নিষ্পাপের যুদ্ধ জয় অথবা একান্তে বিল্পব

স্বাধীনতা (মার্চ ২০১১)

মাহাফুজ হক
  • ৪৮
এক
শোন হাসিনা, তোর পোলায় যেন রাইত বিরাইতে কান্দা কান্দি না করে। গত রাইতে ইছাপুরে নাকি হারামিরা আইছিলো। কে জানে কখন এই গ্রামেও ধুইক্কা যায়। তোর এক পোলার লইজ্ঞা আমরা সবতে মরতে পারমু না।
কাকা আমি কি করমু কন। বুকে দুধ নাই। পোলাডা না খাইতে পাইরা কাইন্দা ওডে। তহন তো আর কিছুতেই থামান যায় না।
না গেলে গলায় টিপ দে। আমরা সবতে মরমু নি।
শেষের কথাটা শুনে আমি শিউরে উঠেছিলাম। পেটে ক্ষুধা ছিল। আমি কান্না করতেও ভুলে গেলাম।
কাকার কথা শুনে।
কাকা কি মানুষ না অমানুষ।।
আমাকে নিয়ে হাসিনা নামের মেয়েটি ঘরটার কোনায় চলে গেলো। আমাকে মাটির ওপরেই রাখলো। একটা ছেড়া কাঁথার উপরে আমি এতক্ষণ ছিলাম।ঘার ঘুরিয়ে দেখলাম হাসিনা সেতা ঝাড়া দিয়ে তারপর ভাঁজ করে আমার নিচে সযত্নে দিলো। তারপর আমার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।
হাসিনা নামের মেয়েটি ঘর থেকে চলে যাওয়ার পরই আমার খুব ভয় ভয় করছিলো। আমার যখন প্রথম চোখ ফুটলো, তক্ষনি আমি হাসিনাকে আমার মুখের সামনে দেখতে পেয়েছিলাম। আমি অবশ্য তখন নাম জানতাম না। শুধু গলার আওয়াজ শুনে চিনতে পেরেছিলাম। বুঝতে পেরেছিলাম, ওর অন্ধকার গহ্বরেই আমি পরিণত হয়েছি। জন্ম হয়েছে আমার। একটু একটু করে।
আমার বয়স এখন সাত মাস। হাসিনা মাঝেমাঝেই অন্যদের একথা বলে। আমি বুঝি না দিন-মাস এসব কি? তবে অনেকেই দেখি তখন আমাকে কোলে নিয়ে খুব আহল্লাদি করে।
“কি সুন্দর দেখতে তো পোলাডা! বাহ, আমার দিকে কেমনে তাকাইয়া আছে! দেখ, দ্যাখ।” আশেপাশের অন্যরাও তখন আমার মুখের সামনে এসে ঝুঁকে কি যেন দেখে।
বাহ! আসলেইতো। দেখছো কি পাকনা! যেনো সব বুঝতাছে।
মাশাল্লাহ। চোখগুলা খুব বড় বড় তো।
সবগুলো মুখ আমার দিকে তাকিয়ে একসাথে বলে উঠে। আমার খুব মজা লাগে তখন। আমি ফিক করে একটু হেসে দেই!
তখন হয়তো সেটা দেখে কেউ বলে, দেখ দ্যাখ মুখের ভিতর দুইটা দাঁত।
কি সুন্দর, কি সুন্দর। ছোট পোলাপান কেউ আশেপাশে থাকলে হাততালি দেয়। আমার তখন খুব মজা লাগে।
বড় মানুষরা তখন ছোটদের বলে, বুঝলি এইগুলা হইলো দুধ দাঁত। এইগুলা একটু বড় অইলেই পইড়া যাইব। বুঝছস।
দুধ দাঁতের কথা কানে যেতেই আমার আবার খিদে লেগে গেলো। হাসিনাকে আশেপাশে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। খুব জোড়েজোড়ে তাঁকে ডাকতে মন চাচ্ছে। আমি মুখ খুলে চিৎকার করলাম আমার খুব খিদে পেয়েছে বলে। কিন্তু খাম খাম বলে মুখ দিয়ে শুধু দুইবার আওয়াজ বেরুলো।
একটু পরেই দেখি হাসিনা দৌড়ে এলো। তার হাতে একটা পেয়ালা। ওটাতে সাদা সাদা আঠালো কি যেনো। মনে হচ্ছে জাউ।
ওগুলো খেতে আমার একটুও ভাললাগে না। আগে মনে হয় কিছু দিতো তাই মিষ্টি মিষ্টি লাগতো। এখন একেবারে বিস্বাদ। কিন্তু কি আর করা। কান্না করা যাবে না। কান্না করলে হয়তো হাসিনা আমাকে চুষনি দিতো। ওটা চুষতেও অনেক মজা। কিন্তু ঐ কাকার কথা মনে পড়ে গেলো। আমি ভয়ে কান্না করার কথা ভুলে গেলাম।
দুই
কিছুদিন আগেও আমি অন্যখানে ছিলাম। শুধু হাসিনা আর সালাম নামের একটা লোকের সাথে। সালামকে আমি শুধু সকালে আর রাতে দেখতাম। দিনের বেলা যখন সজাগ থাকতাম, তখন কোথাও খুঁজে পেতাম না তাঁকে।
আমাকে খুব আদর করতো সালাম। আমার সামনে এলেই দেখতাম আমাকে সে দু’হাতে কোলে তুলে নিতো। আর বাবা বাবা করে শুধু মুখে ও কপালে চুমু দিতো।
মাঝে মাঝে হাসিনাকে বলতো, দেহো দেহো, পোলা ঠিক আমার মতো অইছে।
হাসিনা তখন মজা করে বলতো, তোমার পোলা কি তয় বান্দরের মতো হইবো! বলেই হেসে গড়াগড়ি খেতো। আমার তখন খুব ভালো লাগতো।
কিন্তু কিছুদিন পরেই সালামকে বলতে শুনতাম শুধু যুদ্ধের কথা। দেশ নাকি স্বাধীন হবে। মুজিব নাকি স্বাধীনতা যুদ্ধের ডাক দিয়েছে। হাসিনা তখন অনেক কেঁদেছিলো। কিন্তু তারপর থেকে হঠাৎ সালাম উধাও হয়ে গেলো। তাঁকে আর দেখি না।
প্রথম প্রথম সালামকে দেখি না বলে আমার খুব খারাপ লাগতো। যাওয়ার আগে সে হাসিনাকে বলে গিয়েছিলো, পোলাডারে দেইখা রাইখো।
হাসিনা তখন কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলো, আমারে কে দেখবো। তুমি গেলেগা আমি কেমনে থাকমু।
সালাম বলেছিলো, তোমারে আল্লায় দেখবো, আল্লায় সবাইরে দেহে।
হাসিনা আর কথা বলেনি। উন্মাদের মতো বসে পড়েছিলো দরজার সামনে আমাকে কোলে নিয়ে। আমি বুঝি না হাসিনা এমন করেছিলো কেন! তার চোখ দিয়ে শুধু পানি পরছিলো। বুকের কাপড় খসে পড়েছিলো।
আমার তখন পেট জ্বলছে। খিদে পেয়েছে। আমার মুখের সামনে স্তন কিন্তু হাসিনা কেন আমায় দুধ দিচ্ছে না।
আমি ছটফট করছিলাম স্তনে মুখ দিতে। প্রাণপণ চেষ্টা করছিলাম বুকে মুখ ঘষে। কিন্তু পারছিলাম না। তাই জোড়ে জোড়ে কাঁদতে শুরু করেছিলাম।
তিন
কিছুদিন পড়ে একদিন রাতের বেলায় হাসিনা আমাকে কোলে নিয়ে পাগলের মতো বন বাদর দিয়ে দৌড়ে যেতে লাগলো। আমি বুঝতে পারছিলাম না কি হচ্ছে। কিছু দিন ধরে মাঝে মাঝেই রাতে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেলে শুনতাম দরজায় কারা যেনো টোকা দিচ্ছে। হাসিনা হাসিনা বলে ফিসফিস করে ডাকছে।
হাসিনাকে দেখতাম ভয়ে তখন কাঁটা হয়ে যেতো। কুপির আলো নিভিয়ে দিয়ে আমাকে দু’হাতে বুকে আঁকড়ে ধরতো। আমার তখন খুব ভয় করতো কিন্তু বুঝতে পারতাম না হাসিনা এমন করছে কেনো? ওটা কার গলা। ওটাতো সালামের গলা না।
তারপর থেকে আমি এখানে। হাসিনার সাথে। কাকার বাসায়।
এখানে অনেক লোক। মাঝে মাঝেই নতুন নতুন মুখ দেখি। নানা গলার আওয়াজ শুনি। আমার ভাল্লাগেনা। এতো মানুষের ভিড়ে আমার অস্বস্তি হয়। ভয় ভয় করে। ইদানিং হাসিনার স্তনে চুমুক দিলে দুধ পাই না।
মাঝে মাঝে শুনি কাকা হাসিনাকে ডেকে বলে, যা আইজকা তুই পাক ঘরে যা কালুর মার লগে। হাসিনা তখন আমাকে এক কোনায় কাথা চাঁপা দিয়ে অন্য মেয়েদের সাথে রান্না ঘরে যায়।
মেয়েরা ফিসফিস করে তাঁদের নিজ নিজ ছেলেমেয়েদের সাবধান করে বলে, এইগুলা মুক্তিগো রান্না। কেউ কিন্তু ভুলেও ঐ খাওনে হাত দেইস না। কাহার কানে গেলে খারাবি আছে। আমাগো খাওন পরে রানবো।
আমি তখন ফ্যালফ্যাল করে উপরের দিকে তাকিয়ে থাকি। হাত পা ছুড়ে শূন্যে সাইকেল খেলি।
কাকা আমার কথা বলে না কেনো? আমার কি খিদা লাগে না।
প্রথম প্রথম কাকা আমার খওয়ার খোঁজ নিতো হাসিনার কাছে। তখন আমি শুধু একলা ছিলাম। এখন আমার মতো আরো কয়েকটা পোলাপাইন আছে এখানে। তাই মনে হয় কাকা আমার খোঁজ আর রাখে না। আমার খুব খারাপ লাগে।
ইদানিং মাঝে মাঝে রাতে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়।
কোথায় যেনো গুম গুম শব্দ শুনি। তখন সবাই বলে মুক্তি আর মিলিটারিরা নাকি দূরে কোথাও যুদ্ধ করছে।
যুদ্ধ জিনিসটা কি আমি বুঝি না। শুনলে আমার শুধু বমি আসে!
তবে আমি এইটা বুঝি, এই যুদ্ধের জন্যই আমার আজ এতো কষ্ট।
এই যুদ্ধের জন্যই আজ সবার এতো কষ্ট।
হাসিনার কষ্ট। সালামের কষ্ট। কাকার কষ্ট।
আমার মতো আরো লক্ষ শিশুর কষ্ট। আমি এখন কষ্ট জিনিসটা বুঝতে শিখেছি।
চার
অনেক দিন পর আজ হাসিনার মুখে হাসি দেখলাম।
গভীর রাতে সালাম এসেছিলো। আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। হাসিনা মনে হয় আমাকে কোলে নিয়ে অন্ধকারে কল পাড়ে এসেছিলো।
আমার ঘুম ভাঙ্গলো সালামের চোখের পানি আমার কপালে পড়াতে। চোখ খুলতেই দেখি সালাম আমাকে দু’হাতে বুকে জড়িয়ে ধরে মুখে চুমু খাচ্ছে।
আমার খুব ভাল্লাগলো। আমি আনন্দে ছটফট করে উঠলাম।
সালাম হাসিনাকে বললো, আমার সোনা মাণিকটা শুঁকাইয়া যাইতাছে হাসিনা। তুমিও অনেক শুঁকাইয়া কালা হইয়া গেছো। আর মাত্র কয়দিন। তুমি আমারে নিয়া বেশি চিন্তা কইরো না। ইনশাআল্লাহ্‌, দেশ স্বাধীন অইতে আর বেশি দেরি নাই। ওই শুয়োরের বাচ্চাগো এরপর কুত্তার মতো তাড়ামু এই দেশ থাইক্কা।
হাসিনার মুখটা মনে হয় অন্ধকারেই আনন্দে ভরে উঠলো। আদরের স্বরে বললো। হ, আমরা সবতে আল্লার কাছে তাই চাই। তয় পোলাডার সামনে আর মুখ খারাপ কইরো না।
আমি বুঝতে পারছিলাম না ওঁরা কি বলছে। তবে হঠাৎ শুনলাম কল পাঁড়ের উল্টো দিক থেকে কেউ একজন কথা বলে উঠলো। বললো, সালাম আর দেরি করন যাইব না, তাড়াতাড়ি বিদাই লও। সূর্য উইঠা যাইবো।
সালাম তখন এক হাতেই আমাকে কোলে নিয়ে আরেক হাতে হাসিনাকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর আমাকে হাসিনার কোলে ফিরিয়ে দিয়ে গায়ের চাদরটা ভালকরে পেঁচিয়ে নিয়ে কল পাঁড়ের পিছনের অন্ধকারে উধও হয়ে গেলো।
আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম এর পরেই সূর্য উঠবে!
হাসিনা পাথরের মতো দাড়িয়ে রইলো আমাকে কোলে নিয়ে। আমার আর অন্ধকারে ভালো লাগছিলো না। চারিদিকে শুধু মশা আর মশা। দূরে মাঝে মাঝে অন্ধকারে হঠাৎ হঠাৎ ছোট ছোট আলো দেখা যাচ্ছে। ভেসে ভেসে জ্বলছে আর নিভছে।
আমি ভয় পেয়ে কান্না করতে যাচ্ছিলাম। একটু আওয়াজ হতেই মনে হয় হাসিনার হুঁস ফিরলো। আমার নিয়ে তারপর দ্রুত ঘরে চলে এলো।
পাঁচ
ওহ! কি দুর্গন্ধ। এ কোথায় আসেছে হাসিনা আমাকে নিয়ে। চারিদিকে শুধু অসহ্য ময়লার গন্ধ। মনে হয় পিছনে কোন মজা পুকুর আছে।
একটা মুলি বাঁশের ভাঙ্গা ঘর। ওপরে ছনের চালের অনেক জায়গার ছন সরে গেছে। তাই জায়গায় জায়গায় ফাঁকা হয়ে আছে। সে দিক দিয়ে পরিষ্কার আকাশ দেখা যাচ্ছে। এই ঘরটা মনে হয় আগে গোয়াল ঘর ছিলো।
গতকাল রাতে ঘুমানোর পর আজ সকালে চোখ মেলে দেখি আমি এই ঘরে। শুধু যে আমরাই এখানে, তা না। কাকার বাসায় যে মানুষগুলো ছিলো, সেই পরিচিত মুখগুলোর অনেকেই আছে। তাছাড়া আরো অনেক মানুষ।
নরকের মতো এই ঘরটায় অসংখ্য মানুষ গিজগিজ করছে। গায়ে গা ঘেঁষে, পায়ে পা লাগিয়ে। সবারই ছন্নছাড়া অবস্থা।
আমার কানে আসছিলো এই সব নানা মানুষের ফিসফিস কথা। সবাই একই কথা বলছিলো। মিলিটারি এসেছিলো গতকাল। এই গ্রামে। অনেকেই পালিয়েছে গ্রাম থেকে। যে যেখানে পেরেছে। অনেকে পালাতে পারেনি। হাসিনা আমাকে নিয়ে অন্যদের পিছু পিছু এখানে এসে লুকোতে পেরেছিলো। কিন্তু কাকা পারেনি।
কেউ কেউ অবশ্য বলাবলি করছিলো হয়তো কাকা নিজেই পালাতে চায়নি। নিজের ঘর ছেড়ে তিনি কোথায় পালাবেন? কেন পালাবেন? তাই পালায়নি। মিলিটারিরা নাকি খবর পেয়ে গিয়েছিলো যে কাকা লোকটি মুক্তিবাহিনীদের নানা ভাবে সাহায্য সহযোগিতা করছে।
তারা কাকাকে তোষকের তুলো ধুনো করার মতো করে মেরেছে। কাকার বউ ও মেয়েসহ যে সব মেয়েদের পেয়েছে, ধরে নিয়ে গেছে।
বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে। আরো কত কি!
আমার পেটে খিদে। এ সব শুনতে আমার আর ভালো লাগছে না। হাসিনা আমাকে গতকাল রাত থেকে আর কিছু খাওয়ায়নি। আমি ছটফট করছিলাম। তাই দেখে হয়তো হাসিনা তার পাশে রাখা একটা ভাঙ্গা গ্লাস থেকে তার শাড়ির আঁচল ভিজিয়ে আমার মুখে ফোঁটায় ফোঁটায় পানি দিলো।
পানিতে বিশ্রী গন্ধ। কিন্তু আমি সেই গন্ধযুক্ত পানিই জিব দিয়ে চুকচুক করে খেলাম।
মাঝে মাঝে খিদের জ্বালায় কান্না করলেই হাসিনা আমাকে নানা ভাবে শান্ত করার চেষ্টা করে। বুকের কাছে নিয়ে আঁচল দিয়ে ঢেকে তার স্তনের বোঁটা জোড় করে আমার মুখে পুরে দেয়।
আমি কিছুক্ষণ জোঁকের মতো সেটা চুষতে থাকি। কিন্তু সেখানে কিছুই পাই না। রবারের মতো ওই বোঁটা আমার আর ভাল্লাগে না। ওখানে আর এক ফোঁটাও দুধ অবশিষ্ট নেই।
কে যেনো বললো, আহা, পোলাডা কষ্ট পাইতাছে। কিলো বেটি, মাই দেস না ক্যা, তোর মাইয়ে কি দুধ নাই লো!
হাসিনা কিছু বলে না। গভীর ভাবে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে আঁকড়ে রাখে। তার চোখে শুধু পানি। সেই পানি দু’চোখ জুড়ে ছলছল করে উঠে।
একসময় সূর্যের আলো উধাও হয়ে গেলো। সন্ধ্যা হতেই যেনো নরক নেমে এলো মাটিতে।
চারিদিকে শুধু ঠা ঠা আর গুম গুম শব্দ। যুদ্ধ আবার শুরু হয়ে গেছে।
কে যেনো ফিসফিস করে বললো, মুক্তিবাহিনী আক্রমণ করেছে শয়তানের উপর। পাশের বৃদ্ধ ধমক দিলো আস্তে করে। চুপ কর ছেমড়া। আর কথা কইস না। কেউ কোন কতা কইবা না। রাজাকার শুয়োরের বাচ্চারা আশেপাশেই আছে। ওঁরা শকুনের মতো ঘুরতাছে। একটু আওয়াজ পাইলেই এইহানে বোমা মারবো।
আমি শুনছিলাম আর মাথা ঘুরিয়ে আশেপাশে দেখার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু কিছুই দেখা যাচ্ছে না।
শুধুই অন্ধকার। ঘরের ভিতর রাত নেমেছে! নিস্তব্ধ, নিঃশব্দ এক ভয়ঙ্কর রাত।
আমি মনে হয় এক সময় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ক্ষুধায় আমার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। হাসিনা আমায় সেই ভাবেই কোলে নিয়ে বসে আছে। কি করবে আর। নড়াচড়ার আর জায়গা নেই। চারিদিকে দুর্গন্ধ যেনো আর বাড়ছে। সবাই মনে হয় ঘরের ভিতরেই প্রসাব-পায়খানা করছে। দরজা খুলে মনেহয় বাইরে যেতেও সাহস পায়নি। যদি ভাঙ্গা দরজা খুলতে গিয়ে শব্দ হয়ে যায়!
যদি অন্ধকারে ওঁত পেতে থাকা কোন হারামি টের পেয়ে যায়!
আমি হঠাৎ চিৎকার করে কেঁদে উঠলাম। আর পারছিনা। মনে হয় মরে যাবো খেতে না পেয়ে। চারিদিক থেকে মুহুর্তেই চাপাস্বরে অনেক আওয়াজ একসাথে বলে উঠলো, “মুখ চাপা দে, মুখ চাপা দে মুখপুরি! ওই ডারে থামা। নইলে সব মারা পরমু!
কেউ একজন অন্ধকারে পাশ থেকে আমার মুখ চেপে ধরলো।
হাসিনা প্রথমে ধাক্কা দিয়ে সে হাত সরিয়ে দিলো। মুক্তি পেতেই আমি আরো জোড়ে চিৎকার করে উঠলাম।
হাসিনা এবার আমার নিচ থেকে কাঁথাটা তুলে আমার মুখের উপর চেপে ধরলো। এটা না করলে অন্যরা হয়তো নিজ জীবন বাঁচিয়ে রাখার অসীম তাড়নায় ওদের নিজ হাত জোড় করে আবার আমার মুখে চেপে ধরতো।
হাসিনা কয়জনের হাত সরাবে?
আমার মতো একটি শিশুকে বাঁচানোর জন্য কয়টি পরিপক্ক জীবন দিবে!
আমার আওয়াজ আস্তে আস্তে থেমে যাচ্ছিলো।
কাঁথার এক একটি শিলাইয়ের ভিতর আমার কান্নার এক একটি শব্দ আস্তে আস্তে গেঁথে যাচ্ছিলো।
হারিয়ে যাচ্ছিলো। বিলীন হয়ে যাচ্ছিলো অতল গহ্বরে।
আমি এবার আর নিঃশ্বাসও নিতে পারছিলাম না। বাতাস থেমে যাচ্ছিলো। থেমে যাচ্ছিলো আমার বেঁচে থাকার জন্য অস্থির ছটফট।
কিন্তু আমি আর পারলাম না। একসময় আমি থেমে গেলাম। নিস্তব্দ হয়ে গেলাম। হারিয়ে গেলাম অচেনা অন্ধকারে।
পরিশিষ্ট-না পরলেও ক্ষতি নেই
এক-বিপ্লবের জবানবন্দী
আমি বিপ্লব সালাম। বাংলাদেশের একজন স্বনামধন্য পরমাণু বিজ্ঞানী। মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সালাম আমার বাবা আর হাসিনা বেগম আমার মা।
উপরে যে সাত মাসের বাচ্চার মুখে এই ঘটনা শুনলেন, আমি সেই বাচ্চা! আজ আমার চল্লিশ বছর বয়স!
আপনারা হয়তো ভাবছেন একটা সাত মাসের বাচ্চার এই সব ঘটনা মনে থাকে কি করে! তাছাড়া হাসিনা বেগমতো তাঁকে কাঁথা চাপা দিয়ে মেরেই ফেলেছে!
নাহ, আমি মরিনি। আর বেঁচে আছি বলেই যে আজ আপনাদের এই ঘটনার কথা জানাতে পারছি তাতো বুঝতেই পারছেন। তাছাড়া অলৌকিক হলেও সত্য, জন্মের পর থেকে সব ঘটনাই আমার স্পষ্ট মনে আছে।
কিভাবে? একজন পরমাণু বিজ্ঞানী হিসেবে সেটা আমারও প্রশ্ন! কিন্তু উত্তরটা আমারও জানা নেই। আমি চোখ বন্ধ করলেই সব স্পষ্ট দেখতে পাই। শুধু ওই কাঁথা চাঁপা দেওয়ার পরের কিছু ঘটনা ছাড়া।
আমার গলার আওয়াজ থেমে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই নাকি বাইরে কিছু মানুষের উল্লাস ধ্বনি শোনা যাচ্ছিলো। দেশ নাকি স্বাধীন হয়ে গেছে। মিলিটারিরা সব দলে দলে আত্মসমপর্ণ করছে। রেডিওতে বারে বারে ঘোষণা হচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশের কথা। পরে আমি মায়ের কাছে শুনেছিলাম সৃতিতে সাদা হয়ে যাওয়া সেই কিছুক্ষণের কথা।
দুই-হাসিনার অভিজ্ঞতা
হাসিনার কানে কোনো কথাই যাচ্ছিলো না। ও তখন সত্যি সত্যিই পাথর। অনেকেই ততোক্ষণে বাইরে বেরিয়ে গেছে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সূর্য দেখতে। হাসিনার কথা কারোই খেয়াল নেই।
খেয়াল নেই কাঁথার নিচে কচি গলায় ক্ষুধাত চিৎকার সহ হারিয়ে যাওয়া এক ছোট্ট শিশুর কথা।
এক বাস্তুহারা মহিলা খেয়াল করেছিলো। সে হাসিনাকে ধাক্কা দিয়ে বললো, “কি লো, তুই কি পোলাডারে খাইছস নাকি! ওইডার কোন সাড়াশব্দ নাই কেন? দেখ দ্যাখ মুখপুরি, অহনো বাইচ্চা আছে নি।”
হাসিনা জানে সব শেষ হয়ে গেছে। তবুও ওই কথায় সে একটু আশার আলো দেখতে পেলো। হুড়মুড় করে কাঁথা সরিয়ে সে দেখলো ছেলেটা আর নড়াচড়া করছে না। চোখ বন্ধ কিন্তু শরীরে কোন সাড়াশব্দ নেই।
স্তব্ধ হাসিনার হাত থেকে ধপ করে ছেলেটা মাটিতে পরে গেলো। আর পরে যেতেই তার আঁটকে যাওয়া দমটা যেনো হঠাৎ ফিরে এলো। তারপর সে কি ত্রাহি চিৎকার। সেই চিৎকারে তখন যুদ্ধ জয়ে আনন্দ উল্লাসে মত্ত মানুষগুলোর সম্মিলিত কোলাহলও ম্লান হয়ে গেলো।
হাসিনা তখন আনন্দাশ্রুতে বুক ভসাতে ভাসাতে কোলে তুলে নিলো তার নাড়ী ছেড়া ধনকে। আজ আর ছেলের কান্না থামাতে কোন চেষ্টাই করলো না সে। কাঁদুক। আজ যতো খুশি কাঁদুক। এ কান্নাতো কান্না নয়, বিজয় উল্লাস। এক বিপ্লবীর উল্লাস। সাত মাস বয়সী এক বীর মুক্তিযোদ্ধার উল্লাস। যে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করেছে বেঁচে থাকার জন্য। মৃত্যুকে জয় করে আজ সে হয়েছে এক সাহসী বিপ্লবী যোদ্ধা। এক বীর মুক্তিযোদ্ধা।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মোঃ মামুন মনির আমার বেশ ভাল লাগল। মনে হল একটু ব্যতিক্রম।
মা'র চোখে অশ্রু যখন সুন্দর এমন গল্প তো আমাদের প্রয়োজন
সূর্য এমনিতেই গল্প উপন্যাস পড়তে ভাল লাগেনা। আমি ঢুকে যাই সেই সময়ে । নিজেকে খুজে পাই গল্পের ভেতরে অসহায়, নিশ্চল প্রত্যয়হীন যেন গল্পকারের হাতের পুতুল। এই গল্পেও আমি নিজেকে খুজে পাই সাত মাস বয়সী বিপ্লব সালামের ভেতর। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়টার প্রতি আমার এলার্জী আছে। মুক্তিযুদ্ধ'র ঘটনা, বর্ণনা শুনলে আমার চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনা.......... ভালো হয়েছে লেখাটা........
বিন আরফান. ভালো লিখার প্রসংসা করতে আমি কোন দিধা বোধ করিনা. আপনি অনেক ভালো লিখেন. নিয়মিত নেটে থাকেন সবাই আপনার লিখা পরে মুগ্ধ হনে. ফলে বিজয় আপনাকে হাতছানি নিয়ে ডাকবে.
মাহাফুজ হক @Bisonno Suman, আপনি নিজেও একজন ভালো লেখক। আশা করি আমি ভবিষ্যতেও আপনার সুচিন্তিত মতামত আমার সঙ্গে পাবো।
মাহাফুজ হক বিন আরফান, আপনাকে ধন্যবাদ। পাঠক তখনই লেখকের চেয়েও বড় হয়ে ওঠে যখন সে সমঝধার হয়।
বিষণ্ন সুমন শব্দের গাথুনিতে লিখাটা অনেক প্রানবন্ত হয়েছে
বিন আরফান. এই একটি লেখায় আঞ্চলিক ভাষায় পাইলাম . আসলে গল্পের মজা এইভাবেই পাওয়া যায়. কিলো তই কি পূলাদারে খাইছত নাকি ? এটা কষ্ঠের হলেও তুমি আমার মাথাটা খেয়েছ এটা আনন্দের. আমি আজ থেকে তোমার লেখার একজন ভক্ত. চালিয়ে যাও নতুবা কষ্ট পাব. জানিনা কেন মানুষ লেখাটা দেখ্তেছেনা. তবে আমি তোমাকে ভোট দেবই. শুভ কামনা রইল.

১৯ জানুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৭ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪