*এক*
ভূত দেখার মতো চমকে উঠলাম আমি। ব্যাপারটা পুরোপুরি অপ্রত্যাশিত ছিলো, অন্তত আমার কাছে তো বটেই। সামনের সারিতে বসে থাকা মধ্যবয়েসী মহিলার চেহারায় ক্লান্তির ছাপ তার বয়সটাকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে। তবে কুঁচকে থাকা ভ্রু আর ভাঁজ পড়া চামড়ায় খুব চেনা মুখটা ঢাকা পড়েনি। নাওমী এখানে! নিজেকেই প্রশ্ন করলাম।
.
*দুই*
মেয়েটা আমার বড্ড ঘুমকাতুরে। যে ক'টা দিন সাথে থাকে আমাকে জড়িয়ে ঘুমানো চাই-ই চাই। হোস্টেলে থাকলে কিভাবে ঘুমায় কে জানে...জিজ্ঞেস করা হয়নি কখনো। লজ্জা পাবে তাই হয়তো। চৌদ্দ বছর বয়স ওর, এখনো শিশুসুলভ কোমলতা যায়নি শরীর থেকে। আর গেলেও বা, বাবাদের কাছে মেয়েরা সারাজীবনই পাঁচ বছরের ছোট্ট শিশুটি থেকে যায়। খুব সন্তর্পনে আমার গলা থেকে ওর হাত সরিয়ে রাখলাম। যদিও আমি জানি লাবণ্য টের পাচ্ছে আমি উঠে পড়ছি। আরো কিছুক্ষণ মেয়েটার পাশে থাকতে ইচ্ছে করছে। সপ্তাহখানেক পরেই ওর ছুটি শেষ হয়ে যাবে। হোস্টেলে চলে যাবে বেচারী। মাস দুয়েকের আগে আর দেখা পাওয়া যাবে না ওর। কিন্ত ইচ্ছেটা জলাঞ্জলী দিতে হলো। এগারোটায় গাজীপুরে একটা প্রোগ্রামে যেতে হবে। বেলজিয়ামের একটা এনজিও বাংলাদেশে বেশ কিছু স্কুলে প্রজেক্টরের মাধ্যমে শিক্ষাদানের কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। তাদের একটা প্রাইমারী প্রজেক্টের উদ্বোধন হবে। তাই অধমের নমস্য যাত্রা।
.
*তিন*
অতিথিদের জন্য রাখা চেয়ারে বসে বারবার নাওমীর দিকে চোখ যাচ্ছিলো আমার। প্রায় কুড়ি বছর পর ওকে দেখছি। চেহারায় আগের সেই মায়াবী ভাবটা নেই। স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়েছে। সুখে নেই বোঝা যায়। আচ্ছা, সুখ কি মানুষের চেহারায় লেখা থাকে? শুধু মুখ দেখেই কি বলে দেয়া যায় কে কতোটা সুখী?
নাওমীর সাথে চোখাচোখি হলো। এক নিবিষ্টে চেয়ে রইলো আমার দিকে। তারপরই হঠাৎ করে চোখ বড় বড় হয়ে গেলো ওর। চিনতে পেরেছে নিশ্চয়ই। না চিনলেই অবাক হতাম। তিন বছর প্রেম করার পর প্রাক্তন প্রেমিককে না চেনার কথা না। চারটে বছর! স্মৃতির ডানায় ভর করে একটা উড়াল দিয়ে আসা যায়। নব্বুইয়ের ঢাকা, সবে পতন হয়েছে সেনা সরকারের, ক'দিন আগেও আগুণ জ্বলা রাজপথ তখন শান্ত, জলপাইরঙা সামরিক ট্রাকের গর্জন শোনা যায় না রাতবিরেতে। সেই শান্ত হয়ে আসা ঢাকায় আমার পদার্পণ; বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট শুরু।
সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি তখন, একেবারে গেঁয়ো ভূত না হলেও, মফস্বলের অন্তর্মূখী স্বভাব আমার বরাবরই ছিলো। সকালের ক্লাস, বিকেলে পাবলিক লাইব্রেরীর চত্বর; অথবা টিএসসির আট আনার চা- এইটুকুতেই ছিলো আমার দুনিয়া। সেখানেই অল্প ক'দিনে নাওমী'র বিপুল তান্ডবে প্রবেশ! আমার বদলে যাওয়া, ওর ছোঁয়ায়। শাহবাগ থেকে টিএসসি হয়ে ফুলার রোডে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা শতবর্ষী বৃক্ষগুলো, পলাশীর চায়ের দোকান, হোটেল নীরব কিংবা রমনার গাছের ছায়া থেকে রেসকোর্সের খোলা হাওয়া জানে আমাদের প্রেমের গল্পটা। তখন রাস্তায় নতুন করে লাগানো হচ্ছে সোডিয়ামের বাতি, নিয়নের হলুদ স্নিগ্ধতা ছেড়ে রাতের ঢাকা আশ্রয় নিচ্ছে ফ্যাকাশে সাদা আলোর, সেই বাতির সারি জানে আমাদের প্রথম চুমুর কথা। কয়েক বর্ষার ঝুপ করে নামা সন্ধ্যায় ঝরে পড়া আকাশী জলেরা সাক্ষী ছিলো আমাদের ঘনিষ্ঠতার, ওর ভেজা চুলে নাক ডুবিয়ে মাদকতার স্বাদ নেয়া কোন ঘোর শ্রাবণী আমাবস্যায়। আর ওর মায়াবী চোখে ডুব দিয়ে নিজের অববয়ব দেখার সময়গুলোর সাক্ষী হয়েছিলো শরতের আকাশ।
বছর তিনেক বাদে আমাদের হিসেবটা থমকে গিয়েছিলো, সরল অঙ্ক জুড়ে এসে ভর করেছিলো জটিলতার সমীকরণ, লাভ-ক্ষতির হিসাব-নিকেশ। ভার্সিটির ফাইনাল ইয়ারে থাকা আমি সে হিসেবটা মেলাতে পারিনি, পাতাজুড়ে ভুলেভরা গাণিতিক সংখ্যার মেলা; আর সেখানে একাকীত্বের বেদনায় প্রতিমূহুর্তে বিদীর্ণ হওয়া। সেই অনিঃশেষ অন্ধকারে ভীষণ একলা হয়ে আলো হাতড়ে খোঁজার স্মৃতিটা এখন অনেকটাই ধূসর। সেই অস্থির সময়ে শহরটা বদলে যাচ্ছিলো, সেই সাথে মানুষগুলোও। ওই পালাবদলের সাথে তাল মেলাতে আমার সময় লেগেছে অনেক। সবকিছু ভেঙেচুরে উঠে দাঁড়ানোর গল্পটা আমি জানি, কেবল আমি।
মাইক্রোফোনে কোন একটা ঝামেলা হচ্ছে, কেমন একটা ঘড়ঘড় শব্দ আসছে, কানে লাগছে ভীষণ। রামছাগলগুলোর ন্যাকা ন্যাকা বক্তৃতা শেষ হলেই হয় এখন। খাজনার চাইতে বাজনা বেশী দেখা যাচ্ছে।
.
*চার*
-কেমন আছো?
-ভালো। তুমি এখানে?
-তোমায় দেখে তো মনে হচ্ছে না ভালো আছো।
-আমার প্রশ্নের জবাব তো দিলে না।
-প্রশ্নটা আমারও। তুমি এখানে কেন?
-আমি এই স্কুলের টিচার।
-বাহ! কোন সাবজেক্ট পড়াও?
-প্রাইমারী স্কুলে সাবজেক্টিভ টিচারের দরকার হয় না। এখানে মোটামুটি সবাই সবকিছু পড়াতে পারে। আমার প্রশ্নের জবাব কিন্ত এখনো পাই নি।
-তোমাদের স্কুলে যারা প্রজেক্টরগুলো দিচ্ছে ওদের দেশেই থাকি আমি। যদিও নুন খাই বাংলাদেশ সরকারের।
-বেলজিয়ামে? কি করছো ওখানে?
-বাংলাদেশ হাইকমিশনে আছি। সেকেন্ড ইনচার্জ।
-ভালোই তো।
-হ্যাঁ, ভালো। তোমার খবর বলো। হাজব্যান্ড কি করে? ঢাকায় না থেকে এখানে কেন? তুমি তো বলতে ঢাকায় বাসা না নিলে আমাকে বিয়েই করবে না। এখন মফস্বলের বরে সন্তুষ্ট?
-খোঁটা দিচ্ছ?
-হুম।
-দাও, তোমার সময়, তোমারই তো দেয়ার কথা।
-তোমার যখন সময় ছিলো তখন তো তুমি নিজের রাস্তা বেছে নিয়েছিলে, তাই না?
-পুরনো কথা ভেবে কি লাভ বলো?
-কোন লাভ নেই। বর্তমানের কথা বলো। হাজবেন্ডের কথা বলো। বাচ্চাকাচ্চা কয় ডজন জন্ম নিলো?
-ছেলে, দু'জন, তোমার?
-আমার একটাই মেয়ে। আর তোমার স্বামী?
-ও আমাদের সাথে থাকে না। আমি আম্মুকে নিয়ে থাকি এখানে।
-ও...
-কেন জিজ্ঞেস করবে না?
-অধিকার আছে? পুরনো সম্পর্কের মানুষদের ব্যক্তিগত ব্যাপারে জানতে চাওয়া হয়তো ঠিক হবে না।
-অনেক কারণ। ব্যবসা করতো। বিয়ের পর হঠাৎ ব্যবসায় লস দিলো। আমাকে টাকাপয়সার জন্য চাপাচাপি করতে থাকলো। সাধ্যমতো চেষ্টা করেছে আব্বু আম্মু। ভেবেছিলাম বাচ্চার জন্মের পর ঠিক হয়ে যাবে সব। আম্মু, শাশুড়ী সবাই এই কথাই বলেছিলো। কিন্ত ও আরো উগ্র হয়ে গেলো।
-নেশাটেশা করতো নাকী?
-হ্যাঁ। বিয়ের আগেও করতো। মাঝে ছেড়ে দিয়েছিলো। গায়ে হাত তোলা শুরু করলো। তখন আর থাকতে পারলাম না। চলে এলাম আম্মুর কাছে।
-কয় বছর আগের ঘটনা?
-আট বছর।
-তোমার বাচ্চাদের কথা বলো।
-বড়টা ওর বাবার কাছে থাকে। কলেজে পড়ছে। ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে। আর ছোটটা আমার সাথে আছে। ক্লাস সেভেনে পড়ে। তোমার ওয়াইফ?
আমার বুকের একপাশে চিনচিন করে উঠলো। মুখে তার ছাপ পড়লো কিনা জানি না। কণ্ঠটা যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখেই উত্তর দিলাম,
-নেই। চলে গেছে আমাকে আর আমাদের মেয়েটাকে ছেড়ে।
-ডিভোর্স?
-নাহ। দুনিয়া ছেড়েই চলে গেছে।
-কিভাবে?
-অ্যাক্সিডেন্ট। স্পট ডেড।
-Sorry...
-জীবনে প্রথমবার বোধহয় শব্দটা শুনলাম তোমার মুখে?
-ফালতু কথা বলো না। আর তোমার মেয়ে?
-ওর বয়স চৌদ্দ। নাম রেখেছি লাবণ্য। সেই নামটা, তোমার আর আমার মেয়ে হলে যে নামটা রাখবো বলে ঠিক করেছিলাম, সেটাই।
-কোন ক্লাসে পড়ে? বেলজিয়ামেই?
-নাইনথ স্ট্যান্ডার্ডে। নাহ, বেলজিয়ামে না। আমার বদলীর চাকরী, দু'বছর ইউরোপে, তারপর আফ্রিকায়...তাই ওকে ইউএসএ পাঠিয়ে দিয়েছি। ভার্জিনিয়ার মেরিল্যান্ডে একটা কলেজে পড়ছে।
-আমাদের দুজনের জীবনটাই কি অদ্ভূত হয়ে গেলো তাই না? তোমার স্ত্রী নেই। আমার স্বামী থেকেও নেই।
-জীবনের ধর্মই তো অদ্ভুত।
-আমাকে মনে পড়ে?
-একটা সময় পড়তো। তারপর ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে গেছে। যে নিজের ইচ্ছায় চলে গেছে তার জন্য সারাজীবন মায়াকান্না করে কি লাভ বলো?
-দেশে আছো কয়দিন?
-দিন পাঁচেক। মেয়েটার ছুটি আছে আর এক সপ্তাহের মতো। ওকে নিয়ে আমেরিকায় যাবো। ও হোস্টেলে চলে গেলে আমি বেলজিয়াম ফিরবো।
-আমাদের আর দেখা হবে?
-খুব সম্ভবত...না।
-সবকিছু আবার নতুন করে শুরু করা যায় না?
চিন্তাভাবনা করে উত্তর দিতে হলো না। মুখ থেকে অটোমেটিক উত্তর বেরিয়ে এলো-
-না। একবার আমি নতুন করে জীবন শুরু করেছি। সেটাই আমার দ্বিতীয় জীবন। তৃতীয় বারের আশা আমি করি না।
.
*পাঁচ*
গোধুলীর আলো মিইয়ে যাচ্ছে। সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসছে দ্রুত। আমার গাড়ী ঢাকার দিকে ছুটে চলেছে। পেছনে ফেলে যাচ্ছি নাওমীকে, তার স্মৃতির ডায়েরীর সাথে। থাক, পড়ে থাক। জীবনে কিছু কিছু মূহুর্তে 'না' বলা শিখতে হয়। যে যতো দ্রুত 'না' বলা রপ্ত করতে পারে, তার সমস্যা ততো দ্রুত কমে। মায়া কাটিয়ে ফেলা মানুষেরা 'না' বলতে পারে সহজে। অনেকগুলো বছর আগে যে আমাকে হ্যাঁ বলতে পারেনি, তার জন্য আজ আমার 'না'- শব্দটাই বরাদ্দ। মেয়েটার জন্য চিন্তা হচ্ছে। দুপুরে কি খেয়েছে কে জানে... আজ নিশ্চিত ওর বকা শুনতে হবে। বেরুনোর সময় ওকে বলে যাই নি যে...।।
২৫ জানুয়ারী - ২০১৭
গল্প/কবিতা:
১ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪