সাব-ইন্সপেক্টর মবিন আহমেদ খুব শক্ত নার্ভের মানুষ । সহজে ঘাবড়ে যাওয়া তার স্বভাব বিরুদ্ধ । জীবনের প্রায় অর্ধেকটা সময় এই পেশায় কাটিয়ে দিলেন ,খুন-খারাবি থেকে শুরু করে কতো যে ভয়াবহ ঘটনার সাক্ষী তিনি তার হিসাব নেই । প্রথম-প্রথম একটু কেমন লাগলেও এখন আর কোন কিছুতেই আর কিছু হয়না তার ।কিন্তু এই বাচ্চা মেয়েটার মৃত্যু তাকে কেমন নাড়ীয়ে দিয়েছে । মেয়েটার লাশের দিকে তাকালেই তার ছোটো মেয়েটার মুখ কেমন চোখে ভেসে ঊঠছে ।তিনি কিছুতেই স্থির থাকতে পারছেন না । কি এমন দুঃখ হল মেয়েটার যে জীবনটা শুরু হবার আগেই শেষ করে দিতে হল ?
আজকালকার ছেলেমেয়েদের কোনকিছুর ঠিক নেই ,সবকিছুতে বাড়াবাড়ি ।জীবনে এতো ঝুঁকি নিয়েছেন ,কতো লাশ নাড়াচাড়া করেছেন কিন্তু এতোটা নিঃস্ব কখনো মনে হয়নি নিজেকে ।
কনস্টেবল রফিকের ডাকে মবিন সাহেব স্তম্বিত ফিরে পেলেন ।
- স্যার , লাশটার গা থেকে এই জিনিস গুলো পাওয়া গেছে ।
মবিন সাহেব দেখলেন একটা ট্রান্সপারেন্ট পলিথিন ব্যাগে এক জোড়া কানের দুল ,একটা চিকন হোয়াইট গোল্ডের চেইন আর একটা ভাঁজ করা কাগজ কনস্টেবল রফিক টেবিলের উপর রাখলেন ।
মবিন সাহেবের কপালে ভাঁজ পড়লো । তিনি কিছুটা বিরক্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন , “ কাগজটা আবার কোত্থেকে এলো ?”
- স্যার , মেয়েটার হাতে শক্ত করে এই কাগজটা ধরা ছিল ।লাফ দেবার আগে মনে হয় হাতে ছিল ।
মবিন সাহেবের চোখের সামনে ছাঁদ থেকে আছড়ে পড়া মেয়েটার বীভৎস লাশের ছবিটা ভেসে উঠলো ।শুধু মেয়েটার মুখের জায়গায় তিনি নিজের মেয়ের মুখ দেখতে পেলেন ।
মবিন সাহেবের এই কেসটা নিয়ে কাজ করতেই মন চাইছে না । তিনি অনিচ্ছা সত্ত্বেও তার কাজে মন দিতে চাইলেন । ড্রয়ার থেকে গ্লাভসটা বের করে হাতে পরে নিলেন ,চিঠিটা থেকে হয়তো কোন সূত্র পাওয়া যেতে পারে কি কারণে এমন কচি মেয়েটা পৃথিবী থেকে বিদায় নেবার সিদ্ধান্ত নিলো ।
মবিন সাহেব গ্লাভস হাতে কাগজটা তুলে নিয়ে ভাঁজ খুললেন ।গোটাগোটা হাতে লেখা একটা চিঠি । সম্বোধন , মা !
মেয়েটা মৃত্যুর আগে তার মায়ের কাছে চিঠি লিখে গেছে ।কি এমন কথা থাকতে পারে যেটা সে বেঁচে থাকতে মুখ ফুটে তার মাকে বলতে পারেনি !
মবিন সাহেব চিন্তিত মুখে চিঠি পড়া শুরু করলেন ।
মা! মা! আমার প্রিয় মা!
তোমাকে খুব ,অনেক বেশি করে ডাকতে ইচ্ছা করছে । হয়তো আর কখনো ডাকতে পাড়বো না ,অথবা ডাকলেও তুমি শুনবে না তাই ।
আমি খুব খাড়াপ,খুব পচা ।তাইনা মা ? আমি তোমাকে খুব কষ্ট দেই । অন্যরা যখন গর্ব করে তাদের মেয়ের কথা বলে ,তুমি চুপ করে শোন আর কষ্ট পাও ।আমি সব জানি ,আমি সব বুঝি ।কিন্তু কি করবো বল ,আমি যে এমনই ।
তুমি খুব কষ্ট পাচ্ছ তাইনা মা?কষ্ট পেও না মা ।আমি কষ্ট পেলে যেমন তুমি স্থির থাকতে পারণা ,তেমনি তোমার কষ্টেও আমি মরে যাই ।শুধু বোঝাতে পারিনা ,বলতে পারিনা আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি ।
আমি সব যেনে বুঝেও তোমাকে ছেড়ে চলে গেলাম ।কি করবো বল ? আমি যে আর পারছিলাম না ।
মা তোমার মনে আছে ,আমি যখন নিজে নিজে হাঁটতে শিখেছি তখন একটুখানি চোখের আড়াল হলে তুমি কেমন পাগল হয়ে যেতে ? আমি খুব ছোটো ছিলাম ,তবু আবছাভাবে মনে পরে ।
আমি প্রথম যেদিন হাঁটতে শুরু করেছি তার গল্প শুনে শুনে বিরক্ত সবাই।কিন্তু তুমি নানা রঙ চড়িয়ে এমনভাবে গল্পটা করতে যেন তোমার মেয়ে হাঁটতে শেখেনি বরং তার পায়ের আঘাতে পৃথিবীর দর্প চূর্ণ করেছে ।
মা ,ছেলেবেলা থেকেই তোমার মেয়েটা দস্যি।সমাজের নিয়ম-কাননগুলো আমাকে আষ্ঠে-পড়ীষ্ঠে বাঁধতে চেয়েছে। আমি প্রাণপণ চেষ্টা করেছি ছুটবার ,ওগুলো আমাকে আরো বেশি করে জড়িয়ে ধরেছে । আমি চেঁচিয়ে বলেছি মা আমাকে বাচাও ।
মা ,তুমিতো জান আমি ছুটতে ভালোবাসি ।তারপরও আমার হাতে-পায়ে কেন নিয়মের বেড়ি পড়িয়ে দিলে । আমাকে বললে ,আমার আর ছেলেদের সাথে খেলা চলবে না ,দৌড় করা চলবে না ।
আমি অবাক হয়ে আবিষ্কার করলাম আমার চলা , বলা ,খেলা সবকিছুতে নিয়মের বন্ধন । আমি কিছু বুঝতাম না ,আমি রেগে যেতাম । তুমি বলতে, “মেয়েদের অতো রাগ ভালো না ।“
আমি আরও বুঝতাম না ।আরও রেগে যেতাম ।
কেন মা ? রাগ যদি খারাপ হয় ছেলে ,মেয়ে সবার জন্যই খারাপ ।শুধুমাত্র মেয়েদের জন্য খারাপ কেন হবে ?
আমি বুঝতে পারতাম না ,পারি না , কখনো পাড়বোও না ।
আমার দস্যিপনা ,আর মারামারি স্বভাবের জন্য আমাকে গার্লস স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলে । তারপরও চিন্তায় থাকতে রাস্তায় কারো সাথে ঝামেলা করি কিনা ! আমি ধীরেধীরে আরো একটু বড়ো হলাম ,কিন্তু মনে মনে অনেক ছোটো হয়ে গেলাম । সবার কতো বুদ্ধি আর আমি একটা বোকার হদ্দ ! আমি নিজেকে গুটিয়ে নিলাম । বিশ্বাস করো মা , আমি খুব করে চেয়েছি তোমার ভালো মেয়ে হতে ।
মা তোমার মনে আছে ,বাসের ঐ নোংরা লোকটার কথা যখন তোমাকে বলেছিলাম তুমি আমাকে বললে আর কখনো বাসে না উঠতে ।উঠলেও মহিলা সিটে বসতে বললে ।আবার রাস্তায় চলবার সময় মাথা নিচু করে কোন দিকে না তাকিয়ে হাঁটতে বললে ।রাস্তায় বোখাটে ছেলেগুলোর কথা বললে ঐ পথ দিয়ে যেতে বারণ করলে ।আমি কতো পথ বদলাবো মা ? পথ বদলাতে বদলাতে আমার পৃথিবীটাযে সঙ্কীর্ণ হয়ে যাচ্ছে তুমি কবে বুঝবে মা ?
আমি তবু পথ বদলেছি ।যেন সব দোষ আমার ,সব অন্যায় আমার ।
না অন্যায় নয় ,পাপ ।আসলেই সব পাপ আমার । সব কিছুতেই দোষ না করেও আমি দোষী ।
আমি তোমার কাছে মুক্তি চেয়েছিলাম ।কিন্তু তুমি আমার হাতে-পায়ে অদৃশ্য শিকল পরালে ,চোখে বেঁধে দিলে কালো কাপড় ,কানে গুজে দিলে তুলো ।তবু আমি শিকল পরা পায়েই হাঁটতে চাইলাম ,কালো কাপড়ের ফোকর দিয়ে আলো আমার চোখে এসে পড়লো , তোমার গুজে দেওয়া তুলো শব্দ তোরঙ্গ কে রুখতে পারছিলো না ।আমি আরো বেশি করে মুক্তি চাইলাম ,আমার অভিমান হল ভীষণ তোমার উপর ।
একদিন হঠাৎ অবাক হয়ে দেখলাম আমার পরম নির্ভরতার স্থান যেখানে ,যার কাছে আমি মুক্তি চাইছি সে নিজেইতো বন্দি ।
আমাদের এই সমাজ মেয়েদের হয় দেবীর আসনে স্থান দেয় নয়তো দাসীর । দেবীতো হাতেগোনা কয়জন হয় ,বাকীরা সবাই দাসী ।
আমি দেবী নই ,আমি দাসী হতে চাইনি ।চেয়েছিলাম মানুষ হতে ।
সৃষ্টিকর্তা আমাদের মানুষ হিসেবে সৃষ্টি করেন কিন্তু আমরা পৃথিবীতে আসার পর নানা জাত ,ধর্ম ,বর্ণ , গোত্রে বিভক্ত হয়ে যাই । তেমনি মেয়েরা জন্ম নেয় মানুষ হয়ে কিন্তু জন্মের পর তার স্বগোত্রের সদস্যরা শেখাতে থাকে কিভাবে মেয়ে হয়ে বাঁচতে হবে আর যখন বাইরে পা রাখে তখন সারা পৃথিবী তাকে বারবার মনে করিয়ে দেয় ,”তুমি শুধুমাত্র একটা মেয়ে ।“
তোমরা সবাই আমাকে শেখাতে চেয়েছ কিভাবে মেয়ে হয়ে থাকতে হয় ,মনে করিয়ে দিয়েছ আমি যে একটা মেয়ে ।আমাকে রক্ষা করতে চেয়েছ কিন্তু আমার মধ্যে এমন কোন বোধ জাগ্রত হতে দিতে চাওনি যে আমি নিজেই নিজেকে রক্ষা করতে পারি । তোমরা আমাকে সব দিয়েছ শুধু স্বাধীনটা দাওনি ।
আমাকে হাজারো নিয়মে বাঁধতে চেয়েছ । আমি আজকে সব নিয়মের শিকল ছিঁড়লাম ।
- - - -
মবিন সাহেব চিঠিটা শেষ করে বাড়ি যাবার জন্য উঠে দাঁড়ালেন । আজকে নাইট শিফট ছিল ,কিন্তু এখন তাকে বাড়ি যেতেই হবে ।
মিতিলকে বলতে হবে ,” মা ,তোর মাথা নিচু করে হাঁটবার কোন দরকার নেই।তুই চুপ করে থাকবি কেন ? তুই মাথা উঁচু করে বাঁচবি ,সমাজের ওইসব কিটদের চুপ করিয়ে দিবি । আমি জানি তুই পারবি । আমি আছি তোর পাশে ,সবসময় ।“
ঝড় এলে পালিয়ে বাঁচার কোন উপায় নেই ।