ইরা তার নিস্ফ্রভ দু’টি চোখে একটানা অনেক্ষণ ধরে আকাশের দিকে চেয়ে আছে। আমি একটু দূর থেকে তাকে অনুসরণ করছি। একটু কাছাকাছি যেতে দেখি তার দু’চোখের জলে মুখ ভিজে গেছে। যেন এই আকাশের বুকে লুকিয়ে আছে ইরার একমুঠো স্বস্থি। আমি ডাক দিলাম, ইরা তুমি কাঁদছো কেন? ইরা চোখের পানি মুছে বলল, না তো! এই যে, এখনও তো তোমার মুখ ভেজা দেখা যাচ্ছে!!
আমি একটু অবাক হলাম এই যে, আর কখনও ইরার দু’চোখের পানি এমন করে ঝড়তে দেখিনি।
আমি আবারও জিঙ্গেস করেছি, কোন সমস্যা? কোন কিছু মনে পড়েছে নাকি?
আমাকে বলল- না তো, একটু কষ্ট অনুভব হয়েছে! তবে কেন?
আমি অনেক্ষণ অনুরোধ করার পর ইরা আমাকে বলল-
রাজ জানো এখানে-ই আমার লুকিয়ে আছে পুরো শৈশব স্মৃতি।
আমি খুব আশ্চর্যবোধ করলাম, কারণ আমি যখন বি.এসসি থার্ড ইয়ারে পড়ি তখন ইরার সাথে আমার সম্পর্ক হয়। ইরা তখন কলেজ শেষ করে। ইরা আমাকে জানিয়েছিল তার আপন জন বলতে কেউ নেই এবং কোথায় সে জন্মগ্রহণ করেছে সে নিজেও জানে না। তাকে নাকি এক পরিবার ছোট বেলা কোথায় যেন খুজে পেয়েছে এবং সে পরিবারে-ই সে বড় হয়েছে। গ্রামের ছেলে মেয়েরা প্রায় সময় নাকি তাকে অন্যের লালিত সন্তান বলে উপহাস করতো। এমন আর কতদিন সহ্য করবে? হঠাৎ একদিন রাগ করে তার বান্দবির হাত ধরে শহরের অচেনা পথে পাড়িদেয় সে। তার কিছুদিন পর তার বান্দবী তাকে এখানে ভর্তি করে দেয়। এইটুকু বলে ইরা থেমে যেত, বাকিটুকু আর কখনও তার মুখ থেকে বের করতে পারিনি। প্রথম দিকে শুনলে যতটা বিস্মিত হতাম, আজ আর ততটা বিস্মিত হই না।
.
আমি তার সৌন্দর্য দেখে নয়, তার মেধা দেখে আমি তাকে আপন হওয়ার প্রস্তাব দিই। সম্পর্কের এক পর্যায়ে আমার পরিবারের সম্মতিতে আমি ইরাকে বিয়ে করি। তখন ইরা মেডিকেলের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী।
এর মাঝে দিয়ে সাতটি বছর কেটে গেল। আমার ছেলে সামিদ জন্ম গ্রহণ করে। তার বয়সও এখন পাঁচ বছর। হঠাৎ ইরা আমাকে বলল সে এই জায়গায় ভ্রমণে আসবে। যখন বলল তখন ছুটি ছিল না, এখন ছুটি পেয়ে আমি ইরাকে সহ আমাদের গাড়ীর ড্রাইভার ও তার অনুরোধে ড্রাইভারের স্ত্রীকে নিয়ে এখানে আসি...
আর আজ হঠাৎ শুনি ইরা বলল এখানে-ই নাকি তার পুরো স্মৃতি লুকিয়ে আছে। ইরাকে আরও অনুরোধ করার পর ইরা আমাকে বলল-
এখানে-ই আমি জন্মগ্রহণ করছি। আমাদের কত সুন্দর জীবন ছিল। পরিবারে ছিলাম আমরা ভাই বোন দুইজন সহ মা বাবা। কোন ধরনের অভাব ছিল না।
রাজ এ নদীটি দেখতে পেরেছো?
হ্যাঁ, তবে কেন?
জানো, আমাদের পুরো ধন- সম্পদ এ নদী নিয়ে গেছে। পরবর্তীতে বাবা কঠিন পরিশ্রম করার ফলে কিছু করতে পেরেছেন। এক সময় বাবার বড় একটি রোগ হয়, ফলে বাবা কয়েক মাস ইনকাম করতে পারেনি। সে সময়ে আমার বড় ভাই- শাহেদ ভাইয়া মেডিকেলে পড়তেন। একই সময়ে তার অনেক টাকার প্রয়োজন হয়ে গেছে, পরে সে সম্পত্তি বাবার আদেশে মা স্বল্প দামে বিক্রি করে ভাইয়ার পড়ালেখায় খরচ করে ছিলেন।
সেখান থেকে আমাদের সংসারে খুব অনটন পড়ে যায়। বাবা অনেকদিন শরীরে রোগ নিয়েও মাঠে কাজ করেছিলেন। তাতে কি আর সব কিছু সমাধান হয়? এভাবে খুব কষ্ট নিয়ে আমাদের সময় কেটে যেতে লাগলো।
অনেক কষ্টের ভিতরে ভাইয়ার মেডিকেলের কোর্স শেষ হয়, আমি তখন নবম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছি। তার কিছুদিন পর ভাইয়া কোথায় যেন এক মেডিকেলে চাকরি পেয়ে ছিলেন, বেতনও ছিল উচ্চ পর্যায়ের। এক বছর চাকরি করার পর সংসারটা মোটামোটি দাড়ালো, আর তখনই বাবা ভাইয়ার বিয়ের জন্য মেয়ে দেখতে লাগলেন। আমাদের বাড়ি থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে ভাইয়ার সম্পর্কের একটি মেয়ের সাথে ভাইয়ার বিয়ে সম্পূর্ণ হয়। প্রথম দিকে মেয়েটি খুব ভালো ছিল, সংসারের প্রতি একটু চিন্তাশীল ছিল। আমার আম্মুর একটি সমস্যা ছিল- ভালো মন্দের জন্য একটু ডাক দেয়া। সব সময় সতর্ক করে কাজ করার জন্য ভাবিকে খুটি নাটি ডাক দিতো। এ কারণে ভাইয়া মা ও বাবার উপরে রাগ করে সংসারের টাকা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। সংসারে টাকা দেয় না, ঠিকমত বাড়িতে আসে না। কোথায় থাকে কেউ নাকি জানে না। ভাইয়ার এমন দেখে বাবার মাথায় খুব রাগ উঠেছিল, তাই ভাইয়াকে খবর দিয়ে বাড়িতে আনা হলে বাবা এগুলো নিয়ে খুব রাগারাগি করেছেন। এতটাই রেগে ছিলেন যে, সেদিন প্রেসার বেড়ে গিয়ে বাবা পৃথিবী ত্যাগ করেন। এরপর থেকে সংসারের প্রতি আমাদের আরও বেশি কষ্ট বাড়তে থাকলো।
ভাইয়া আমাকে পড়ার খরচ চালাতো না, সংসারে ঠিকমত টাকা পয়সা দিতো না। তার স্ত্রীও ঠিকমত আমাদের বাড়িতে থাকতো না। আমি টিউশনি করতাম, আর মা সকাল বেলা বাচ্চাদের আরবী পড়াতেন। এমন কষ্ট করে আমাদের সংসার চলতে থাকলো। তবুও জীবন যুদ্ধে পিছ পা হতে চাইনি।
এই তো পরশু দিন সকালে ভাবি আমাদের বাড়িতে আসেন, সেদিন বিকালে ভাইয়াও। সেদিন রাতে মা ভাইয়ার প্রতি অনেকটা রেগে গেছেন। আমার মেট্রিক পরীক্ষা শেষ, তাই টেবিলে বসে কলেজে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। রেগে যাওয়ার এক পর্যায়ে ভাইয়া মা’কে ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বের করে দেন। আমি আবার ভাইয়াকে কিছু বলতাম না, সব সময় বড় ভাইয়ের মত সম্মান করতাম। তবে শিক্ষিত ভাইয়ের এমন আচরণ দেখে আমি হতবাক হয়ে গেলাম। একজন মা একজন সন্তানের জন্য কি না করে? একজন সন্তান মানুষ করতে গিয়ে কত জ্বালা-ই না সহে নিতে হয়, অথচ একটি সন্তান সামান্য একটু কথার কাটাকাটি সহে যেতে পারেন না! সে রাতে আর কিছু বললাম না, নীরব আঘাত নিয়ে যেন ঘুমিয়ে পড়লাম। মা সেদিন অনেকটা কেঁদেছেন। এর আগেও নাকি ভাইয়া মায়ের সাথে উল্টা- পাল্টা আচরণ করে মা’কে ঘর থেকে বের করে দেয়; সব শোক নিয়ে মা খুব কষ্ট পেয়েছেন।
এই তো সেদিনের ঘটনা- ভাবি অসুস্থ ছিলেন, কিন্তু ভাইয়া বাড়িতে ছিলেন না। মা বাড়িতে ডাক্তার নিয়ে আসেন এবং ভাবিকে ডাক্তার দেখান আর পাশের বাড়ির একজন থেকে চারশত টাকার মত ধার করে ডাক্তার বিদায় করেন। তার দু’দিন পর ভাইয়া বাড়িতে আসলেন, আমি ঘরে ছিলাম না। মা কাকে দিয়ে যেন ভাইয়ার কাছে টাকার জন্য পাঠালেন। ভাইয়া বললেন- যে মা তার ঘরের বউকে নিজের পকেটের টাকা দিয়ে ডাক্তার দেখাতে পারেন না, সে মা ঘরে না থাকায় ভালো! সে মা’কে কাল থেকে যেন আর ঘরে না দেখি, ঘরে দেখলে মেরে বস্তা ভরে নদীতে ফেলে আসবো। এগুলো নিয়ে বাড়াবাড়ি করে এ তিনবার মা’কে ঘর থেকে বের করে ভাইয়া ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয়। সে যে মা লুকিয়েছেন, আর মা’র খোঁজ পেলাম না! আমি পাশের বাড়ির আমার এক বান্দবীর কাছে এমন কথা শুনে আমি আর ঘরে ফিরলাম না। প্রাইভেটের টাকা সে ধার করা মহিলাকে দিয়ে বাড়ি থেকে বিদায় নিলাম।
আমি ইরার কথা শুনে- দু’চোখের জলে ভিজে গেছি! হায় রে পৃথিবী! হায় রে সন্তান!! হায় রে মা...!!!
.
আমি সেদিন থেকে খুব সতর্কতার সাথে চলাফেরা করি। চারদিক দেখি তাকে একটু দেখার প্রত্যাশায়। ইতিমধ্যে বেশ কয়েক মাস চলে গেছে। একদিন বিকাল চারটার দিকে আমি অফিস থেকে বাড়ি ফিরেছি। যেতে যেতে পথের মধ্যে একজন বুড়ো মহিলা একটি পুকুর পাড়ে বসে আছে দূর থেকে দেখা যাচ্ছে। পাশে জনগন কেউ নেই, একটি কুকুর তার সাথে শুয়ে আছে।
ড্রাইবারকে গাড়ি থামাতে বললে, ড্রাইবার গাড়ি থামায়। গাড়ি থেকে নেমে তার পাশে গিয়ে দেখি তার দু’টো পা আগুনে পোড়া দাগে সাদা হয়ে আছে। হাত- মুখের চেহারা গুলো দগ্ধ হয়ে গেছে।
ইরাকে ফোন দিলাম-
আচ্ছা ইরা- তোমার আম্মুর পায়ে পোড়া দাগ আছে না?
মুখের নিচ দিকে ডানে বড় করে একটি তিল আছে না?
ইরা : তুমি এই সব কি বলছো? ইদানিং দেখেছি তুমি এগুলো সম্পর্কে একটু বেশি ভাবো! সমস্যা কি তোমার, বলবা?
এই শোনো ঐ সব বাদ দাও। তাড়াতাড়ি বাসা ফিরো, আমি তোমার জন্য চা করে রেখে দিয়েছি। চা ঠান্ডা হয়ে যাবে।
রাগ করে ফোন কেটে দিলাম। সোজা প্রশ্ন করলে উত্তর না দিয়ে বেশি প্যাচলামী করবে! আমাকে একদিন রাতে কি যেন বলেছিল, আমার পুরোটা মনে নেই। তবে যতটুকু বলেছিল তার মাঝে পায়ের পোড়া দাগের কথা পুরো মনে আছে।
তাকে বললাম- আমি আপনাকে নিয়ে যেতে এসেছি। আমার সাথে চলেন। আমাকে প্রশ্ন করলো- আ প নি কে ? কো থা য় থে কে এ সে ছে ন?
আমি সরকারী লোক। আমার কাজ হলো- যারা রাস্তাঘাটে পড়ে থাকে, যাদের ছেলে- মেয়ে নাই, কিংবা যারা ছেলে- মেয়ে থাকা সত্যেও তারা বুড়ো মা- বাবার খোজ খবর নেয় না আমি তাদেরকে নিয়ে যেতে এসেছি।
আ মা কে কো থা য় নি য়ে যা বে ন?
সরকারী অফিসে নিয়ে যাবো, সেখানে আপনাদের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের ব্যবস্থা আছে। ভালো করে হাটতে পারে না, যেন কতদিন খাবার খায়নি! একটা লাঠিতে ভর দিয়ে আমাকে তার পশ্চিম পাশে বড় একটা বাড়ি আছে সেদিকে নিয়ে যেতে লাগলো। বাড়ি দেখে দুর থেকে বুঝলাম- এটা কোন জমিদারের বাড়ি। যেতে যেতে বাড়ির কাছে চলে গেলাম। সেখানে বাড়ির একপাশে একটা টঙ আছে, ছেঁড়া কাপড় দিয়ে চারপাশ ঘিরে রয়েছে। আমাকে সেটা দেখিয়ে দিল। ভিতরে ঢুকে দেখি, বিছানা বলতে বাগানের ছোট ছোট পাতা গুলো। আর বালিশ বলতে- একটি কাপড়ের ভিতরে কত গুলো পাতা দিয়ে মুড়িয়ে বেধে দিয়েছে।
শরীরে দেওয়ার মত কিছু নেই, পাশে ছেঁড়া- ফাটা কত গুলো কাপড়। বাসা থেকে বের হয়ে দেখি, জমিদারের মেয়ে চিৎকার করেছে। আপনারা কারা? কার অনুমতি নিয়ে এখানে এসেছেন?
জ্বী আপু- আমি সরকারী লোক। আমি বুড়ো মা’কে নিয়ে যেতে এসেছি।
জমিদারের মেয়ে : আগে আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি, বুড়িটাকে নিয়ে যেতে এসেছেন বলে। এই বুড়িটা অনেক বছর আমাদের এখানে কাজ করেছে। এখন আর কাজ করতে পারে না, তাই এখানে তাকে রাখার মানে-ই হয় না। আর দ্বিতীয়ত, আমাদের একটা মান সম্মান আছে! মানুষ এখানে এমন দেখলে কি ভাববে! আমাদের সম্মানহানী হবে।
হায় রে মানুষ! কারও জীবন, আর কারও সম্মান! পৃথিবীতে কিছু কিছু মানুষ জন্ম নেয় অসহায়দের জন্য জীবন দিতে, আর কিছু কিছু মানুষ জন্ম নেই নিজের সম্মান রক্ষা করতে!!
দক্ষিণ দিকে চেয়ে দেখি, অনেক পূরনো একটি থালা। এই থালাতে জমিদারেরা খাবারের পর যদি থাকে তাহলে তাদের কাজের মেয়ে তাকে এনে খেতে দিতো। আর যদি না থাকতো তাহলে বুড়ি মা উপবাস থাকতে হতো। এভাবে চলে গেছে তিনটি বছর...!
বুড়ি মা চলো, আমরা সরকারী অফিসে ফিরে যায়। বুড়ি মা কাজের মেয়েটিকে তার ডাইরিটা দিতে বলল। কাজের মেয়ে অনেক যত্ন করে চারটি বছর ডাইরিটা গোপন করে রেখেছে। ডাইরিটা আমার কাছে তুলে দিয়ে কাজের মেয়েটি কান্না স্বরে বলল- এই ডাইরিতে বুড়ো মায়ের পুরো জীবন কাহিনী, ডাইরিটা কাউকে দিবেন না!
বুড়ি মা’কে যেন সর্বোত্ত ত্রুটির ক্ষমা করেন এমন প্রতিশ্রুতি নিয়ে আমি আর আমার ড্রাইবার বুড়ি মা’কে নিয়ে গাড়ির কাছে চলে গেলাম। বুড়ি মাকে গাড়িতে উঠাবো ততক্ষণাৎ তার সাথে থাকা কুকুরটি আমার দিকে তাড়িয়ে এসেছে, আমি তাকে ছেড়ে দিয়ে চলে গেলাম। বুড়ি মা এখন আর তার কুকুরটি রেখে যেতে চেয়েছেন না। করার কিছু নেই, তার সাথে কুকুরটি গাড়িতে তুলে নিলাম। ইরাকে ফোন দিলাম নিচে আসো (কারণ আমরা তিন তলা থাকতাম), দ্যাখো কাকে নিয়ে এসেছি। ইরা বলল- তুমি উপরে নিয়ে আসো, আমি এখন নিচে যেতে পারবো না। তারপরেও অনুরোধ করলে সে আমার আম্মুকে নিয়ে নিচে আসে। ইরা দেখে তাকে চিনে ফেলল, আম্মুকে বললাম- উনি ইরার আম্মু। আজ থেকে তোমরা আপন বোনের মত চলা- ফেরা করবে। উনাকে কখনও খারাপ চোখে দেখবেন না। ইরা অনেক্ষণ জড়িয়ে কান্না করার পর বুড়ি মা কুকুরটিকে তোষামদ করে এখানে থাকতে বললে কুকুরটি এখানে-ই থেকে ছিল।
কিছুক্ষণ পর আমার পাঁচ বছরের ছেলেটি নার্সারী থেকে আসলে তাকে বলি- ঐ যে বুড়ি মা’কে দেখেছো, সে তোমার নানু। যাও নানুকে সালাম করো।
নানুকে সালাম দিয়ে বলল- এতদিন কোথায় ছিলে তুমি?
তুমি জানো নানু- তোমার সাথে খেলবো বলে আমি কত খেলনার জিনিস রেখে দিয়েছি? কতদিন আম্মুর সাথে রাগ করে খাবার খায়নি! কত পুতুল তোমার জন্য সাজিয়ে রেখে দিয়েছি, আজ থেকে তোমার সাথে খেলবো, দাদুর সাথে আর খেলবো না...
একটু দূর থেকে ওর আম্মু ওর দিকে চেয়ে আছে। ছেলেটি তার আম্মুকে সাথে সাথে বলে ফেলল-
আম্মু তুমি কত সুন্দর, তোমার আম্মু এত কালো কেন?
তুমি আমার আম্মু না, তোমার আম্মু কেন এতো কালো! আমি ছেলের মুখের দিকে চেয়ে অবাক হয়ে গেছি।
কিছুক্ষণ পর ভাবলাম, ডাইরিটা তো নিয়েছি কিন্তু এটার ভিতরে কি, একটুও তো দেখলাম না। ড্রইং রুম ত্যাগ করে, বেড রুমে চলে গেলাম। ডাইরিটা খুলে আমি অবাক হয়ে গেলাম-
১০.০২.১৯৭৮ : আমার স্বামী আমাকে এ এলাকার সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে হিসেবে প্রস্তাব দিয়ে পুরো এলাকা ডাক ঢোল পিঠিয়ে আমাদের বিয়ে সম্পূর্ণ করে।
১৮.০৫.১৯৮০ : আজ সন্ধের দিকে আমার ছেলে শাহেদ জন্মগ্রহণ করে। আমি শাহেদকে জন্ম দিতে এতটা-ই কষ্ট পেয়েছি যে, আমি সৃষ্টিকর্তার কাছে দোয়া করেছি যেন কোন নারী এতটা কষ্ট ভোগ করে সন্তান জন্ম না দিয়ে তার আগে মৃত্যুবরণ করে।
১৮.০২.১৯৮৩ : আজ বিকালে আমাদের গরুর ঘরে আগুন লেগেছে। তার পূর্ব পাশে আমার ছেলে শাহেদ খেলা করেছিল। আমি শাহেদকে বাঁচাতে গিয়ে আমার দু’টো পায়ের চামড়া আগুনে পুড়ে ফেলি; কারণ গরুর ঘর এমন জায়গায় ছিল যে, আমি যদি সোজা আগুনের উপর দিয়ে তাকে বাঁচাতে না গিয়ে অপর পাশ দিয়ে যায় তাহলে শাহেদকে আর ফিরে পেতাম না। আগুনে জ্বলে সে ছাই হয়ে যেত।
২৮.০৯.১৯৮৫ : আজ আমার মেয়ে ইরা জন্মগ্রহণ করে। আমি আমার মেয়ের জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে অনেক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
১০.০৭.১৯৯৭ : আমার ছেলে শাহেদ মেট্রিক পরীক্ষায় এ জেলার সকল ছাত্র- ছাত্রীর মাঝে সবচেয়ে ভালো ফলাফল অর্জন করে। এই খুশিতে তার বাবা পাঁচটা গরু জবাই করে এ এলাকার নি¤œবিত্ত থেকে শুরু করে উচ্চবিত্ত পর্যন্ত সকলের দাওয়াতের ব্যবস্থা করেন।
০২. ০৮.২০০০ : আমার ছেলে আই.এ পরীক্ষায় এই থানার সকল পরীক্ষার্থীদের মাঝে সবচেয়ে ভালো ফলাফল অর্জন করে। এই খুশিতে তার বাবা বড় বড় তিনটা গরু বিক্রি করে এই এলাকার সবাইকে দাওয়াতের ব্যবস্থা করেন এবং কিছু জমি বিক্রি করে আমার ছেলেকে সবচেয়ে ভালো প্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগ করে দেয়। ধীরে ধীরে আমাদের অল্প একটু সম্পদ ছাড়া বাকি সব সম্পদ নদী নিয়ে যায়।
৩০.১২.২০০৩ : নদী ভাঙার পর আমাদের যেটুকু সম্পদ ছিল সেইটুকু বিক্রি করে দিই শাহেদের পড়ালেখার জন্য।
১৫.০৯.২০০৪ : আজ শাহেদের বাবার শরীরে এক ধরনের ভাইরাস ঢুকে পড়ে। এ থেকে মুক্তি পেতে হলে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী রোগ ভালো না হওয়া পর্যন্ত তাকে সব সময় বিশ্রামে থাকতে হবে। তবুও সংসারের জন্য কঠিন পরিশ্রম করে যাচ্ছেন।
১৭.০২.২০০৬: আমার ছেলে শাহেদ মেডিকেলের পড়ালেখা শেষ করে এবং ভালো একটি মেডিকেলে তার চাকরী হয়।
০৩.০৭.২০০৬: আজ শাহেদের বাবা শাহেদের সাথে রাগ করে প্রেসার বেড়ে গিয়ে হার্ট-এট্যাক করেন, পরে মেডিকেলে নিয়ে গেলে তাকে আর বাঁচানো সম্ভব হয়নি।
১৩.০৩.২০০৭ : আজ আমার ছেলে শাহেদ আমাকে ঘর থেকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়। এর আগে আমাকে দু’বার ঘর থেকে বের করে দেয়, কিন্তু তখন আমি কোথাও যায়নি, তবে এবার প্রতিজ্ঞা নিচ্ছি- আমি বেঁচে থাকা পর্যন্ত আর এ ঘরে ফিরবো না! আমি বের হয়েছি, কিন্তু আমার মেয়েকে সাথে নিতে পারিনি। তবে আমি আমার মেয়ের জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছি, যেন তিনি সর্বদিকে তার খেয়াল রাখেন এবং সব সময় ভালো থাকে।
আমি তার ডাইরির দিকে চেয়ে- নিজেকে যেন সাগরে ভাসিয়ে দিয়েছি, আর প্রার্থনা করেছি- এমন ছেলে যেন পৃথিবীতে আর জন্ম না নেয়...!!