রাফির চোখ আজ জ্বলজ্বল করছে। ঢাকা শহরের ফ্লাট বাসার ডাইনিং টেবিলে সে দেখছে তার গ্রামের খালবিলে ভেসে থাকা পানি ফল। শাপলা ফুলের পানি পানি গন্ধ আজ পেয়েছে সে কংক্রিটে গড়া শহরের তার মালিকের বাসার ডাইনিং টেবিলে। মাস খানেক আগে রাফি গ্রাম থেকে এই আজব ঢাকা শহরে আসছে। কি আজব কান্ড, কত বড় বড় বিল্ডিং আর মানুষ গুলো যেন আলাদা রকম। সব কিছুর মাঝে রাফির মনে পড়ে তার গ্রাম আর মাকে, তার মায়ের শরীরের গন্ধকে। মায়ের শরীরের গন্ধ তো তার ভুলে যাবার কথা, তারপর কেন যে মনে পড়ে সেটা হয়ত সৃষ্টিকর্তাই বলতে পারেন।
ছোট্ট ছয় বছরের মেয়ে রাফি । আমাদের বাড়ীওয়ালার বাসায় কাজ করে। অবাক হচ্ছেন? অবাক হবার কিছুই নায়। এছাড়া আর কি জুটবে এসব বাবা-মা ছাড়া একা একা বড় হওয়া বাচ্চাদের।
রহিমা নামের অসহায় গ্রাম্য মেয়েটির যখন বিয়ে হচ্ছিলনা তখন এলাকায় কামলার কাজ করতে আসা আবদুল সবুরের সাথে তার বিয়ে হয়। আবদুল সবুর সেখানে এসেছিল সিজিনাল কাজ করতে। কিছু দিন যেতে না যেতেই রহিমা গর্ভবতী হয়। এরই মধ্যে আবদুল সবুরের এলাকার কাজ শেষ হয় আর সাথে সাথে মিটে যায় তার শরীরের চাহিদা। শুরু হয় রহিমার উপর নানা নির্যাতন। আর হঠাৎ একদিন কাউকে কিছু না বলে অন্তঃস্বত্তা রহিমাকে রেখে সে কোথায় জানি চলে যায়। পরে রহিমা জেনেছিল তার স্বামীর আগের একজন বউ আছে। রহিমা তাতে দুঃখ পায়নি কারন গরীবদের দুঃখ বিলাস করলে পেটে ভাত জুটে না। অন্তস্বত্তা শরীরে রহিমা বের হয় ঘর থেকে যুদ্ধ করতে, ভাত জুটানোর যুদ্ধ। কিছুদিন পরই জন্ম নিলো রহিমার আরও একটি খাবার মুখ, তার নাড়ি ছেড়া ধন, তার সন্তান, রাফি।
লিকলিকা কালো চেহারার বাচ্চা রাফি। কিভাবে ভালো হবে? রহিমা যে খেয়ে না খেয়ে দশ মাস গর্ভে রেখেছে তার বাচ্চাটাকে। তার ভাঙা ঘরে নতুন অতিথির আগমন তাকে সুখ দেয়নি। নিজের খাবার জোটাতে যে অপারগ সে কিভাবে অার একটা মুখে অন্ন দিবে। তবে বাচ্চাকে দেখে সে নতুন করে সংগ্রাম করার শক্তি পেল। বাচ্চা জন্মের পর রহিমা আবদুল সবুরকে খবর দেবার চেষ্টা করল। রহিমা ভাবলো সন্তানের কথা শুনে হয়ত তার স্বামী ফিরে আসবে। কিন্তু আসলোনা ফিরে তার স্বামী।
শুরু হল রহিমার ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে বেঁচে থাকার লড়ায়। তবে কাজ করতে গেলে বাচ্চা দেখে কেউ কাজে নিতে চায়তোনা রহিমাকে। তাই ছোট্ট রাফিকে ঘরে রেখে কাজে যেতে হত রহিমাকে। পুরুষের সাথে পাশাপাশি রহিমা মাঠেও কাজ করেছে। অক্লান্ত পরিশ্রম ও রহিমার সন্তানের মুখে অন্ন দিতে সক্ষম ছিলনা ।
অনেক পুরুষ তাদের কামনা মেটাতে রহিমাকে ব্যবহার করতে চেয়েছিল। কিন্তু সে সবকিছু থেকে নিজেকে রক্ষা করেছে শুধু রাফিকে নিয়ে বাঁচার জন্য। অনেক লোভনীয় প্রস্তাব ও রহিমা পেয়েছে। এদের মধ্যে একজন ছিল আলমগীর। রহিমা যে বাড়ীতে বুয়ার কাজ করত সেখানে আলমগীর ও কাজ করত। রহিমাকে সে বিয়ে করতে চায় আর সাথে রাফির ও দায়িত্ব নিতে চায়। রহিমা তাকে প্রত্যাক্ষান করে। কারন পুরুষদের সে একটু বেশি ভয় পায়, অবিশ্বাস করে।
রাফির হঠাৎ খুব জ্বর। অসুস্হ বাচ্চারেখে রহিমা কাজে ও যেতে পারছেনা । বাচ্চাকে ডাক্তার দেখানোর ক্ষমতা না থাকার পাশাপাশি তাকে খাওয়ানোর ক্ষমতা নায় রহিমার। সাথে সাথে সমাজের নোংরা মানুষের লোভনীয় দৃষ্টি রাতের ঘুম হারাম করেছে রহিমার। গ্রামের এক প্রভাবশালীর নজর পড়েছে রহিমার উপর। এবার তার আর রক্ষা নায়। কিছু একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে তার।
রাতে রাফির জ্বরটা খুব বেড়েছিল। রহিমা খুব ভয় পেয়েছে। চিকিৎসার ক্ষমতা না থাকার পাশাপাশি রাফির ক্ষুধা মেটানোর ক্ষমতা তার নেয়। তার উপর হায়েনাদের নজর পড়েছে রহিমার শরীরে। সকালে অালমগীর এসেছে খাবার নিয়ে, সাথে এনেছে রহিমার জন্য প্রস্তাব।
আলমগীর রাফির বাবা হতে চায়। রহিমা কিছুই বল্লনা।
আলমগীর রাফির সব চিকিৎসা খরচ দিল , হাসপাতালে পরিচয় দিল রাফি তার সন্তান। রহিমা নিরব থাকা হয়ত বলে দিল আলমগীরকে তার প্রস্তাব মেনে নেওয়া। কিন্তু রহিমার কাছে এটা কোন ভালোলাগা বা ভালোবাসা ছিলনা, পুরুষদের আজ সে বড্ড বেশি ভয় পায়। সব কিছু মেনে নেওয়া শুধু তার রাফিকে দুবেলা মুখে ভাত তুলে দেবার জন্য, রাফি-রহিমার বেঁচে থাকার জন্য।
আলমগীরের ঘরে রহিমা আর রাফির নতুন জীবন শুরু হয়। রহিমা তার সন্তানের নতুন পরিচয় নিয়ে খুব খুশি ছিল। কিছুদিন পর আলমগীর রহিমাকে বলে সে রাফিকে তার বোনের বাড়ী নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু রহিমাকে এখন সে নিবে না।
রাফির বয়স এখন চার বছর। ছোট্ট রাফিকে নিয়ে আলমগীর তার বোনের বাড়ী যাবার নাম করে বের হয়। অার সেখানে রাফিকে রেখে আসে আলমগীর । ছোট্ট রাফি বুঝতেও পারে না তার সাথে কি ঘটছে। আলমগীর তাকে বলে যায় কিছুদিন পরে এসে নিয়ে যাবে রাফিকে। কিন্তু সে রাফিকে কাজ করার জন্য অনির্দিষ্ট কালের জন্য বিক্রি করে দেয় রাফিকে। মালিকেরা স্বামী-স্ত্রী দুজনই চাকরী করায় রাফিকে তালা বন্দী করে রাখতো সারা দিন। তার পরও রাফি অপেক্ষা করত হয়ত একদিন তার মা এসে তাকে নিয়ে যাবে। কিন্তু এর পর আর রাফির মায়ের সাথে দেখা হয়নি।
রাফির বয়স এখন ছয় বছর। ও এখন আমি যে বাড়ীতে ভাড়া থাকি সে বাড়ীওয়ালার বাসায় কাজ করে। আগেও সে কিছু বাসায় কাজ করেছে। সেগুলো ছিল তার গ্রামের এলাকায়। তাই মায়ের সাথে দেখা হওয়ার সম্ভবনা বেশি ছিল। কিন্তু এখনতো সে ঢাকা শহরে। এর আগে যে বাসায় কাজ করত তারা একদিন রাফিকে রাতের বেলায় ঘর থেকে বের করে দেয়। সারা রাত বাচ্চা মেয়েটা বাহিরে থাকে। কেউ একজন তাকে এই বাসাতে দিয়ে গেছে। এখানে হয়ত রাফি ভালোই আছে। এই বাসাতে রাফির মত আরও দুইটা বাচ্চা আছে । তাদের সাথে খেলে রাফি। বাচ্চা দুইটা বোঝেনা যে কাজের মেয়ের সাথে খেলতে নেয়। তাই পরিবারের সবাই নিষেধ করার সত্ত্বেও ওরা রাফির সাথে খেলতে চায়। অবশ্য এর জন্য রাফিকে সবসময় বকা শুনতে হয়।
রাফির কাছে আমি শুনেছিলাম ওর বাবা-মা এর নাম কি? কিন্তু রাফিরা তো বাবা- মা এর নাম জানেনা। অবাক হলেও এটাই সত্য যে রাফি আমাকে বলেছিল ও নাম জানেনা। তবে ও এখনও বিশ্বাস করে ওর মা একদিন ওকে নিতে আসবে। রাফি আমাকে বড় আপু বলে ডাকে। যদিও রাফিদের জন্য কিছু করার ক্ষমতা আমার নাই , তারপরও এরাই আমাকে বেশি ভালোবাসে। ক্ষমতা না থাকলেও আমার মনে হয়, পারবকি আমি রাফিদের মত বাচ্চাদের বড় আপু হতে,,,,,,,
রাস্তার ধারে বেলকুনি ধরে দাড়িয়ে থাকে রাফি। হাজার মানুষের ভিড়ে চোখ দুটি তার কাকে জানি খুজে সবসময়। হয়ত ও ভাবে এই রাস্তা দিয়ে ওর মা এসে একদিন হয়ত ওকে নিয়ে যাবে। কিন্তু কেউ আর আসেনা রাফিকে নিতে। জানিনা রাফির মায়ের সাথে আর দেখা হবে কিনা। হয়ত হবে, হয়তবা হবেনা...........
আমি স্বপ্ন দেখি রাফিদের মত শিশুদের তার অধিকার ও শৈশবের উৎফুল্লতা ফিরিয়ে দিতে। আমি যেন রাফিদের মত শিশুদের বাবা মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিতে পারি, এটাই আমার স্বপ্ন।
১৩ নভেম্বর - ২০১৬
গল্প/কবিতা:
৩৭ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪