(এক)
সে অনেক কাল আগের কথা । আমার তখন যুবক বয়স কাজ করি একটা সংবাদপত্রের অফিসে । কাজের খাতিরে ছুটতে হয় বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের অজো পাড়া গাঁ ।তখনও বিয়ে থা করি নি , বাবা মা গত হয়েছেন অনেক আগেই -নির্ঝঞ্ঝাট,বাঁধাহীন,বন্ধনহীন,পিছুটানহীন মুক্ত পুরুষ বলা চলে ।শুক্রবার প্রেসক্লাবের মাঠে ফুটবল খেলা আর দিনশেষে অফিস ছুটির পর বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়া এই ছিল আমার নিত্য রুটিন ।মাঝে মধ্যে অবশ্য রুটিনের বাইরেও অনেক কাজ করতে হত । সে সময় প্রচন্ড ঘুরাঘুরির নেশা ছিল । সেই সাথে আমার খবরের কাগজের চাকরিটাও ছিল তার অনুকূলে । প্রায় খবর সংগ্রহের জন্য বাংলাদেশের অনেক অখ্যাত নাম না জানা জায়গায় যাবার তলব পড়ত । আর যে সকল খবরের জন্য পত্রিকা অফিস থেকে আমাকে পাঠানো হত তার রকমও ছিল কৌতূহল উদ্দীপক এবং বিস্ময় জাগানিয়া । কোথাকার কোন পল্লীগ্রামে একহাজার বছরের পুরনো বটগাছের গুড়িতে সাত বছর ধরে আহার নিদ্রাহীন এক সাধু বাবা ধ্যানস্থ আছেন, কোথায় মাটি খুঁড়তে গিয়ে দেখা মিলেছে পুরাকালের এক সোনার মূর্তি,কোথায় কেউ একজন জলচরের মত পানিতে ডুব মেরে ঘন্টার পর ঘন্টা অবলীলায় কাটিয়ে দিচ্ছে এই সকল খবর সংগ্রহের জন্য আমাকে পাঠানো হত ।এদের বেশীর ভাগ খবরই বোগাস ,লোকমুখে বানানো ।একদিক থেকে আমার বেশ সুবিধাই হত বলা চলে । আজগুবি খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে ভ্রমণের নেশাটাও কিছুটা পূরণ হত ।সেদিন কি একটা খবরের প্রুফ দেখছি একমনে হঠাৎ অফিসের পিয়ন এসে জানালো সম্পাদক সাহেবের তলব পড়েছে । আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে সম্পাদক সাহেবের রুমে ঢুকতেই বেঁটে মোটা ফর্সা চেহারার চশমা চোখে সম্পাদক সাহেব একগাল হেসে আমাকে সামনের চেয়ারে বসতে ইশারা করলেন । তারপর চায়ের অর্ডার দিয়ে টেবিলের উপর কনুই ভর দিয়ে আমার দিকে এগিয়ে এসে সহাস্য গলায় বললেন-"কাল পরশুর মধ্যে তোমাকে একবার দিনাজপুর যেতে হবে ।"
আমি ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলাম-"এবারও কি কোন সাধু বাবা নাকি উভচর মানব ?"
তিনি মৃদু হেসে বললেন-"এবারের টপিকটা আরো ইন্টারেস্টিং । সেদিন আমার এক প্রতিবেশী ভদ্রলোক বংশীবাদক লোকমান ফকিরের গল্প শুনালো । যেনতেন বংশীবাদক না ,বাঁশি বাঁজিয়ে বৃষ্টি নামাতে পারে । এমন ক্ষমতা তার ।"
আমি কৌতুক করে হেসে বললাম-"বাঁশি বাঁজিয়েই যদি বৃষ্টি নামানো যায় তাহলে তো দেশের কৃষকদের খরার মৌসুমে হাপিত্যেশ করতে হয়না ।আপনিও কি বিশ্বাস করেন এমনটা সম্ভব?"
সম্পাদক এবার চেয়ারে বেশ আয়েশী ভঙ্গিতে গা এলিয়ে দিয়ে বললেন-"বিশ্বাস অবিশ্বাস সত্য মিথ্যা যাচাই করা তো মুখ্য উদ্দেশ্য নয় । আজকাল একটু রঙচঙে খবর ছাড়া পাঠক পড়তে চায় না । " সম্পাদক সাহেব তার সোনালী ফ্রেমের চশমাটা খুলে রুমালে মুছতে মুছতে আবার বলতে লাগলেন-" কম্পিটিশানের জামানা চলছে ।বুঝোই তো ব্যাপারটা। ব্যাঙের ছাতার মত পত্রিকা গজিয়ে উঠছে । খুন,ধর্ষণ,দাঙ্গা,ছিনতাই ,চুরি ,ডাকাতি তো কমন হয়ে গেছে । খবরের মধ্যে একটু অভিনবত্ব না আনলে একজিস্টস্ করাই মুশকিল হয়ে পড়বে ।তাছাড়া খবর পড়ে আজকাল আর সত্য মিথ্যা যাচাই করতে যাবে এত সময় কোথায় মানুষের ? পেপার পত্রিকা পড়া অনেকটা অবসরে বিনোদন হয়ে গেছে ।আর তোমার তো শুনেছি ঘুরাঘুরির শখ । এক ঢিলে দুই পাখি মারা হয়ে যাবে কি বল ?"
বংশীবাদক লোকমান ফকিরকে নিয়ে আমার কোন কৌতূহল নেই আমি রাজী হয়েছি স্রেফ কয়েকদিনের ধরাবাঁধা অফিসের কাজ থেকে মুক্তি পেয়ে নির্ভেজাল ঘুরাঘুরি হবে সেই আশায় ।বৃহস্পতিবার অফিস ছুটির পর সন্ধ্যায় বাক্স পেট্রা গুছিয়ে ট্রেনে চেপে পড়লাম ।সেকেন্ড ক্লাস কামরা । ভ্রমণের সময় অনেকে দেখি নাক ডেকে একেবারে ঘুমে বুঁদ হয়ে থাকে । আমার আবার উল্টো স্বভাব মোটেও তেমন ঘুম পায় না । দীর্ঘ ভ্রমণ তাই সঙ্গে রেখেছি আগাথা ক্রিস্টির ডিটেকটিভ বই ।লম্বা একটা হুইসেল দিয়ে হিস্ হিস্ শব্দ করে ট্রেন অতি ধীর গতিতে চলতে আরম্ভ করলো । ততক্ষণে সন্ধ্যার অন্ধকার চেপে বসেছে চারদিকে । চলন্ত ট্রেনের জানালা দিয়ে টিমটিম করে জ্বলা প্লাটফর্মের বৈদ্যুতিক আলো দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেলাম কখন যেন । তারপর এক এক করে আলো ঝলমলে শহর ছাড়িয়ে নিচ্ছিদ্র অন্ধকারের মাঝে এসে পড়লাম ।ট্রেনের জানালা দিয়ে হু হু করে খোলা হাওয়া আসছে । দূরে অতিক্রান্ত ছায়াচ্ছন্ন অস্পষ্ট মাঠ ঘাট গাছপালা আর ট্রেনের সাথে সমতালে ধাবমান চাঁদটার দিকে তাকিয়ে মনটা প্রশান্তিতে ভরে উঠলো ।ব্যাগ খুলে আগাথা ক্রিস্টির বই হাতে পড়তে আরম্ভ করলাম । পড়তে গিয়ে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম টের পাই নি চোখ মেলে জানালায় চোখ রাখতেই দেখি ফকফকা চারপাশ । ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে দিনাজপুর রেলওয়ে প্লাটফর্মে ।হাত ঘড়িতে সময় দেখে বুঝলাম রাত পেরিয়ে ভোর হয়েছে । একটু অবাক হলাম এই ভেবে যে যাত্রাকালে এমন গাঢ় ঘুম আর কখনো হয় নি ।প্লাটফর্ম থেকে বেরিয়ে বাসে চাপলাম বিরামপুরের উদ্দেশ্যে । রাস্তাঘাটের একেবারে দুঃসহ অবস্থা । খানা খন্দ ভাঙাচুরা রাস্তা তারপর মুড়ির টিনের মত লক্কর ঝক্কর বেহাল বাসের দশা ।বাসের তীব্র ঝাঁকুনিতে হাড়গোড় ব্যথায় টনটন করছে ।প্রায় বিধ্বস্ত অবস্থায় বাস থেকে নেমে ভ্যানে চড়ে পাচ মাইলের মাটির কাঁচা রাস্তা ভেঙে তবেই সেই বংশীবাদক লোকমান ফকিরের গ্রাম রসুলপুরে পৌছলাম ।
(দুই)
একবারে গন্ডগ্রাম বলতে যা বুঝায় রসুলপুর সেরকম জায়গা । স্কুল নেই,হাতের কাছে ভালো পোস্ট অফিস নেই ,বিদ্যুৎ নেই , বেশীর ভাগ মানুষ অশিক্ষিত চাষাভূষা ।থাকার মধ্যে আছে গোটা তিনেক মক্তব আর ছোট্ট একটা বাজার ।হাটের দিনে বেশ ভিড় পড়ে সেখানে । দূর দূরান্ত থেকে গরীব চাষীরা আসে বাজার সদাই করতে । এই ধরনের গ্রামে বংশীবাদক লোকমান ফকিরের বৃষ্টি নামানোর আষাঢ়ে গল্প জন্মাবে নাতো আর কোথায় জন্মাবে !আমার থাকার বন্দোবস্ত হল একটা ইংরেজ কুঠিতে । ব্রিটিশ শাসনের সময় এখানে ইংরেজরা তাদের শাসন কার্যের সুবিধার্থে কুঠি নির্মাণ করেছিলেন । এখন তার ভগ্ন দশা ।ছাঁদ ভেঙে পড়তে পড়তে কিভাবে যেন আটকে আছে ।পলেস্তারা খসা দেয়াল ,ভাঙা মরচে ধরা বারান্দার রেলিঙ ,ইট খসা বিশালাকার স্তম্ভ ,পাঁচিলের গা ভেদ করে ওঠা অশ্বথের চারা মিলিয়ে একটা জীর্ণ পুরাতন গন্ধ । কাঠের দরজা জানালা দেখলে বুঝা যায় এগুলো কিছুদিন হল নতুন করে লাগানো হয়েছে ।বাইরে থেকে কোন কারনে কেউ এসে পড়লে এই কুঠিতে আশ্রয় নেয় ।রান্নাবান্নার কাজে আছে বছর আঠারোর বদু নামের যুবক ।বড় বেশী কথা বলে সে । লোকমান ফকির সম্বন্ধে জিজ্ঞাস করতেই সে হরহর করে অনর্গল বকে আকাশ বাতাস এক করে ফেলল । লোকমান ফকির সম্বন্ধে বদুর মুখে যা জানলাম তাতে বেশ বুঝতে পারলাম লোকমান ফকিরকে গ্রামের কেউ ভাল চোখে দেখে না । তার উপর অনেক অভিযোগ আছে মানুষের । সে গ্রামের শেষ প্রান্তে একটা নির্জন জংলা মত জায়গায় ভাঙা মন্দিরে একা বাস করে ।কারো সাথেই তার ওঠাবসা এমনকি কথাবার্তা নেই । জনশ্রুতি আছে সে সেখানে বসে দিনরাত্রি তন্ত্রমন্ত্র সাধনা করে । কালোযাদুর চর্চা করে ।গ্রামের চেয়ারম্যান বিশিষ্ট হাজী সাহেব অত্যন্ত কড়া স্বভাবের মানুষ ।লোকমান ফকিরের ইসলাম পরিপন্থী কার্যকলাপের কারণে তাকে একঘরে ঘোষণা করেছে । তাকে নিয়ে কেউ যাতে আলোচনা না করে এমন বিধিনিষেধও জারি করেছে ।এত কিছুর পরও গ্রামের সহজ সরল অশিক্ষিত এই মানুষগুলোর অলস আড্ডায় ঘুরেফিরে কিভাবে যেন লোকমান ফকিরের কীর্তিকলাপ এসে পড়ে ।দীর্ঘ ভ্রমণে ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে পড়েছিলাম । সিমেন্ট বাঁধানো পাতকুয়োর বালতি বালতি শীতল পানি শরীরে ঢালতেই দীর্ঘ পথের ক্লান্তি ভুলে প্রশান্তিতে মনটা ভরে গেল ।প্রগল্ভ স্বভাবের হলেও বদুর রান্নার হাত বেশ ভাল । টেংরা মাছের ঝোল, মিষ্টি কুমড়ার ঘন্টো ,মসুরের ডাল দিয়ে ঠেসে ভরপেট খেয়ে বিছানায় সটান হয়ে লম্বা একটা আরামের ঘুম দিলাম । ঘুম যখন ভাঙল তখন পড়ন্ত বিকাল । সূর্যের ম্লান আলোকরেখা জানালা দিয়ে এসে পড়েছে ঘরে ।শরীরটা বেশ ঝরঝরে লাগছে ।লোকমান ফকিরের সন্ধানে বেরিয়ে পড়লাম । ইংরেজ কুটিরের সামনেই ফাঁকা মাঠের মত জায়গা পড়ে আছে ।তাতে কিছু গরু ছাগল চড়াচ্ছে রাখাল বালক। পশ্চিমের আকাশ লাল করে ঢলে পড়েছে রক্তিম সূর্য । অস্তগামী সূর্যের আলোকচ্ছটায় চারপাশ স্বর্ণোজ্জ্বল ।হাটতে হাটতে গ্রামের বাড়িঘর দেখতে লাগলাম । মাটির কোঠাবাড়িতে খড়ের দোচালা ঘর । গ্রামের ছোটছোট ছেলেমেয়েরা উঠোনে কানামাছি অথবা গোল্লাছুট জাতীয় কিছু একটা খুব হৈচৈ করে খেলছে । অশতীপর বুড়ো বুড়ি দাওয়ায় বসে ছেলেমেয়েদের মৃদু ভর্ৎসনা করছে । গ্রামের চাষীরা বাজারের থলে হাতে বাজারের দিকে যাচ্ছে ।বাজারগামী এক মধ্যবয়সী লোককে থামিয়ে লোকমান ফকিরের আস্তানার কথা জিঞ্জাস করতে লোকটা কঠিন চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো ।আমি আমার পরিচয় এবং উদ্দেশ্য ভেঙে বলার পরও তার দৃঢ় কঠিন মুখের অবয়োব একটুও বদলালো না ।আরও গ্রামের দু একজনকে প্রশ্ন করলাম । তারও কাঠের পুতুলের মত নির্বাক ।ছোট বাচ্চাদের লোকমান ফকিরের কথা জিজ্ঞেস করতেই ভূত দেখার মত ভয় পেয়ে একদৌড়ে বাড়ির ভেতর পালালো। অগত্যা হাল ছেড়ে একটু ঘুরেফিরে আমাকে ফিরতে হল কুঠিতে ।রাতে খাবার পরে বদুকে ডেকে জিজ্ঞাস করতেই সে গম্ভীর মুখে বলল-"নিষেধ আছে ।"
আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম-"কার নিষেধ?"
-"চেয়ারম্যান সাহেবের।"
-"কিন্তু সেটাতো গ্রামের মানুষদের জন্য । আমি তো আর তোমাদের গ্রামের না ।তাছাড়া আমি সাংবাদিক ।"
-"লোকমান ফকিরের সাথে দেখা করতে চাইলে আপনাকে চেয়ারম্যান সাহেবের অনুমতি নিতে হবে ।"
বুঝলাম চেয়ারম্যানকে গ্রামের লোকজন বাঘের মত ভয় পায় । এখানে তিনিই রাজা । তারা অনুমতি ছাড়া গ্রামের মানুষের সাহায্য পাওয়া একপ্রকার দুরাশা ছাড়া কিছু না ।পরদিন সকালে চেয়ারম্যান সাহেবের সাথে দেখা করতে গেলাম ।
(তিন)
বয়স পয়তাল্লিশ ছেচল্লিশের বেশী হবে না । বুক পর্যন্ত নেমে পড়া মুখভর্তি কাঁচাপাকা দাড়ি । কানে আতরের তুলা গুঁজা ,চোখে সুরমা লাগিয়েছেন ।সিজদা দিয়ে কপালের মাঝে কালো দাগ করে ফেলেছেন।মাথায় সুশোভিত টুপি ,চেহারায় প্রভুত্বের ছাপ । পান চিবতে চিবতে কথা বলছেন । তার তীব্র তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আমার উপর । কথাবার্তা অস্বাভাবিক রকমের কর্কশ । পানের বোটায় চুন নিয়ে মুখে পুরে জিঞ্জাস করলেন- "সাংবাদিক?"
আমি মাথা নেড়ে উত্তর দিলাম -"জ্বী"
-"এর আগেও আপনার মত অনেকে আসছিল লোকমান ফকিরের খোঁজে । পারে নাই দেখা করতে । আমি দেখা করতে দেই নাই ।" চেয়ারম্যানের কথার মাঝে বেশ দাম্ভিক ভাব । তিনি রুক্ষ কঠিন গলায় বললেন-"ঈমান আর আমলের অভাব । তা নাহলে কেউ একটা কাফের নাফরমানের সাথে হৈ হৈ করে দেখা করতে আসে ? আপনি কাফের দেখতে এসেছেন । আপনাকে নিষেধ না করলে আমরাও সেই পাপের ভাগীদার হব । আমার দ্বারা এতবড় জঘন্য কাজ হবে না । "
আমি চেয়ারম্যানের কথায় দমে গেলাম । শেষ পর্যন্ত একটা চেষ্টা করা যায় কিনা ভেবে অনুনয়ের গলায় বললাম-"দেখুন চেয়ারম্যান সাহেব আমি অনেকদূর থেকে এসেছি লোকমান ফকিরের সম্বন্ধে জানতে । সে সত্যি বাঁশি বাজিয়ে বৃষ্টি নামাতে পারে কি না তার সত্য মিথ্যা উদঘাটন করা সাংবাদিক হিসেবে আমার দায়িত্ব । আপনি যদি দয়া করে একবার দেখার সুযোগ করে দেন তাহলে,,,,,,,।" চেয়ারম্যান আমার কথায় ক্ষেপে গিয়ে গর্জে উঠলেন-"আপনি আমার কথা বিশ্বাস করছেন না । ওটা একটা শয়তান তান্ত্রিক । কালো জাদুকর । শয়তানী কূটকৌশলে সে সকলের চোখে ভেলকি লাগিয়ে বৃষ্টি নামায় । নাউজুবিল্লাহ্ । বৃষ্টি নামানোর মালিক আল্লাহ । মানুষের সাধ্য আছে ? আপনি আমারে অবিশ্বাস করে বড় অপমান করছেন । ঠিক আছে আপনি লোকমান ফকিরের কুফরি কারবার দেখবেন খোলা মাঠে সবার সামনে । তারপর আপনার খবরের কাগজে লিখবেন লোকমান কালো জাদুকর তান্ত্রিক । সে ইসলামের শত্রু । কি লিখতে পারবেন ? যদি লিখতে পারেন তাহলে মাঠ ভর্তি মানুষের সামনে লোকমানের শয়তানি কারবার দেখাব । কি রাজি আছেন সাংবাদিক সাহেব ?"
আমি পড়লাম ভীষণ দ্বিধাদ্বন্দে । একদিকে লোকমান ফকির সম্বন্ধে এতগুলো মানুষের অকাট্য বয়ান অন্যদিকে নিজে থেকে নিশ্চিত না হয়ে একটা মানুষকে ইসলামের শত্রু হিসেবে অভিহিত করার উদ্বেগ চেপে ধরলো আমাকে ।শেষ পর্যন্ত কিসের টানে জানি না চেয়ারম্যানের কথায় রাজী হয়ে গেলাম ।আমার নিজেরও যে প্রচন্ড কৌতূহল হচ্ছিল সরেজমিনে একটা চাঞ্চল্যকর ঘটনার সাক্ষী হতে । আর এই নির্লজ্জ কৌতূহলের কারনে আজও আমাকে গ্লানিতে পুড়তে হচ্ছে ।প্রচন্ড অপরাধবোধে আমি আজও তিলে তিলে যন্ত্রণা পাচ্ছি । লোকমান ফকিরের বীভৎস অসহায় মুখটা আজও প্রতি রাতে আমার দুঃস্বপ্নের কারন ।সেদিন কিসের মোহে আমি চেয়ারম্যানের চুক্তিতে সম্মতি জ্ঞাপন করেছিলাম ভাবলে আজও গা শিউরে ওঠে ,অনুশোচনায় দগ্ধ হতে হয় ।
(চার)
ইংরেজ কুঠির সামনে ফাঁকা মাঠটাতে গ্রামের ছেলে বুড়োর দল ভেঙে পড়েছে । অনেক দূর দূরান্তের গ্রাম থেকে মানুষজন এসে ভিড় করেছে । ভীড়ের মাঝে বংশীবাদক লোকমান ফকির।বয়স বড়জোর চল্লিশ হবে । নামের সাথে চেহারার কোন মিল নেই । নামের উপাধি ফকির হলেও চেহারা চরিত্রে ছিটেফোঁটা ফকির সন্ন্যাসীর বেশ নেই ।গ্রামের আট দশটা মানুষের মতই সরল তার হাবভাব পোশাক পরিচ্ছদ।অনাহারে অর্ধাহারে গ্রামের একপ্রান্তে একঘরে অবস্থায় থাকতে থাকতে চেহারা ভেঙে গিয়ে রোগক্লিষ্ট দেখাচ্ছে তাকে।তার হাতে অতি সাধারণ বাঁশের বাঁশি ।এতগুলো মানুষের মাঝে তাকে অত্যন্ত ভীতসন্ত্রস্ত এবং অসহায় দেখাচ্ছে । অসহায় চোখে সে সমাগত জনতার দিকে তাকিয়ে আছে। তার দৃষ্টির মাঝে একটা করুণ মিনতি । লোকমানকে দেখে ভীষণ মায়া হল আমার ।আমার মন আপনা থেকেই বলে উঠলো লোকমান কখনো মানুষের চোখে ধূলো দিয়ে যাদুমন্ত্র বলে বৃষ্টি নামাতে পারে না ।মানুষ ঠকানোর মত বিদ্যা অন্তত এর দ্বারা সম্ভব না । বার বার অন্তর তোলপাড় করছিল লোকমান নির্দোষ । লোকমান নির্দোষ । তার ভীষণ বিপদ । তার ভীষণ বিপদ ।সমাগমের মাঝে চেয়ারম্যান আসতেই কৌতূহলী মানুষজনের গুঞ্জন থেমে গেল । সবাই একদৃষ্টে সসম্ভ্রমে চেয়ারম্যানের দিকে তাকিয়ে । চেয়ারম্যান অত্যন্ত রাশভারী ভঙ্গিতে লোকমানের পাশে দাঁড়ালেন । তীব্র দৃষ্টিতে আপাদমস্তক লোকমানকে নিরীক্ষণ করে ধেড়ে গলায় ডাকলেন-"সাংবাদিক সাহেব কোথায় ?তিনারে সামনে আসতে বলেন । "
আমি ভীড়ের পিছনেই ছিলাম । চেয়ারম্যানের ডাক পড়তেই ভীষণ বিব্রতভাবে ভীড় ঠেলে সামনে গিয়ে দাড়ালাম । চেয়ারম্যান আমার দিকে একপলক দৃষ্টি ফেলেই উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্যে ঈমান আর কাফের সম্পর্কে সুবিস্তৃত ভাষণ দিলেন । বার বার উদাহরণ টেনে লোকমান ফকিরের ঘৃণ্য কৃতকর্ম সম্পর্কে সকলকে সতর্ক করে দিলেন ।পরকালে লোকমান ফকিরের মত কাফেরের কি শাস্তি হবে সে সম্পর্কে গ্রামের মানুষকে অভিহিত করলেন । আর এই পুরো সময়টা জুড়েই লোকমানের সকাতর করুণ দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল আমার উপর । চোখের ভাষায় বার বার আমাকে ধিক্কার জানাচ্ছিল যেন সে । লোকমানের দিকে আমি লজ্জায় তাকাতে পারছিলাম না। তার এই বিপন্ন দশার জন্য মূলত আমিই তো দায়ী । চেয়ারম্যান সবাইকে স্বগোতস্বরে তিনবার আস্তাগফিরুল্লাহ্ পড়তে বলে লোকমানের দিকে ক্রূর দৃষ্টি ফেলে গমগমে স্বরে নির্দেশ দিলেন-"তোর খেল্ শুরু কর লোকমান ।"
লোকমান তার বাঁশি হাতে নিষ্কৃতি পাবার জন্য করজোড়ে চেয়ারম্যানকে কাতর চোখে মিনতি করতেই চেয়ারম্যান খেঁকিয়ে ওঠে গর্জন করলো -শুরু কর লোকমাইন্যা " ।
লোকমান কম্পিত হাতে নিরুপায় ধরাশায়ীর মত ঠোঁটে বাঁশি ঠেকিয়ে ফুঁ দিতেই সুর বেরিয়ে এলো ফল্গুধারায় ।
(পাঁচ)
বাঁশির সুরের মূর্ছনায় জনতার সবাই বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লো । সে কি সুর !সে কি রাগিণী ! লোকমানের বাঁশি থেকে বেরিয়ে আসছে মেঘ মল্লরের রাগ ।তার অশ্রুসজল চোখে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুধারা । সুরের মোহনীয়তায় পুরো পৃথিবী যেন এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেছে । বাতাস তার দিক ভুলে গেছে,বনের পাখি ভুলে গেছে তার কাকলি ,নদীর স্রোতধারা ভুলে গেছে তার প্রবাহমান গতি ,ফুল তার সুবাস বিলাতে ভুলে গেছে । এমন স্বর্গীয় সুর কি এই ধূলোমাটির পৃথিবীর হতে পারে ? এও কি সম্ভব ? আর লোকমান ,সে কি এই পৃথিবীর নাকি এই পৃথিবীর হয়েও কল্পনার অতীত অন্য কোন জগতের ।চেয়ারম্যান আকাশের দিকে তাকিয়ে অধীর হয়ে কিসের যেন অপেক্ষা করছেন ।জ্যৈষ্ঠের গনগনে আকাশ থেকে আগুন ঝরে পড়ছে ।সেই আগুনের তাপ মাঠ থেকে তরঙ্গায়িত হয়ে অনবরত উঠে ভারী করছে বাতাস। কোথাও তিলমাত্র মেঘের হাতছানি নেই । চেয়ারম্যান আরও আকুল হয়ে অসহিষ্ণু ভাবে চক্রাকারে ধীরে ধীরে ঘুরতে ঘুরতে আকাশ পর্যবেক্ষণ করছেন । লোকমানের সুর তার অশ্রুধারার মত ক্রমাগত বাড়তে বাড়তে সব কিছুকে ছাপিয়ে অনতিক্রম্য ঊর্ধলোকে বিলীয়মান হয়ে যাচ্ছে ।অকস্মাৎ দমকা বাতাস উঠলো নিরুদ্ধ প্রকৃতিতে । প্রখর রোদ্রজ্জ্বল আকাশে দেখা দিল মেঘের আভা ।উপস্থিত সকলে চোখের উপর হাত রেখে আকাশের দিকে চাইলো ।একটু একটু করে দেখতে দেখতে সূর্যের তেজ কমে গিয়ে পুরো আকাশটা ঢেকে গেল কালো মেঘে ।যেন অচিন্তনীয় কোন এক মহা শক্তি তার প্রবল পরাক্রমে পর্যুদস্ত করলো সূর্যের তেজ। শো শো শব্দে তীব্র বেগে বাতাস বইতে লাগলো ।মেঘে মেঘে ঘর্ষণ লেগে প্রচন্ড বজ্র নির্ঘোষে আকাশের এ মাথা থেকে ও মাথা ঝিলিক দিয়ে গেলে বিদ্যুতের তীব্র রেখা । সমাগত ভীড়ের লোকজন আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে যে যেদিক পারলো পড়িমরি করে দৌড়ে পালালো । মুহূর্তেই শান্ত প্রকৃতি তার রুদ্র মূর্তির বেশ ধরলো । লোকমানের বাঁশির সুর তবুও থামে না । তার দুচোখ বেয়ে তখনও অবিরত অশ্রু ঝরছে । একটা মানুষের চোখে এত অশ্রু থাকতে পারে !ইংরেজ কুঠির খোল মাঠে বৈরী আবহাওয়ায় তখন কেবল আমরা তিনজন দাঁড়িয়ে । আমি লোকমান আর চেয়ারম্যান । চেয়ারম্যানের চোখেমুখে প্রবল উত্তেজনার ছাপ যেন সে এই কাঙ্খিত মুহূর্তটির অপেক্ষায় ছিল এতক্ষণ । আমি বিস্ময়ে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছি লোকমানের দিকে । কালো মেঘের বুক চিড়ে ছোট ছোট ফোটায় বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে ।লোকমানের অটল অপার্থিব সুরে এতটুকু বিরতি নেই ,বেসুর নেই ।বরং সুরের লহরী যেন আরও বিক্ষুব্ধ হয়ে আকাশ বাতাসে প্রকম্পন তুলছে । সেই সুর মেঘের রাজ্যে গিয়ে তলোয়ারের মত মেঘ কেটে কেটে বৃষ্টি ঝড়াচ্ছে । চোখের পলকে হুড়মুড় করে বড় ফোটায় প্রবল ধারায় বৃষ্টিপাত শুরু হল । বর্ষণের তেজে পৃথিবী ঝাপসা অস্পষ্ট হয়ে উঠলো । লোকমানের বাঁশির সুরের বিরাম নেই বরং তা আর ঝঞ্ঝাময় হয়ে উঠেছে । লোকমানের অশ্রু বৃষ্টির ধারার সাথে একাকার হয়ে মিশে গেছে । অদূরে কড়াৎ করে ঝিলিক দিয়ে বাজ পড়লো বাতাসে হেলে পড়া তাল গাছের মাথায় । মুহূর্তে সেটা পুড়ে ভস্ম হয়ে গেল ।কিছুদূরেই প্রবল ঝাপসা বৃষ্টি মাথায় চেয়ারম্যান আমাকে লক্ষ করে বিজয়ের হাসি হাসছে ।বিদ্যুতের ঝলকানিতে তার চোখদুটো জ্বলে উঠলো। বিজয়ী ভঙ্গিতে হাটতে হাটতে আমার কাছে এসে আমার কাঁধে হাত রেখে চেয়ারম্যান প্রত্যয়ী ভঙ্গিতে বলল-"কি সাংবাদিক দেখলে তো ?আর এক মুহূর্ত এই গ্রামে নয়। ফিরে গিয়ে খবরের কাগজে বড় বড় হরফে হেডলাইন ছাপাবে লোকমান ফকির ভন্ড কাফের ইসলামের শত্রু ।"
(ছয়)
এই অত্যাশ্চার্য ঘটনার পর আমি আর একমুহূর্ত রসুলপুর গ্রামে থাকি নি ।পরদিন খুব ভোরে ট্রেনে চেপে ঢাকায় ফিরে এসেছি ।লোকমান ফকিরের খবরটা আর খবরের কাগজে ছাপাই নি । কেউ জানতে চাইলে বলেছি লোকমান ফকির বলে সেখানে কেউ কখনো ছিল না । সবই গাল গল্প লোকমুখে প্রচারিত । বাঁশি বাঁজিয়ে বিজ্ঞানের এই যুগে কেউ বৃষ্টি নামাচ্ছে এটা কি কোন বিশ্বাসযোগ্য কথা হল? অশিক্ষিত কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষ মাত্রই এসব আষাঢ়ে গল্প বিশ্বাস করে । আমার কথায় লোকমান ফকিরের বাঁশি বাজিয়ে বৃষ্টি নামানোর গল্পটা সবাই রূপকথা ভেবে স্বস্তি পেলেও আমি আমার চর্মচক্ষে যা দেখেছি সেটা তো আর রূপকথা নয় । এ যে ঘোর বাস্তব । শুধু আমি নই অনেকে এই বিরল ঘটনার সাক্ষী হয়ে থাকবে ।কিছুদিনের মাঝেই পত্রিকা অফিসের চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছিলাম । বংশীবাদক লোকমান ফকিরের শেষ পরিণতি কি হয়েছিল তা আর জানতেও যাই নি ।কেন যাই নি তার কারণটা ঠিক ব্যাখ্যা করতে পারব না তবে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলে একটা ব্যাপার থাকে ।এই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করেছিলাম বংশীবাদক লোকমানের সাথে খুব অশুভ কিছু হয়েছিল। এই অভূতপূর্ব ঘটনার পরও আমার মনে হয় নি লোকমান ভন্ড তান্ত্রিক কপট কেউ । তার চোখের সেই করুণ মিনতি ,অশ্রুসজল আকুতি ,কম্পিত হস্ত কখনো কপট হতে পারে না । কখনো পারে না ।তাহলে লোকমান কে? সে কি এই পৃথিবীর কেউ নাকি অন্য কোন জগতের ?এই প্রশ্নের উত্তর আমি আমার স্বল্প জ্ঞানে আজও হাতড়ে ফিরি ।সঠিক উত্তর পাই না । তখন হ্যামলেট নাটকের সেই বিখ্যাত উক্তিটা কানে বারংবার বেজে ওঠে-'There are more things in heaven and earth,
Horatio,than are dreamt in your philosophy'
১৪ অক্টোবর - ২০১৬
গল্প/কবিতা:
৭ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪