উপকথা
এই গল্পের কিছু শব্দ এবং ঘঠনার বিবরন, কাহিনী ও চরিত্রের প্রয়োজনে এমন ভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যা শুধু প্রাপ্ত বয়স্ক পাঠক পাঠিকাদের উপযোগী। তাই আঠারো বছরের নিচে কোমলমতি ও আপ্রপ্ত বয়স্ক পাঠক পাঠিকাদের প্রতি অনুরোধ রইলো, তারা যেনো এই গল্পটি না পড়েন।
এক
মুন্সি সাব মিলিটারি আইছে। মনে অয় ওগো বড় সাব। কাজের ছেলে দেলু এসে ফিসফিস করে হোসেন মুন্সিকে খবরটা দিলো।
মুন্সির মেজাজটা খিচড়ে গেলো ফিসফিস করে কথা বলতে শুনে। ধমকে বললেন, “হারামির বাচ্চার মুখ দিয়া যেন কতা বেরুইতাছে না। মিলিটারি আয়ে নাই যেন ভূত আইছে”।
দেলু চুপ করে দাঁড়িয়েছিলো। তিনি আবার হুঙ্কার দিলেন, “দারাই আসছ কে? জলদি গিয়া বসার ঘরের দরজাটা খোল হারামজাদা। তাড়াতাড়ি যা”।
মুন্সি তখন তার ছোট বউয়ের খাটে শুয়ে ছিলেন। কোনরকমে পাঞ্জাবিটা গায়ে চড়িয়ে তিনি হুড়মুড় করে ঘর থেকে বেড়িয়ে এলেন।
বাড়ির সামনের বাগানে মেজর জাকির হোসেন বসে আছেন। মুন্সি তাকে দেখতে পেয়েই হাত কচলাতে কচলাতে সামনে গিয়ে বললেন, আস্লাম-ও-অলাইকুম স্যার। ক্যায়া বাত, ক্যায়া বাত! আপনি কিউ আয়া? আমিতো অহনি আপনের অইখানে যাইতাছিতাম। এই গরিবের বাড়িতে আপনেরে কই বেঠাই। ভিতরে চলেন স্যার। ভিতরে। আন্দার।
আনন্দের অতিসজ্জায় হোসেন মুন্সি তখন বাংলা উর্দুতে কথা বলতে গিয়ে জট পাকিয়ে ফেলছিলেন।
মেজর উর্দুতে বললেন, শুনাহে আপকা মাকান বহুত বাড়িয়া খুবসুরুত হ্যাঁয়। ইশ্লিয়ে আভহি দেখনে আয়া। ইয়ে বাগিচা ভি ভহুত খুবসুরুত বানায়াহে আপ্নে।
মেজর জাকির আর বাড়ির ভিতর গেলেন না। বাগানটাই তার ভালো লাগছে। আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছু ফুল গাছও আছে।
মুন্সি আবার কিছুক্ষণ পর বাড়ির ভিতরে গেলেন। তারপর হাতে করে একটা লম্বা কাগজের লিস্ট নিয়ে ফিরে এলেন। তার পাশে খাবারের ট্রে হাতে তার মেয়ে বিনু।
বিনু তার খুব আদরের মেয়ে। বড় বউয়ের ঘরে হয়েছে এই মেয়ে। অসম্ভব রূপবতি তার এই মেয়ে। চাঁদপানা মুখটিতে আল্লাহ্ তায়ালা যেন লাবণ্য ঢেলে দেওয়ার সময় থামতে ভুলে গিয়েছিলেন। মুন্সির চার মেয়ের মধ্যে বিনুই সবার ছোট মেয়ে। বাকি তিন মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। তারপর এক ছেলে। ছেলে এখনো স্কুলে পড়ে। ক্লাস সেভেনে।
মুন্সি তার হাতের লিস্টটা মেজর জাকিরের হাতে দিয়ে বললেন, এই যে স্যার। এই খানে সব বজ্জাত মুক্তির নাম ঠিকানা আছে। সবকটার। আমি নিজে সব খোঁজখবর নিয়া তারপর বানাইছি।
মেজর জাকির লিস্ট হাতে নিলেন ঠিকই কিন্থু তার চোখ জোড়া বিনুর দিক থেকে সরছেনা।
মুন্সি এবার বললো স্যার এইটা আমার ছোট মেয়ে বিনু। বরই আদরের। আপনার জন্য এই সামান্য নাস্তাপানি ও নিজ হাতে বানাইছে। খান স্যার, খান।
কথাটা মিথ্যা হলেও বিনু কিছু বললো না। চুপ করে বাগানের বেতের চেয়ারে নাস্তা রেখে চলে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়ালো। মুন্সির মনের গোপন বাসনা যুদ্ধের নামে এই গণ্ডগোল শেষ হলে মেজর সাহেবের কাছে তার এই মেয়ের বিয়ে দিবেন। তিনি শুনেছেন, মেজর সাহেব এখনো অবিবাহিত।
মেজর জাকির একদৃষ্টিতে বিনু ঘরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সেদিকে তাকিয়েই রইলো। তার পিছনে দাড়িয়ে থাকা অধস্তন মিলিটারির লোকগুলোও যে দু’একবার আড়্ চোখে দেখছে না তা নয়। এতে অবশ্য মুন্সির খুব গর্বই হচ্ছিলো। যাক বিনু তাহলে মেজর সাহেবের মনে ধরেছে। এই যুদ্ধ তো শেষ হয়ে যাবে ফুঁৎকারে। তখন আর পায় কে তাকে। পশ্চিম পাকিস্তানের সুদর্শন মেজর হবে তার মেয়ের জামাই।
দুই
রাতে মানিক এসেছিলো বাসায়। মানিক মুন্সি সাহেবের দূর সম্পর্কের এক বোনের ছেলে। অসম্ভব সুঠাম ও বলশালী দেহের অধিকারী মানিক। বিনুর সাথে মানিকের একটা গোপন আশনাই আছে। এটা অবশ্য মুন্সি সাহেব জানেন না।
মানিককে মুন্সি অবশ্য খুব পছন্দ করেন। এর পিছনে হয়তো একটা কারন আছে। মানিকের মা মানে তার ঐ দূর সম্পর্কের বোনকে তিনি একসময় খুবই পছন্দ করতেন। আর মানিকও দেখতে হয়েছে ঠিক তার মায়ের মতো। কিশোর বয়সে মানিকের মায়ের সাথে লতিফ মুন্সির ঐটা প্রথম প্রেম ছিলো। কোন কারনে পূর্ণতা পায়নি। তবে বিয়ে করতে না পারলেও আর সবই করেছিলেন তিনি।
আজ মানিককে দেখে মুন্সি সাহেব খুশি হয়ে বললেন, রাতে ভাত খাইয়া যাইস মানিক। তারপর আজকে মেজর সাহেবের হঠাৎ তার বাড়িতে আগমনের কথাটা খুব রসিয়ে রসিয়ে বললেন তিনি মানিকের কাছে।
শুনতে শুনতে মানিকের মুখ শক্ত হয়ে যাচ্ছিলো কিন্তু সে কোনরকমে নিজেকে সামলে নিলো। মুন্সি লতিফ মিয়া জানেন না যে মানিক হলো স্বাধীনতাকামী মুক্তি বাহিনীর স্পাই। অনেক বড় এক সক্রিয় সদস্য।
রাতে খাওয়ার পর এক ফাঁকে মানিক বিনুর সাথে দেখা করলো। বাইরের কল পাড় থেকে হাতমুখ ধুয়ে ফিরার সময় মানিক দেখলো বিনু অন্ধকারে সিঁড়ি কোঠার নিচে দাড়িয়ে আছে। এটা ওদের দেখা করার গোপন জায়গা। একতলা পাকা বাড়ির এই সিঁড়ি কোঠাটা বাড়ির বাইরের দিকে।
বিনু লিস্ট টার কথা মানিককে বললো। লতিফ মুন্সি অবশ্য এটার কথা মানিককে বলেননি। শুনার পর মানিক কিছুক্ষণ থম ধরে থাকলো। তারপর মানিক এনিয়ে বিনুকে চিন্তা করতে নিষেদ করে কিছুক্ষণ জড়িয়ে ধরে আদর করে চলে গেলো।
মুন্সি সাহেব রাতে তার ছোট বউয়ের ঘরেই শুতে যান। যখন দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলেন তখন এই বউয়ের বয়স ছিলো তার মেজো মেয়ের সমান। দেখতে ছিলো ঠিক শশার মতো। বুকদুটো যেন ছিলো কচি ডাব, ঠাঁসা পানিতে ভরা। গ্রামের এক ছেলের বিয়ের উঁকিল হতে গিয়ে মেয়ে দেখে তিনি নিজেই বিয়ে করে ফেলেন। তা এই বউ সুফিয়ার ঘরে কোন সন্তান নেই। এতে অবশ্য মুন্সির কোন ক্ষতি হয়নি। বরং লাভ হয়েছে। বউয়ের শরীরটা এখনো বেশ টাইট আছে।
ঘুমানোর আগে পান খাওয়া লতিফ মুন্সির একটা স্বভাব। সুফিয়া পান বানাতে বানাতে মুন্সির পাঁশে এসে খাটে বসলো। তারপর বললো পরের বাড়ির বাঁধ ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে আপনার নিজের বাড়ির বাঁধ যে নিজে নিজেই ভাঙ্গতে শুরু করেছে, সেই খবরকি আপনি রাখেন?
মুন্সি বউয়ের হাত থেকে পানটা মুখে দিয়ে চিবোতে চিবোতে সুফিয়ার বুকের দিকে লোভী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। তার বুকের আঁচলটা এক পাশে সরে গেছে। ব্লাউজ এর ভিতর অতি কষ্টে যেনো ঐ উঁচু টিবি দুটো গাঁদাগাঁদি হয়ে বসে আছে। একে অপরের পাশাপাশি। কাছাকাছি। উপরের অংশটুকু এমনভাবে মুখ বের করে আছে যেনো একবার সুযোগ পেলে বক্ষবন্ধনীর বাঁধন ছিঁড়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে। মুন্সি পান চিবোতে চিবোতে সুফিয়ার বুকের উপর চোখ রেখেই বললো, “কোন সমস্যা নাই। আইজ রাইতে এমন শক্ত কইরা বাণ দিমু যে ভাঙ্গা বাঁধ আবার আপনা আপনিই ঠিক অইয়া যাইবো।”
সুফিয়া মুন্সির ইঙ্গিত বুঝতে পেরে আক্ষেপের স্বরে বললো, আ মরণ! আমি কই কি আর আপনে কন কি? আমি কইতাছি বিনুর কথা। বিনুর মনে অয় মানিকের লগে একটা কিছু আছে! আপনি একটু খোঁজ লইয়া দেইখেন।
লতিফ মুন্সি এ কথায় পাত্তা দিলেন না। বললেন, “দূর। ওরা দূরসম্পর্কের অইলেও ভাইবোন তো? দেখা হইলে মাঝে মাঝে একটু আলাপ সালাপ করে আর কি। ঐডা কিছু না। মানিক বড় ভালা ছেলে। ওঁর মনে খারাপ কিছু নাই। আর কয়দিন পরেই বিনুরে আমি মেজর সাবের সাথে বিয়া দিমু।” এই বলে তিনি সুফিয়াকে দু’হাতে জাপটে ধরে বিছানায় শুয়ে পরলেন। রাতে সুফিয়ার কাছে আসার আগে প্রতিদিনই তিনি যে টনিকটা খান, আজ বোধ হয় সেটা একটু বেশি খেয়ে ফেলেছিলেন।
তিন
আজ সারাটা দিন লতিফ মুন্সির প্রচুর ধকল গেছে। গতকাল তার দেওয়া লিস্ট অনুযায়ী আজ ভোঁর রাত থেকে মিলিটারিরা গ্রামের সব বাড়ী বাড়ী তল্লাশি করে যাঁদের পেয়েছে ধরে নিয়ে গেছে। মুন্সির বড়ই আনন্দ হচ্ছে। বাড়ী বাড়ী সব হাহাকার। বিচ্ছু গুলো আরো ধরা পড়লে ভালো হতো। বেশির ভাগই ধরা পরেনি। শালারা সব গেলো কোথায়?
মেজর সাহেব বোধহয় রাতে আবার হামলা দিবে। হামলা দিয়ে এবার সবকটাকে ধরুক। ধরা খেলে বুঝবে যুদ্ধ করার মজা। এক পাগল বললো যুদ্ধে নামতে আর সব গেলো পাগল হয়ে যুদ্ধ করতে।
পাকিস্তানের হর্তাকর্তারা কি সব গাধা নাকি যে চাইলেই দেশ ভাগ করে দিবে!
লতিফ মুন্সি মাগরিবের নামাজ পড়ে আজ বেশ বড়সড় মোনাজাত নিলেন। তিনি আল্লার কাছে খুব কান্নাকাটি করলেন, যুদ্ধ যাতে তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়। যতো দ্রুত শেষ হবে ততো দ্রুত তিনি বিনুর বিয়ে দিতে পারবেন। কে জানে বিনুর বিয়ে হয়ে গেলে তিনিও হয়তো আবার সুযোগ পাবেন। আরো দুইটা বিয়ে তার এখনো জায়েজ আছে! তার বহু দিনের ইচ্ছা আসল পাকিস্তানি পাঠান মেয়ে বিয়ে করার। এ কারণে তিনি তার নিজের বিয়ের কোঠা সব পূরণ করেন নি। চারটার মধ্যে দুটো করেছেন। বাকি দুটো আল্লাহ্ পাক চাইলে বিনুর বিয়ের পর পশ্চিম পাকিস্তানে করবেন। ওদিকের সব রমণীই অতি সুন্দর। কে জানে তাঁর ভাগ্য ভালো থাকলে অবিবাহিত বিয়াইনও কিছু পেয়ে যেতে পারেন।
মোনাজাত শেষ করে তিনি আয়নার সামনে গিয়ে যত্ন করে চোখে সুরমা দিলেন। তারপর নিজের চেহেরার দিকে তাকিয়ে মনে মনে নিজের খুব প্রশংসা করলেন। এখনও বেশ শক্তপোক্ত আছেন। চোখে সুরমা দিলেতো আর কথাই নেই। চেহারা একেবারে নূরানি হয়ে ফুটে উঠে।
এমন সময় দেলু ছোকরাটা এসে তার ভাবের ব্যাঘাত ঘাটালো। এই হারামিটা সবসময়েই অসময়ে এসে আবোল তাবোল খবর দেয়। তিনি বেশ বিরক্ত হয়ে বললেন, এই সময়ে তই আখানে কেন? কি হইছে জলদি কইয়া তাড়াতাড়ি বের হ্ নাপাক কোনহানকা!
দেলু ভয়ে ভয়ে বললো, হুজুর বাইরে এক মিলিটারি আইছে। মনে অয় আপনারে তৈরি অইয়া হের লগে যাইতে কইতাছে।
লতিফ মুন্সি বাইরে বের হয়ে মিলিটারি সৈন্যর কাছে শুনে যা বুঝলেন তা হলো, হঠাৎ মেজর সাহেব ক্যাম্পে এক জরুরি মিটিং ডেকেছে। তারও মিটিং এ থাকতে হবে।
মুন্সি তৈরিই ছিলেন, তাই দেরি না করে সাথে সাথে রওনা হলেন।
চার
বিনু সারাদিন খুব ভয়ে ভয়ে কাটাছিলো। সে জানে মানিক নিরাপদেই আছে। লিস্টের কোথাও তার নাম নাই। কিন্তু মানিক আজ দেখা করতে এলো না কেন? তাছাড়া আব্বা আবার এই রাইতে আর্মি ক্যাম্পে গেলো কেন? খুব অশুভ কিছু হচ্ছে না তো? বিনুর খুব ভয় ভয় করতে লাগলো। সে অস্থির হয়ে ছটফট করলো কিছুক্ষণ। তারপর দিশা না পেয়ে সে তার ছোট ভাই কামালকে বললো এক দৌড়ে মানিকদের বাড়ী গিয়ে মানিকের খোঁজ নিয়ে আসতে। মানিককে বাড়িতে না পাওয়া গেলে মানিকের বোনকে যেন বলে যত রাতই হোক মানিক যেন বিনুর সাথে দেখা করে।
লতিফ মুন্সি ক্যাম্পের ভিতর ঢুকার সময় দেখলেন, গ্রামের অনেক গুলো জওয়ান ছেলেকে চোখ হাত বেঁধে কেম্প লাগোয়া পুকুরের পাড়ে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। তিনি ভিতরে ঢুকতেই মেজর জাকির হোসেন তার অস্থির পায়চারী থামালেন। তার হাতে সেই লিস্ট।
তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এ ক্যায়া হ্যাঁয়, ইস্মেতো আস্লি গাদ্দারকা নামহি নেহি হ্যাঁয়। আপকা ভাঞ্জা মানিকহি সাবছে বাড়া গাদ্দার। ওর্ জিস জিসিকা নাম ইস লিস্টমে হ্যাঁয়, ঊনকভি পেহেলেসে ক্যায়সে পাতা চাল গিয়া? সাব শালে ভাগ গিয়া, ক্যায়সে? আস্লি মুক্তি কাঁহা হ্যাঁয়?
মুন্সি হতভম্ব হয়ে গেলেন একথা শুনে। তিনি কাতর স্বরে বললেন স্যার কোথাও ভুল হয়েছে। মানিকতো কখনো এসব করে বলে খবর পাইনি।
এমন সময় এক মিলিটারি ভিতরে ঢুকে উর্দুতে বললো, মানিককে পাওয়া গিয়েছে। এই মাত্র সরকারি হাসপাতালের পিছনে এক ভাঙ্গা বাড়ির সামনে থেকে মানিককে ধরে আনা হয়েছে। সাথে আরো দুই জন। ওরা সন্দেহজনক ভাবে চলাফেরা করছিলো। সার্চ করে ওদের কাছে হ্যান্ড গ্রেনেড পাওয়া গেছে। তবে সবইকে ধরা যায়নি। অন্ধকারে পালিয়েছে।
লতিফ মুন্সি দৌড়ে গেলেন বাইরে। সেই পুকুরের পাড়েই মানিক ও আর দুই জন অন্যদের সাথে মাথার পিছনে হাত রেখে দাড়িয়ে আছে। ওদের সবারই হাত পা বাঁধা। মানিকের মাথার পিছনে রক্ত জমাট বেঁধে আছে। মুন্সির বিশ্বাস হচ্ছিলো না মানিক এই কাজ করতে পারে বলে। সে তো তার সামনে মুক্তিদের সবসময় গালিগালাজ করতো। এখন তার আদরের ভাগিনার এই অবস্তা দেখে তার খুব কষ্ট হলো। কে জানে একটু পরেই হয়তো ও মরবে। কোন ভাবেই কি এই হারামজাদাকে বাঁচানো যায়না? তিনি তার দুই সাঙ্গপাঙ্গকে দেখলেন একটু দূরে দাড়িয়ে তারা কথা বলছে। তাদেরকে ডেকে খানিকক্ষণ আলাপ করলেন কি করা যায় এ নিয়ে। এই ঘটনায় ওরাও হতবম্ব।
মুন্সি তখন শেষ চেষ্টা করার জন্য আবার ছুটলেন মেজর সাহেবের রুমের দিকে।
পাঁচ
কামাল মানিকের বাড়ী পৌঁছার আগেই খবর পেলো মানিককে মিলিটারি ধরে ফেলেছে। চারদিক সব থমথম করছে। কখন কোথা থেকে কি হয় কিছু বলা যায় না। তবে মুক্তিবাহিনীর চিহ্নিত বেশীরভাগ সদস্যই ধরা পড়েনি।
বাড়িতে ফিরে এসে কামাল বিনুকে এই খবর দিতেই বিনু প্রায় পাগল হয়ে গেলো। সে মানিককে ছাড়া এক মুহূর্তও বাঁচবে না। যেভাবেই হোক মানিককে বাঁচাতে হবে। ওদের হাইস্কুলেই যে মিলিটারিরা ক্যাম্প করেছে সেটা বিনু জানে। তাই সে পারিপার্শ্বিক কোন চিন্তাভাবনা না করেই অন্ধকারে দরজা খুলে ছুটলো। যত দ্রুত সম্ভব তাকে মিলিটারি কাম্পে পৌঁছতে হবে। মানিকের কিছু হওয়ার আগেই। যেভাবেই হোক ঐ মেজরের সাথে দেখা করতে পারলে হয়তো একটা কিছু করা যাবে। প্রয়োজনে ও পায়ে পড়বে। তাছাড়া ওর আব্বাওতো ওখানেই গেছে ঘণ্টা দুয়েক আগে। বিনু উন্মাদের মতো দৌড়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্যাম্পের কাছাকাছি চলে এলো। কিন্তু মিলিটারি ক্যাম্পের সামনে দিয়ে ভিতরে ঢুকার সাহস ও পেলো না।
সামনের দিকে আজ এতো রাতেও অনেক ভিড়। অনেক সৈন্য অস্ত্র হাতে নিয়ে দাড়িয়ে আছে। বিনু ক্যাম্পের পিছনের দিকে চলে গেলো। পিছনের গেইটের সামনে তিনজন মিলিটারি দাড়িয়ে আছে। কাছে যেতেই ওকে দেখতে পেয়ে মিলিটারি তিনজন সতর্ক হয়ে গেলো। ওদের চোখে লোভী দৃষ্টি। এতো সুন্দরী একজন মেয়ে এখানে এতো রাতে একা কেন এসেছে সেটা ওঁরা বুজতে পারছিলো না। ওদের একজনকে বিনু চিনতে পারলো। সেদিন সকালে ও মেজর জাকিরের সাথে ওদের বাসায় গিয়েছিলো। সেও বিনুকে চিনতে পেরে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ক্যায়া বাত?
বিনু বাংলায় কোন রকমে বোঝালো যে মেজর জাকিরের সাথে সে দেখা করতে চায়। সৈন্যটি কি চিন্তা করে ওকে দাঁড় করিয়ে রেখে ভিতরে গেলো। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে বললো, চলিয়ে।
মেজর জাকির তখন পান করতে বসেছিলেন। শেষপর্যন্ত যে কয়েকটা আসল মুক্তিকে ধরা গেছে এটাও কম কথা নয়। এই আনন্দে পান না করলে চলে না!
দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকার সময় বিনু কোথাও তার আব্বাকে দেখতে পাচ্ছিলো না। একথা সৈন্যটিকে জিজ্ঞাস করতে সে বললো ‘মালুম নেহি’। বিনু ভাবলো মনে হয় মেজর সাহেবের ওখানেই পাওয়া যাবে। তাই সে দ্রুত পা ফেলে ভিতরে ঢুকলো।
যেই বিল্ডিংয়ে বিনু ঢুকলো সেটা ও চিনে। এটাতে আগে হেড মাষ্টার থাকতো। পিছন দিক এটা। ভিতরে ঢুকার আগে ওর একটুও খেয়াল হলোনা তার পরনের শাড়ির কথা। উদ্ভ্রান্তের মতো দৌড়ে এসেছিলো বলে তার পরনের শাড়ি একেবারে আলুথালু হয়ে আছে। সে বারান্দা দিয়ে ভিতরে ঢুকে করিডোর পেরিয়ে বসার ঘরে গেলো। বসার ঘরের ভিতরে শুধু মেজরকে দেখতে পেলো। সোফায় বসে আছে মদের গ্লাস হাতে। তার আব্বা লতিফ মুন্সি ওখানে নেই।
এতক্ষণে বোধহয় বিনুর খেয়াল হলো তার বেশভূষার কথা। বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে সে তার সুতি শাড়ির আঁচলটা বুকের উপর দিয়ে নিয়ে শক্ত করে কোমরের পিছনে গুঁজে দিয়েছিলো। এখন সেটা খুলে গিয়ে তার বুকের উপর থেকে সরে একপাশে গড়াগড়ি খাচ্ছে। পাগলের মতো দৌড়ে আসার কারণে ঘামে তার ব্লাউজ একেবারে ভিজে গিয়ে চপচপ করছে।
বিনু কথা বলতে গিয়ে পারলো না। তার গলার ভিতরতা একেবারে শুকিয়ে গেছে। জোড়ে জোড়ে নিঃশ্বাস ফেলার কারণে তার সুগঠিত আকর্ষণীয় বুক দুটো নিঃশ্বাসের সাথে সাথে ফুলে ফুলে উঠছে। সুতি কাপরের ভিজা ব্লাউজটা যেনো বুকের প্রতিটি খাঁজে গিয়ে আটকে আছে। আর সেই ভিজা ব্লাউজের কারণে সে দুটো একেবারে স্পষ্ট হয়ে তার ভরা যৌবনকে উগলে দিচ্ছে। অন্য সময় হলে যে কেউ তাকে এ অবস্থায় দেখে পূর্ণ যৌবনা ভেনাসের জীবন্ত মূর্তির সাথে তুলনা দিতো। কিন্তু নেশাগ্রস্থ মেজর জাকিরের চোখ দুটো বিনুকে এক নজর দেখেই যেনো ধপ করে জ্বলে উঠলো।
ছয়
ওদিকে কামালের কথা শুনেই বিনু যখন দৌড় দিয়েছিলো, তখন কামালও তার পিছনে পিছনে দৌড় দেয়। কিন্তু খানিক পরেই সে বিনুকে হারিয়ে ফেলে। কামাল তারপর মিলিটারি ক্যাম্পে গিয়ে তার আব্বার নাম বলতেই একজন দূর থেকে দেখিয়ে দিলো। লতিফ মুন্সিকে সবাই ভালো করেই চিনে।
কামাল দেখলো তার আব্বা তখন কয়েকজন মিলিটারির সাথে কথা বলছে। ওদিকে পুকুর পাড়ে দশ বার জন লোক দাড়িয়ে আছে। মন হচ্ছে মুক্তিবাহিনীর লোক। দূর থেকে একজনের শরীর দেখেই কামাল চিনতে পারলো সেটা ওর মানিক ভাই। কামালের দুচোখ ভিজে গেলো মানিককে দেখে।
কামাল যখন তার আব্বাকে গিয়ে বিনুর কথা বললো তখন লতিফ মুন্সি যেনো কিছু বুঝতে পারছিলো না। একের পর এক নানা ঘটনার কারণে লতিফ মুন্সি একেবারে দিশেহারা হয়ে গেলেন। বিনুতো এখানেও আসেনি। তিনিতো সেই সন্ধ্যে থেকে এখানেই দাড়িয়ে আছেন। বিনু মিলিটারি ক্যাম্পে এলেতো তিনি অবশ্যই তাকে দেখতে পেতেন। তাহলে সে গেলো কোথায়?
তিনি কোন কুল কিনারা না পেয়ে আবার মেজর সাহেবের রুমের দিকে গেলেন। কিন্তু দরজার সামনে পাঞ্জাবী মিলিটারিগুলো তাকে বাঁধা দিলো আবার। মেজর এখন কারো সাথে দেখা করবেন না। একান্তে শূরা পান করছেন। তখনো মানিকের ব্যাপারে সুপারিশ করার জন্য তিনি মেজর সাহেবের ঘরে যেতে চাইলে এই শালারা বাঁধা দিয়ে একই কথা বলেছিল। কই অন্যদিনতো শূরা পান করার সময় তিনি এসে দেখা করার কথা বললে বাঁধা দেয় না। বরং ভিতরে গেলে মেজর জাকির উলটো তাঁকে শূরার পাত্র হাতে সঙ্গ দিতে বলে। একবার চুমুক দিয়ে স্বাদ চেখে দেখতে বলে। কিন্তু যাকে মেয়ের জামাই বানাবেন তার সাথেতো আর শূরার পাত্র হাতে বশা যায় না।
তিনি কামালকে বাড়ি চলে যেতে বলে বাইরে অস্থির ভাবে পায়চারী করতে লাগলেন। খানিকক্ষণ পরে মেজর জাকির দরজা খুলে টলতে টলতে বেড়িয়ে এলো। বোঝাই যাচ্ছে খুব নেশা করেছে আজ। চোখে মুখে তার পরিপূর্ণ তৃপ্তির রেষ। সামনে লতিফ মুন্সিকে দেখেই তিনি একটু থমকে দাঁড়ালেন। তারপর বললেন, বহুত আচ্ছা! বহুত আচ্ছা।
লতিফ মুন্সি কিছু বুঝলো না কি এমন আচ্ছা করেছে সে এর মধ্যে! তবে তিনি সামনে যেতেই মেজর জাকির বললো, ক্যায়া বাত, ইত্না পেরেশান কিউ? আভিতো খুশ রেহেনা চাহিয়ে। থোড়া দের বাদ ফায়ার চলেগি, মুক্তি খতম!
তিনি পুকুর পাঁড়ের দিকে গিয়ে নিশানা করতে বললে সারিবদ্ধ মিলিটারি জোয়ানরা এক কাতারে দাড়িয়ে বন্দুক উঁচিয়ে ধরলো। সামনে তখন মুক্তি বাহিনীর ছেলেগুলো দাড়িয়ে একের পর এক।
ফায়ার বলার সাথে সাথে বন্দুকগুলো সব একশাথে গর্জে উঠলো। মানিক একটু সামনের দিকে ছিলো। ফায়ার শুনার মুহুর্তেই সে পুকুরে ঝাঁপ দিয়েছিলো। তাই গুলি তার পাশ কেতে বেড়িয়ে গেলো। তারমতো আরো কয়েকজন ঠিক সময়ে ঝাঁপ দেওয়াতে তাঁদেরও গুলি লাগেনি।
আবার গুলি ছোড়ার আগেই হঠাৎ ক্যাম্পের চারিদিকে বিকট শব্দে বোমা ফাটতে লাগলো। একের পর এক। ডানে বায়ে সবদিকে।
সাত
মুক্তিবাহিনী আক্রমন করেছে। চারিদিক থেকে ঘিরে ধরেছে ক্যাম্প।
মেজর তখন ঘটনার আকস্মিকতায় দিশেহারা হয়ে তার রুমের দিকে দৌড় দিলো। মিলিটারিরা সব নিজ নিজ পজিশন নিয়ে গুলি ছুড়ছে। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর এই আচমকিত গোরিলা হামলায় পেরে উঠছে না তারা।
লতিফ মুন্সিও দৌড়ে মেজরের পিছনে পিছনে আসতেই দরজার সামনে এক মিলিটারি ছুটে এসে বললো, স্যার ওঁ লাড়কি ফাঁস লাগাকে মর গিয়া।
মেজর জাকির খেঁকিয়ে উঠে বললো, শাট আপ। গো টু ইউর পজিশন। এই বলে ভিতরে ঢুকে গেলো।
আতঙ্কিত লতিফ মুন্সিও তার পিছু পিছু গিয়ে ভিতরে ঢুকল। মেজর জাকির সামনের বসার ঘর পেরিয়ে সরাসরি তার শোবার ঘরে ঢুকে গেলো। লতিফ মুন্সি আগে কখনো ভিতরের ঘরে যায়নি। কিন্তু আজ তিনি মেজরের পিছু পিছু তার শোবার ঘরের সামনে চলে গেলেন। কিন্তু ভিতরে ঢুকার আগেই মেজর ঘর থেকে বেড়িয়ে এসে দরজা আগলে দাড়িয়ে রইলো। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম।
লতিফ মুন্সির মন্তা কেমন কুঁ গাইতে লাগলো। হঠাৎ তার মনে হচ্ছে তার পাপের বোঝা খুব ভারী হয়ে গেছে। সে আচমকা ধাক্কা দিয়ে মেজরকে ফেলে দিয়ে রুমের ভিতর ঢুকে গেলো। যা দেখলো তাতে তার সমস্ত শরীরের প্রতিটি রক্ত কনা একেবারে জমাট বেঁধে হিম হয়ে গেলো।
পরনের শাড়িটা গলায় পেঁচিয়ে ফ্যানের সাথে ঝুলছে বিনু। তার পাপ গুলো যেনো সব বিনুর শাড়ির সাথে পেঁচিয়ে গেছে। এখন সেটা এক বিশালাকৃতির সাপ হয়ে ফেনা তুলে আছে তার দিকে। এক্ষণই ছোবল দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করবে তার।
হঠাৎ লতিফ মুন্সির শরীরের রক্ত টগবগ করে ফুটতে লাগলো। তার শিরা উপশিরা বেয়ে সে রক্ত একেবারে মাথায় পৌঁছে গেলো। শুয়োরের বাচ্চা, এইটা তুই কি করলি বলে একাটা হুঙ্কার দিয়ে তিনি মেজর জাকিরের গলা টিপে ধরলেন।
কিন্তু বেশিক্ষণ পারলেন না। মেজর জাকির বোধহয় প্রস্তুতই ছিলো। সে কোমরের বেল্ট থেকে কোনরকমে তার পিস্তলটা বের করে মুন্সির কার বরাবর তুলেই ট্রিগার টিপে দিলো।
লতিফ মুন্সি সাথে সাথে তার জীবনের সমস্ত পাপ সাথে নিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো।
মেজর জাকির তখন চিৎকার করে বাইরে ডিউটিতে থাকা সৈন্যদের নাম ধরে ডাকতে লাগলো। কিন্তু কেউ কোন সাড়া দিলো না।
ওদিকে মুক্তিবাহিনীরা একে একে মিলিটারি ক্যাম্পের সব কিছু দখল করে নিয়েছে। এবার তারা মেজরের বাংলোকে ঘিরে এগিয়ে আসতে লাগলো।
১৯ জানুয়ারী - ২০১১
গল্প/কবিতা:
৭ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪