নদীর পাড়ে বসে মিনার বন্ধুদের সাথে আলাপ আলোচনা করছিল। দেশের বুকে যুদ্ধের দামামা চলছে। তারা কয়েকজন বন্ধু মিলে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল। মিনারের সিদ্ধান্ত সবাই সবসময় মেনে নেয়।তাই বন্ধুদের কে সে সবসময় প্রভাবিত করতে পারে। তারা চার জন বন্ধু মিলে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিল আর এমন সময় তাদের আর একজন বন্ধু মেহেদী দৌঁড়ে এসে মিনার কে উদ্দেশ্য করে বলল, এই মিনার শুনছিস যুদ্ধ ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে।
কি বলছিস। আমাদের গ্রাম তো শহরের খুব কাছাকাছি তাহলে পাক সেনারা তো খুব দ্রুত আমাদের গ্রামে চলে আসবে।আমাদেরকে তো তাহলে ওদেরকে প্রতিরোধের ব্যধবস্থা নিতে হয়। মিনার সংশয় প্রকাশ করে বলল।
সেটা বলার জন্যপই তো দৌঁড়ে আসছি।তুই জানিস না দোস্ত তোর বাবা কাদের খান পাক সেনাদের খবর দিয়ে দিয়েছে।সে তাদেরকে এখানে চলে আসার জন্যপ লোক পাঠিয়ে দিয়েছে।এখানে তাদেরকে সব ধরনের সহযোগিতা করার জন্য তোর বাবা প্রস্তুত রয়েছে।এতটুকু বলে মেহেদী চুপ করল।
কি বলছিস ? মিনার বিস্মিত হয়ে বলে উঠল।
মিনারের কথার জবাবে মেহেদী বলল,ঠিকই বলছি। শোন মিনার তোর বাবা আমাদের গ্রামের রাজাকার বাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছে।সে আমাদের গ্রামের সব হিন্দুদের নিধনের দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে আর যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করবে তাদেরকেও ধ্বংস করে দেবে এমন সিদ্ধান্তই নিয়েছে।মসজিদের ইমাম মতিউর চাচা তোর বাবাকে খুব করে নিষেধ করেছিলমানুষের ক্ষতি যেন সে না করে কিন্তু কে কার কথা শোনে।
মেহেদীর কথা শুনে মিনার বলল,তাহলে তো বাবাকে আগে থামাতে হবে।সে এতবড় জঘন্যি কাজ করতে পারে না কিছুতেই।আমি সেটা হতে দেব না।
তোর বাবা সে কথা কিছুতেই শুনবে না মিনার।মতিউর চাচা সে কথাও বলেছিল যে আপনার ছেলে শিক্ষিত সে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে তার দিকে চেয়েও তো আপনি এমন খারাপ কাজে যোগ দিতে পারেন না।কিন্তু তার জবাবে তোর বাাবা বলেছে, ছেলে বউ আমি কাউকেই ছেড়ে দেব না যদি তারা কেউ আমার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়।মেহেদী বলল।
এবার মিনার বলল,আচ্ছা ঠিক আছে আমি বাবার বিষয়টা দেখছি। শোন মেহেদী আমরা সবাই যুদ্ধে যাচ্ছি রাতে আমাদের এলাকার কমান্ডার এই নদীর পাড়ে আসবে তুইও থাকবি ঠিক আছে । আমাদের কে সে অস্ত্র বুঝিয়ে দেবে আর কার অধীনে আমরা যুদ্ধ করবে সেটাও বলে দেবে।আমরা তারপরে যুদ্ধের ট্রেনিং নিয়ে আমাদের গ্রামসহ আশেপাশের সব গ্রামের প্রতিরক্ষায় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে অংশগ্রহন করবো ঠিক আছে।
আচ্ছা ঠিক আছে। তুই তাহলে বাড়ীতে গিয়ে তোর বাবাকে বুঝিয়ে বল। কারণ সে যদি আমাদের বিপক্ষে থাকে তাহলে এ এলাকার প্রতিরক্ষা করা আমাদের পক্ষে কঠিন হয়ে যাবে।কারণ তোর বাবা এলাকার সবচেয়ে প্রভাবশালী লোক।মেহেদী তার বন্ধু মিনারকে বলল।
মেহেদীর কথার জবাবে মিনার বলল,আচ্ছা বাবার বিষয়টা তো আমি দেখছি।দেখি তাকে না থামাতে পারলে আমরা সবাই মিলে যদি প্রতিরোধ করি তাহলে রাজাকার ,পাক সেনারা কেউই আমাদের সঙ্গে টিকতে পারবে না।বাবার বিরুদ্ধে আমি কঠোর প্রতিরোধ গড়ে তুলব।তোরা সবাই রাতে চুপিসারে এখানে চলে আসিস।আমি কমান্ডারের সঙ্গে সব আলোচনা করে এসেছি। আমরা আজ রাত থেকেই কিন্তু ঘর ছেড়ে যুদ্ধের প্রয়োজনে যেখানে যেতে হয় সেখানে যাব।কি সবাই তৈরি তো?
মিনারের কথা শুনে সবাই বলে উঠল,আমরা সবাই তৈরি।আমরা দেশের জন্যর জীবন দিতে প্রস্তুত।আমরা স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্ত আকাশ দেখতে চাই।আমরা স্বাধীনতা চাই যেকোনো দামে।
সবার কথা শুনে মিনার খুব খুশি হলো।সে সবাই কে উদ্দেশ্যর করে বলল,ঠিক আছে এখন চললাম।রাতে সবার সঙ্গে দেখা হবে।
মিনার বিশ্ববিদ্যােলয়ে লেখাপড়া করছে।দেশে যুদ্ধের দামামা বাজতেই সে গ্রামে চলে এসেছিল।দেশের অবস্থা কোনদিকে মোড় নেয় সেটা দেখার জন্যম।অবশেষে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল।আর তারা পাচ বন্ধু মিলে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করার প্রতিজ্ঞা করে নিল।যেকোনো দামে তারা তাদের গ্রাম সহ দেশের প্রতিটি অঞ্চল প্রতিরক্ষা করার প্রতিজ্ঞা করে নিল।
মিনারের সামনে প্রথমেই সবচেয়ে বড় বাঁধা এসে দাঁড়াল তার বাবা কাদের খান।সে এলাকার সবচেয়ে ধনী আর প্রভাবশালী লোক।যুদ্ধে বিজয়ী হতে হলে মিনারকে তাই তার বাবাকেই নিবৃত্ত করতে হবে সবার আগে। আর সেটাই করলো সে।বাড়ীতে ফিরে মিনার তার বাবাকে বলল,বাবা আমরা সবাই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করছি পাকিস্তানিদের এ দেশ থেকে তাড়াবার জন্যই । আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ গড়তে চাই। আর আমি শুনলাম তুমি নাকি সবার বিরুদ্ধে গিয়ে পাকিস্তানিদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে এ এলাকার রাজাকার বাহিনীর প্রধান হয়েছ।আমি এ পথ থেকে তোমাকে ফিরে আসার জন্যব অনুরোধ করছি।দয়া করে তুমি নিজেদের লোকের ক্ষতি করতে এগিয়ে এসো না।
মিনারের কথা শুনে তার বাবা চরম রেগে গেল। সে চিৎকার করে বলল,দু’কলম লেখাপড়া শিখে তুমি পন্ডিত হয়ে গেছ,দেশ তো স্বাধীন ই আছে আবার স্বাধীন করবা কি। কিছু বিপথগামী লোকের কথায় দেশে যুদ্ধ শুরু হয়েছে সবগুলো অল্পতেই মরে যাবে।দেখবা কয়েকদিনের মধ্যোই সবকিছু শান্ত হয়ে যাবে।
বাবার কথা শুনে মিনার বলল,বাবা তোমাকে অনুরোধ করে বলি তুমি রাজাকার বাহিনী ছেড়ে দাও আর কিছু না করতে পারলে চুপচাপ বসে থাক।তুমি সবকিছু বুঝতে পারছ না।দেশ স্বাধীন হয়ে যাবে ইনশ্আল্লাহ্ । আর আমার কথা না শুনলে তোমরা কিন্তু স্বাধীন দেশে তখন চরম অপমানের স্বীকার হবে।
মিনারের কথা শুনে এবার উত্তেজিত হয়ে উঠল কাদের খান। সে তার ছেলে মিনারকে বলল,ভদ্রতা বজায় রেখে কথা বলো মিনার তোমার কোনো যুদ্ধে যাওয়া হবে না আর আমিও আমার পথ থেকে ফিরে আসবো না আর যদি তুমি আমার কথা না শোনো তাহলে চিরদিনের জন্যয তোমার মায়ের মতো আমি তোমাকে ও ত্যা জ্যম ঘোষনা করবো।
বাবার কথা শুনে মিনার অনেক কষ্ট পেল।সে তার বাবাকে এবার বলল,বাবা তাহলে তুমি আমার কথা শুনবা না। রাজাকার হিসেবে তুমি বাংলাদেশের বিপক্ষে কাজ করবা।
কাদের খান বলল,কিসের বাংলাদেশ। পাকিস্তান আমাদের দেশ। তুমি আর আমাকে বোঝাতে আসবা না ।আমি তোমার কোনো কথা শুনবো না। তুমিও যদি তোমার মায়ের পথে চলো তবে আমার সঙ্গ ছাড়তে পারো। আমি পাকিস্তান ছাড়তে পারবো না। তোমরা আমার বাড়ী থেকে বের হয়ে গিয়ে বাংলাদেশ গড়ার মিছে স্বপ্ন দেখ।
বাবার কথার জবাবে মিনার বলল,ও তাহলে মায়ের সঙ্গেও তুমি খারাপ আচরণ করেছ।বাবা তোমার কিন্তু শান্তি হবে না এর ফল তুমি কঠিন ভাবে ভোগ করবা।
হয়েছে হয়েছে এবার তুমি আসতে পারো।তবে তোমাদের ভুল কয়েকদিনের মধ্যেেই ভেঙ্গে যাবে তখন না হয় তোমার মাকে নিয়ে আবার ফিরে এসো।কাদের খান কঠোরভাবে বলল।
মিনারের মা এতক্ষণ সব কথা নিরবে শুনছিল।সে তার স্বামীকে আগেই এলাকার রাজাকার বাহিনীর দায়িত্ব নিতে নিষেধ করেছিল।কিন্তু কাদের খান কারো কথা শুনতে রাজি নয়।
এবার মিনারকে তার মা বলল,চল বাবা আমাকে নিয়ে আর কোথাও রেখে আয় আর তুই মুক্তিযুদ্ধে চলে যা।আমি আর এই রাজাকার কাদের খানের সঙ্গে থাকতে চাই না।
মিনার মায়ের কথা শুনল । সে আর তার বাবাকে কিছু বলল না।স্বাধীনতা পেতে সে প্রথমেই তার বাবাকে ছাড়ল।এবার মাকে নিয়ে সে ঘর ছেড়ে বাইরে বেড়িয়ে আসল।
তার মা তাকে বলল,মিনার বাবা তোর তো রাতেই যুদ্ধে যেতে হবে।তাই বেশি দূরে তো আর যেতে পারবি না,তাহলে বলতাম তোর মামার বাসায় আমাকে দিয়ে আয়,এখন আমাকে কোথায় রাখতে চাচ্ছিস?
মিনার বলল,তুমি চিন্তা করো না মা।তোমাকে মতিউর চাচাদের বাড়ীতে রেখে যাবো।সেখানে তুলি তোমাকে দেখে রাখবে।
মিনার তার মাকে সঙ্গে নিয়ে তুলিদের বাসায় এসে হাজির হলো।তুলিদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক খুব গভীর।তুলির মা হচ্ছে মিনারের মার বান্ধবী। আর তুলির বাবা মতিউর চাচা মিনারকে খুব ভালোবাসে।সে মসজিদের ইমাম তাকে সবাই সন্মান করে।মিনারের সঙ্গে তুলির সম্পর্ক রয়েছে অনেকদিন আগে থেকেই।দুইজনের বিয়েও ঠিক করে রেখেছিল মিনারের মা,কিন্তু মিনারের বাবার আপত্তির কারণে তা এখনও বাস্তবায়ন হয়ে ওঠেনি।
মিনার তুলিদের বাসায় তার মাকে রেখে দিয়ে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিল।কেননা ততক্ষণে চারিদিকে আঁধার নেমে এসেছে।আর মিনারকে তাড়াতাড়ি নদীর পাড়ে গিয়ে আর সব যোদ্ধার সঙ্গে মিলতে হবে।তাকে দেরী করলে হবে না।কারণ অত্র এলাকার নেতৃত্ব তাকেই গ্রহণ করতে হবে।
ঘর থেকে বের হতে তার পথ আটকাল তুলি।মিনারকে সে বলল,আমার জন্যর কি বলে গেলে,তুমি তো যুদ্ধে চলে যাচ্ছ আমরা কি করবো।আমি কি তোমাকে ভালোবাসি না তাহলে আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছ না কেন? আমি তোমাকে ছেড়ে কিভাবে থাকব?
তুলির কথার জবাবে মিনার বলল,দেখ তুলি দেশের প্রশ্নে কোন আপোস নয়।আমি তোমাকে ভালোবাসি,কিন্তু দেশ আমার কাছে তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ।সুতরাং তোমাকে সবুর করতে হবে,আমার জন্যত অপেক্ষা করবে যতদিনে দেশ স্বাধীন না হয় ততদিনে হয়তো তোমার সঙ্গে দেখা হবে না।যদি বেঁচে থাকি তবে আমাদের আবার দেখা হবে আর না হলে হবে না।
এভাবে বলছ কেন?আল্লাহ্ র রহমতে তোমার কিছু হবে না।তুমি ফিরে আসবে আর আমাদের আবার দেখা হবে।আমাদের ভালোবাসা আবার পূর্ণতা ফিরে পাবে।মিনারের কথা শুনে তুলি বলে উঠল।
ঠিক আছে আল্লাহ্ ভরসা আমি চললাম।আমার জন্যব আর সবাই অপেক্ষা করছে।তুমি ভয় পেয় না,আমরা যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করে ছাড়ব ইনশ্আল্লাহ্ ।আর তখন স্বাধীন দেশে আমাদের বিয়ে হবে,আমি চললাম।মিনার আবার তুলির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বলল।
যাচ্ছ যাও আর বাঁধা দেব না।দেশের কাজে আমি বাঁধা হয়ে দাঁড়াব কেন,তবে আমাদের ভাগ্যেব কি ঘটে তাও বা কে জানে।আমাদের খোঁজ রেখ।তুলি কাঁদতে কাঁদতে বলল।
তুলির কান্না দেখে মিনারের চোখও ছলছল করে উঠল।সে কান্না লুকাতে দ্রুত তুলির সামনে থেকে চলে এলো।শুধু বলল,চললাম তুলি তুমি ভালো থেক।
মিনার যুদ্ধে অংশগ্রহন করলো।সে আর তার বন্ধুরা আর সব যোদ্ধার সঙ্গে নিজেদের গ্রামসহ আশেপাশের সব এলাকার দায়িত্ব নিয়ে নিল। যুদ্ধ পুরোদমে চলতে লাগল।কমান্ডারের নির্দেশে মিনার সম্মুখ সমরে অংশগ্রহণ করে বেশ সফলতা অর্জন করে সুনাম কুড়াল। এইভাবে চারমাস কেটে গেল। মিনার আর বাড়ীতে ফিরে যায়নি।তবে সে নিজ গ্রামের খবর নিয়মিত নিতে লাগল।
একদিন গ্রাম থেকে তার বন্ধু আর সহযোদ্ধা মেহেদী খবর নিয়ে এলো তাদের গ্রামে পাকিস্তানিরা বেশ নির্যাতন শুরু করে দিয়েছে।আরও কিছু খবর এনেছে যা খুবই নিদারুণ।
মিনার মেহেদীর কাছে জানতে চাইল,কি নিদারুণ খবর এনেছিস ভাই আমাকে সবকিছু খুলে বল।
মিনারের কথা শুনে এবার মেহেদী সবকিছু খুলে বলল।সে বলল, আমাদের গ্রামের অবস্থা খুবই করুণ।প্রায় প্রতিটি বাড়ীই পাকিস্তানি রা রাজাকারদের সঙ্গে নিয়ে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে।আর অনেককেই মেরে ফেলেছে ,প্রতি বাড়ীর যুবতি মেয়েদের ধরে নিয়ে গেছে তোদের বাড়ীর কাছাড়ি ঘরে নিয়ে তাদেরকে আটকে রেখেছে।তোর বাবা এসব কাজের নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছে পাকিস্তানিদের সঙ্গে নিয়ে।
মেহেদীর কথা শুনে মিনার খুব কষ্ট পেল।সে এবার জানতে চাইল তার মা আর তুলিদের কপালে কি ঘটেছে সে বিষয়ে।
মিনারের কথা শুনে মেহেদী দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।একটু চুপ থেকে সে বলল, কেউ বেঁচে নেই শুধু তুলি রয়েছে।আর সবাই আগুনে পুড়ে মরে গেছে,তোর বাবা জানতো না যে তোর মা মতিউর চাচাদের বাড়ীতে রয়েছে। তাহলে হযতো বাঁধা দিত তুলিদের বাড়ীতে আগুন দিতে।কিন্তু সে বুঝতে পারেনি,শুনলাম পরে যখন শুনেছে তখন যে রাজাকার ঐ বাড়ীতে আগুন দিয়েছে তার হাত কেটে দিয়েছে সে কিন্তু তাতে কি হবে সাড়া গ্রামে তোর বাবাই বেশি নির্যাতন চালিয়েছে।মানুষের সম্পদ লুটে নিয়েছে আর সব অল্প বয়েসি মেয়েদের পাকিস্তানিদের হাতে তুলে দিয়েছে।তোদের কাছাড়ি ঘরটাই এখন পাকিস্তানিদের ক্যা ম্প। আমাদের গ্রাম এখন পাকিস্তানিদের আর রাজাকারদের দখলে চলে গেছে।
মিনার মনে মনে অনেক কষ্ট পেল তার মা আর বেঁচে নেই।আর তার মৃতু্যর কারণ তার বাবা ই। এ কষ্ট মিনার কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না।সে খুব বিষণ্ণ হয়ে উঠল। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে মিনার এবার মেহেদীর কাছে জানতে চাইল,তুলি এখন কোথায়?
পাকিস্তানিদের ক্যা ম্পে রয়েছে।সেখানে অনেক মেয়ে আটকা রয়েছে।তোর বাবা পাকিস্তানিদের সঙ্গে নিয়ে আটকে রেখেছে মেয়েগুলোকে।আর সেখানে তুলিও রয়েছে।মাঝে মাঝে পাকিস্তানিরা বিভিন্ন মেয়েকে ধরে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করে। মেহেদী বলল।
মেহেদীর কথা শুনে মিনার তার চোখ মুছল।তারপরে বলল,কমান্ডারের সঙ্গে কথা বলতে হবে তার অনুমতি নিয়ে আজকে রাতেই আমরা আমাদের গ্রামের দিকে রওনা হবো।আগে আমাদের গ্রামকে রাজাকার আর পাকিস্তানি মুক্ত করতে হবে তারপরে আবার আর কোনো দিকে আমরা যুদ্ধ করতে যাব।
মিনারের কথা অনুযায়ি ই কাজ করলো মেহেদী। সে কমান্ডারের সঙ্গে কথা বলে পুরো দশ জনের একটি মুক্তিযোদ্ধার দল নিয়ে নিল। রাতেই তারা নিজেদের গ্রাম মুক্ত করার জন্য রওনা হয়ে গেল। খুব সাবধানে তারা গ্রামের পর গ্রাম পাড়ি দিতে লাগল।কেউ যেন তাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সন্দেহ না করে সেদিকে তারা সবসময় সজাগ দৃষ্টি রাখল।পথের মাঝে যেন কোনো ঝামেলা না হয় আর কোনো মুক্তিযোদ্ধাকে হারাতে না হয় সে কারণে মিনার আর মেহেদী সবসময় সাবধানতা অবল্বমন করতে লাগল।
দুইদিন একাধারে মাঠ ঘাট প্রান্তর পেরিয়ে মুক্তিবাহিনীর দল মিনারের গ্রামে এসে পৌঁছাল।তাদের মিশন এই গ্রাম মুক্ত করা ।এই গ্রামের সকল রাজাকার আর পাকিস্তানিদের নিধন করাই তাদের প্রধান মিশন।রাতের আঁধারে মিনার বাহিনী গ্রামের নদীর পাড়ে এসে হাজির হয়েছে।তারা সিদ্ধান্ত নিলো ভোররাতে পাকিস্তানিদের ওপরে ঝাপিয়ে পড়বে তারা। এটাই তাদের ধ্বংস করার সঠিক সময়।
মিনার বাহিনী ভোর রাতের সিদ্ধান্ত নিয়ে সবাই নদীর পাড়ে অবস্থান নিয়ে নিল।তারা ভোর রাতের অপেক্ষা করতে লাগল।সঙ্গে নিয়ে আসা খুব সামান্যো খাবার তারা নিজেদের মাঝে ভাগ করে খেয়ে নিল।একটু বিশ্রাম নেয়ার জন্য সবাই শরীরটা মাটির ওপরে বিছিয়ে দিল।কেউ কেউ ঘুমিয়ে পরলো কিন্তু মিনার আর মেহেদীর চোখ ঘুম স্পর্শ করলো না। কারণ এই যুদ্ধে তাদের পরিবারের সবাই হারিয়ে গেছে আর যাদের কারণে তাদের এই নিঃস্ব হওয়া তাদের নিধন না করা পর্যন্ত তাদের চোখে আর ঘুম আসবে না।
কোথাও মসজিদে ফজরের আযান শুনে চমকে উঠল মিনার । ভোর হয়ে গেছে প্রায় আর বসে থাকার উপায় নেই।মিনার খুব দ্রুত সবাইকে ডেকে তুলল। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে মিনার তাদের বাড়ীর পানে দ্রুত গতিতে ছুটে চলল।
দশ মিনিট হেঁটেই মিনার বাহিনী নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে গেল।তারা আর দেরী করলো না সরাসরি আক্রমন করলো পাকিস্তানি বাহিনীর ওপরে।পাকিস্তানি বাহিনী প্রস্তুত ছিল না,রাজাকার বাহিনীও সংঘটিত ছিল না তাই তারা কিছু বুঝে উঠতে পারলো না।তারা মিনার বাহিনীর আক্রমনকে সামলাতে পারলো না।
প্রায় আড়াই ঘন্টা অবিরাম যুদ্ধের পরে পাকিস্তান আর রাজাকার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পরাজিত হলো।কোনো পাকিস্তানি সেনা জীবিত রইল না। কিন্তু রাজাকার বাহিনী সংঘটিত না থাকার কারণে অনেকেই বেঁচে গেল।
রাজাকার কাদের খানকে মেহেদী বন্দি করে রেখে দিল । তার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারল না মেহেদী।আর মুক্তিযোদ্ধারা তাকে গুলি করে শেষ করে দিতে চেয়েছিল কিন্তু মেহেদী তাদেরকে বাঁধা দিল।কারণ কাদের খানের বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবে মিনার।সুতরাং তাকে আপাততঃ জীবিত রাখলো সবাই।
ততক্ষণে ভোরের আলো ফুটে গেছে। চারিদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয়ী হওয়ার খবর ছড়িয়ে পরেছে।এই গ্রামে আর কোনো পাকিস্তানি জীবিত নেই সে বিষয়ে নিশ্চিত হলো মিনার বাহিনী। এবার মিনার তাদের কাছাড়ি ঘরের দিকে দ্রুত ছুটল,গোলাগুলিতে কোথায় কার কি অবস্থা কেউ তা জানে না।মিনারদের কাছাড়ি ঘর থেকে বিভিন্ন মেয়েরা বের হয়ে যেতে লাগল।মিনার মনে মনে তুলিকে খুঁজতে লাগল।কিন্তু সময় মিনারের পক্ষে ছিল না।সবাই বের হয়ে গেল তুলিকে সে বের হতে দেখল না।
ঘরের ভিতরে প্রবেশ করে মিনার দেখল তুলি গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পরে আছে বেঁচে থাকার আর আশা নেই।মিনারকে দেখে খুব কষ্ট করে তুলি বলল, অবশেষে তুমি এলে। কাল রাতে বেশ নির্যাতন করেছে ওরা আমাকে । আমি আর সহ্যআ করতে পারিনা। তাই আল্লাহ্ হয়তো আমাকে মুক্তি দিয়ে দিয়েছেন।ঘুমিয়ে ছিলাম হঠাৎ গোলাগুলির শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল।দেখি এক পাকিস্তানি আমাদের ওপরে নির্বিচারে গুলি চালাচ্ছে।একটা গুলি এসে আমার বুকে লাগল।আর ততক্ষণে এক মুক্তিযোদ্ধার গুলি লেগে পাকিস্তানি মাটিতে লুটিয়ে পরে মারা গেল।আমি হয়তো বেঁচে ছিলাম তোমার সঙ্গে দেখা হবে সেই কারণে। এতটুকু বলে তুলি আর কিছু বলতে পারল না।সে নিশ্চুপ হয়ে গেল।
মিনার তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, এভাবে চলে যেও না তুলি আমি তোমাকে কতো ভালোবাসি তাতো জানলে না।তুলি চলে যেও না।
মিনারের কথা শুনে হাসি মুখে তুলি বলল, আমিও তোমাকে অনেক ভালোবাসি।চললাম।এতটুকু বলে এবার তুলি নিথর হয়ে গেল।
মিনার চিৎকার করে বলল, না তুলি তুমি এভাবে চলে যেতে পারো না।
মিনারের চিৎকার শুনে মেহেদী দৌঁড়ে তার কাছে ছুটে এল।তুলির মৃতদেহ দেখে সেও তুলি বলে কেঁদে উঠল।পরক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়ে মেহেদী মিনারকে সান্ত্বনা দিল।সে বলল,মিনার ভেঙ্গে পরলে চলবে না দোস্ত তোর মতো কতো তুলিদেরকে হারিয়ে ফেলছে রোজ রোজ কতোজন।চোখ মুছে ওঠ দোস্ত।এখনো দেশ স্বাধীন হয়নি।আমাদের অনেক কাজ বাকি রয়েছে।
মেহেদীর কথা শুনে মিনার নিশ্চুপ হলো।সে উঠে দাঁড়িয়ে মেহেদীকে বলল,দোস্ত আমি সবকিছু হারালাম।তুলির লাশ দাফন করার ব্যেবস্থা কর।তারপরে আমরা এই গ্রাম ছেড়ে আর কোথাও যুদ্ধে গিয়ে অংশগ্রহন করবো।
আচ্ছা আমি সবকিছু করছি।কিন্তু আর একটি কাজ তো বাকি আছে দোস্ত,সে বিষয়ে কি সিদ্ধান্ত নিবি।মেহেদী বলল।
কোন বিষয়ে? মিনার জানতে চাইল।
রাজাকার কাদের খান আমাদের হাতে বন্ধি।তার বিষয়ে তোর কি সিদ্ধান্ত।কি করবো তাকে নিয়ে? মেহেদী জানতে চাইল।
একটু ভাবলো মিনার। তারপরে বলল, স্বাধীনতা পাবার জন্য। আমি আমার মাকে হারিয়েছি, আমার তুলিকে হারিয়েছে।একজন রাজাকারকে হারালে আমার কষ্ট হবার কথা নয়।তবু আমার চোখের জল ঝরবে। সুতরাং আর সব রাজাকারকে ধরে তোরা যা করেছিস রাজাকার কাদের খানের বেলায়ও সেটাই করতে হবে।
মিনারের কথা শুনে মেহেদী বলল, বুঝে বলছিস তো কাদের খান তোর বাবা।
আমি জানি মেহেদী।কিন্তু সে দেশের মানুষের বিপক্ষে কাজ করেছে।সে মানুষের বাড়িতে লুটপাট চালিয়েছে। সুতরাং তার বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই।মিনার দৃঢ়চিত্তে বলে উঠল।
তোর সিদ্ধান্তই কার্যকর করা হবে।মেহেদী আস্তে করে বলল।
মিনার তার বাবাকেও হারানোর কঠিন সিদ্ধান্ত দিয়ে দিল।স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সবকিছু ছাড়ল মিনার।
রাতের আঁধারে কাদের খানকে নদীর পাড়ে নিয়ে গুলি করে শেষ করেদিল মুক্তিযোদ্ধারা।মিনার কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে গুলির শব্দ শুনল।সে মেহেদীকে বলল,নদীতে ভাসিয়ে দিতে তার বাবার লাশ।
মিনার নিজেদের গ্রামকে স্বাধীন করেছে কিন্তু দেশ এখনো স্বাধীন হয়নি।তাদের কাজ এখনো বাকি।যদিও সে স্বাধীনতার জন্য সবকিছু হারাল।কিন্তু তার জন্য সে থেমে যেতে পারে না।তার মিশন এখনো বাকি।সুতরাং সবাইকে নিয়ে সে আবার নতুন মিশনের উদ্দেশ্যেয যাত্রা করলো।দেশ স্বাধীন করাই তাদের মূল মিশন।
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
একজন মুক্তিযোদ্ধার গল্প।বিষয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
২২ জানুয়ারী - ২০১৭
গল্প/কবিতা:
১১৬ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪