লতিফা তার মার কাছে জানতে চায়, ”মা তোমার কাছে একটা কথা জানতে চামু, আবার রাগ করবা না তো?
কি বলবি বল,আমার অনেক কাজ পইরা আছে। লতিফাকে তার মা বলতে বলল।
আচ্ছা মা , বাবাকে সবাই খুনি কালাম কইয়া ডাকে কেন? লতিফা জানতে চাইল।
হারে আমার মাইয়া তোরে এ কথা কেডায় কইছে?
কেন তুমি হোন নাই হক্কলেই তো কইয়া বেড়ায়, তুমি বুঝি হোন নাই?
না আমি হুনি নাই তুই এহন এইখান দিয়া যা।
মায়ের চোখ গরম দেখে লতিফা কেটে পড়ল মায়ের সামনে থেকে।
মরিয়ম বিবি মনে মনে কষ্ট পায় মেয়ের সঙ্গে খারাপ আচরণ করে । তার বুকটাও হু হু করে ওঠে। কিন্তু সে জানে যে লোকটা কোনো খারাপ কাজ করে নাই। তবুও নিজের মনকে কিছুতেই মানাতে পারে না মরিয়ম বিবি। সারাদিন মলিন মনে সে সমস্ত কাজ সমাধা করে।আর সারাদিনেও লতিফা মার কাছে কিছু জানতে চায়নি,মনে মনে সে রাগ করেছে মায়ের ওপরে।
রাতে মায়ের কাছে গিয়ে চুপচাপ বসে রইল লতিফা।তার মা বুঝতে পারল মেয়েটার বেশ অভিমান হয়েছে বোধহয় তার ওপরে। অবশেষে মরিয়ম বিবি মেয়ের অভিমান ভাঙ্গতে তাকে কাছে ডেকে বলল,“আয় মা আমার কাছে আয় । শোন সেইটা এক বিশাল গল্পের মতো কিন্তু আসলে সেটা ছিল একটা দুঃখের ঘটনা যার কারনে তোর বাবাকে খুনি হতে হইছে।”
মায়ের কথা শুনে লতিফা বলল,“ হুম আমি সেই দুঃখের ঘটনাটাই হুনতে চাই,কেন আমার বাবারে খুনি হইতে হইছে। কেন সবাই আমার বাবারে খুনি কইয়া ডাকে?”
হুনতে চাস? মরিয়ম বিবি মেয়ের কাছে জানতে চাইল।
হ হুনমু তুমি কও।লতিফা মার কাছে ফের জানতে চাইল।
মরিয়ম বিবি কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। কিছুক্ষণ হয়ত সে ভেবে নিলো কিভাবে শুরু করবে মেয়ের কাছে তার বাাবার খুনি হওয়ার কাহিনি বলা।
মরিয়ম বিবিকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে এবার লতিফা মাকে আবার তাগাদা দিয়ে বলল,“ও মা, মাগো কও না, চুপ কইরা আছো কেন?”
এবার মরিয়ম বিবি “হোন তয়” বলে শুরু করল। আবার একটু চুপ থেকে সে বলতে লাগল, “সেই একাত্তর সালের কথা।তোর বাপ মুক্তিযুদ্ধ শেষ কইরা সবে বাড়ীতে ফিরা আইছে ,অস্ত্র তহনও জমা দেয় নাই।হেয় তো যুদ্ধে আগোনা পাকিস্তানিরে খুন করছে।তয় হের লাইগা হেরে কেউ খুনি কয় না।
তাইলে কেন কয়? লতিফা মায়ের কথার মাঝে জানতে চাইল।
মেয়ের কথা শুনে মরিয়ম বিবি বলল,“হ কইতাছি সবুর কর,হেই কথাই তো কইতাছি। তোর বাপে যুদ্ধ থেইকা ফিরা আইসা দেখল তোর বড় মা,মাইনে তোর বাপের প্রথম বউ তারে পাকিস্তানি আর রাজাকারেরা সবতে মিইলা সারাটা যুদ্ধের সময় নির্যাতন করছে।তোর বাপে যুদ্ধে এত মইজা গেছিল যে সে আর সারা যুদ্ধে বাড়ীর কারো কোনো খোঁজ খবর রাখে নাই।তোর চাচা-চাচি ,দাদা-দাদি সবাইরে পাকিস্তানি হানাদার আর রাজাকারেরা মিইলা মাইরা ফালাইছে।তোর বড় মার চেহারা ছবি খুব সুন্দর ছিল নাকি তাই তারে না মাইরা রাজাকার ক্যাম্পে নিয়া নির্যাতন চালায়।তোর বাপে যুদ্ধ জয় কইরা ফিরইা আইসা সব শুনল আর সে তখন অস্ত্র জমা না দিয়া নিজের কাছে রাইখা দিল।
এতটুকু বলে মরিয়ম বিবি চুপ করল।
লতিফা মাকে চুপ করতে দেখে বলল, ও মা থামলা কেন,কও হের পর কি হইল।
একটু সবুর কর।দম নিয়া কই। মরিয়ম বিবি আবার বলতে লাগল,হের পর তোর বাপে তোর মারে তন্ন তন্ন করে সারা গ্রাম জুড়ে খুঁজতে লাগল । সব রাজাকার রা গা ঢাকা দিল ।তোর বাপে কাউরেই খুঁইজা পাইল না।গ্রামে প্রভাবশালী লোকেদের ভয়ে কেউ মুখ খুলল না,আর বেশির ভাগ মানুষই তহন ছিল অসহায়।যুদ্ধের পরে দেশের অবস্থা ছিল অগোছালো তাই কেউ কারো সহায়তায় আগাইয়া আসে নাই।তোর বাপে মানুষটা খুব ভালা মানুষ। তোর বড় মারে খুব ভালোবাসত।তাই দিনের পর দিন তারে খুঁজে বাইর করার চেষ্টা করতে লাগল। এতটুকু বলে মরিয়ম বিবি আবার চুপ করল।
হের পর কি অইল মা , চুপ করলা কেন।লতিফা মা কে তাড়া দিয়ে বলে উঠল।
দশ বছর পার হয়ে গেল তোর বাপে তোর মারে আর খুঁজে পাইল না ।তয় তোর বাপে আশা ছাড়ে নাই । ততদিনে বহু রাজাকার এলাকায় আবার ফিরইা আইসা তাদের রাজত্ব কায়েম করল।চেয়ারম্যান হইল সেরা রাজাকার ।তার দলবল নিয়া সে গ্রামে নিজস্ব রাজত্ব জারি করল। তোর বাপে ছিল সাহসী মুক্তিযোদ্ধা সে চেয়ারম্যানের সকল অবৈধ কাজে প্রতিবাদ করতে লাগল আর তাতেই সে চেয়ারম্যানের শত্রু হইয়া গেল।
একটু দম নিয়ে মরিয়ম বিবি আবার বলতে শুরু করল। তোর বাপে বাজারের ওপর যুদ্ধের পর এসে ব্যবসা দিয়াছিল। চেয়ারম্যান তাও নষ্ট করার চেষ্টা করতে লাগল। তয় তোর বাপের লগে কিছুতেই সে পারছিল না। এইভাবে আরো পনের বছর কাইটা গেল তোর বাপে একা একা জীবন কাটাইয়া দেবার চিন্তা করে নিল। মনে মনে সে তার হারানো বউ রে খুঁজে পাওয়ার আশা পোষণ করতে লাগল।
হঠাৎ একদিন চেয়ারম্যান তারে ডাইকা কইল, শোন কালাম তোমারে এমন একটা জিনিস আমি ফিরাইয়া দিতে পারি যাতে এই যুদ্ধের পচিশ বছর পরে ও তুমি চমকাইয়া যাবা।
যুদ্ধের পরে তারেই খুঁজে পেলাম না,আপনি তো বদ লোক আপনি আমারে কি চমক দেবেন। তোর বাপে তাচ্ছিল্য ভরে চেয়ারম্যানকে কথাটি বলল।
তোর বাপের কথা শুনে চেয়ারম্যান বলে উঠল,বড্ড তেজি তুমি কালাম,তোমাকে আমি ফিরিয়ে দিতে পারি তুমি যাকে খুঁজে চলছ তারে ই ।
চেয়ারম্যানের কথা শুনে তোর বাবা ঠিক চমকে উঠে বলল,পরি বিবি র খোঁজ আপনি জানেন।বলুন কই আমার পরি রে লুকাইয়া রাখছেন ।তোর বাবা তহন খুব উত্তেজিত হইয়া উঠল।
তারে পাইতে হইলে চল আমার সঙ্গে।চেয়ারম্যানে তোর বাপেরে তার সঙ্গে যাইতে কইল।
হ এক্ষুণি যামু।
তোর বাপে চেয়ারম্যানের কথা মতো তোর বড় মারে যুদ্ধের এত বছর পরে আবার ফিরা পাইল। চেয়ারম্যান যুদ্ধের এত বছর পরেও তোর বড় মারে আটকাইয়া রাখছিল। কি মনে কইরা ফেরত দিল তোর বাপে তা বুঝতে পারছিল না,তয় চেয়ারম্যান দুইদিন পরে তারে ডাইকা নিয়া কইল কালাম আর আমার লগে কোনো শত্রু তা করবা না সেই জন্যে তোমার বউরে আমি ফেরত দিছি।
জ্বি আচ্ছা বলে তোর বাপে চইলা আসল।
তোর বাপে ভেতরে ভেতরে আগুন হইয়া গেল মনে মনে সে কইল,শালা হারামির পুত তোরে আমি শেষ করমু তয় দুইদিন সময় দিলাম আগে আমার পরি বিবি র মুখ থেইকা সবকিছু হুইনা লই।
এদিকে পরি বিবি র কান্না আর থামে না তোর বাপেরে ফিরা পাইয়া। কয়দিন পরে আস্তে আস্তে পরি বিবি স্থির হইতে পারল আর তোর বাপেরে সবকিছু খুইলা কইল।
এতটুকু বলে মরিয়ম বিবি চুপ করল।
ওমা থামলা কেন,হের পর কি করল বাবা কও না খুইলা কও। লতিফা তার মাকে আবার তাগাদা দিয়ে বলল।
হ কমু তো মা তুই একটু সবুর কর।
আমার আর সবুর করতে ইচ্ছে করে না ।মাইনষে বাবারে যহন খুনি কইয়া ডাকে আমার হোনতে আর ভালো লাগে না।তাই হুনতে চাই বাবা কেন খুনি হইল,তুমি কও তো মা।
মেয়ের কথা শুনে এবার মরিয়ম বিবি বলল, আচ্ছা হুন কইতাছি। হের পর তোর বড় মা আস্তে আস্তে সবকিছু খুইলা কইল তোর বাপের কাছে , কারা কারা তারে নির্যাতন করছে আর তাদের মধ্যে কারা কারা এখনো বেঁচে আছে । সবকিছু স্বামীর কাছে প্রান খুলে কইল তোর বড় মা। কেঁদে কেঁদে একথাও সে কইল যে হারামি গুলোর শাস্তি যেন তার স্বামী নিজ হাতে দেয়। ওদের খুন করলেই সে মনে শান্তি পাবে।তোর বড় মায়ের কথা শুনে তোর বাপের মাথায় আগুন চেপে গেল ।সে পরি বিবি কে হাতে ধরে কথা দিল একজনকেও সে ক্ষমা করবে না।
কয়েকদিনের মধ্যেই যে পাচ জনের নাম পরি বিবি কইছে সবাইরে ই খুন করার কথা দিল তোর বাপে।
তোর বাপে কথা রাখছিল।চেয়ারম্যান সহ আর বাকি চার রাজাকার কে একে একে খুঁজে বের করে অতি গোপনে কোনো প্রমাণ না রেখে খুন করে ফেলল সব কয়টা জানোয়ার কে। এলাকায় তোলপার পড়ে গেল, এলাকার কেউ কেউ বিষয়টা টের পেল কিন্তু আইনের লোকের কাছে কেউ স্বীকার করল না । কারণ খুন হওয়া রাজাকারে রা সবগুলোই ছিল অপরাধী ।মানুষের জন্য ভোগান্তির। তাই সবাই খুশি হলো তাদের খুন করার জন্য।আর এ কারনেই কেউ কেউ তোর বাপের নামের সাথে খুনি লাগাইয়া দিছে। আর তোর বাপেরে সবাই খুনি কালাম কইয়া ডাকা শুরু করছে।
একটু থেমে মরিয়ম বিবি বলল,হোন লতিফা খুনি শয়তান গুলোরে তোর বাপে খুন করায় তোর বড় মা মনে মনে খুবই শান্তি পেল। তবে তার ভাগ্য ভালো না।তোর বাপের ভাগ্যটাও ভালো না। কিছুদিন পর তোর বড় মা মারা যায় । তোর বাপের এত পছন্দের বউটা মারা যাবার ফলে সে সবদিক থেকে ভেঙ্গে পড়ে। পাচ বছর পর্যন্ত তোর বাপে আর সংসারে মনোযোগী হইতে পারেনি। অবশেষে তার আত্নীয়-স্বজন আর বন্ধুরা মিলে কপাল পোড়া আমারে খুঁজে বের করে তোর বাপের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেয়। আমি ছিলাম এতিম অসহায় আর তোর বাপেরে আমার পছন্দ হওয়ায় আমি বিয়েতে রাজি হইয়া গেলাম। আর এহন তো আল্লাহ্ আমাদের কে এত সুন্দর একটা মেয়ে দান করেছেন তাই জীবন টা খুবই সুন্দর লাগে। বুঝলি মা লতিফা তোর বাপে মানুষটা ভালো মানুষ সে খুনি হইলেও জানোয়ার দের খুন করেছে,তারা মানুষ ছিল না,তারা যুদ্ধের সময় নারী নির্যাতন করছে,অন্যের সম্পদ লুট করছে,মানুষ অহেতুক খুন করছে।তাই মাইনষে তোর বাপেরে খুনি কইলেও তুই আর দুঃখ পাস না মা ঠিক আছে।
হ মা আজকে থেইকা আমার সব দুঃখ শেষ,এতদিন না বুইঝা কষ্ট পাইছি বাবারে খুনি কওয়াও।আর কষ্ট পামু না ।বাবা তো ভালো কাজ করছে। আমার মনে আর কষ্ট নাই। সবকিছু জেনে আমার মনের কষ্ট দূর হইল।
মেয়ের কথা শুনে মরিয়ম বিবির মনের কষ্ট দূর হলো। আর যাই হোক মেয়ে তো তার বাবা মাকে আর ভুল বুঝবে না।
এবার সে তার মেয়েকে আদর করে বলল,চল মা এখন ই তোর বাবা এসে যাবে হয়ত ,আমরা খাবার তৈরি করি গিয়ে ।সবাই একসাথে খাব।
ঠিক আছে চল মা। মায়ের কথায় লতিফা রাজি হয়ে বলল।
মেয়েকে খুশি মনে দেখে মরিয়ম বিবিও মনে মনে তৃপ্তি পেল।
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
কাঠখোট্টা এই সমাজে একজন মুক্তিযোদ্ধা খুনি হিসেবে কিভাবে চিহিৃত হয়েছে তার কাহিনি বিবৃত হয়েছে এই গল্পে।রুপক অর্থে এই গল্পের মাধ্যমে কাঠখোট্টা সমাজকে আগুল তুলে দেখানো হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা খুনি হলেও সে অপরাধি নয়। সুতরাং বিষয়ের সাথে গল্পের সামঞ্জস্যতা রয়েছে।
২২ জানুয়ারী - ২০১৭
গল্প/কবিতা:
১১৬ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪