টেনিস ক্লাব থেকে ৪৫ টাকা দিয়ে বল আর বাজারের দামি টেপ "টেসা" ৩০ টাকা দিয়ে কেনার পর সবাই ক্রিকেট খেলার জন্য রেডি, বলে টেপ প্যাচানোর দায়িত্ব টা আমিই পেলাম।
খেলা শুরু করার আগে সবসময় একটা শর্ত দেয়া হয়, যে যদি কেউ বল হারায় তবে পুরো টাকা তার একার দিতে হবে।
.
তেমন খেলাধুলা না করলেও একেবারে যে পারি না তা নয়। কোন মাঠের সুব্যবস্থা না থাকায় পিচঠালা রাস্তায়ই খেলতে হয়, আর খেলতে হয় খুব সাবধানে কারন আসে পাশে সব বাসা।
খেলছি তখন ২ বলে ৩ রান লাগে জিততে। মারলাম বলটা অফদিয়ে উরে গিয়ে পাশের বাসার একটা জানালা দিয়ে ডুকে পরলো! সাথে গ্লাস ভাংগার মতো একটা শব্দ। সব পোলাপান একদম উসাইন বোল্ট এর মতো দৌড় দিয়ে পালালো! এর কারন অবশ্য সবারি জানার কথা, একে তো রাস্তায় কেউ খেলতে দিতে চায়না, তারপর যদি কারো ক্ষতি হয় তবে তো তার চৌদ্দগুস্টি উদ্বার করে দেয়।
আমিও দৌড়টা দিতে চাইছিলাম কিন্তু বলের দাম হিসেব করে দৌড় টা আর দেই নি। বলটা যেভাবেই হোক নিয়ে আসতে হবে। বাসার কাছে যেতে যেতে ভাবতে লাগলাম, এই দিকের জানালা গুলো অনেক দিন অফ ছিলো, আজ এগুলো খোলা কেন!
জানালায় উকি মেরে দেখলাম, শো-কেস এর আয়না টা ভেংগে গেছে, ভয় করতে লাগলো চলে আসবো তখনো কেউ একজন ডাকলো, ঔ এইদিকে আসো, তুমিই বল মারছো তাইনা!!আব্বুকে বললে তোমায় কি করবে জানো!! আমার আব্বুকে তো চিনোনা...! কত্ত রাগী ...!
আমি সরি বললাম। অইটাই প্রথম খেলতে গিয়ে কাউকে সরি বলা।
হুম.... ঠিক আছে! যাও...
আমি অনেক সাহস করে বলটা চাইলাম!
বল চাইতেই মেয়ে ভ্রু কুচকে অবাক হবার মতো করে বললো তোমার সাহস তো কম না তুমি শো-কেস এর আয়না ভাংগার পরও আবার বল চাইছো!
আব্বুকে ডাকবো!!!!?
এইবার সত্যি ভয় পেয়ে, আমিও উসাইন বোল্ট এর মতো দৌড় দিছিলাম।
কিন্তু পোলাপানের কাছে ফিরে আসতেই জরিমানা চাওয়া শুরু করলো তখন ক্লাস সিক্স এ পড়ি, আমায় বাসা থেকে বেশির ভাগ সময় কোন টাকা দিতো না, বাকি দোকান ঠিক করা ছিল ওখান থেকেই ইচ্ছা মতন খেতাম। এতো টাকা কই পাবো তাই ভাবতেছিলাম..........
স্কুল থেকে ফেরার পথে মেয়েটার সাথে দেখা, খুব সাহস করেই এগিয়ে গিয়ে বললাম, বলটা দিয়ে দিও প্লিজ,নইলে আমার ৭৫ টাকা জরিমানা দিতে হবে আর এত টাকা আমার কাছে নাই।
শুনে মেয়েটা কেমন জানি একটু তাকালো, তারপর বল টা দিতে রাজি হলো। আর আমার নাম জিগ্যেস করলো। আমি ওর নাম জিগ্যেস করলে বলেছিল ওর নাম তন্নি।
বলটা দিয়ে একটা শর্ত দিলো যে,তোমায় কখনো যেন ব্যাটিং -বোলিং করতে না দেখি, তাহলে আব্বুকে বলে দিবো যে, তুমিই শো-কেস এর গ্লাস ভাংছো।.
.
এরপর অনেক দিন আর ব্যাট-বল হাতে নিই নাই, শুধু কিপিং করতাম। সরকারি কিপিং ২ দলের হয়েই। তবে এটা খেয়াল করতাম যে, জানালা দিয়ে তন্নিও খেলা দেখতো।
একদিন হাবিলদার (সাব্বির) এর বলে আমার ডান হাতের কানি আংগুলের সেকেন্ড এবং থার্ড ফ্যালাংস টা ভেংগে যায়। ((হাবিলদার বলতাম কারন ওর বাবা পুলিশ ছিল। "পুলিশের পোলা হাবিলদার " এইভাবে বলেই রাগাতাম!
))
।
২১ দিন গলার সাথে হাত ঝুলিয়ে রাখতে হইছে, এরপর আর খেলতাম না, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম। এর মাঝে ওর পরিবারের সাথে আমার পরিবারের ভাল একটা শখ্যতাও গড়ে ওঠে। ওরা এলাকায় নতুন ছিলো, তাই আমাদের ওখানেই বেশি আশা যাওয়া ছিল।
.
তন্নি যেদিন বাসায় প্রথম আসছিল, তখন আমি গেমস খেলছিলাম। আমায় বলেছিল, তুমি ক্রিকেট খেল না কেন?কাল থেকে খেলবা! এমন ভাবে বললো মনে হল যেন আমার টিচার!
.
তারপর অনেক দিন কেটে গেল, কথাও হয়েছে অনেকবার। সেম ক্লাস ছিলো বলে পড়া-শুনাও শেয়ার করা যেত। তাই বাসা থেকেও তেমন কোন বাধা ছিল না। এমনি কয়েক বছর কেটে গেল।
.
হঠাৎ একদিন খেয়াল করলাম, রাস্তার ধারের অই জানালা গুলো বন্ধ! কেমন জানি খারাপ লাগা শুরু হলো, তারপর এক বন্ধু কে জিগ্যেস করলাম, এরা কই রে? উওর দিলো বাসা ছেড়ে চলে গেছে।
.
বাসায় এসে আম্মাকে বললাম, আম্মা তন্নিরা চলে গেছে?
--হ্যা চলে গেছে।
কেমন মানুষ তোমাকেও বলে গেল না!
--বলে গেছে তো,তুই তখন ঘুমাইছিলি, তোকে ডাকতে চাইছিলো, আমি নিষেধ করছি, কাচা ঘুমে তোকে কেউ ডাকলে তুই তো খুব রাগ পাস তাই।
.
শুনে মনটা আরো খারাপ হয়ে গেল।
আম্মা বললো, তন্নি একটা গল্পের বই তোকে দিয়ে গেছে, তোর টেবিল এর উপর ই তো রাখা দেখিস নাই?
আমি তারাতারি গিয়ে বইটা হাতে নিলাম। নাটক-সিনেমার মতো বইয়ের পাতার ফাকে কিছু একটা আশা করেছিলাম, কিন্তু কিছুই পেলাম না।
তখন ক্লাস ১০ এ পড়ি।
কিছুদিন পর একটা ফোন আসলো, অপরিচিত নাম্বার তাই একটু আগ্রহ পেলাম।
হ্যালো কে?
আমি,তন্নি....
ত ত তন্নি!!!
হুম
ফোন নাম্বার কোথায় পাইলা!!!
মানে!
না, মানে,আসলে....... কিছু না আরকি, এমনি কে কে কেমন আছো?
এরকম করে কথা বলতেছ কেন! কি হইছে?
না,কিছু হয়নি, তুমি ফোন দিছো তাই আরকি...
তাই আরকি কি?
কিছু না, কি জন্য ফোন দিছো?
এমনি দিছি, আন্টি কোথায়?
আম্মা? আম্মা আছে তো দাড়াও ডাক দেই, বলেই আম্মা আম্মা করে চিল্লাইতে লাগ্লাম।
ওপাশ থেকে তন্নি বলতেছে, এমন ভাবে চিল্লাইতেছ যেন কোথাও আগুন লাগছে!
আমি- না, আম্মাকে চাইলা না তাই ডাকলাম।
তন্নি -হুম, আন্টি হয়তো পাশে নাই, আচ্ছা এখন বলো তোমার কি অবস্থা?
আমি-ভালোই আছি।
তন্নি -আচ্ছা, রাখি এখন পড়ে কথা হবে। আব্বু আসছে.....
ফোন টা কেটে দেবার পর তন্নির বাবার উপর খুব রাগ হলো, সালা এই একটা ক্ষেত্রে বাংলা সিনেমার সাথে বাস্তব জীবন মিলে, তা হলো মেয়ের বড় ভাই আর বাপ সবসময় ভিলেনের চরিত্রে অবস্থান নেয়।
এরপর আমি কখনো ফোন দেবার সাহস পাই নি।
ও আবার একদিন ফোন দিলো অনেক কথা বললাম। শেষএ জানতে চাইলাম, আমাদের এখানে ঘুরতে এসো।
ও বললো হ্যা -আম্মু যাবে বলছে।
আগ্রহভরে জিগ্যেস করলাম তুমি আসবে না!!!!!
তন্নি -জানিনা।
আমি-জানিনা মানে!
তন্নি -উমমম----- #হয়তো_বা ।
.
.
.
৯ বছর পর......
.
তন্নির মা--হ্যালো বাবা,অনেক দিন হলো তোমাদের দেখি নাই, আসো না একবার তন্নিকে নিয়ে ঘুরে যাও।
আমি -জ্বি,আচ্ছা।
তন্নি পাশে থেকে জিগ্যেস করছে, কে আম্মু ফোন দিছে?
আমি -হুম, এই ক'দিন আগেও তো গেলাম। একমাসও হয়নি, তারউপর তোমার শরীরের অবস্থাও তেমন ভালো না,এই অবস্থায় জার্নি করাটাও রিস্ক।
তন্নি - তুমি যাবে কিনা তাই বলো !! (অভিমানী চেহারায় -গাল ফুলিয়ে)
.
আমি- (বেগতিক দেখে) #হয়তো_বা grin emoticon