নিস্তব্ধ প্রান্তর। চারদিকে শান্ত মায়াময় পরিবেশ। চোখ যতদূর যায় সবুজ আর সবুজ। নির্মল বাতাস সবুজ শান্তির পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে উপত্যকার বিশাল প্রান্তরে। টিলার পথে দুজন যুবক হাঁটছিল। একজন দেশী, আর অন্যজন শ্বেতাঙ্গ যুবক। তারা দুজন দীর্ঘ যাত্রায় অনেকটাই ক্লান্ত। শ্বেতাঙ্গ যুবকটি থেমে থেমে ক্যামেরা’র শাটার টিপছে। হ্যাভারস্যাক আর গিটার পাশে নামিয়ে বসে পড়ল ক্লান্ত অপর যুবক। তার হাতে একটা জিপিএস; সেখানে কিছুক্ষণ চোখ বুলিয়ে নিল,পথ ভুল করে এদিকে এসে পরেছে তারা। আসল ট্র্যাক থেকে খানিকটা বায়ে বুনো পথে চলে এসেছে। এদিকে পাখির ডাক আর সুন্দর ঝির ঝির শব্দে বয়ে চলা ঝিরির ছন্দময় সুরে যে কারো মন ভাল হয়ে যায়। কিন্তু তার মন খানিকটা বিক্ষিপ্ত। সে কারনেই পথ ভুল করা। সেই কৈশোরের পর এই পর্বতে আর আসা হয়নি কিন্তু মনে হচ্ছে যেন সেদিনের কথা।
বেশিক্ষণ বসাটা ঠিক হবে না ভেবেই উঠে দাঁড়াল, পাশেই ফটোগ্রাফিতে ব্যস্ত শ্বেতাঙ্গ যুবকের দিকে তাকাল সে, “পাবলো, আমাদের দ্রুত এগোনো দরকার। ”।
পাবলো নামের যুবকটি মিষ্টি হাসল, “কিংশুক, তোমার সমস্যা কি? তুমি কি অপূর্ব সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারছো না?”
কিংশুক বিরক্ত চোখে তাকাল, “পাবলো,পাহাড়ে সন্ধ্যেটা ঝপ করে নামে। তুমি বুঝতেই পারবে না। আমাদের বেলা ফুরোবার আগেই নিরাপদ কোথাও পৌঁছতে হবে।”
অনিচ্ছা সত্ত্বেও ট্রাইপড তুলে নিল সে। হ্যাভারস্যাক কাঁধে ঝুলিয়ে আবারো হাটতে লাগলো দুজন।
সন্ধ্যা নাগাদ তারা শহরের একটা রেস্ট হাউজের কাছাকাছি পৌঁছতে পারল। অনেক ঝামেলা করে শেষে জোগাড় হল একটি রুম। সারাদিনের ক্লান্তি চেপে বসেছে। অচেনা পাখির ডাক আর ঝিঝি জাতীয় পাহাড়ি তক্ষকের ডাক শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ল দুজন।
২।
রেস্ট হউসের বারান্দায় বসে সকাল দেখছিল পাবলো। এত সুন্দর দেশ ছেড়ে কিংশুক কেন নিউ ইয়র্ক বাস করে সেটা তার মাথায় ঢোকে না। কফির মগ হাতে পাশে এসে দাঁড়াল কিংশুক। তার স্বপ্নময় চোখের দিকে তাকিয়ে পাবলো আর কিছু বলল না তাকে। তবে খুব শীঘ্রই মুখ খুলতে হবে ভেবে নিল। নাস্তা আর অন্যান্য টুকটাক কাজ সেরে নিল দুজনে।
খানিক পরেই আবারো তাদের ট্র্যাকিং শুরু হল। বুনো পথে হাঁটল দুজন অনেকটাই। দূরের দিগন্তে পাহাড়শ্রেণী দেখা যাচ্ছে। পাশেই পথের আল দিয়ে চলে গেল কাঠবিড়ালী। পাবলো শুরু করল তার ছবি তোলা। অনেক চেষ্টার পর দুরন্ত প্রাণীটি ধরা পড়ল ক্যামেরায়। ছবি তুলতে তুলতেই সামনেও এগোচ্ছে দুজন। পথের মাঝে ঝিরি আর প্রপাত দেখে মুগ্ধ ।
কিংশুক একে তাকে জিজ্ঞেস করে জানতে চাইছে সামনে যাবার উপায়। সাহায্যে এগিয়ে এল বাংলা জানা এক রাখাইন কিশোর,সে জানালো- “ফার্স্ট টিরিপ চান্দের গাড়ী সকাল আটটায়। একটু সামনে গেলেই পাবেন। ”
আসলেই কিছুটা এগোবার পর দেখা মিলল একটা জিপ, পাহাড়িরা একেই বলে চান্দের গাড়ি। তাতেই চাপল দুজনে। আঁকাবাঁকা সর্পিল পথে ছুটে চলার রোমাঞ্চকর অনুভূতি ঘিরে ধরল দুজনকে।
পাবলো চেঁচিয়ে বলল, “অনেকটা রোলার কোস্টারের মতো লাগছে।”
কিংশুক পাল্টা জবাব দিল, “রোলার কোস্টার বটে! শুধু সিট বেল্ট নেই।”
দীর্ঘ যাত্রার পর চিম্বুকের চুড়ায় এসে বিরতি।
কিংশুক বলল, “সী লেভেল থেকে প্রায় ২৩০০ ফিট উপরে আছি আমরা। ভাবতে পারো?”
গাড়ী থেকে নেমে সিড়ি বেয়ে অল্প একটু উঠতে হল। পাবলো হাসল, “পাহাড়ের উপরেই রাস্তা। এজন্যই মনে হচ্ছে না এত উপরে আছি।” ক্যামেরা হাতে পাহাড়ে ঘুরতে লাগলো; অপূর্ব সুন্দর পাহাড়ি ফুল,গুল্ম দেখে শাটার টিপছে। চিরসবুজ পাহাড়ে একাকার মিশে থাকা মেঘ আর নদীর অপূর্ব ছবি বিস্ময় নিয়ে ক্যামেরায় জমা করছে সে। অল্প পরেই আবার যাত্রা শুরু হল। দীর্ঘ পাহাড়ি পথে উত্তাল যাত্রা।
বিকেলের দিকে থানছি বাজারে এসে নেমে পড়ল দুজন, ঝুলন্ত ব্রিজ দেখে পাবলো ফটোগ্রাফি শুরু করতেই থামিয়ে দিল কিংশুক, “সামনে আরও পথ বাকি।”
পাবলো নিরাশ হলেও থেমে গেল। পাহাড়ি সাঙ্গু নদী তারা পার হল খেয়া নৌকাতে। ছোট্ট ক্যানু’র মত। নৌকা চলতে শুরু করল। দুপাশে সবুজ আর সবুজ। নির্মল প্রকৃতি।
৩।
চিরসবুজ শৈল শ্রেনীর পাদদেশে গড়ে ওঠা এক অর্পূব লীলাভমি কাপ্রু পাড়া গ্রাম। নীলগিরি অদ্ভুত সুন্দর এক পাহাড়। তার পাশেই ছোট্ট গ্রামটি পটে আঁকা যেন। জুম ক্ষেত গুলোকে মহান শিল্পির আঁকা ছবি মনে হয়। পাহাড়ি পথে হেঁটে চলা মেয়ে গুলো মায়াময় হাসি দিয়ে চলে যাচ্ছে। ভাষা বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় মাঝে। আকারে অনেক বড় একটা ফল খাচ্ছে পাবলো, শশার মত খেতে। পাহাড়ি এই ফলটির নাম মারফা। কিংশুক থমথমে মুখে বসে আছে। স্পর্শ করতে পারছে না কোন খাবার।
একটু পরেই অশীতিপর এক বৃদ্ধ ঢুকলেন ঘরে। তার পিছে দুজন পাহাড়ি ম্রো মেয়ে, গ্রামটিই মুরং দের। তাদের হাতে সুদৃশ্য ঝুরি ভর্তি ফল,পিঠা আর পানীয়। মেয়েদুটি অকারণেই হাসছে,জড়তাহীন সুন্দর হাসি। সেই হাসিতে না বুঝে পাবলোও যোগ দিল। হাসি ভাষার উর্ধে একটি ব্যাপার। হাসি কান্নার রুপ পাহাড়, সমতল পৃথিবীর সবখানেই এক।
কিংশুক তার গীটার নাড়াচাড়া করছে, টুং টাং শব্দটা কেমন খাপছাড়া, বেমানান এই পরিবেশে। কিছু ভাল লাগছে না তার, সব কিছুতেই অস্থির লাগছে। তার এই অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ছে পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে। বিষণ্ণ মনে তার হাজার ভাবনা খেলা করে। এত কষ্ট করে তার এই পাহাড়ি গ্রামে ছুটে আসা সফল হবে তো! যার সন্ধানে এই ছুটে আসা তার দেখা কখন পাবে সে! এটিই কি সেই গ্রাম?
৪।
একদল গ্রামের যুবকের সাথে পাবলো আসর জমিয়ে বসে আছে। ভাষার পার্থক্য সত্ত্বেও সে কিভাবে যোগাযোগ করছে সে এক রহস্য। তার হাতে ভাত আর পাহাড়ি ফল পচিয়ে বানানো পাহাড়ি মদ। তার নাকি খেতে হুইস্কি’র চেয়েও মধুর মনে হচ্ছে। সে বাঁশের উপজাতীয় পান পাত্র এগিয়ে দেয় কিংশুকের দিকে। সাড়া না পেয়ে তাকায় আড় চোখে, কিংশুকের অস্থিরতা চোখ এড়ায় না তার। প্রশ্ন ছোঁড়ে-
-“কি হল বন্ধু ? চুপ কেন?”
-“এইতো,ভাবছি এই গ্রামের কথা। কি সরল জীবন। ”, উত্তর কিংশুকের।
-“ সরল? আমার তো বেশ কঠিন মনে হচ্ছে। ম্যালেরিয়া আর কৃমির ভল্ট একএকজন। ”, পাশের সুদর্শন ম্রো কিশোরদের ফোলা পেটের দিকে দেখাল সে।
-হাসল কিংশুক, “ তারপরও ওরা যে কি সাহসী আর তেজদিপ্ত ওরা, ভাবতেও পারবে না। ”
-“স্বজাতি বলেই তোমার এমন মনে হয়।”
-“আমার জাতি চাকমা। ওরা আমার স্বজাতি না হলেও ভালবাসি ওদের।”, কিংশুক উত্তর দেয়।
এবার প্রশ্ন করার মউকা মিলে যায় পাবলোর ,
-“তাহলে থেকে জাওনি কেন এখানে? এত বছর কেন নিউ ইয়র্ক ছিলে?”
কিংশুক বাকহীন চেয়ে থাকে। আসলেই এই ক্যানো’র কোন উত্তর তার সঠিক জানা নেই। পাবলো ছাড়বার পাত্র নয়, চেপে ধরে আবারো। তার জোরাজুরিতেই কিংশুক শুরু করে তার পাথর চাপা দেয়া কষ্টের গল্প।
৪।
স্থানীয় চাকমা সার্কেলের রাজার ছেলে সুদীপ রায় পড়াশোনা করতেন ঢাকায়। সেখানেই পরিচয় বাঙালি তরুণী স্বাতী’র সাথে। পরিচয়,পরিনয় অবশেষে বিয়েতে গড়াতে বেগ পায়। জন্ম নেয় ফুটফুটে এক সন্তানও। তাকে নিয়ে দুজনের অনেক স্বপ্নবোনা। পালাক্রমে ঢাকায়, পাহাড়ে খারাপ কাটে নি দিনগুলো। অবশেষে এল সেই ক্ষণ, যুবরাজ থেকে রাজা হবার দিন।
সেদিন বেজে উঠেছিল সানাই। বিউগলের মর্মস্পর্শী সুরে মুখরিত হয়ে উঠেছে বাড়ির আঙিনা। ঘরবাড়ি আর আশপাশের গাছপালাগুলো সেজেছে বাহারি সাজে। বর্ণিল সাজগোজ আঙিনার সীমানা পেরিয়ে গেছে, প্রাসাদের সিংহদ্বার পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে অনেক দূরের পাহাড়ি পথ পর্যন্ত।
বাহারি ঝালর লাগানো সামিয়ানা পাতানো হয়েছে বিশাল পাহাড়ি উপত্যকা জুড়ে। কাগজ,কাপড়, বাঁশফুল, বেত, কাঠ, নারকেল মালার নকশী কারুকাজ চারদিকে। রাজ পরিবারের সদস্য, চাকর বাকর,পিয়ন, পেয়াদা আর অতিথিরা ব্যস্ত নানা আয়োজনে। বিয়েবাড়ির মত ধুম লেগেছে।
এই সার্কেলের রাজপূণ্যাহ ছিল সেদিন। বছর শেষে এলাকাবাসীর কাছ থেকে খাজনা আদায়ের উৎসব এটি। আর এ উৎসবকে ঘিরেই মুখর হয়ে উঠেছে রাজবাড়ি প্রাঙ্গণ, আশ পাশের উপজাতি গ্রাম আর গোটা বান্দরবান শহর।
রাজবাড়ির অতিথিশালায় বিভিন্ন প্রত্যন্ত এলাকা থেকে হাজির হয়েছে সবাই, প্রাঙ্গন মুখরিত ।খাজনার সাথে উপহারের কমতি নেই। ডালায় করে তারা এনেছে মদ, মোরগ, ফলমূল, বিন্নি ধানের খই,পিঠা। প্রাণপ্রিয় রাজাকে এক নজর দেখার জন্যে মাইলের পর মাইল পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে এসেছেন অতি সাধারণ জুমিয়ারাও।
অনুষ্ঠানে সেদিন বৃদ্ধ রাজা রাজ্যভার তুলে দেন ছেলে যুবরাজ সুদীপ রায়ের হাতে। পাহাড়ে বাঁধা পরে সুদীপের জীবন। ব্যাপারটি পছন্দ করতে পাড়লো না স্বাতী। নক্ষত্রের নামের মেয়েটির মন নক্ষত্রের মত উদার ছিল না। কিশোর পুত্রকে নিয়ে একরকম জোর করেই পাহাড় ছাড়ে সে।
কিন্তু কিশোরের মনে রয়ে যায় উপত্যকা’র শ্যামল প্রান্তর। গ্রামের প্রপাত আর ঝিরির সুর। সাঙ্গু নদীর বাঁকে বাঁকে তার মন পরে থাকে। অবাক জলধারা’র সেই ডাকে সাড়া দিতে চায় বালকের মন। গ্রামের বন্ধুদের সাথে বন ভ্রমণ, মোরগের বারবিকিও, গয়াল-ভালুক দেখা! বাবা আর বাল্য বন্ধুদের সাথে পাহাড়ি গ্রামের ঈশ্বরের গেঁথে দেয়া হুয়া ইয়োং পাথরের ফলক পূজা, কানচাং গাছ আর ঝর্ণাপাড়ে পূজা মনে পরে। সেই স্মৃতি বুকে নিয়ে নগরে ঘুরে বেড়ায় সে। একসময় যুবক হয়ে উঠে সে, মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে ডাক্তারী পরীক্ষায়ও বসে। পুরোপুরি নাগরিক জীবনে ঢোকা যুবকের বুকে হঠাৎ জেগে উঠে পাহাড়ী গানের সুর
- “এই জিংগানিত তরে যদি ন পাং ও পরান বি কোন দিন পুরি ন ফেলেচ......।”
৫।
সাজ সাজ রব চতুর্দিকে। আজ বৈসাবি’র দিন, নববর্ষ। ফুল বিজুর এই দিনে আনন্দে মেতেছে গ্রামবাসী। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ফুল দিয়ে ছেয়ে ফেলেছে গোটা গ্রাম। আনন্দের এই রঙ লেগছে চারদিকে, মুখর হয়ে উঠেছে গোটা পাহাড়। এই গ্রামের এক ঘরে আজ অবাক জলধারা নেমেছে। পাহাড়ি ঝিরির মত, শান্ত অচঞ্চল। একে অপরের হাত ধরে নির্বাক বসে আছে দুজন, যত কথা সব তাদের চোখে চোখেই হয়ে যাচ্ছে। জলধারা বইছে তৃপ্ত পিতার মনে, চোখে তার স্পর্শ নেই কোন।পাহাড়ের মতই শক্ত ধাঁতে গড়া অন্তর,কিন্তু মোমের মত নরম। দুজনের চোখই শুকনো কিন্তু মন ভিজে যাচ্ছে। সুদীপ রায় কিংবা কিংশুক রায় কাঊকে দেখেই তাই বোঝার উপায় নেই প্রায় চৌদ্দ বছর পর বাবা ছেলের দেখা হল আজ।