আমি মা হয়‌েছ‌ি

মা (মে ২০১৯)

রওনক নূর
মোট ভোট প্রাপ্ত পয়েন্ট ৫.৬২
  • ১০
  • ১০০
নঁকশী করে সুঁতো দিয়ে স্বপ্ন বুনছে ছোট্ট ছোট্ট কাঁথাতে আমার কাকিমা। একেকটা তৈরি শেষে আমাকে দেখায়। আমি দেখি আর হাসি। এত ছোট্ট সুন্দর কাঁথায় আমার বাচ্চাটা ঘুমাবে। একটা কাঁথা কত স্বপ্ন দেখাতে পারে সেটা আমার ভেতরে ও আসার পর আমি বুঝেছি। প্রতিদিন ছোট ছোট বাচ্চাদের ছবি নেট থেকে নামিয়ে ওর বাবাকে পাঠায়। কখনও বলি তোমার রাজকন্যা আসবে আর কখনও বলি রাজপূত্র আসবে। আমার ভেতরে ওর জন্ম হওয়ার পর থেকে ওর বাবাকে ছেড়ে আমি আমার বাবার বাড়ীতে চলে এসেছি। সবাই কত যে খুশি। কিন্তু আমি শুধু ওর বাবাকে মিছ করি। সারাদিন ওকে নিয়ে অনেক গল্প করি আম্মু আর কাকিমার সাথে কিন্তু সন্ধ্যা হলে মনে হয় ওর বাবা কাছে থাকলে খুব ভালো হত।

অনেক বায়না করে ওর বাবাকে এনেছিলাম এর মধ্যে একবার। চোখের দিকে তাকাতে পারছিলামনা আমি। আমার কপালে চুমু দিয়ে বলেছিলো আমার মুখটা কেমন মা মা হয়ে গেছে। আসলে ভেতরে ভেতরে তো আমি মা হয়ে গিয়েছি সেই প্রথম যেদিন জানতে পেরেছি মা হব সেদিন থেকে। আমার পেটে হাত দিয়ে বাবুর সাথে অনেক গল্প করেছিলো বাবুর বাবা। বলেছিলো আমার ছোট্ট বউটার ভেতরে আরেকটা বাচ্চা।

মা হওয়াটা অনেক কষ্টের। আমার কলিজাটা আমার পেটে আসার পর থেকে আমার সব ভাবনা ওকে ঘিরে । ও আমার ভেতরে আসার পর থেকে আম্মু আর শ্বাশুড়ির প্রতি আমার ভালোবাসা আরো কয়েক গুন বেড়ে গেছে। প্রতি রাতে আমি সেসব মায়েদের জন্য কাঁদি যারা সন্তানের কাছ থেকে কষ্ট পায়। আমার বাবুর বাবাকেও বলেছি যে কখনও যেন মাকে কষ্ট না দেয়।

ছোটবেলা থেকে দুধ আমার খুব অপছন্দ। কিন্তু আমি এখন দুবেলা দুধ খাচ্ছি আমার জুনিয়রের জন্য । দুধ, ডিম, কলা, সবজি, বেদানা, মাছ সবকিছু বেশি বেশি খাচ্ছি আমার বাচ্চাটার জন্য। প্রতিদিন প্রচুর পানি খাচ্ছি। ওর বেড়ে উঠার জন্য। আমি চাই ও যেন খুব সুস্থ শরীর নিয়ে পৃথিবীতে আসে। প্রতিদিন সুরা ইয়াছিন, আর রহমান, ওয়াক্বিয়া আর মুলক পড়ি আমি। আমার বাচ্চাটাকে শোনানোর জন্য। সারাদিন ফোনে দোয়া কালাম শুনতে থাকি। আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে ওকে ভালো রাখবো আমি।

রাতে ঘুম আসেনা, খুব অস্থির লাগে। চোখ বন্ধ করলেই ভয় লাগে। মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখি চোখ বন্ধ করলেই। কিযে হচ্ছে আমার সাথে বুঝতে পারিনা। কাকিমা আর আম্মু মজা করে বলে, মা হওয়া কি এতটা সহজ। মা হতে গেলে তো একটু কষ্ট করতেই হবে। আমিও সব কষ্ট মেনে নিয়েছি। পেটে একটু একটু ব্যথা করে, খাবার খেতে কষ্ট হয়। কিন্তু আমি সহ্য করি, কারন আমি মা।

ঢিলাঢালা জামা পড়তে হবে এখন থেকে। ওর জন্য আমার পেটটা বেশ বড় হয়ে গেছে। ভাবতেই আনন্দ লাগে যে আমার বাবু বড় হয়ে যাচ্ছে। আমি মেক্সি বানিয়ে নিলাম বুকে চেইন দিয়ে। আমার বাবুকে যেন খাওয়াতে সমস্যা না হয় এজন্য। আমার সন্তান এ পৃথিবীতে আসছে ভেবেই আমি প্রায়ই কেঁদে ফেলি আনন্দে। কত স্বপ্ন নিয়ে আসছে আমার কলিজাটা।

আমার ছোট্ট ভাতিজার সাথে শুয়ে শুয়ে খেলা করছিলাম। হঠাৎ পেটের মাঝখানে কি যেন নড়ে উঠলো। আমি চুপ হয়ে গেলাম। কিছুক্ষণ পর আবার নড়ে উঠলো। আমি চিৎকার করে আম্মুকে ডাকলাম। খুশিকে কান্না পেলো আমার। আম্মু বল্ল আমার বাচ্চাটা নড়াচড়া শুরু করেছে। আমি আনন্দে বাবুর বাবাকে ফোন করে জানালাম। বাবুর বাবাও আনন্দে কেঁদে ফেলে। আমাদের ছোট্ট সোনাটা আমাকে নড়াচড়া করে জানিয়ে দিলো তার উপস্থিতি। এখন থেকে আমি ওকে ওর নড়াচড়া থেকে অনুভব করতে পারবো। আমার পিচ্চি ভাতিজা সেই অনন্দে নাচতে থাকে , একটা ছোট্ট বাবু আসছে আমাদের ঘরে।

ছোট্ট হাত, ছোট্ট দু পা আর আদর আদর মুখটা আমার জীবনটাকে বদলে দিবে। ছোট্ট আঙুল দিয়ে আমার আঙুলগুলো ধরে সাহস দিবে আমাকে। ওর বাবাকে বলেছি, ' দেখো ও পৃথিবীতে আসলে আমাদের জীবনটা বদলে যাবে। সবথেকে সুখি মানুষ হয়ে যাবো আমরা"। ওর বাবাও আমার মত ছোট্ট আঙুলগুলো ধরবার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে। প্রতিদিন অনেক রাত পর্যন্ত মেসেজ আদান প্রদান করি আমরা। এক একটা দিন যেন যেতেই চাচ্ছেনা। প্রতিদিন দিন গুনতে গুনতে আমরা ক্লান্ত। ক্যালেন্ডারে দাগ দিয়ে নিয়েছি ওর আসার দিন পর্যন্ত। ছোট্ট সোনাটা আমার ঘরে সুখের বন্যা নিয়ে আসবে আমার ঘরে।

কাঁথাগুলো সব গুছিয়ে রাখছে কাকিমা। ওগুলো স্যাভলোন দিয়ে ধুয়ে রাখতে হবে। কাকিমা নিজের হাতে চল্লিশটা কাঁথা বানাবে। কাকিমা যখন একেকটা কাঁথা শেষ করে আমাকে দেখায় তখন জুনিয়র নড়াচড়া দেয় বেশি। ও হয়ত কাঁথা দেখে খুব খুশি হয়ে যায়। ওয়েলকাম জানানোর প্রস্তুতি খুব আনন্দ দেয় ওকে। বাবুর নানাভাই আর নানুআপুকে আমি বলে দিয়েছি তাড়াতাড়ি বাবুর জন্য নতুন ঘর বানাতে। আমার বাচ্চা নতুন বাড়ীতে উঠবে। ও আসবে বলে আব্বু আম্মু আমার জন্য খুব সুন্দর করে ওয়াশরুম বানিয়ে দিয়েছে, যেন আমার ওয়াশরুম আমি একা ব্যবহার করতে পারি।

মনটা খুব অস্থির লাগছে আজ। তলপেটে খুব ব্যথা। বাবুর বাবাকে জানালাম শরীর খারাপ লাগছে। ও তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়তে বল্ল। বিকালে তেলে ভাজা খাবার দিয়ে নাস্তা করেছি বলে হয়ত এত পেটে ব্যথা করছে। কষ্ট করে সহ্য করছি, কারন আমি মা, মাকে তো অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়। সারাটা রাত পেটে ব্যথা। আম্মু আব্বু সারাদির কত খাটনি করে তাই তাদেরকে ডাকতে মন চাইলোনা। সারাটা রাত সহ্য করে ফজরের সময় চিৎকার দিয়ে কেঁদে ফেল্লাম পেটে ব্যথায়। আম্মু আমার চিৎকার শুনে ভয় পেয়ে গেলো। ওয়াশরুমে গেলাম। ফ্লাস করার আগে দেখলাম রক্তের মত কিছু। কিন্তু রক্ত আসবে কিভাবে, আমার ভেতরে তো আমার জান বাচ্চাটা রয়েছে।

ঘরে এসে চেক করে দেখলাম সত্যিই রক্ত। আমি চিৎকার করে উঠলাম, আমার সব শেষ হয়ে গেছে। দৌড় দিয়ে আব্বু আম্মু আমার কাছে এসে রক্ত দেখে তারাও ভয় পেয়ে গেলো। ডক্টরকে ফোন করে জানালে ডক্টর বল্লেন, " সামান্য রক্ত যখন এসেছে এটা কোন ব্যাপার না, বিকালে ওকে নিয়ে আসেন"। বাড়ীতে হুজুর ডেকে ব্যবস্থা নেওয়া হল। আমি আমার বাবুর বাবাকে ফোন দিয়ে জানালাম সব শেষ হয়ে গেছে হয়ত। ডক্টরের কাছে আরও দুবার ফোন করলে তিনি একই কথা বল্লেন বিকালে নেবার জন্য। আমার আম্মু আমাকে বুঝালো যে আমার ছোট ভাইয়ের জন্মের আগে আম্মুরও এখন হয়েছিলো। এটা হতেই পারে। আমার বাবুর ক্নে সমস্যা হয়নি।

দুপুরে এম্বুলেন্সে করে আমাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলো। যাবার সময় আম্মু আর কাকিমা বারবার বল্ল কিচ্ছু হয়নি আমার বাবুর। ও ভালো আছে। এম্বুলেন্সে যখন ছিলাম, পেটের মধ্যে মনে হল ও নড়ে উঠলো। আমি হেসে ফেল্লাম, যদিও চোখ দিয়ে পানি ঝরছিলো। আমার মনে বিশ্বাস ছিলো ওর কিচ্ছু হবেনা। আমার কলিজাটাকে আল্লাহ্ আমাকে উপহার দিয়েছেন, নিশ্চয় তিনি আমাকে কষ্ট দিবেননা।

হসপিটালে ডক্টর আমাকে দেখা মাত্রই তাড়াতাড়ি ভর্তি করে নিলে, স্যালাইন দিলেন। আমার বাবুর বাবা রওনা করছে ঢাকা থেকে। আমি ওকে অবশ্য ফোন দিয়ে বলেছি আমার বাচ্চা ভালো আছে তুমি চিন্তা করোনা।

দুজন নার্স এসে আমাকে আল্ট্রা করাতে নিয়ে গেলো। আম্মু,আব্বু, ভাইয়া, ফুপুআম্মু, কাকিমা, কাকুরা সবাই ছিলো পাশে। কিন্তু আমার দুচোখ শুধু আমার বাচ্চার বাবাকে খুজছিলো। আল্ট্রা করানোর পর জানতে পারলাম আমার কলিজাটার হার্টবিট বন্ধ হয়ে গেছে। আল্ট্রা করার সময় আমি অবশ্য দেখেছিলাম আমার সোনাটাকে। ওকে আমার ভেতর থেকে বের করে ফেলা হবে। আমার কলিজাটাকে ছিড়ে বের করা হবে। এই হাসপাতাল থেকে ও আর আমি আলাদা হয়ে যাবো। নঁকশা করা কাঁথা গুলোতে ও শুবেনা। আমার আঙুল গুলো ওর ছোট্ট আঙুল দিয়ে ধরবেনা। আমি শুধু বলেছি ওর বাবা আসুক। তারপর ওকে আমার থেকে বের করে নিও।

ওর বাবা এসেছে। চোখ দিয়ে যেন তার কান্নার বদলে এখনই রক্ত বের হয়ে যাবে। আমাকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হল।

আমার কলিজার টুকরা পৃথিবীতে না আসলেও আমি মা হয়েছি। ও আমার সন্তান, আমাদের ছেলে। আম্মু আব্বু আর সবাই বলেছে ওর সাথে আমার পরকালে দেখা হবে। আমি অপেক্ষা করছি ওর জন্য। হয়ত ও অপেক্ষা করছে ওর মায়ের জন্য। একদিন ঠিকই দেখা হবে আমাদের। সেদিন আমাকে জড়িয়ে ধরতে ভুলিসনা সোনা, সেদিন মাকে কাঁদতে দিস তোকে জড়িয়ে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
ফয়জুল মহী অনন্যসাধারণ লিখনী । শুভেচ্ছা সতত ।
ভালো লাগেনি ৩১ জানুয়ারী, ২০২০
m sattar অভিনন্দন!
রওনক নূর অালহামদুলিল্লাহ্
Fahmida Bari Bipu অনেক অভিনন্দন :)
নুরুন নাহার লিলিয়ান অনেক অনেক ভালবাসা তোমার জন্য ।
তোমার জন্যও অনেক ভালোবাসা অাপু
রওনক নূর এটা অামার জীব‌নে ছয়মাস অা‌গে ঘ‌টে যাওয়া ঘটনা যা অামার জীবটা‌কে বদ‌লে দি‌য়ে‌ছে। পরকা‌লে হয়ত দেখা হ‌বে অামার সন্তা‌নের সা‌থে। দোয়া কর‌বেন।
রণতূর্য ২ সত্যি খুব মর্মাহত হলাম গল্পটি পড়ে।অত্যন্ত সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন একজন মায়ের অনাগত সন্তানের প্রতি গভীর মমতা।ভোট ও শুভকামনা রইল। আমার পাতায় আমন্ত্রণ রইল।মন্তব্য করে অনুপ্রানিত করলে খুশি হবো।
এটা অামার জীব‌নে ছয়মাস অা‌গে ঘ‌টে যাওয়া ঘটনা যা অামার জীবটা‌কে বদ‌লে দি‌য়ে‌ছে। পরকা‌লে হয়ত দেখা হ‌বে অামার সন্তা‌নের সা‌থে। দোয়া কর‌বেন।
ইনশাল্লাহ দেখা হবে।দোয়া রইল।
রুহুল আমীন রাজু এক বেদনাবিদুর মায়ের গল্প ... সুন্দর লিখেছেন।
এটা অামার নিজ‌ের জীবন‌ের বাস্তব গল্প। দোয়া করব‌েন অামার জন্য

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

এবারের বিষয় মা। আমার জীবনে ঘটে যাওয়া কিছু কষ্টের স্মৃতি গল্পাকারে প্রকাশ করার চেষ্টা করেছি আমি। আমার বিশ্বাস ও পৃথিবীতে না আসলেও আমার ভেতরে এসেছে, তাই আমি মা হয়েছি। ইনশাআল্লাহ্ ওর সাথে আমার দেখা হবে। গত ২৯ অক্টোবরে ঘটে যাওয়া কষ্টগুলো হয়ত কখনও ভুলবোনা আমি। হয়ত আমার কলিজার টুকরাটা আমার জন্য অপেক্ষা করছে। তার মাকেও হয়ত সৃষ্টিকর্তা তার আঙুল ছোয়ার সুযোগ দিবেন।

১৩ নভেম্বর - ২০১৬ গল্প/কবিতা: ৩৭ টি

সমন্বিত স্কোর

৫.৬২

বিচারক স্কোরঃ ২.৯২ / ৭.০ পাঠক স্কোরঃ ২.৭ / ৩.০

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪