পূজারিণী

ঋণ (জুলাই ২০১৭)

সেজান খন্দকার
১.পুকুর পাড়ে বসে ঢিল ছুড়ছে আশিস। ছোটোবড়ো ঢিলগুলো পানিতে পড়ে টাপুর টুপুর শব্দ হচ্ছে।
এই জায়গাটি আশিসের খুব পছন্দের। শান্ত পুকুর, পুকুরের চারদিকে ঘন জঙ্গল। মাঝে মাঝে দু`একটা পাখি হঠাৎ হঠাৎ দেকে উঠছে। বেশ গা ছমছমে পরিবেশ। কিন্তু এখানে কিসের যেনো স্নিগ্ধতা খুঁজে পায় সে। প্রকৃতির খুব কাছে আসা যায়, তাকে অনুভব করা যায়।
যখনই কোনো চিন্তা তার মাথায় আসে, চট করে চলে আসে বাড়ির পেছিনের এই পুকুর ধারে। তবে আজ কোনো কিছু চিন্তা করতে পারছে না। পুরনো স্মৃতি গুলো শুধু তারা করছে তাকে।
ও পাড়ায় একটা বেশ বয়স্ক লোকের সাথে ভাব হয়েছে তার। তার কারণ লোকটা গাছ ভালবাসে, তার বাগানে অনেক দুর্লভ গাছ আছে। আশিসেরও একটা বাগান আছে। তার নিজ হাতে গড়া। আদর যত্ন দিয়ে বড় করে তুলছে সে। নিজের সংগ্রহের গাছ নিয়েই সে খুশি থাকতে চায় না, তার আরো গাছ চাই।
বিকেলের দিকে বেরিয়ে পড়ল আশিস। ও পাড়ার বন্ধুর সাথে দেখা করে তার কাছ থেকে কিছু গাছের বীজ নিয়ে আবার রওনা হল বাড়ি মুখো।বৃষ্টি শুরু হয়েছে। তাতে কিছু যায় আসে না। সে নির্বিকারভাবে পথ চলছে।
বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছে সে। কানাই কাকার বাড়ির পর অল্প কিছু পথ। হটাৎ পা পিছলে পরে গেল আশিস। তখনই শোনা গেল এক কিশোরীর মন মাতাল করা হাসি। ঝমঝমে বৃষ্টির সাথে এই প্রাণ খোলা হাসির শব্দ তার শরীরে একটা দোলা দিল, যেন এক মুহুর্তে বিদ্যুৎ খেলে গেল।
কিছুকাল আগে কানাই কাকা তাদের বাড়িতে কাজ করতো। সকাল থেকে সন্ধ্যে ফরমাশ খাটতো। কানাই কাকার বউ আশিসকে বড্ড ভালবাসে। তবে এতোদিন তাদের কোনো খোজ খবর নেয় নি জন্য একটু খারাপ লাগল, বলতে কি লজ্জাও পেল।
ময়নাকাকী বারান্দা থেকে ডাক দিল, ও কে গো? আশিস? এসো বাবা এসো। ভিজে তো কাক ভেজা হয়েছো।
'অন্যদিন আসবোক্ষণ কাকী, আজ থাক।
'থাকবে কেনো, পানি মাথায় বসে গেলে জ্বর হবে, সে খেয়াল আছে তোমার? এসো এসো।
আর উচ্চ বাক্য করার সাহস হল না, উঠে গেল বারান্দায়। কাকীমা গামছাটা এগিয়ে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করল, কেমন আছো? তোমার তো টিকিটাও ধরতে পারি না বাপু, কোথায় থাকো বলত?
মাথা মুছতে মুছতে বললাম, ভিতরবাড়িতেই থাকি। খুব একটা বাইরে বেরোনোর দরকার হয় না।
'সেই ভাল, সেই ভাল। তোমার ধুতি-পাঞ্জাবী সবই তো ভিজে গেছে, দাড়াও বাপু, তোমার কাকার লুঙ্গীটা বের করে দেই।'
কাপড় ছেড়ে লুঙ্গী পরে, চাদর গায়ে দিয়ে বারান্দায় দারালাম।
'ও মা, এখানে দাঁড়িয়ে কেনো? ভেতরে চলো, সন্ধে তো হয়ে এল, কিছু খেয়ে নাও। বৃষ্টি কখন ছাড়বে তার তো ঠিক নেই।
খুব লজ্জা করছিল, তাও ভেতরে গেলাম। দেখলাম, ঘরে আসবাব মানে কিছু থালাবাসন, চৌকি, আলনা, টেবিল আর ছোট একটা বাক্স।
চৌকির এক কোণায় বসে আছে মেয়েটা। বুকের মধ্যে ধ্বক করে উঠল। ঘুপচির মধ্যে ক্ষীণ আলোয় চেহারাটা ভাল বোঝা যাচ্ছিল না।
কাকীমা বলল, কিরে দীপা, ছোটবাবুর জন্য মুড়ি চিড়ে দিবি তো, যা।
মেয়েটা উঠে রান্নাঘরের দিকে ছুটলো। বাড়িতে মোট এই দুটিই ঘর। দুটিই ছনের। ঘরের একোণায় ওকোণায় পানি পড়ছিল।
হরিণীর মত কখন যে মেয়েটা পেছনে এসে দাড়িয়েছে দেখতেই পারি নি। পেছন ফিরে দেখলাম, মেয়েটির গায়ের রঙ শ্যামবর্ণ, কিন্তু মুখের দিকে তাকালে কিসের মায়ায় যেনো চোখটা আটকে যায়। ডাগর ডাগর চোখদুটি যেনো কথা কইতে পারে।
আশিস পাটির উপর বসে, মরিচ দিয়ে মুড়ি খাচ্ছে। ঠিক খাওয়া নয়, গেলা। কারন সে জানে, এটা না খেলে কাকীমাকে অসম্মান করা হবে।

২.আশিসের মা নেই। বড় দুই ভাই বিয়ে করে বউ বাচ্চা নিয়ে এক পরিবারেই আছে। বাবা, ভাই, বউদি, চাকর-বাকর নিয়ে বেশ বড় পরিবারই তাদের। এদের মধ্যে থেকেও সে যেনো এই পরিবারের না। একটা আগাছার মত বেড়ে উঠেছে সে, কিন্তু পরগাছা না। সময় মত সবই চাহিদাই পূরন হয়, ঐ এক যত্নটা ছাড়া। এ নিয়ে আশিসের মাথা ব্যাথা নেই। সে নিজের কাজ নিজে করতেই বেশি পছন্দ করে।
এই পরিবার আর পাড়ার সাথে তার যোগাযোগটাও ভাল নেই। পাড়ার সবাই তাকে সমীহ করে চলে। তাই তার কোথাও যাওয়ার নেই।
নিজের ঘরে বসে সে আনমনে ভাবছে। ভাবতে তার খুব ভাল লাগে। আরামকেদারায় বসে চোখটা বুজে কালকের সেই কথা ভাবছে, কালকের সেই দীপার কথা ভাবছে। হাসি পাচ্ছে, গম্ভীর হচ্ছে, প্রশ্ন করছে নিজেকে।
কই আগে তো কখনও এমন হয় নি, কত সুন্দরী মেয়েকে সে দেখেছে, তাদের প্রতি কখনো তো তার কৌতুহল হয় নি। তবে আজ কি এমন হল? কি এমন আছে তার মধ্যে? না কিছুই নেই। একটু বই পড়া যাক। নাহ, সেই প্রাণ খোলা হাসির শব্দে কিছুই করা যাবে না দেখছি।
আনমনে বাহির বাড়িতে হাটছে আশিস। পাড়ার মধ্যে তার গণ্ডি খুব অল্প। হাটতে হাটতে কখন যে বাগানে চলে এসেছে বুঝতেই পারে নি। হঠাৎ তার চোখ আটকে গেল একটা পেয়ারা গাছে, দীপা, দীপা গাছে উঠে পেয়ারা পারছে? বিস্ফোরিত হয়ে গেল তার চোখ, মেয়েটা করছেটা কি? পরে যাবে তো। নাহ তেমন কিছুই হল না, কোঁচড় ভর্তি করে পেয়ারা পেরে কাঠবিড়ালির মত তরতর করে নেমে এলো। নেমে এসে একদম আশিসের সামনে দাঁড়াল। আশিস বলার মত কোনো কথা খুঁজে পেল না। দীপা আশিসের মনের ভাব বুঝে আনমনে একটু হাসল, কিন্তু প্রকাশ করল না। অল্প একটু হাসির রেশ টেনে রেখে আশিসের কাছে এগিয়ে এল। কোন ভয় নেই, সঙ্কোচ নেই। বলল, ছোটবাবু, পেয়ারা খবেন?
কোনমতে মাথাটা একটু ঝাকাল আশিস, কিন্তু এতে হ্যা বা না কিছুই বোঝা গেল না। কোঁচড় থেকে দুইটা পেয়ারা আশিসের হাতে গুজে দিয়ে মুচকি একটা হাসি দিয়ে চলে গেল দীপা। অবাস্তব চোখে দাঁড়িয়ে রইল সে।

যুদ্ধ, এই শব্দটাকে খুব ঘৃণা করে আশিস। এখন আরো বেশি করে ঘৃণা করতে শিখেছে। চারদিকে তার বিশেষ নজর নেই। তবে বুঝতে পারছে দেশের অবস্থা খুব খারাপ। গ্রামের প্রভাবশালী প্রায় সবাই পাকিস্তানীদের পক্ষে। এমনকি নিজের বাবাও। বাবা তার কৌশলে, ক্ষমতায়, অর্থে নানা প্রকারে এ দিকটায় পাকিস্তানীদের আসা রোধ করবে। কিন্তু এটাও তো পাকিস্তানীদের সাথে চুক্তি। এরকম সাত-পাচ ভাবতে ভাবতে বাড়ির বের হয় আশিস। দীপাদের বাড়ির থেকে চাপা গলার আওয়াজ আসছে মনে হচ্ছে, আর একটু কান পেতে শোনে সে। হ্যা, হ্যা, সত্যিই তো। বাড়ির ভিতর ঢুকতে তার লজ্জা করে। তাই চোরের মত ঘাপটি মেরে একপাশে গা বাঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কিছুক্ষণ পর তিনটি জোয়ান ছেলে বাড়ির পিছনের দিকের জঙ্গলে চলে যায়। আশিস তড়িঘড়ি করে দীপার ঘরে উঠে যায়। দীপা একটু ঘাবড়ে গেলেও সামলে নেয়।
'কেমন আছো দীপা?'
ভাল। কদিনতো আপনাকে দেখাই যাচ্ছে না। ভাবলাম ভারতে চলে গিয়েছেন কিনা।
,আচ্ছা দীপা, তোমার কি মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে হাত আছে?
একটু যেনো ভড়কে যায়, তবে ব্যপারটা বুঝে গেছে জেনে আর ঢাকবার চেষ্টা করে না।
,হ্যা। আমি তো বিনা প্রতিবাদে নিজের দেশটাকে অন্যের হাতে তুলে দিতে পারি না, তাই ওদের সাথে হাত মিলিয়েছি। মুক্তিযুধ্যে সরাসরি অংশগ্রহণ না করতে পারলেও অনন্ত কিছুটা অবদান রাখতে পারি। কিন্তু এখন তো আপনিও জেনে গেলেন ব্যাপারটা। সব ফাস হয়ে গেল। সব চেষ্টা বৃথা হয়ে গেল।
,এখনও হয় নি, আমি তোমার সামনেই আছি, আমাকে মেরে ফেললেই সব আগের মত হয়ে যায়।
এ কথায় যেনো হতবিহ্বল হয়ে যায় দীপা। আশিসের সব মনের ভাব বুঝতে পারে। বুঝতে পারে বাবা পাকিস্তানীদের পক্ষে হলেও ছেলেকে ওই চোখে দেখা ঠিক হয় নি তার।
দীপা আশিসের চোখের দিকে তাকায়, আশিসও নতুন করে দীপাকে দেখে। দুই জোড়া চোখ খুব কাছাকাছি চলে আসে। এতোটা কাছে যে নিশ্বাসের শব্দও স্পষ্ট শোনা যায়। আজকে খুব সুন্দর রোদ্রজ্জল দিন। বনে বনে বর্ষার সব ফুল ফুটেছে। বেলির মিষ্টি সুবাসে ঘরময় ভরপুর। পরিবেশটাও যেনো প্রচন্ড উত্তেজক। আজ তারা এক হয়ে যাবে? বন্য হয়ে উঠবে? কিন্তু তারপরেই যে সব শেষ। না, আশিস সব কিছু শেষ করে দিতে চায় না। এই সুন্দরীর পূজা সে সারাজীবন করে যেতে চায়। গা ঝাড়া দিয়ে উঠে পরে আশিস।

৩.আজকে আশিসের বিয়ে। তার বাবার পছন্দ করা মেয়েকে সে বিয়ে করবে। পরিবারের সবার চৈতন্য ফিরেছে যে আশিস নামে একটা ছেলে আছে এই পরিবারে, আর এখন তার বিয়ে দেওয়ার উপযুক্ত সময়। কিন্তু আশিস বলতে পারল না, বলতে পারল না যে তার হৃদয়জুরে একজন আছে। আজ এই পুকুর পাড়ে বসে নিজেকে বলছে আশিস, কেনো পারছো না? সবাই ছিঃ ছিঃ করবে বলে? কই কখনো তো তোমার কোনো ভাল দিকগুলো দেখে কেও বাহ বাহ দেয় নি। তাহলে তারা ছিঃ ছিঃ করার অধিকারই বা কিভাবে রাখে?
সে জানে কোনো কিছুতেই কিছু হবে না। বাড়িসুদ্ধ এতো লোক, চাকর-বাকড়, পাড়া-প্রতিবেশি এদের সামনে সে দীপার কথা উচ্চারণও করতে পারবে না। কিন্তু দীপাকেও সে ফাকি দিতে পারবে না। তাই তার এতো চেষ্টা, চোখে অন্ধকার দেখছে সে, মাঝে মাঝে তার কানে বাজছে জয় বাংলা ধ্বনি। বুকের মধ্যে জ্বালাপোড়া করছে, মুখ দিয়ে সাদা ফেনা উঠছে। বসে থাকতে থাকতে চিৎ হয়ে পড়ে গেল আশিস। শেষবারের মত চোখ বোজার আগে, মনে মনে সে প্রশ্ন করল, আমি কি তোমার কাছে ঋণী? নাহ, সে কারো কাছে ঋণী না।
নিঃশব্দে গাছ থেকে একটা পাতা খসে পড়ল।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মোঃ নুরেআলম সিদ্দিকী গল্পের ধারাবাহিকতায় যদিও একটু এলোমেলো, কিন্তু গল্প খুব চমৎকার। চালিয়ে যান। ভোট রইলো ....
ধন্যবাদ। চেষ্টা করবো আপনাদের আনন্দ দেয়ার।
কাজী জাহাঙ্গীর বিষয়টা তেমন খুব জুটিল বা বেশ ঘোরপ্যাঁচ পুর্ণ তা নয়, একটা হালকা ভাল লাগার বিষয়ের সাথে খুব মুন্সিয়ানার সাথে মুক্তিযুদ্ধের ভাবটাকে জুড়ে দিয়েছেন তাতেই প্রকাশ পায় লেখক হিসাবে আপনার পরাঙ্গমতা। গল্প কবিতায় স্বাগতম। আশা করি নিয়মিত হবেন। অনেক শুভকামনা, ভোট আর আামার পাাতায় আমন্ত্রণ।
আমার লেখা প্রথম গল্প। কেবল ক্লাস নাইনে পড়ি, এর চেয়ে বেশি কিছু মাথায় এলো না, তাই এই লিখে ফেললাম।
ফেরদৌস আলম আপনার গল্পের বর্ণনায় প্রাণ আছে। ভাল লাগলো ভাই।
খন্দকার আনিসুর রহমান জ্যোতি সে জানে কোনো কিছুতেই কিছু হবে না। বাড়িসুদ্ধ এতো লোক, চাকর-বাকড়, পাড়া-প্রতিবেশি এদের সামনে সে দীপার কথা উচ্চারণও করতে পারবে না। কিন্তু দীপাকেও সে ফাকি দিতে পারবে না। তাই তার এতো চেষ্টা, চোখে অন্ধকার দেখছে সে, মাঝে মাঝে তার কানে বাজছে জয় বাংলা ধ্বনি। বুকের মধ্যে জ্বালাপোড়া করছে, মুখ দিয়ে সাদা ফেনা উঠছে।...// মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে লিখা চমৎকার একটা বিচ্ছেদ কাহিনী খুব ভালো লাগলো....নিঃশব্দে গাছ থেকে একটা পাতা খসে পড়ল। ...শেষটাও ভালো ছিলো ...ধন্যবাদ সেজান খন্দকারকে ...

২৮ জানুয়ারী - ২০১৭ গল্প/কবিতা: ৬ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪