দিনমজুর সলিমুদ্দির তিন মেয়ে।দুটি মেয়েকে সে কোনো ভাবে পার করেছে।মানে এক রকম কষ্ট করে কোনো মতে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে।কিন্তু সে বিপাকে পরেছে ছোট মেয়ে সালেহাকে নিয়ে।মেয়েটার গায়ের রঙ কালো আর সে কারণে তার তেমন একটা চাহিদা নেই।কিন্তু বাবা হয়ে সে তো আর বসে থাকতে পারে না।তাই সে দিকে দিকে মেয়ের সমন্ধ খুঁজতে লাগল।মেয়ে কালো বলে সমন্ধ জুটতে চায় না কিছুতেই। আর সে তো দিনমজুর তাই বেশি ভালো সমন্ধ তার কপালে যে নাই সেটাও সে জানে।
খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে সালেহার মামা গণি একটা সমন্ধ খুঁজে পেল। সে ছেলেদের পক্ষ থেকে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এলো তার দুলাভাইয়ের কাছে মানে সলিমুদ্দির কাছে।
সলিমুদ্দি সবকিছু শুনে গণিকে বলল, তোমার সব কথা হুইনা মনে হইল পোলা ভালাই হইব।তয় পোলার মুদি কারবারের বয়স বেশি হয় নাই।আর বেশি ভালাও না তার কারবারের অবস্থা।অহন তোমার বইনের লগে কথা কইয়া দেহ হেয় কি কয়।মাইয়া দিব এই পোলার লগে।
সলিমুদ্দির কথা শুনে তার বউ বলল, গণি যহন আনছে পোলা ভালাই হইব।তয় আমি বাঁধা দিমু কি কইয়া।আমি চিন্তা করতাছি পোলার বাপে যে শর্ত দিছে হেই লইয়া। এছাড়া এই পোলার লগে আমগো সালেহারে দিতে আমার কোনো আপত্তি নাই।এহন তুমি দেহ কি কইরা টাহা জোগাড় করবা।
বোনের কথা শুনে তার ভাই গণি বলল, হ বইন তুমি ঠিকই কইছ।সালেহারে হেরাও নিবে তয় কারবারের ভালা করার জন্যি পোলারে দুই লাখ টাহা দেয়াই লাগবে নাইলে এ বিয়া হইব না।এহন সলিমুদ্দি ভাই তুমি দেহ কেমনে কইরা টাহা গুলা জোগাড় করবা।এমন পোলা কিন্তু সহজে আর পাইবা না।
হ হেইয়াই তো ভাবতাছি। হাতে তো কোনো টাহা পয়সা নাই।রোজ কামলা খাইটা যা পাই হেইতো তো সংসার ই চলে না ঠিকভাবে। আর এহন এতগুলা টাহা কই পামু।বুঝি সালেহার বিয়াটাই দিতে পারমু না।এমন সুন্দার পোলাডা হাতে আইয়াও হাত ছাড়া হইয়া যাইব।সলিমুদ্দি তার দুঃখের কথা বলে উঠল।
এত ভাইঙ্গা পইরেন না তো । টাহা জোগাড় করার চেষ্টা কইরা যান আর দেহি আমিও কিছু দিতে পারি কিনা তয় সালেহার মামি তো কাউরে কিছু দিতে চায় না হেইডাই চিন্তা করি। গণি দুলাভাইকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে উঠল।
ভাইয়ের কথা শুনে তার বোন বলল, হয় সালেহার বাপ এত চিন্তা কইর না।দেহ লোকজনের কাছে চাইয়া মাইয়াডা পার করতে পারো কিনা।গণি তো চেষ্টা করবে কইছেই।একটু থেমে সে তার ভাইকে অনুরোধের সুরে বলল ভাই গণি আমাগো লইগা তুই কিছু করিস।দেহ না তো দুলাভাইয়ে খুব চিন্তায় আছে।
বোনের কথা শুনে গণি বলল, হ কিছু দেওয়ার চেষ্টা করমু।তয় আমিও তো গরিব মানুষ বেশি কি আর দিতে পারমু।তোরাও চেষ্টা কর।আইজ আমি চলি তয় পোলারা কিন্তু সাত দিনের সময় দিছে হের মাঝেই ওদেরে কইতে হইবে তোরা পারবি কিনা।
গণির কথা শুনে তার বোন বলল, তুই না কইস না, ওগো বুঝাইয়া কইস সময় একটু বেশি লাগলেও আমরা আমগো সালেহারে হেগো পোলার লগেই দিমু।
হ গণি এ পোলা আমরা হাত ছাড়া করমু না তুমি যেভাবেই হউক তাদের বুঝাইয়া কইও আমার টাহা জোগাড় কইরা তাদেরকে দিমু।সলিমুদ্দি এবার গণিকে তাদের আগ্রহের কথা বলে দিল।
আইচ্ছা আমি গেলাম তাইলে। সাত দিন পরে পোলার বাপেরে নিয়া আইসা তোমাদের কাছ থেইকা টাহা নিয়া যামু আর বিয়ার কথা পাকা কইরা যামু ঠিক আছে। গণি এই কথা বলে বিদায় নিল।
সলিমুদ্দি মেয়ের বিয়ে নিয়ে বেশ চিন্তায় পরে গেল। বিয়ের এতো কাছে এসে ও কি তবে তার সালেহার বিয়েটা আটকে যাবে। কিন্তু কোথায় পাবে সে এতগুলো টাকা।তার কাছে এ টাকা যে পাহাড় সমান।কিন্তু মেয়ে তার কালো টাকা ছাড়া কেউ কি আর তার সালেহাকে নিতে চাইবে। সে ভালো না মন্দ তাতো কেউ ই দেখতে চাইবে না তবুও যে এত ভালো একটা সমন্ধ তার মেয়ের জন্য এসেছে এটাতো খুব ভালো কথা।না এ বিয়ে তাকে দিতেই হবে যে করেই হোক।সে মানুষের কাছে হাত পাতবে, মানুষ তাকে ফিরিয়ে দেবে না নিশ্চয়।
বউয়ের কাছে সলিমুদ্দি বলল, কাল আমি এলাকার চেয়ারম্যানের কাছে যামু কি কও।হে তো ইচ্ছা করলে টাহা গুলা দিতে পারব।তুমি কি কও?
আমি আর কি কমু।যাইয়া দেহ। আমাগোর তো মাইনসের কাছে যাইতেই হইব।দেহ হেয় চেয়ারম্যান গ্রামের মাথা যদি আমাগোর সাহায্য করে তয় সালেহার বিয়াডা হইয়া যাইত।সলিমুদ্দি কে উৎসাহ দিয়ে তার বউ কথাগুলো বলল।
সলিমুদ্দি তার ভাবনা অনুযায়ি কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল।
পরদিন ভোরে সে সবার আগে চেয়ারম্যানের বাড়িতে গিয়ে হাজির হলো। এলাকার লোক হিসেবে চেয়ারম্যান এর কাছে সে পরিচিত ছিল।তাই তাকে দেখে চেয়ারম্যান তাকে জিগ্যেস করল, কি রে সলিমুদ্দি এতো ভোরে আমার বাড়িতে এলি তোকে তো আগে কখনো আমার বাড়িতে আসতে দেখিনি।
সলিমুদ্দি বলল, চেয়ারম্যান সাইব বড় বিপদে পইড়া আইছি।টাহার অভাবে মাইয়াডার বিয়া দিতে পারতেছি না।আপনি যদি একটু দয়া করেন।এরপর আস্তে আস্তে সলিমুদ্দি সবকিছু তার কাছে খুলে বলল।
সবকিছু শুনে চেয়ারম্যান বলল, দেখ সলিমুদ্দি দুই লাখ টাকা অনেক টাকা তোরে এত টাকা আমি কোথা থেইকা দিমু।আমার হাতে এত টাকা নাই।তুই একটু অপেক্ষা কর আমি ভিতর ঘরে গিয়া দেখি তোরে কত টাকা দিতে পারি।
একটু পর চেয়ারম্যান বাইরে বেড়িয়ে এসে সলিমুদ্দির হাতে কিছু টাকা দিয়ে বলল, দেখ সলিমুদ্দি এই এহানে পাচ হাজার টাকা রয়েছে এটা নিয়া যা তোর মেয়ের বিয়েতে খরচ করিস।এর বেশি আর আমি দিতে পারমু না তোরে।
সলিমুদ্দি হতাশ হলো।সে এত কম টাকা পাবে চেয়ারম্যানের কাছ থেকে তা ভাবতে পারেনি।সে কি বলবে তা আর ভেবে পাচ্ছে না।নিশ্চুপ টাকাটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তার আশাহত হওয়ার বিষয়টা চেয়ারম্যান বুঝতে পারল।তাই সে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, সলিমুদ্দি এখন বাড়ি যা আর দেখ আরো ধনী লোকজন তো রইছে তাদের কাছে গিয়াও চাইয়া দেখ।
সলিমুদ্দি মুখ থেকে আর কোনো কথা বের করতে পারল না।সে আশা করেছিল চেয়ারম্যান তাকে একটা বড় অঙ্কের টাকা দিয়ে সাহায্য করবে কিন্তু চেয়ারম্যান তাকে চরমভাবে আশাহত করলো।সে নিথর কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল।চেয়ারম্যান ঘরের ভিতরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল।
সলিমুদ্দি বুঝে গেল আর দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই।সে ব্যথিত মন নিয়ে বাড়ির পানে পা বাড়াল।তার মনে ভয় ঢুকে গেল বুঝি সে আর সালেহার বিয়েটা দিতে পারবে না।কারণ এতগুলো টাকা সে কেমন করে জোগাড় করবে।যদি চেয়ারম্যান ই তাকে মাত্র পাচ হাজার টাকা দেয়।গ্রামের আর বাকি কারো কাছে টাকা চাইলে তাকে আর কত টাকা ই বা দেবে।সে মনে খুব কষ্ট নিয়ে গ্রামের বাজারে চলে এল। বাজারে এসে সে তার দিনমজুর বন্ধু রহিমচান এর সঙ্গে দেখা করলো । তার কাছে সবকিছু খুলে বলল।
সবকিছু শুনে রহিমচান বন্ধুকে সান্ত্বনা দিল।আর বলল, চল চায়ের দোকানে যাই চা খাইতে খাইতে কথা কমু।
চা খামুনা দোস্ত তুই পারলে টাহার একটা ব্যবস্তা কর।সলিমুদ্দি তার বন্ধুকে বলল।
আরে হেই কথাই তো তোরে চা খাইতে খাইতে কমু। ল ঐ চায়ের দোকানে বসি। এ কথা বলে রহিমচান সলিমুদ্দির হাত ধরে চায়ের দোকানে নিয়ে বসাল।
চা খেতে খেতে এবার রহিমচান সলিমুদ্দিকে বলল, দোস্ত চিন্তা করিস না নে চা খা আরে সালেহা তো তোর একার মাইয়া না ওতো আমাদেরও মাইয়া আমরা সবেতে মিইলা ওর জন্যি চেষ্টা করমু।
বন্ধুর কথা শুনে ভালো লাগল সলিমুদ্দির।আর যাই হোক তাকে তো সান্ত্বনা দিচ্ছে তার বন্ধু।সে এবার হাসি মুখে তার বন্ধুকে বলল, তা রহিমচান তুই একটু আমারে দুই একজন টাহাওয়ালা লোকের খোঁজ দে না ভাই।যদি তারা সাহায্য করে তয় আমার মাইয়াডার একটা গতি হয়।আমি খুব চিন্তায় আছি দোস্ত।
হেই কথাই তো তোরে কমু দোস্ত।ঐ পাড়ার কাবিল মিয়া খুব ধনী লোক হুনছি শহরে বড় কারবার আছে তার।চল তোরে নিয়া এহন তার কাছে যামু তোর ভাগ্য ভালো হে এহন গ্রামে আছে।
সলিমুদ্দি্ আর রহিমচান কাবিল মিয়ার বাড়িতে এসে হাজির হলো।কাবিল মিয়া বিশাল ধনী ব্যক্তি।কিন্তু তাতে কি হবে সে হাড়কিপটে লোক।তার হাত থেকে পানি ও খসে পড়ে না।কিন্তু রহিমচানের তা জানা ছিল না তাই সে আশাবাদি হয়ে তার দোস্ত সলিমুদ্দি কে হাড়কিপটে কাবিল মিয়ার বাড়িতে নিয়ে এসেছে।
কাবিল মিয়া সাহায্যের কথা শুনে কিছুক্ষণ নিশ্চুপ হয়ে রইল।তারপরে পকেট থেকে দুই হাজার টাকা বের করে সলিমুদ্দির হাতে দিয়ে বলল, এই নাও এইটা নিয়া বিদায় হও আমি কোনো সহযোগিতার মাঝে নাই।কোথা থেকে তোমরা যে এসে হাজির হও।
রহিমচান কাবিল মিয়ার আচরণে খুবই কষ্ট পেল।সে বুঝেছিল তার বন্ধুকে সে কাবিল মিয়ার মাধ্যমে বড় ধরণের সাহায্য করবে কিন্তু তা আর হলো কই।সে নিশ্চুপ সলিমুদ্দির হাত ধরে কাবিল মিয়ার বাড়ি থেকে বাইরে বেড়িয়ে এলো।
সলিমুদ্দি আর রহিমচান হতাশ মনে আবার বাজারে ফিরে এলো।রহিমচানকে এবার সলিমুদ্দি বলল, দোস্ত আজকে আর কোনহানে যামু না।মাইনসের কাছে টাহা চাইলে হক্কলে রাগ করে।আজ বাড়ি চইলা যাই।কি কও।
যাও তয় কাবিল মিয়া দেয় নায় তয় কি হইছে।মন খারাপ কইর না।কাল তোমারে দোস্ত এমন এক লোকের কাছে লইয়া যামু যে তোমারে দুই লাখ টাহা একাই দিতে পারে। হের নাম ওসমান সওদাগর।সে বড় কারবার করে গঞ্জের বাজারে।আমাদের পাশের গ্রামের লোক।দোস্ত তুমি কাইল সকাল সকাল বাজারে চইলা আইস। আমিও্র চইলা আসমু। দুইজনে এক লগে হের কাছে যামুনে।দোস্ত সলিমুদ্দিকে আশার কথা শুনিয়ে আসতে বলল রহিমচান।
আইচ্ছা বলে সলিমুদ্দি বন্ধুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়িতে চলে এলো।
সে ভাবনায় অস্থির হয়ে উঠল।আসলে মানুষের কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে মেয়ের বিয়ে দেয়া খুবই কঠিন কাজ।কেউ কারো ব্যথা বুঝতে চায় না।সলিমুদ্দি বউরে তার কষ্টের কথা খুলে বলল আর আজকের সংগ্রহের টাকাগুলো বউয়ের হাতে দিয়ে লুকিয়ে রাখতে বলল।
সালেহা আড়াল থেকে বাবার কষ্টের কথাগুলো শুনল।বাবার জন্য খাবার নিয়ে এসে সে বলল, আব্বা ভাত খান তো।অত চিন্তা কইরেন না, আমার বিয়া লগব না।আপনে যদি টাহা জোগাড় করতে না পারেন তয় আমার বিয়া লাগব না।হের জন্য আপনে অত চিন্তা কইরেন না।নেন ভাত খান।
তুই তো বুঝবি না মাগো। দে আমারে খানা দে খাইয়া লই।মাইয়ার বিয়া দেয়া বাপের কাছে এক বড় কাজ।সলিমুদ্দি মেয়ের না বোঝার কথা বলল।
তুই যা তোরে এত কথা কইতে হইবে না।সালেহার মা তাকে চলে যাওয়ার জন্য বলল।
সালেহা মার কথা শুনে পাশের রুমে চলে গেল।
সলিমুদ্দি তার বউকে শাষণ করে বলল, দেখ মাইয়ার লগে এত কড়া কথা কইস না।মাইয়ায় তো দুই চার কথা কইতেই পারে।
হইছে হইছে অত কথায় কাম নাই।নিজে খাইয়া নেন।মাইয়ারে অত লাই দেওনের কাম নাই।দেহেন মাইয়াডারে কেমনে বিদায় করতে পারেন।সালেহার মা তার স্বামীকে উল্টা কড়া কথা শুনিয়ে দিল।
সলিমুদ্দি আর কোনো কথা বলল না। সারাদিনের ক্লান্তিতে সে দুর্বল হয়ে পড়েছিল। বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিতেই সে ঘুমিয়ে পরল।
পরদিন ভোরবেলা সবার আগে সলিমুদ্দি বাজারে এসে হাজির হলো।কিন্তু তারও আগে তার দোস্ত রহিমচান এসে তার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।তাকে দেখেই রহিমচান বলল, কিরে সলিমুদ্দি দেরি করলি কেন, আমাগো আইজকে অনেক দূর যাইতে হইবে।তোরে তো কইছি ওসমান সওদাগরের বাড়ি হেই পাশের গ্রামে। অনেক দূরের পথ রে ভাই।চল হাঁটা দেই।তা বাড়ি দিয়া খাইয়া আইছস তো?
হ পান্তা ভাত খাইয়া আইছি।তুই খাইছস। সলিমুদ্দি বলে উঠল।
হ খাইছি। ল তাইলে জোড়ে পা চালাই।রহিমচান বলল।
দুই বন্ধু মিলে ওসমান সওদাগরের বাড়ির পানে ছুটে চলল এক বুক আশা নিয়ে। তারা জানে যে সে একজন ধনী লোক।সুতরাং তারা আশাবাদী হতেই পারে। রহিমচান পথ চলতে চলতে সে কথাই বলতে ছিল সলিমুদ্দির কাছে।সলিমুদ্দি দোস্তের কথা শুনে মনে মনে খুশি হয়ে বলল, তা দোস্ত রহিমচান আমাগো হেয় টাহা দিবে তো?
আল্লাহ্ আল্লাহ্ কর।আমি তো হুনছি হেয় ধনী লোক।দেখ হেয় যদি কৃপণ না হয় তয় তোর মাইয়ার বিয়ার জন্য আর কারো কাছে হাত পাততে হইবে না।সে একাই সব টাহা দিয়া দেবে। চল এই গ্রামে তো আইসা গেছি অহন কারো কাছে জানতে চাই ওসমান সওদাগরের বাড়িটা কই।হাঁটতে হাঁটতে রহিমচান সলিমুদ্দিকে বলল।
হ দোস্ত তাই দেহ জিজ্ঞাস কইরা কই রইছে ওসমান সওদাগরের বাড়িটা? সলিমুদ্দি বলল।
এবারে আর কিছুটা পথ হেঁটে রাস্তার ওপরে কয়েকটা দোকান দেখতে পেল তারা।মনে হয় ছোট একটা বাজার হবে হয়ত।রহিমচান একজন দোকানদারকে জিজ্ঞেস করল, ভাই আমরা পাশের গ্রাম থেইকা আসছি ওসমান সওদাগরের বাড়িতে যামু।কইতে পারেন ওনার বাড়িটা কোন দিকে।
জবাবে দোকানদার বলল, হ কমু না কেন, ঐ তো আর একটু সামনে যাইয়া দুইটা বাড়ির পরই হের বাড়ি।
রহিমচান আর সলিমুদ্দি এবার কিছু পাওয়ার আশায় দ্রুত পা চালাল।পনের মিনিটের মধ্যেই তারা ওসমান সওদাগরের বাড়িতে পৌঁছে গেল।বড় বাড়ি দেখলে সহজেই বোঝা যায় সে একজন ধনী লোক।
কিছুক্ষণ বসে থাকার পর তারা ওসমান সওদাগরের দেখা পেল।
তাদের কথা শুনে ওসমান সওদাগর বলল, সবই তো শুনলাম, কিন্তু তোমরা যেমনটা আশা করে এসেছ তেমন দিন এখন আর আমার নেই।ছেলেরা আমার কারবার আর তেমন একটা উন্নতি করতে পারেনি।আমিও বৃদ্ধ হয়ে গেছি তাই আমার আর আগের দিন নেই।তবুও তোমরা যখন আশা করে এসেছ দেখি কিছু দিতে পারি কিনা।তোমরা বস আমি আসছি। এ কথা বলে ওসমান সওদাগর ভিতরে চলে গেল।
সে ভিতরে যেতেই সলিমুদ্দি বলে উঠল, নারে দোস্ত কপালখান খারাপই আমার। বুঝি আর সালেহার বিয়াটা হইল না।
অত উতলা হইও না, চুপ কইরা বইস দেখি।সলিমুদ্দির অস্থিরতা দেখে রহিমচান বলল।
দশ মিনিট পরে ওসমান সওদাগর বাইরে এসে রহিমচানের হাতে একটা দশ হাজার টাকার বান্ডিল দিয়ে বলল, শোনো মিয়া এই দিতে পারলাম এইটা নিয়া খুশি থেক। আমার আগের দিন থাকলে তোমাদের মেয়ের বিয়ের সব টাকাই আমি দিতে পারতাম।
রহিমচান ওসমান সওদাগরকে অনেক ধন্যবাদ দিয়ে আবার তার বন্ধু সলিমুদ্দিকে নিয়ে নিজেদের গ্রামের পানে পা বাড়াল।তারা অনেকটা আশাহত হলো, কিন্তু কি করা যাবে লোকটা তো তার বর্তমান অবস্থার কথা তুলে ধরেছে।
হাঁটতে হাঁটতে সলিমুদ্দি বলল, দোস্ত এহন কি করবি, আমি তো আর কিছু চিন্তাই করতে পারতেছি না।কেমনে কইরা কি করমু।
এত ভাবিস না।ল আগে বাড়িতে যাই।আর কয়দিন তো আছে, আমরা রোজই কারো না কারো কাছে সাহায্যের জন্য যামু।চল এবার জোড়ে পা চালা। সলিমুদ্দিকে রহিমচান সান্ত্বনা দিয়ে বলল।
সপ্তাহ পার হয়ে গেল।রোজ মানুষের কাছে হাত পেতে সলিমুদ্দি পঞ্চাশ হাজার টাকা পর্যন্ত জোগাড় করতে পেরেছে।সে চেষ্টা করেছে অফুরন্ত।কিন্তু মানুষ সহজেই দিতে চায় না।বিশ্বাস করতে চায় না মানুষের কথা, তাই সে এর বেশি টাকা জোগাড় করতে পারল না।
তার বউ তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, গণি আসুক পোলার বাপ মারে নিয়া তাইলে আমরা পোলার বাপেরে বুঝাইয়া কমু এহন এই টাহা ডা নিয়া বিয়াডা দিয়া দিক।হেরপর আস্তে আস্তে হেগ সব টাহা আমরা শোধ কইরা দিমু।
হে কথা কি হেরা হুনবে।সলিমুদ্দি বলে উঠল।
হ হুনবে হেগ পা ধইরা কমু লাগলে।মাইয়াডার বিয়া এহন দেওয়াই লাগে।সলিমুদ্দির বউ বলল।
বাবা মায়ের কথা পাশের রুম থেকে সালেহা শুনল।সে জোড়ে বলে উঠল, হ তোমরা পাগল হইছ বুঝছি, এত ছোট হইয়া আমার বিয়া লাগব না।এমন বিয়ার চাইতে গাঙ্গে ডুইবা মরমু আমি দেইখো।
তুই চুপ কর পোড়া মুখি। সালেহার মা তাকে থামতে বলল।
আর কেউ কোনো কথা বলল না।সলিমুদ্দি নিশ্চুপ হয়ে ভাবতে লাগল।সালেহা মার কথা শুনে বিছানায় মুখ লুকিয়ে একা একা নীরবে কাঁদতে লাগল। আর তার মাও একই ভাবে পাশের রুমে বসে কাঁদল অঝোর ধারায়।সলিমুদ্দি নীরবে সবার কান্না উপলব্ধি করতে লাগল কিন্তু তার কোনো সান্ত্বনার বানী জানা ছিল না।সে নিশ্চুপ ই রইল।
পরদিন বিকেলবেলা ছেলের বাবা মাকে নিয়ে গণি হাজির হলো সালেহাদের বাড়িতে।
সালেহার বাবা মা তাদের খুব খাতির যত্ন করল।তারা খাতির যত্ন পেয়ে বেশ খুশি হলো।তারা হাসি মুখে নানা ধরণের আলাপ আলোচনা করতে লাগল।কথার এক পর্যায়ে ছেলের বাবা বলল, তয় গণি হোন একটা কখা কই। মাইয়া আমাগো পছন্দ হইছে।আর সলিমুদ্দি ভাই ও দেখতাছি খুব ভালা লোক। সবই ঠিক আছে বেলা তো পইরা আইল এহন তাইলে কাজের কথায় যাই।
হ কন।গণি বলল।
না কইছিলাম কি ঐ টাহা ডা লইয়া আমরা এহন যাইতে চাই।ছেলের বাবা বলল।
গণি কিছুক্ষণ চুপ করে রইল।তারপরে বলল, না ভাই সাইব একটু সমস্যা হইছে যে সলিমুদ্দি ভাই এহন সব টাহা জোগাড় করতে পারে নাই।তাই আপনারে অনুরোধ করছে যে এহন যা জোগাড় হইছে তা নিয়া যান আর বিয়াডা সাইরা ফেলেন।বাকি টাহা তারা আস্তে আস্তে শোধ কইরা দেবে।
গণির কথা শুনে ছেলের বাবা মা উঠে পরল। আর ছেলের বাবা বলল, হেয়া হইবে না।আমার এহন টাহা দরকার পরে দিলে কাজ হইবে না। এই লও আমরা চললাম।
গণি অনুরোধ করে বলল, আমি আরো দশ হাজার বাড়ি গিয়া দিয়া আমু আপনের হাতে ।এহন পঞ্চাশ হাজার আছে এইঠা নিয়া যান আর বিয়ার তারিখ ঠিক কইরা যান।
সলিমুদ্দি ছেলের বাবার হাত ধরে অনুরোধ করল।তার বউও তাই করল, কিন্তু ছেলের বাবা মায়ের মন নরম হলো না।তারা শেষে চলে যেতে যেতে বলল, আর দুই দিনের মাঝে টাহা দিতে পারলে এই বিয়া হইব।আর নাইলে হইব না।
সলিমুদ্দি আর তার বউ মনে খুব কষ্ট পেল।তারা অনেক আশা করেছিল যে এবার মেয়েটার বিয়ে হয়ে যাবে।কিন্তু তা আর হলো না।সালেহা বাবা মায়ের এত কষ্ট দেখে নিজের রুমে নিশ্চুপে বসে কাঁদতে লাগল।গণি দুলা ভাই আর বোনকে নতুন সমন্ধ এনে দেবে এমন সান্ত্বনা দিয়ে নিজের বাড়ির পানে পা বাড়াল।
চারিদিকে অন্ধকার নেমে এসেছে।প্রকৃতির বুকে রাতের আঁধার ঘিরে ধরেছে।আর অন্ধকারে ভরে গেছে সলিমুদ্দির ঘরটা।ঘরের মধ্যে তিনটি মানুষ। আর তাদের আঁখিযুগল এখন জল ঝরাতে ব্যস্ত।কেউ কারো দিকে ফিরে দেখছে না।শুধু নীরবে যে যার কষ্টকে আঁখিজলের সাথে ঝরিয়ে দিচ্ছে।
সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে প্রতিদিনের মতো সালেহার মা তাকে ডেকে তোলে সবার আগে।আজও তেমনি সালেহাকে কয়েকবার ডাকল সে।কিন্তু কোনো সাড়া পেল না।কি হয়েছে তোর পোড়া মুখি বলতে বলতে সে সালেহার রুমের দরজা খুলে দেখল সালেহা ঘরে নাই।হয়তো বাথরুমে গেছে ভেবে সে তাদের ঘর থেকে একটু দূরে বাথরুমে ছুটে গেল।সেখানে ও সালেহা নাই।কোথায় গেল মেয়েটা।সে এবার সালেহার বাবাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বলল, সালেহারে তো ঘরে দেহি না, কই গেল মাইয়াডা কও দেহি।
কই আর যাইব ওর বান্ধবি লতার কাছে গেছে বুঝি। যাও লতাগো বাড়িতে যাইয়া একটু খুঁইজা আও।ঘুম চোখে সলিমুদ্দি বলল।
না না আমার কেমন জানি লাগতাছে, মাইয়া তো এত আগে ঘুম দিয়া ওঠে না তয় লতাগো বাড়ি যাইব কেমনে।তুমি উঠইা দেহ। আমি লতাগো বাড়ি গেলাম। সলিমুদ্দির বউ এতটুকু বলে দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
দশ মিনিট পরে সলিমুদ্দির বউ কান্না করতে করতে দৌঁড়ে এসে সলিমুদ্দিকে বলল, এই কই গেলা মাইয়া তো লতাগো বাড়িও যায় নাই, তাড়াতাড়ি বাইর হও, খুঁইজা দেহ মাইয়া কই গেল।
সলিমুদ্দি ঘর থেকে বের হয়ে বলল, কি কও, মাইয়া কই যাইব।আমি অহন ই খুঁজতে যাইতেছি।
এমন সময় বাড়ির উল্টা দিক থেকে লোকজনের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল। সলিমুদ্দি সেদিকে দৌঁড় লাগাল আর দেখল রহিমচান লোকজন নিয়া তার বাড়ির দিকে আসছে।
সলিমুদ্দি দৌঁড়ে তাদের কাছে গেল আর তার বউও পিছু পিছু আসল।রহিমচান সলিমুদ্দিকে বলল, দোস্তরে কি হইছিল সালেহার লগে।আমগো মাইয়া তো আর নাইরে। গাঙ্গে তার লাশ ভাইসা উঠছে। তাড়াতাড়ি গাঙ্গ পাড় চল।
রহিমচানের কথা শুনে সলিমুদ্দির হাত পা ছেড়ে দিল যেন। তার বউ অজ্ঞান হয়ে পরল।তাকে কিছু মেয়ে ধরে বাড়িতে নিয়ে গেল। আর সলিমুদ্দি রহিমচানের হাত ধরে ও মা সালেহা, মাগোরে বলতে বলতে চিৎকার করে নদীর পাড়ের দিকে ছুটল।
সলিমুদ্দির আর মেয়ের বিয়ে দেয়া হলো না।
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
একটি বিবাহ সংক্রান্ত বিরহের গল্প।
২২ জানুয়ারী - ২০১৭
গল্প/কবিতা:
১১৬ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪