরিবেশে যা হবার তাই হল, লোডশেডিং। আমি ঘরে টেবিলের উপর মোমবাতি জ্বালিয়ে বিভূতিভূষণের উপন্যাস পড়তে আরম্ভ করলাম। পড়তে পড়তে রাত ন’টা বেজে গেল। তবু অঝোর ধারায় বৃষ্টি। কারেন্টেরও দেখা নেই। কলিগ ফোন করে বলল, “আজ এই প্রচণ্ড বাদলায় আর যেতে পারবনা ভাই”। সত্যি সেই দুর্যোগ মাথায় করে আসার কোন উপায় ছিল না। আমি মোমবাতি নিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে গ্যাসের ওভেনে ভাত বসিয়ে দিলাম। সকালের রান্না করা ডাল-তরকারি ছিল। খাওয়াদাওয়া করে রাত দশটার মধ্যে শুয়ে পড়লাম।

মাঝরাতে প্রবল বিদ্যুতের গর্জনে ঘুম থেকে চমকে উঠলাম। তখনও কারেন্ট আসেনি। মোমবাতিটাও খুঁজে পেলাম না। অন্ধকারে হাতড়ে বাথরুম থেকে ঘুরে এলাম। দমকা বাতাসে কখন জানলা খুলে গেছে, খেয়ালই করিনি। বিছানায় জলের ছাট আসতে লাগল। জানলাটা বন্ধ করতে গেছি, তখনই প্রচণ্ড বজ্রপাত হল। সেই বিদ্যুতের আলোয় একঝলকে দেখতে পেলাম, আমার ঘরের পাশেই যে একটুকরো ফাঁকা জমি ছিল, সেখানে প্রায় বিশ হাত দূরে এক সাদা কাপড় পরা মহিলা কোলে একটি বাচ্চা নিয়ে আমার দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। দৃষ্টিতে যেন আগুন ঝরছিল। বুকের মধ্যে ধক করে উঠল। বিদ্যুতের আলো চলে যাবার পর আর কিছু দেখতে পেলাম না। ঘুম উড়ে গেল। মিনিটখানেক পর আবার বজ্রপাত। দেখি সেই ভয়ানকমূর্তি মহিলা আরও কাছাকাছি চলে এসে জানলা থেকে প্রায় দশ হাত দূরে দাঁড়িয়ে আছেন। লক্ষ্য করলাম, হাঁটুর নিচ থেকে পুরো ফাঁকা। মানে শুন্যে দাঁড়িয়ে আছেন। বিদ্যুতের আলোটা মোটামুটি পাঁচ সেকেন্ড ছিল। সেই আলোয় এমন ভয়ানক দৃশ্য দেখে আমার গায়ের রক্ত হিম হয়ে গেল আর হৃৎস্পন্দন বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হল। তারপর কি হয়েছিল, আমার আর হুঁশ ছিল না। পরদিন সকালে যখন হুঁশ এলো, দেখি বাড়িওয়ালা চোখেমুখে জলের ছিটে দিচ্ছেন।

জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি এরকম দরজাটরজা খুলে মেঝেতে শুয়ে ছিলে কেন? নেশাটেশা করেছ নাকি?”

মনে পড়ল, মাঝরাতে বাথরুমে গিয়েছিলাম। অন্ধকারে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করতে ভুলে গেছিলাম। রাত্রির বৃত্তান্ত ওনাকে আর কিছু বললাম না। শুধু বললাম, “আমি আর এ বাড়িতে থাকব না”।

তল্পিতল্পা গুটিয়ে সেদিনই বাড়িবদল করলাম।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
রঙ পেন্সিল ভাল লাগলো গল্প। অনেক শুভকামনা
আবু আরিছ পুরোটা পড়া গেল না, যখন বললেন পুরুতমশায় আপনার বাড়ির ঠিকানা বলছে, তালা নিয়ে খুতখুতানি, খুবই সস্তা বিষয়, বারটার পর আপনার শখ হলো মন্দির দেখার, এসব খামখেয়ালি ছাড়া আর কিছুই নয়...

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

গল্পটিতে একটি ভাড়াবাড়ির কথা বলা হয়েছে, যেখানে লেখক এক ভৌতিক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়ে ভয়ে অচৈতন্য হয়ে পড়েন। কিভাবে সেই পরিস্থিতির সম্মুখীন হলেন, তার বিশদ বিবরণ দেওয়া হয়েছে। গল্পটি পশ্চিমবঙ্গের পরিপ্রেক্ষতে লেখা। তাই স্থানের নামগুলো অপরিচিত মনে হতে পারে।

১৯ এপ্রিল - ২০১৭ গল্প/কবিতা: ৯ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪