১. ছমির মুন্সি মহা বিরক্ত । তার বাঁশি গুলো দিয়ে সঠিক আওয়াজ বেরুচ্ছে না। সে একজন অভিজ্ঞ বংশীবাদক। বাঁশি বিক্রী করে রেলওয়ে ষ্টেশনে। তবে ১লা বৈশাখের মেলায় তার বেচাবিক্রী যথেষ্ট ভালো হয়। স্থানীয় জেলা শহরে প্রতি বছরের ন্যায় মেলার প্রস্তুতি চলছে । মেলার আর মাত্র তিন দিন বাকী। অনেক বড় একটা মঞ্চ তৈরী হচ্ছে। এমপি ডিসি এসপি সহ অনেক গন্যমান্য মানুষ বক্তৃতা করবেন। শহর থেকে নামী দামী শিল্পী আসবে। সঙ্গীতের জমজমাট আসর বসবে। ছমির মুন্সি চৈত্র মাসের দুপুরে তার নিজ হাতে তৈরী করা বাঁশি একের পর এক পরীক্ষা করছে। প্রচন্ড গরমে তার গা দিয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছে সেদিকে তার ভ্রুক্ষেপ নেই। এবারের বাঁশি গুলি ঠিক মত আওয়াজ দিচ্ছে না । সে ইচ্ছে করলে এই বাঁশি বিক্রি করে দিতে পারে তবে গ্রাহক ঠকাতে তার মন সাঁই দেয় না। তিনি সদ্য তৈরী বাঁশি গুলি পুড়িয়ে ফেলার জন্য উঠোনের কোনে সামান্য মাটির দেওয়াল ঘেরা রান্না ঘরের চুলার পাশে রেখে দিলেন। আগামী কাল থেকে আবার নতুন বাঁশি বানাবেন ছমির মুন্সি......।
২.ছমিরন তার মাটির ব্যাংকটি ভেঙ্গেছে এই মাত্র। সে এক হাতে তার দুই বছর বয়সী শিশু পুত্র রতন কে সামলাচ্ছে অন্য হাতে টাকা গুনছে। আগামীকাল ছমির মুন্সি আসবে তাকে নিতে। রতনের বাপও যাবে সাথে। প্রতি বছর ১লা বৈশাখের মেলায় বাপজান আসেন নাইর নিতে। ছমিরনের মনে আনন্দের বান ডেকেছে..সে গুনগুন করে গান করছে ....আজ পাশা খেলব রে শ্যাম... শ্যাম গো তোমার সনে.....। সে দারুন বাঁশি বাজাতে পারে। বাপের কাছ থেকে শিখেছে এই বিদ্যা। রতনের বাপ তাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছে বাঁশির সুরে পাগল হয়ে। তিন বছর আগের মেলায় তাদের প্রথম দেখা হয়ে ছিল....সে তখন মেলার মজমায় বাপ জানের সাথে বাঁশি বাজিয়ে ক্রেতা আকৃষ্ট করছিল। যুবকের চোখে পলক পড়ে না। সে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে এক কিশোরীর দিকে। কি সুন্দর বাঁশি বাজায়!! রতনের বাপের নাম ফিরোজ। রাজমিস্ত্রীর কাজ করে তবে মনের জগৎটি তার রাজা বাদশাহর মত। গান বাজনা খুব পছন্দ করে দেখতেও রাজপুত্রের মত। ছমির মুন্সির পরিবার বিয়েতে কোন আপত্তি করেনি...জামাই মাশশাল্লাহ তার মনের মত হয়েছে....
৩. শুল্কা তিথির রাত্রী। রহস্যময় জোসনা আকাশে। মিয়াবাড়ির দীঘির পাড়ে যে গোরস্থান সেখানে চার জন আগন্তক। আধিভৌতিক চন্দ্রালোতে কারো মুখ চেনার উপায় নেই। চার জনের কাছে চারটি মোটা ভারী ব্যাগ তার ভিতর শক্তিশালী বিস্ফোরক। শেষ বারের মত তারা তাদের অপারেশন এর ব্যাপারে আলাপ সেরে ফেলেছে......
৪.এসপি সাহের এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন টেবিলে রাখা মিনারেল ওয়াটারের দিকে। তার প্রচন্ড তেষ্টা পেয়েছে তিনি পানি খেতে পারছেন না। ডিসি সাহেব তার দিকে তাকিয়ে কথা বলছেন। মিটিং চলছে বৈশাখী মেলার আইন শৃঙ্খলা বিষয়ে। । কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিতে এসপি সাহেব কে আদেশ দিচ্ছেন তিনি।
৫. বাংলা বছরের আজ প্রথম প্রহর বৈশাখের ১ তারিখ। সকাল থেকে ভেসে আসছে ঢাক-ঢোলের শব্দ। বিশাল একটা আনন্দ শোভা যাত্রা চলছে শহরে। অনেকের মুখে বাহারী মুখোশ ,কেউ লাঙল জোয়াল কাঁধে নিয়ে যাচ্ছে শোভা যাত্রার অগ্রভাগে। জেলে,কামার, কুমোর, তাঁতী নানা রকম সাজে সেজেছে শিশুরা। স্কুল কলেজের ছেলে মেয়েরাও যোগ দিয়েছে এই বর্নিল শোভাযাত্রায়।
সকাল ৮টা । এই মাত্র কবুতর উড়িয়ে মেলার উদ্বধোনী ঘোষনা করলেন মাননীয় এমপি সাহেব।
৬. রতন সাত সকালে নতুন জামা পরে বসে আছে মেলায় যাবে। এবারের মেলায় নানা ভাইয়ের কাছ থেকে বাঁশি উপহার নেবে। ছমিরন ছেলের যন্ত্রনায় অস্থির। কিছুক্ষন পর পর তার মাথার চুল আঁচড়িয়ে দিতে হচ্ছে........।
বিকাল ৫টা। স্থান মেলা চত্বর। ফিরোজ তার স্ত্রী আর শিশু পুত্র রতনকে নিয়ে মেলায় বেড়াতে এসেছে। মেলার প্রবেশ মুখে একজন বাঁশি বিক্রেতা তার নতুন বাঁশি গুলি বাজিয়ে ক্রেতা আকৃষ্ট করছেন। তিনি আর কেউ নন রতনের নানা ভাই ছমির মুন্সি। ছমিরন ভিড় ঠেলে বাপজানের কাছে এগিয়ে যায়। কন্যা আর নাতি কে দেখে ছমির মুন্সির বাঁশির সুর আবেগে আরো মোলায়েম হয়ে আসে। ছমিরন বাঁশির এই আবেগ ঠিকই টের পাই। রতনের বাপের সাথে যে দিন তার বিয়ের তারিখ ঠিক হয় সেইদিন বাপজান এমন করে বাঁশি বাজিয়ে ছিল। আহা কি প্রাণ কাড়া সেই সুর একদম পরানটা আউলা করে দেয়......
ফিরোজ তাকিয়ে আছে একজন অপরিচিত মানুষের দিকে। লোকটির হাতে মোবাইল ফোন হাতে ভারী একটা ব্যাগ। সে ধীর পায়ে ছমির মুন্সির মজমার দিকে এগিয়ে আসছে। শত শত লোক মন্ত্রমুগ্ধর মত বাঁশির সুরে মোহিত হয়ে আছে। কেউ যেন ফিরোজের মাথার মধ্যে বলে উঠে সাবধান সামনে বিপদ। ফিরোজ ব্যাগসহ লোকটিকে জড়িয়ে ধরার সাথে সাথে প্রচন্ড বিষ্ফোরনে কেঁপে উঠে মেলা চত্বর। পর পর চারটি বিষ্ফোরনের শব্দ। চারিদিকে আহত মানুষের চিৎকার। বিকেল থেকেই কাল বৈশাখী মেঘের আনাগোনা ছিল বিষ্ফোরনের কিছুক্ষনের মধ্যে প্রবল বেগে ঝড় শুরু হলো। দমকা হাওয়ার গাছের পাতার মত উড়ে গেল মঞ্চের উপরের সামিয়ানা সাথে প্রবল বেগে বৃষ্টি। দুরে থেকে ভেসে আসছে পুলিশের গাড়ির শব্দ। বিদুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে। সমস্ত শহর ডুবে গিয়েছে গাঢ় অন্ধকারে.............।
রাত সাড়ে এগারাটা নাগাদ বিদুৎ চলে আসলো...মানুষের চোখ টিভি চ্যানেল উপর। প্রায় সমস্ত চ্যানেলে একই নিউজ । বৈশাখী মেলাতে সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে। নিহত হয়েছে ছয় জন। আহত হয়েছে প্রায় শতাধিক মানুষ । আহতদের স্থানীয় হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। নিহতদের কয়েক জনের নাম পরিচয় জানা গেছে তাদের মধ্যে একজনের নাম ফিরোজ। সে পেশায় রাজ মিস্ত্রী ।
৭. বাঁশের চাটাইয়ের বেড়ার ঝাঝরি দিয়ে চাঁদের আলো এসে পড়েছে ঘরে । সেই চন্দ্রালোতে এক ধরনের আলপনা তৈরী হয়েছে ঘরের ভেতর। সেই আলপনার কিছু অংশ এসে পড়েছে ঘুমন্ত রতনের মুখের উপর। তার মুষ্টিবদ্ধ হাতে ধরা আছে নানা ভায়ের দেওয়া বাঁশের বাঁশি। ছমিরন তাকিয়ে আছে তার ঘুমন্ত শিশুপুত্রের মুখের দিকে। কষ্টে তার বুক ভেঙ্গে যাচ্ছে। মাত্র চারদিন আগেও রতনের বাপ ছিল তাদের সাথে। ছমিরন রতনের হাত থেকে বাঁশি তুলে নিয়ে ঘরের কপাট খুলে বেরিয়ে আসে। বাড়ীর দক্ষিণে বাঁশঝাড়ের নিচে চৈত্রের সদ্য ফসল তুলে নেওয়া বিরান মাঠ। জোসনার জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে সেই বিরান ভূমি....। নিশি পাওয়া কন্যার মত ছমিরন এসে দাড়ায় সেই শূন্য মাঠে। বাঁশিতে তোলে সুর .....বন্ধু আমি তোমার নাম লইয়া কাঁন্দি.....তার চোখের জলের ফোটায় ধুয়ে যায় বাপজানের দেওয়া বাঁশি.......................
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
ধুতরাফুল .
ধন্যবাদ বর্তমান প্রজন্মের জনপ্রিয় লেখক মিলন বণিক কে....
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।