বাবার সমস্ত সঞ্চয় দিয়ে, খেয়ে-না খেয়ে নাহিদকে লেখাপড়া শিখিয়ে বি.ত্র পাস করালেন। আশা, নাহিদের একটা চাকরি হবে, সে সংসারের হাল ধরবে। বোন দুটিকে বিয়ে দিবে, ভাইটাকে পড়ালেখা শিখিয়ে মানুষের মত মানুষ করবে। ঘরের সবাই দুবেলা দুমুঠো পেট ভরে খেতে পারবে।
কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। সে ঢাকায় আসলো আজ পাঁচ মাস। বাবাকে কিছু টাকা দিয়ে সাহায্য করবে, সে তো দূরের কথা, নিজে চলাই মুশকিল হয়ে পড়েছে। একবেলা খেলেতো অন্য বেলায় উপোষ থাকতে হয়।
ঢাকায় একটা টিউশনি করে সে। দশম শ্রেণীর একটা মেয়েকে পড়ায়। পরিচিত এক বড় ভাই টিউশনিটা দিয়েছে তাকে। সেখান থেকে যা পায় তা দিয়ে মেস বাড়া আর খানা করচ চলে অনেক কষ্টে।
চাকরির খুজে এখানে সেখানে দৌড়াতে দৌড়াতে আজ সে বড় ক্লান্ত। আর চাকরি হবেই বা কি করে! তার তো এই শহরে কোনো মামা খালু নেই। তার ওপর নেই ঘুষ দেয়ার মত টাকা। তারপরও চেষ্টা করে যাচ্ছে। যদি কিছু একটা হয় কোথাও।
নাহিদ ভাবে, আমার জন্মটাই মনে হয় হয়েছে এক অনিয়মের বেড়া জালে। ধিক্কার দেই আজ এই সমাজ ব্যবস্থাকে, যে সমাজ ব্যবস্থায় মেধার কোন মূল্যায়ন করে না। যেখানে চাকরির জন্য যাই সেখানে চাই অভিজ্ঞতা। আরে বাবা, চাকরি যেখানে করারেই সুযোগ পেলাম না সেখানে অভিজ্ঞতা আসবে কোথায় থেকে! কি লাভ হলো এই পড়ালেখা করে? কি হবে এই সার্টিফিকেট দিয়ে? কেন চাকরিতে ইন্টারভিউ ইন্টারভিউ নামের ত্রই খেলার ব্যবস্থা? কেন? কেন এসব?
কখন যে বিকেল সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত প্রায় ১০ টা বেজে গেল নাহিদ বুঝতেই পারল না। একটু পরে সেখান থেকে উঠে বাসায় চলে আসলো সে। আজকে রাতেও তাকে না খেয়ে থাকতে হবে। রান্না করার মত কিছুই নেই বাসায়। পকেট খালি তাই কিছু কিনতেও পারেনি। টিউশনির বেতন পাওয়ার জন্য আরো ২ দিন অপেক্ষা করতে হবে। আজকের এবং সামনের দুই দিন তার খাবার হলো মেসের সামনের জলিল চাচার চায়ের দোকানের দুইটা টোষ্ট বিস্কুট আর দুই গ্লাস জল।
বালিশের নিচ থেকে বাবার চিঠিটা বের করে একবার দেখে নিল সে। চিন্তা করছে পড়বে কি পড়বে না। আজকের চিঠির ওজনটা মনে হয় একটু বেশি। বাড়তি কোন কথা হয়তো লেখা আছে চিঠিতে। খাম খুলে চিঠিটা পড়তে লাগল সে।–
বাবা নাহিদ,
কেমন আছিস? আশা করুণাময়ের কৃপায় ভালো আছিস। আমাদের অবস্থা তোকে কি আর বলবো, সবতো তোর জানাই আছে। তোর মায়ের বুকের ব্যাথাটা আবার বেড়েছে। বাজারের সালাম ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম। ডাক্তার বলেছে তোর মাকে শহরের ভালো ডাক্তার দেখাতে। কিন্তু কি ভাবে নিয়ে যাই, সংসারের অবস্থা তো তোর জানাই আছে।
আমার শ্বাস কষ্টটা আরো বেড়েছে। তোর বোন সামিনার জন্য একটা বিয়ে প্রস্তাব এসেছে। ছেলে আমাদের পাশের গ্রামের। মোটামোটি ভালো। বাজারে ছেলের একটা মুদি দোকান আছে। ছেলের বাবার একটাই দাবী, তার ছেলেকে একটা মোটর সাইকেল দিতে হবে। তুই তো জানিস মোটর সাইকেল ক্রয় করার মত সামর্থ আমার নেই। যা একটু ফসলী জমি আছে, তা বিক্রি করলে হয়তো কিনে দিতে পারব। কিন্তু জমিটা বিক্রি করলে ঘরের সবাইকে না খেয়ে মরতে হবে।
বাবারে যত তাড়াতাড়ি পারিস কিছু একটা কর। আর যে পারছিনা সংসারটা নিয়ে।
চিঠির এই পর্যন্ত আসার পর অন্য লাইন গুলো আর পড়তে পারল না সে। চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। চারদিকে অন্ধকার দেখতে লাগল। একি! চিঠি ভিজে যাচ্ছে কেন? তার দুগালও ভেজা। সে কাঁদছে! সত্যিইতো সে কাঁদছে। আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না সে। ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কাঁদলো অনেকক্ষণ।
নাহিদ মনে মনে বলছে, এমন এক সন্তান হলাম, বাবা-মার কোন উপকারেই আসতে পারলাম না। মাঝে মাঝে মনটা বিদ্রহী হয়ে উঠে। সৃষ্টি কর্তাকে বলতে ইচ্ছে, এ কেমন বিচার তোমার খোদা, যার আছে তাকে আরো দাও, আর যার নেই তার কাছ থেকে সবটাই কেড়ে নাও।
নাহিদ যে মেয়েকে পড়ায় তার নাম কলি। মিস্টার চৌধুরী সাহেবের এক মাত্র মেয়ে। কথায় বলে কিছু মানুষ জন্মের সময় সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মমায়। কলিও তাদের দলের একজন। তার জীবনের কোনো চাওয়া তার বাবা-মা অপূর্ণ রাখেনি। যখন যা চেয়েছে তখনি তা হাতের কাছে পেয়েছে। মিস্টার চৌধুরী এবং মিসেস চৌধুরী সব সময় বিজি থাকেন। একজন তার ব্যবসা নিয়ে আরেকজন তার ক্লাব, পার্টি নিয়ে।
নাহিদ যখনি কলিকে পড়াতে যায় তাদের বাসায়, বেশির ভাগ সময় পুরো বাসা খালি থাকে। কাজের মেয়ে পড়ানোর ফাকে একবার নাস্তা দিয়ে যায়। কলি মেয়েটা ইংরেজী এবং অন্য অন্য বিষয়ে যতটা ভালো ঠিক ততোটা খারাপ অংকে। নাহিদকে বলে, স্যার, এই অংক বিষয়টা কি খুব দরকার জীবনে?
-নিশ্চয় দরকার।
-কিযে বলেন স্যার! কেন দরকার হবে? ১ থেকে ১০০ পর্যন্ত জানলেই হলো। এতে করে মানুষ টাকা পয়সার হিসাবটা রাখতে পারবে। অযথা কি সব বীজগণিত, পাটিগণিত ঘোড়ার ডিম দিয়ে অংক বই বের করেছে। কিছু বুঝি না।
-তুমি বুঝনা, এই জন্য আমাকে রাখা হয়েছে তোমাকে বুঝানোর জন্য।
-স্যার, আপনি যতই বুঝান আমার মনে হয় না আমি কোন দিন অংকে পাস করবো।
-চেষ্টা করো।
-চেষ্টা করে কাজ নেই। চলেন দুজনে গল্প করি।
-কলি, আমি এখানে গল্প করতে আসিনি। পড়ায় মনযোগ দাও।
-কলি, মুখ কালো করে বললো, স্যার, আজ আমার আর পড়তে ভালো লাগছে না। আজ আমি আর পড়বো না।
নাহিদ জানে আজ আর এই মেয়ে পড়বে না। নাহিদ তার মেসে ফিরে আসলো।
পরের দিন আবার কলিকে পড়াতে নাহিদ মিস্টার চৌধুরীর বাসায় গেল। কলি অনেক সেজেগুজে এসেছে নাহিদের সামনে। আজ কলি পরেছে সাদা টি-শার্ট এবং ব্লু কালারের জিন্স। এই প্রথম এই রকম পোশাকে কলিকে দেখছে নাহিদ। নাহিদ কোন দিন কল্পনাও করতে পারেনি কোন মেয়ে এই রকম পোশাক পরতে পারে। আবার ভাবে সে, আমি গ্রামের ছেলে তাই হয়তো আমার কাছে অবাক লাগছে। শহরের মেয়েরা মনে হয় এই রকম পোশাকেই পরে।
-কলি তোমার বাবা-মা কোথায়?
-তারা তো একটা পার্টিতে গিয়েছে।
-তোমাদের কাজের মেয়েটাকে বল আমাকে এক গ্লাস পানি দিতে।
-স্যার কাজের মেয়ে তো আজ বাসায় নেই।
-কোথায়?
-ওকে আমি ছুটি দিয়েছি আজ।
-কেন?
-কারন আজ সারাটা সন্ধ্যা আমি আপনার সাথে গল্প করবো।
-কলি আমি তোমাকে কালকেও বলেছি, আমি এখানে গল্প করতে আসি না, তোমাকে পড়াতে আসি।
-স্যার, একবার আমার দিকে তাকান। আমাকে কেমন লাগছে আগে বলেন।
-ভালো লাগছে।
-না তাকিয়েই বললেন ভালো লাগছে!!
-একি কলি, তুমি পাশে এসে বসলে কেন? কেউ দেখলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। যাও তুমি ঐ চেয়ারে গিয়ে বসো।
-স্যার, কেউ এখন বাসায় আসবে না। আর স্যার আপনি কি বলেন তো? আপনি দেখি কিছুই বুঝেন না। ছেলে মানুষ এত অবুঝ হয় নাকি! স্যার, পড়ালেখার বাহিরে আপনি আমার দিকে একটু খেয়াল করেন এতে করে আপনার ভালোই হবে খারাপ হবে না।
-কলি, আমি এখন যাই।
-স্যার, সত্যিই আপনি একটা বোকা। হাতের কাছে সোনার হরিন পেয়েও আপনি তাকে ছেড়ে দিলেন।
এরপর থেকে কলিকে পড়াতে আর যায়নি নাহিদ। কলিকে পড়ানো ছেড়ে দিয়েছে আজ ২০ দিন।
বিষন্ন মন নিয়ে রাস্তার পাশ ধরে হাটছে নাহিদ। জীবনের কোন হিসাব নিকাশেই সে মিলাতে পারছে না। হঠাৎ একটা পাজারু গাড়ী এসে থামল তার পাশে। সে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। গাড়ী থেকে নেমে আসলো কলি এবং একটা ছেলে।
-নাহিদ স্যার, কেমন আছেন?
-জি, ভালো।
-আপনার চেহরা দেখেতো তা মনে হচ্ছে না। ও আচ্ছা ,পরিচয় করিয়ে দেই। এ হচ্ছে আমার নতুন টিচার শফিক। আর শফিক ইনি হচ্ছেন আমার আগের টিচার মিস্টার নাহিদ। যার কথা তোমাকে বলেছি আগে।
-ও ইনিই তা হলে সেই নাহিদ সাহেব।
- কি মশাই রাজ্য এবং রাজত্ব এই ভাবে কেউ হাত ছাড়া করে?
-নাহিদ স্যার সত্যি আপনার জন্য আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু যে নিজের ভালো নিজে বুঝে না তার জন্য কষ্ট পেয়ে কি হবে।
আসি স্যার।
শফিক চলো, সালমানের নতুন মুভি লাগিয়েছে। মুভিটা হলে গিয়ে দেখে রাতে আমরা ডিসকোতে যাবো।
-চলো সোনা।
নাহিদের পাশ কেটে কলি এবং শফিককে নিয়ে পাজরু গাড়ী ছুটে চলেছে গুলশান-বনানীর দিকে। আর পিছনে পড়ে রইল এক অসহায় ছেলে, সাথে উড়ছে চলে যাওয়া গাড়ীর কালো ধোয়া।
মেসের জীর্ণ, নোংরা কুৎসিত, স্যাঁতসেঁত ছোট ঘরখানিতে নাহিদ শুয়ে আছে। সাদা দেয়ালগুলো থেকে উড়ছে শুকনো হিমেল নিশ্বাস নিষ্প্রভ বিষন্নতা।
আজ নাহিদের করুন পরিণতি দেখে তাকে উপহাস করছে তার সাথে দীর্ঘ পাঁচ মাস বসবাস করা এই রুমের এক জোড়া টিকটিকি, গুটা বিশেক তেলাপোকা আর শত শত ছারপোকা। ছারপোকা গুলো ধিক্কার দিয়ে বলছে, তোর শরীরের অভিশপ্ত রক্ত প্রতি রাতে চুষে চুষে খাই। তারপরও শেষ হয় না। তুই একটা অকর্মা। তুই তোর মা-বাবা, ভাই-বোনদের সহায় হতে পারলি না।
গত তিনদিন জ্বরের মাঝে পড়ে আছে নাহিদ। মাথা ভুঁ ভুঁ করে ঘুরছে। গত তিনদিন পেটে একটা দানাও পড়েনি। শরীর অনেক দুর্বল। ঘরের নোংরা ঘুনে ধরা চৌকিতে পড়ে আছে সে একা। পরের সপ্তাহে তার বাবার আরেকটা চিঠি এসেছে।
মায়ের শরীরের অবস্থা ভালো না। যে কোন সময় কিছু একটা ঘটে যেতে পারে। বার বার নাহিদকে দেখতে চাইছে। চিঠির শেষের একটা লাইন পড়ে আর্তকে উঠল নাহিদ। নীলিমা বিয়ে করেছে, এক প্রতিষ্ঠিত চাকরিজীবীকে।
শেষ পর্যন্ত নীলিমাও চলে গেল! যাবেই তো, কেউ কি চায় তার জীবনটা অনিশ্চয়তার মাঝে পড়ে থাক। সুখ এমনি এক বস্তু যাকে সবাই প্রার্থনা করে। জেনে শুনে কেউ কি কষ্টের নদীতে সাঁতার কাটতে চায়? চায় না। আর মেয়েরা সাধারণত তাদের জীবন সম্পর্কে খুবেই হিসাবি। জীবন এবং সংসার সম্পর্কে তারা কোন ছাড় দিতে চায় না। নীলিমাতো আর ১০টা মেয়ের মতই একটা মেয়ে।
এই সেই নীলিমা, দীর্ঘ আটটি বছর যাকে ভালোবেসে চলেছে নাহিদ। যে নাহিদের জন্য প্রতিক্ষায় বসেছিল। হ্যাঁ, প্রতিক্ষায় বসেই ছিল নীলিমা, সুর্বন সুযোগের প্রতিক্ষায়। আর যখনি তা সে পেলো তখনি তা লুফে নিল। অথচ এই নীলিমাকে পাবার জন্য নাহিদ জীবন বাজি ধরেছিল। নীলিমা তাদের আটটি বছরের সম্পর্ককে পায়ের নিচে ফেলে থেঁৎল পিষে চলে গেছে।
ভাঙ্গা জানালার দিয়ে বাহিরের আকাশের দিকে তাকিয়ে নাহিদ মনে মনে বলছে, নীলিমা তুমি সুখে থেকো। পাজরের হাড় পুড়ে আমি তোমাকে কাজল পড়িয়ে দিব। হাতের শিরা কেটে আমি লাল রং দিয়ে তোমার সংসারে একে দিব সুখের আল্পনা। তোমার জন্য আমার সকল ত্যাগ, সকল প্রার্থনা। আমি জানি এই ত্যাগ এই প্রার্থনা তুমি স্বীকার করবে না। তুমি ভুলে যাবে নাহিদ নামের কোনো এক দুর্ভগার সাথে তোমার আটটি বছর সম্পর্ক ছিল। তুমি ভুলে যাও, তবু তুমি সুখি হও।
অনেক চেষ্টা করেছে নাহিদ নীলিমাকে ভুলার জন্য, কিন্তু পারছে না। যত চেষ্টা করে ভুলার ততো তার মুখখানা চোখের সামনে ভেসে উঠছে। শত চেষ্টা করেও নীলিমাকে ভুলতে পারছে না। নাহিদ সত্যিই ব্যর্থ। নীলিমা তার নিশ্বাস প্রশ্বাসে, রক্তের কণায় মিশে গেছে।
নাহিদ ভাবছে, আসলে সে একটা বোকা ছেলে। তা না হলে আটটি বছর প্রেম করেও কেন নীলিমাকে চিনতে পারলাম না? কেন?
নাহিদের সার্টিফিকেট গুলো, বায়োডাটা, চাকরির দরখাস্ত আর ভোটার আইডি কার্ড আগুনে পুড়ছে। নাহিদ চেয়ে আছে সেদিকে। আগুনের কুন্ডলী একে বেকে উপরের দিকে উঠছে। তার ১৪ বছরের পরিশ্রমে সঞ্চয় করা সার্টিফিকেট। যার সাথে মিশে আছে তার বাবার পরিশ্রমের ঘামে ভেজা টাকা, মায়ের দোয়া, ভাই-বোনদের প্রত্যশা, আজ আগুনে পুড়ছে। নাহিদ চেয়ে দেখছে। আগুনের লাল শিখায় ভাসছে বাবার করুন মুখ, মৃত্যু পথযাত্রী মায়ের মুখ, ভাই-বোনদের বেকুল চেহারা আর নীলিমার প্রাচুর্য মাখা মুখখানা। জ্ঞান হারাবার আগ পর্যন্ত নাহিদের কানে ভেসে আসছে মানুষের চিৎকার, আগুন! আগুন!! আগুন!!!............