নিবারণ মাঝি নৌকার গলুইয়ের শেষ মাথায় বসে আছে। সে তাকিয়ে আছে মাথাভাঙ্গা নদীর স্বচ্ছ জলে। সবুজ শ্যাওলার ভেতর ছোট ছোট মাছের খেলা চলছে । শরতের নীল আকাশের ছায়া পড়েছে মাথাভাঙ্গা নদীর জলে। শেষ বিকেলের কনে দেখা সূর্যরশ্মি প্রতিফলিত হচ্ছে নদীর দু পাশের কাশ বনে। নিবারণ মাঝির হাতে জলন্ত বিড়ির ছাই ভেঙ্গে ভেঙ্গে পড়ছে জলে। সে আছে ঘোরের মধ্যে। গায়ে প্রচন্ড জ্বর তার বৃদ্ধ শরীরে বেশ জেকে বসেছে। তাও কিছু না হলেও আশি বছর বয়স তো হবেই। গোটা জীবন টাই কেটে গেল তার এই খেয়াঘাটে। তার জীবনটাও যেন নদীর সাথে বাধা পড়ে গেছে। নদীটাও কি দিন দিন তার মত বুড়ো হয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিন কত রকমের মানুষ জন পার হয় এই খেয়া নৌকায় তার কোন হিসেবই নেই। যৌবন কালের স্মৃতি হাতড়ায় নিবারণ মাঝি। মাথাভাঙ্গা পাড়ের মাড়োয়ারীরা খুব ভালো মানুষ ছিল। যে বার গোপাল বাবুর বড় মেয়ে শান্তির বিয়ে হলো কলকাতায় । বড় বড় সব বজরা নৌকা করে বরপক্ষ এসেছিল বিয়েতে। সাত দিন ধরে চলে ছিল সে বিয়ের আয়োজন নিবারণ মাঝিরও নিমন্ত্রন ছিল। খাওয়া দাওয়ার পর বরযাত্রীদের জন্য আনা এক খিলি বানারসী পান ও সাথে চার আনা নগদ দক্ষিণা দিয়ে ছিলেন গোপাল বাবু। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় রাতারাতি দেশ ছেড়ে চলে গেল বেশীর ভাগ ধনী হিন্দুরা। তাদের জন্য খুব কষ্ট হয় নিবারণ মাঝির। ফেলে যাওয়া বাড়ির গুলোর দিকে তাকালে বুকের ভেতর কেমন যেন ছ্যাত করে উঠে নিবারণ মাঝির। গোপাল বাবুর বাড়ীর সামনে বিরাট একটা ফটক আর সেই ফটকের মাথার উপর আছে অতিকায় দুটি বাঘের মূর্তি তাদের জ্বলন্ত চোখের দিকে তাকালে মনে হতো একে বারে জীবন্ত এই বুঝি লাফ দিয়ে তোমার ঘাড় মটকাবে। রঙতা হাউজ নামে আরো একটা বাগান বাড়ি ছিল তার ফটকের মাথার উপর রাধাঁকৃষ্ণের যুগল মূর্তি আহা কি অপূর্ব সুন্দর দুচোখ জুড়িয়ে যেত নিবারণ মাঝির। ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময়টা খুব অভাবে কেটে ছিল নিবারণ মাঝির। শেখ মুজিবের ডাকে বাঙলার দামাল ছেলেরা পাকহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাড়িয়ে ছিল। সেদিনকার সেই আন্দোলনের ঢেউ এসে লেগে ছিল মাথাভাঙ্গা পাড়ের প্রান্তিক জনপদে। কি উথাল-পাতাল বর্ষা সে বছর। নৌকার ছইয়ের ভেতর বসে দেখেছে কত লাশ ভেসে গেছে মাথাভাঙ্গার ¯রাত্রে কম বয়সী মেয়ে অল্প বয়সী বউ এর লাশ শার্টপ্যান্ট গায়ে থাকা যুবকের লাশ দাড়িমুখে মৌলানার লাশ যেন মরা মানুষের মিছিল ভেসে চলেছে মাথাভাঙ্গার ¯রাতে। গা গুলিয়ে উঠতো লুঙ্গির ট্যাক থেকে পাতার বিড়ি বের করে কষে কয়েকটা টান না দিলে খাবারে রুচি পেত না নিবারণ মাঝি। দেশ যে দিন স্বাধীন হলো সেই দিন মুক্তি সেনারা আর তাদের বীর কমান্ডাররা স্কুল মাঠে মেশিন গানের গুলি ছুড়ে জয় বাংলা শ্লোগানে আকাশ বাতাস ফাটিয়ে দিয়ে ছিল। স্বাধীন দেশে লোকজন আবার যে যার কাজে ফিরে গেল । জমে উঠতে শুরু করলো ব্যবসা বানিজ্য। বড় বড় নৌকায় গুড়ের চালান যেতে লাগলো জেলা শহরে। আশ্বিনের ভরা বর্ষা মৌসুমে নৌকা পার হতে অনেক কষ্ট হতো মানুষের একটা খ্যাপ মার গেলি ছাত্রছাত্রীরা তাদের ক্লাশ ধরতে পারতো না..দশটা বারোটা গরুর গাড়ী গাংঙের দুই পাড়ে জমা পড়ে যেত। বনেদী ঘরের বৌ ঝি রা গরুর গাড়ীর চারিদেকে রঙিন শাড়ি টাঙ্গিয়ে পর্দা করে রাখতো সেই পর্দার ফাঁক দিয়ে দুরন্ত ছানাপোনা গুলি অবাক চোখে খেয়াঘাটে আসা গাড়িঘোড়া মানুষ জন দেখতো। বছরে একবার হালখাতা হতো খেয়া ঘাটের চাতালে। স্থানীয় মানুষেরা সারা বছর নদী পার হতো বিনে পয়সায় তবে হালখাতার সময় যার যতটুকু সামর্থ্য ধান, চাল, গম, নগদ টাকা কিছু না হলে গাছের কটা নারকেল নিয়ে হাজির হতো খেয়াঘাটের টং ঘরে । হালখাতার আগের রাতে গুড়ের জিলাপী ভাজা হতো সকালে সেই জিলাপী পদ্মপাতায় বিলি করা হতো আহা কি সব দিন ছিল। নিবারণ মাঝির তখন নিজেকে রাজা বাদশা মনে হতো। প্রতি বছর খেয়াঘাটের নিলামে ডাক হতো। কে কত টাকায় ঘাটের ইজারা নিতে পারে। টক্কর লেগে যেত সেয়ানে সেয়ানে রমজান বিশ্বাস আলতাব মিয়া গোপাল বাবুরা ছিলেন তখনকার দিনের ইজারা কর্তা। তমসের মাঝী নিবারণ মাঝি ফড়িং মাঝি খুব উৎকন্ঠায় থাকতো ডাকের দিনে। কে যে হাটের মালিক হবে আর মাঝিদের মধ্যে কাকে কাকে রাখা হবে এই চিন্তায়। শীতকালে নদী যখন শুকিয়ে যেত তখন দুটো নৌকা এক সাথে বেধে নদীর দুই পারে পোতা খুটিতে লম্বা একটা শক্ত মোটা দড়ি বেধে রাখা হতো লোকে বলতো চাপনৌকা। লোকজন নিজেরাই সেই দড়ি টেনে সহজে নদী পার হয়ে যেত। তখন মাঝিদের বিশ্রামকাল। গ্রামে টেলিভিষন এসেছে। নিবারন মাঝি রাতের বেলা কোন কোন দিন টেলিভিষন দেখতে বাজারে আসে চা বিস্কুট খায়। চায়ের দোকানে লোকজন বলাবলি করে নদীর উপর নাকি ব্রিজ হবে মানুষের নদী পার হবার কষ্ট দুর হবে। নিবারণ মাঝির বুকের ভেতরটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠে। আপন মনে বলতে থাকে. “তা হলি আমাগের কি হবে তিন পুরুষ নৌকুর কামাই খাই আমরা তালি কোনে যাবো মুনিষ খাইটি খাতি হবে” হঠাৎ একদিন নিবারন মাঝি দেখলো নদীর দুধারে বিশাল আকৃতির মেশিনপত্র চলে এসেছে। ইট,পাথর,বালি,রড সিমেন্ট গাড়ী গাড়ী চলে আসছে.দিনভর কাজ চলে নদীর দুপাড়ে। শত শত মানুষ শ্রম দিচ্ছে নদীর দু পাড়ে। দানবের মত গর্জন করতে থাকে বড় বড় সব মেশিনপত্র। দেখতে দেখতে চোখের সামনে মাথাভাঙ্গা নদীর উপর বিশাল ব্রিজ তৈরী হয়ে গেল। আর কয়েকদিন পরে শুভ উদ্বোধন করবেন মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়। ভেতরে ভেতরে প্রচন্ড ভেঙ্গে পড়ে নিবারণ মাঝি। একা নিঃশব্দে বসে থাকে নৌকার গৌলুয়ের উপর। ঘোলাটে চোখে ব্রিজের দিকে তাকিয়ে থাকে। এক সময় সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত নেমে আসে মাথাভাঙ্গার তীরে। অনেক রাতে স্বজনেরা বাড়ি নিয়ে যায় বৃদ্ধ নিবারণ মাঝিকে। তার অবস্থা অতি খারাপের দিকে আর হয়তো টিকবেনা এ যাত্রা। একদা প্রচন্ড উতাল-পাতাল বর্ষায় শক্ত হাতে হাল ধরে নদীর এপার ওপার করেছে যে নিবারণ মাঝি তাকে যে আমাদের আর প্রয়োজন নেই।
নিবারন মাঝির নিথর দেহ পড়ে আছে নৌকার পাটাতনের উপর। গ্রামের ডাক্তার আবেদ আলী নিবারণের হাত ধরে গম্ভির মুখে বসে আছে। মাঝির নাড়ীতে প্রাণের কোন স্পন্দন পাওয়া যাচ্ছে না..স্বজনদের কান্নার আওয়াজ নদী পাড়ের বাতাসে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে ফিরে আসছে।
মাননীয় মন্ত্রীর গাড়ি বহরের সাথে স্থানীয় এমপি সাহের জেলা প্রশাসক পুলিশ সুপার সহ গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গও আছেন। আজকে মাথাভাঙ্গা নদীর উপর ফিতা কেটে ব্রীজ উদ্বোধন করা হবে। রাস্তার দু ধারে স্কুলের ছেলে মেয়েদের সাথে সাধারন মানুষও দাড়িয়ে আছে মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়ের অপেক্ষায়। হাটবোয়ালিয়া বাজারে ঢোকার একটু আগে শ্মশান ঘাটের কাছাকাছি আসতে দেখা গেল একদল লোক খাটিয়ায় করে নিবারণ মাঝির লাশ নিয়ে যাচ্ছে দাহ করতে। তাদের মুখে হরি নাম ...“বল হরি বল হরি হরি বোল” এই মাত্র মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়ের গাড়ির বহর নিবারণ মাঝির শব যাত্রার পাশ কেটে বেরিয়ে গেল........
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
ধুতরাফুল .
বিচারক দয়া করে ১.০৮ দিয়েছে .. বিচারকদের কোন লেখনী পড়তে পারলে বুঝতে পারতাম কেমন মানের.....!!!!
ফেরদৌস আলম
যদিও দীর্ঘদিন পরে গল্পকবিতায় আমার আসা হল। তবে আপনার গল্প পড়ে অনেকটা মুগ্ধ আমি। অসাধারণ বর্ণনাভংগি, গল্পের মোহময় পরিসমাপ্তি, সব মিলিয়ে দারুণ লিখেছেন।
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
সময়ের সাথে মানুষের যাপিত জীবন ও জীবিকার লড়াই যা ঝড়ের মত সব কিছু লন্ডভন্ড করে দেয়..ধুতরাফুল।
১৫ ফেব্রুয়ারী - ২০১৭
গল্প/কবিতা:
১৮ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।