রমণীর গুণে

রমণী (ফেব্রুয়ারী ২০১৮)

তাসনীমুল করিম
সকাল ৮ টা । মেয়ের স্কুলব্যাগে টিফিন রেখে মেয়েকে কিছুদূর এগিয়ে দিল তাহমিদা নূর ওরফে ডা. তাহমিদা নূর যদিও সে আর ডাক্তারি করে না কয়েক বছর যাবৎ। পড়াশোনা করেছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজে, সেখানে সে বেশ ভাল ছাত্রী ছিল। ছোট থেকেই ছিল ভীষণ শান্ত স্বভাবের। পাবনা জেলার একটি গ্রামে বড় হয়েছে। এমবিবিএস করে ইন্টার্নির সময় তার বিয়ের প্রস্তাব আসে। পাত্র তার বেশ পছন্দ হয়।নাম আরিফ, পেশায় মেরিন ইঞ্জিনিয়ার তবে সমস্যা হল ছয় মাস বাড়িতে আর ছয় মাস কর্মস্থলে থাকে। তাহমিদা রাজি হয়েছিল এই ভেবে যখন তার স্বামী বাড়ি থাকবে না সে সময়টা ডাক্তারি করেই কাটিয়ে দিতে পারবে।
বিয়ে হল। তারা বেশ সুখী ছিল। এদিকে তাহমিদা এফসিপিএস শেষ করল আর আর একটা হাসপাতালে নিয়মিত রোগী দেখত । বিশেষ করে যখন আরিফ কর্মস্থলে থাকত তখন সে হাসপাতালে আরেকটু বেশি সময় দিত। শ্বশুর বাড়িতেই থাকত তাহমিদা । আরিফের এক ভাই ছিল, নাম আরমান। সে দূরে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত, বাড়ি আসত কয়েক মাস পর পর। বাড়িতে থাকত তার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি। তাহমিদার শ্বশুড় আকরাম খান ছিলেন ব্যতিক্রমধর্মী আর ভীষণ রাগী স্বভাবের। কারও সাধ্য নেই তার উপর কিছু বলার। মেয়েদের সম্পর্কে তার ধারণা মেয়েরা শুধু ঘরের কাজ করবে। পেশাজীবী নারীদের সম্পর্কে তার ধারণা নেতিবাচক। আরিফকে ভীষণ ভালবাসলেও আকরাম খানকে কিছুটা ভয় করত তাহমিদা।
আরিফ যখন বাড়ি থাকত না তাহমিদার উপর তার বিভিন্ন সন্দেহ থাকত যা হয়ত মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েড ভালো ব্যাখ্যা করতে পারতেন। মেডিকেল কলেজের একটা অনুষ্ঠানে গিয়েছিল তাহমিদা, সেখানে বন্ধুদের সাথে কিছু ছবি তুলেছিল সে। আকরাম খান কোনভাবে তা দেখতে পাই আর তাহমিদাকে নানারকম প্রশ্ন করে বিব্রত করেন। অনেক মন খারাপ হয়েছিল তার।
একদিনের ঘটনা । আরিফ তখন বাড়ি ছিল না। তাহমিদার ফিরতে দেরী হচ্ছিল, প্রায় ১ টার সময় আকরাম খানের বাড়ির সামনে একটা গাড়ি থামল । গাড়ি থেকে নেমে এল তাহমিদা। আকরাম খান দরজা খুলে দিলেন। তারচোখে জ্বলন্ত আগুন। চিৎকার করে বলে উঠলেন,
“কোথায় ছিলে এতক্ষণ, বাড়ি ফেরার দরকার কি?”
তাহমিদা হকচকিয়ে বলল, “বাবা, কিছু মনে করবেন না, আজ একটা বৃদ্ধা রোগিনীর অবস্থা ভীষণ খারাপ ছিল, তার বাড়িতে গিয়েছলাম আর এখন তার ছেলে গাড়িতে করে নামিয়ে দিয়ে গেল”।
“থাক আর ডাক্তারির বাহানা করতে হবে না; ঠিক আছে, তোমাকে আর ডাক্তারিই করতে হবে না। অত টাকা আয় করার দরকার নেই, ভদ্র রমণীর মত সংসার কর”, দৃঢ়স্বরে বললেন আকরাম খান।
তাহমিদা বলল, “বাবা, আমি ডাক্তারি টাকার জন্য করি না, অসুস্থদের সেবা করলে আমি খুশি হই, এটা আমার ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন”।
আকরাম খান ক্ষিপ্তকণ্ঠে বললেন, “ তবে বেরিয়ে যাও, সেবা কর গিয়ে আর এ বাড়িতে এসো না। থাকতে চাইলে যা বলেছি সেভাবেই থাকবে, আমার ভদ্র ছেলের জন্য তোমার মত বেয়াদপ মেয়ের দরকার নেই”।
তাহমিদার দু চোখে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। সে তার ঘরে গিয়ে চুপিসারে কাঁদতে লাগল। পরদিন সে আর হাসপাতালে গেল না।
কয়েকদিন পর আরিফ বাড়ি ফিরল। সে তাহমিদাকে ভালবাসত কিন্তু তার সাহস নেই বাবার বিরুদ্ধে কোন কথা বলার। তার অবস্থা অনেকটা রবীন্দ্রনাথের হৈমন্তীর সেই অপুর মত। আরিফের এই নির্লিপ্ততা দেখে তাহমিদার মন একেবারে ভেঙ্গে গেল। কি করবে সে এখন!
শেষ পর্যন্ত তাকে তার স্বপ্নকে জলাঞ্জলি দিতে বাধ্য হল। এখন তাকে দেখলে আর ডাক্তার মনে হয় না, পুরোদস্তুর গৃহবধু। তার একটা মেয়েও হয়েছে তার। মেয়ে হওয়াতে তার শ্বশুর স্বভাব অনুযায়ী তেমন খুশি হননি যদিও আরিফ কিন্তু অনেক খুশি। তার মেয়ে স্কুলে যেতে শুরু করেছে। সে নিজে তার মেয়েকে পড়ায়, তার ইচ্ছা তার মেয়ে ডাক্তার হবে।
ডিসেম্বর মাস। রাত ১১টা। তাহমিদা রাতের খাবার শেষ করে তার মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে নিজে শুয়ে পড়ল। আরিফ বাড়ি নেই। কেন জানি আজ তার ঘুম আসছে না। মনে পড়ছে তার আগের দিনের কথা। তার মা তাকে মাথায় হাত বুলিয়ে বলত, “ঘুমিয়ে পড় তাড়াতাড়ি ভোরে উঠে পড়িস, ভোরে উঠে পড়লে পড়া মনে থাকে ভাল; তবে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় ভাল করবি”। একবার সে জীববিজ্ঞান অলিম্পিয়াডে বিভাগীয় পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল আর মেডেল নিয়ে যখন বাড়ি এসেছিল তখন তার বাবা বলেছিল যে আমার তাহমিদা একদিন অনেক বড় বিজ্ঞানী হবে। ভাবতে ভাবতে তার চোখের কোনে পানি জমে উঠল।
সে প্রায় ঘুমিয়েই পড়েছিল। মাঝরাতে হঠাৎ দরজা ধাক্কানোর আওয়াজে উঠে পড়ল। দরজা খুলে দেখল ভয়ার্ত মুখে তার শ্বাশুড়ি মা দাঁড়িয়ে আছেন আর তাকে বললেন যে তার শ্বশুর কেমন কেমন করছেন। সে ছুটে গেল। গিয়ে দেখল আকরা্ম খান চিৎ হয়ে শুয়ে কাঁপছেন আর তার গলা দিয়ে গোঙানির মত আওয়াজ বের হচ্ছে। তাহমিদার আর বুঝতে বাকি রইল না যে আকরাম খানের মুমূর্ষু অবস্থা উপস্থিত। এই মুহুর্তেই তাকে হাসপাতালে নিতে হবে। শীতের রাত, চারিদিকে কুয়াশায় ঢাকা। অনেকবার মোবাইলে কল করে সে তার দুজন প্রতিবেশীকে ডাকতে পেরেছে। তাদের সাথে মুমূর্ষু আকরাম খানকে নিকটবর্তী হাসপাতালে নিয়ে যায়, কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখে কোন বিশেষ ডাক্তার নেই। শুধু দু তিন জন ইন্টার্নি ডাক্তার। পরীক্ষা করে দেখা গেল হার্টের গুরুতর সমস্যা, দ্রুত অপারেশন করতে হবে। কিন্তু এই ছোট শহরে এখন না আছে ভাল ডাক্তার না আছে অপারেশনের যন্ত্রপাতি।আর ঢাকায় নেওয়ার মত সময়ও নেই। তবে কি আকরাম খান সত্যিই মারা যাচ্ছেন!
তাহমিদা বলল, “আমিই অপারেশন করব” । যদিও সে অনেকদিন ডাক্তারি প্রাকটিস করেনি, কিন্তু এ মুহূর্তে আর কোন উপায় নেই। মেডিকেলে পড়ার সময় কার্ডিওলজীর এক প্রফেসর তার পড়ার প্রতি আগ্রহ দেখে অনেক খুশি হয়েছিলেন, তিনি তাকে মেয়ের মত স্নেহ করতেন। পরে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান । তাহমিদা কার্ডিওলজীর উপর ডিগ্রী নিচ্ছে জানতে পেরে তিনি যুক্তরাষ্ট্র থেকে কার্ডিয়াক অপারেশন এর জন্য আধুনিক ও মূল্যবান এক সেট ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি পাঠিয়ে দেন যা সে আগে ব্যবহার করেনি তবে ব্যবহারের নিয়ম কানুন সে ভালোভাবেই আয়ত্ত্ব করেছিল। আর সেগুলো সে স্মৃতি হিসেবে একটা ঘরে তালা মেরে রেখেছিল। সে দ্রুত তা বাড়ি থেকে সেগুলো আনার ব্যবস্থা করল।
শীতের রাত ৩টার সময় এক মফস্বল শহরে আধুনিক পদ্ধতিতে আকরাম খানের জটিল এক কার্ডিয়াক অপারেশন সম্পন্ন হল। ৮ ঘন্টা পর তার জ্ঞান ফিরল। কিছুটা সুস্থ হয়ে পাঁচদিন পর বাড়ি ফিরল আকরাম খান। সব জেনে আজ সে অনুতপ্ত। আরিফ ফিরে এসেছিল বাবাকে দেখতে। তাহমিদা পাশে বসেছিল।
আকরাম খান বলে উঠল, “এখন এসে আর কি, মৃত্যুর সময় তো আর পাইনি, আগের আকরাম খান মারা গেছে, এখন যে আকরাম খান বেঁচে আছে সে কে জানো? সে ডা. তাহমিদার নূর এর বাবা”।

আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মোঃ নুরেআলম সিদ্দিকী গল্পের কাহিনী বেশ মনোরঞ্জন, খুব ভালো লাগলো। লিখতে থাকুন, শুভকামনা সহ শুভেচ্ছা নিরন্তর
ভালো লাগেনি ২৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮
সালসাবিলা নকি খুব ভালো লেগেছে গল্পটি
ভালো লাগেনি ১৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮
মামুনুর রশীদ ভূঁইয়া গল্পের উপস্থাপনা বেশ ভালো। আরো ভালো গল্পের পরিসমাপ্তি। ভালো লেগেছে। পছন্দ, ভোট ও শুভকামনা রইল। সময় পেলে আমার ‘ভয় ফ্রেন্ড’ ও ‘রমণী রমণ মন’ পড়ে মন্তব্য জানালে অনুপ্রাণিত হবো। ভালো থাকবেন।
Farhana Shormin ভাল লাগল। আসবেন আমার গল্প ও কবিতার পাতায়। ধন্যবাদ।
ভালো লাগেনি ২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮

০২ ডিসেম্বর - ২০১৬ গল্প/কবিতা: ১ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪