ঝাটা দিয়ে আইজকে তোর দুইধে মুখ সুজা কইরে দেব।হারামজাদা,এত্ত বড় বাইড় বাইড়ছে,আমার মুখের উপর কথা কইস।দাড়া আইজকে তোর বাপের নাম ভুলাই দেবরে শুয়োর।
ও কাকা,ও কাকা আমার কোন দোষ নেই,তালেবরে আমি ফেইলে দিইনি,ও একলা একলাই পইড়ে গেছে।
একলা একলা পইড়ে গেছে,ফিরিস্তার মত ছেইলেডারে মাইরে ফেইলতে চাইছিলি,তোরেই আইজকে মাইরে ফেইলব শালা কাইলো ভূত।
ও মাগো-ও আব্বাগো-ও কাকা-কাকা-রে আমারে ছাইড়া দেন।হু-হু-হু।
ওরে ধলুর বাপ,ছেইলেডাতো মইরে যাবেনে,ছাইড়ে দেরে বাজান,ছাইড়ে দে।
তালেবের ডাক নাম হলো ধলু।টুকটূকে ফসসা,নাদুস-নুদুস চেহারার কারনে জন্মের পর ওর বাপ-মা ওকে ধলু নামে ডাকে।আর স্কুলের নাম হলো মোহাম্মদ আবু তালেব।
কপিল আলীর কাছ থেকে প্রতিবেশি সাইরা বানু বাজপাখির মত ছোঁ মেরে কেড়ে নেয় শহীদ আলীর ছেলেটাকে।ষাটউর্ধ্ব পড়ন্ত বয়সী বিধবা মহিলা এই সাইরা বানু।কোন ব্যাটা ছেলের মা হইতে পারে নাই সে।চার চারটা মেয়ে,বিয়ে দিয়ে দিয়েছে সে অনেক দিন হয়ে গেছে।স্বামী মারা যাবার পর এত বড় একলা বাড়িতে একা একাই দিন কাটে তার।ধর্ম কর্ম নিয়েই সারাদিন ব্যস্ত থাকে সে,ইদানিং বাড়ির বাহিরে খুব বেশি একটা বেরও হয় না।কপীল আলী যখন শহীদ আলীর ছেলেটাকে মারতে মারতে বাড়ির পাশ দিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল,ছেলেটার কান্না শুনে এই ভর দুপুরে সে আর ঘরের মধ্যে বসে থাকতে পারল না।সাইরা বানুর জোরাজুরিতে কপিল হাত ছেড়ে দেয় জায়েদের।হ্যা ছেলেটার নাম জায়েদ।এরই কথা আজকে আপনাদের বলব,তবে পরে আসি সে কথায়।
তুমি বইলে যাইত সাপের বাইচচা আইজকে বাইচে গেলোগো চাচি,আরেক দিন দেইখি আমার ছেইলের পাছে,হু।
কপীল, একা একা ফস-ফস করতে করতে নিজের বাড়ির ভিতর ঢুকে গেল।সাইরাবানু আর কপীল আলীর বাড়ি একই জায়গায়,সাইরা বিবির স্বামি কপীলের দূরসম্পর্কের চাচা হয়। তাছাড়া কপিলের মা আর সাইরা বানু ছোট বেলার সই।সেই সূত্রে উভয়ের একই জায়গায় বসত।জায়েদের প্রতি সাইরা বানুর এক ধরনের বিশেষ মমতা রয়েছে।
২
শহীদ আলী আর কপীল আলী এক মায়ের পেটের আপন দূই ভাই।এক মায়ের পেটের বলছি এজন্য যে,সমাজের আর সব মায়েদের মত চিরাচরিত স্বভাব-জাত ভালবাসা উভয় সন্তানের প্রতি সমান নয় তার।এ এক আজব ব্যপার,অতি রহস্যময়তায় ঘেরা।এর সদুত্তর আজও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।বড় ছেলে কপীল আলী।জান প্রান উজাড় করে দিয়ে মা তাকে ভালবাসে।সারাদিন শুধু কপীল আর কপীল।যদিও ছেলে বড় হয়েছে,সংসার পেতেছে,তিন সন্তানের জনক সে।তালেব হচ্ছে কপীল আলীর একমাত্র ছেলে।বিধাতার কি আজব খেলা,কপিলের ছেলেটা মায়ের পেট থেকে একটা বাকা পা নিয়ে জন্মেছে।না একদম পঙ্গু নয়,হাঁটা চলা কাজ-কর্ম সবই করতে পারে সে।তালেবের দাদী অর্থাৎ কপীল আলীর মা সাইরা বানুর মতই বৃদ্ধ বয়সী একজন মহিলা।থাকে বড় ছেলের বাড়িতে,ছোট ছেলের নাম গন্ধ সে শুনতে পায় না।চোখের সামনে দেখলে তাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়,অভিশাপ দিতে থাকে,রাত দিন শুধু গালাগালী করে।সত্যিই বড় আজব লাগে,এ কেমন নিষ্ঠুরতার বহিপ্রকাশ!কিন্তু শহীদ আলী মায়ের পিছু কখনও ছাড়ে না,সব সময় যেন আঠার মত লেগে থাকে।যেদিন স্ত্রীকে হত্যার দায়ে,শহীদ আলীকে পুলীশ ধরে নিয়ে যায়,মা বারান্দায় হেলান চেয়ারে বসে ছিলেন,না একটুও নড়েন নি,তার চোখে দূ ফোটা জলও দেখা যায় নি,বাড়ির আর সবার মত সেও ছিল নিরব।সেঝ বোনটা দৌড়ে গিয়ে দারোগা বাবুর পা জড়িয়ে ধরেছিল,তাতে কাজ হবার কথা নয়।শহীদের ছেলে জায়েদ উঠোনের কোনে বরই গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে ছিল,তার দিকে লক্ষ করে শহীদ বলেছিল,ও জায়েদ,তোর দাদী,দেইখে রাইখিসরে আব্বা,তোর দাদায় কয়ে গেছে।আমি দেইখছি,তুই দেইখবি,আর আইসবনারে বাপ,আর আইসবনা।এর পর অনেক কিছু ঘটে গেছে,স্ত্রী হত্যার দায়ে,ফাঁসী হয়ে যায় শহীদ আলীর।নিথর দেহটার জায়গা হয়েছে গন কবরস্থানে,লাশটা পর্যন্ত কেউ গ্রহন করল না।অবশ্য ছেলেটাকে পিতার সাথে শেষ সাক্ষাত করার সুজোগ করে দিয়েছিল জেল সুপার সাহেব।সে দিন পিতার সাথে সাক্ষাতে বাপ ব্যাটার কি কথা হয়েছিল তা কেউ জানেনা,জানার দরকারও নাই।খুনির রক্ত বলে,মামার বাড়িতেও জায়গা মেলেনি জায়েদের।মাত্র ১২ বছরের একটা ছেলে,সারা পৃথিবিটা আজ তার জন্য অন্ধকার,এত আপন জনের মাঝেও সে যেন আজ সকলের কাছে সব চেয়ে বেশি পর।বাপ মা ছাড়া একলা বাড়িতে,এ বাড়ি ও বাড়ি,এ পাড়া ও পাড়া করে করে পেটে কিছু ভাত জোটে তার।আজ আর কারো বাড়িতে ভাত জোটেনি,খুধার যন্ত্রনায়,ছেলেটা কপীল আলির নারিকেল তলায় পেটটা উপুড় করে দিয়ে কাতরাচ্ছিল,এমন সময় কপীল আলীর ছেলে তালেব এসে ডাক দিল,ও জায়েদ,ওঠরে,উঠে পড়।চলেক দুই ভাই মিলে গাছের থিকে জামরুল পাইড়ে খাবানে।
তুই যা,তোর সাথে দিখলে কাকা মারবেনে।
দিখবেনানে তুই চলেক।
যদি দেইখে ফেলে?
তোর কিছু হবেনানে,আমি দেখবানে তুই চলেক তো।
আগত্যা জায়েদ তালেবের সাথে যেতে বাধ্য হল।সারা গায়ে ওই এক জনই আছে ওকে ভালবাসে।মাঝে মাঝে চুরি করে নিজের খাবারটাও ওকে খেতে দেয়।তালেবের মা একদমই পছন্দ করে না,তার ছেলে জায়েদের সাথে মিশুক।কিন্তু তালেব কারও কথা শোনে না।আজকেও তার ব্যতিক্রম হয় নি।আর এই জামরুল পাড়তে গিয়েই তালেব গাছ থেকে পড়ে হাত ভেঙে ফেলেছে।যার ফল স্বরুপ কাকার হাতে চরম পিটুনি খেল জায়েদ,ভাগ্যিস সাইরা বানু এসেছিল।
৩
আইচ্ছা দাদী,আমার আব্বারে ওরা ধরেনিয়ে মাইরে ফেইল্ল ক্যান?
তুই পুইচকে ছেইলে,এত কথা বুইঝবিনে।
আমার মাইরে কিডা মারছিলো,আমি দেইখছি।
সাইরাবানু জায়েদের মুখ চেপে ধরে।এই কথা আর কাউরে কইসনেরে ব্যাটা ,তোরেও ওরা মাইরে ফেলবেনে!
যদিও শহিদ আলীর ইতমধ্যে ফাশি হয়ে গেছে কিন্তু গ্রামবাসী এতদিন পর আসল সত্যটা জানতে পেরেছে।সেদিন কপিল আলীর বউয়ের সাথে কপীলের সেঝ বোনের ঝগড়া হয়।ঝগড়ার এক ফাকে সব সত্য কথা বের হয়ে আসে।
ও বড় ভাবি,তুই সাধু সাইজতিছিস,ক্যানরে?আমি বুঝি জানিনে,যে তুই আর বড়ভাই মিলে ছোট ভাবিরে মাইরে ফেইলেছিস।মায় খালি বড়জনরে বাচানোর জন্যে ছোট ভাইরে পুলিশের হাতে তুইলে দিছে,আমারে তোমরা ঘরে আইটকে রাইখছো।পাগল বানাইদিছো আমারে,আমি কিন্তু পাগল না,কয়ে দেব………
বাড়ির সবাই টানাহেচড়া করতে করতে, জায়েদের সেঝ ফুপুকে ঘরের মধ্যে নিয়ে গিয়ে্,আবার শিকলীদিয়ে বেঁধে রাখলো। মানুষ যা জানার জেনে গেছে।সর্বনাশ যা হবার তা হয়েছে।কিন্তু যে ছেলে তার পরিবারের সবাইকে এত ভালবাসে,বিশেষ করে যে মায়ের জন্য এত বেশি পাগল ছিল,সেই কিনা নিজের হাতে ছেলে টাকে মেরে ফেললো! নাতীটাকে পর্যন্ত সহ্য হয় না তার।ছিনামার ঘটনাকে হার মানায়,যেন রুপকথায় সাজানো গল্প,এ পার্থীব জীবন কতই না বিচিত্র!কিন্তু কেন?এ রহস্যের জট আজো খোলে নাই।অবুজ বালকটির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকা যায় না,সর্বশ্ব হারা এতিম ছেলে।কি এমন দোষ থাকতে পারে ছেলেটির,এর প্রতি এত অবিচার কেন?একা একা নিজের কাছে প্রশ্ন করে যায় সাইরা বানু।যায়েদের দাদীর সাথে সাইরাবানুর পরিচয় সেই ছোট্ট বেলা থেকে,বিয়ের আগে এরা দুজন ছিল সই।বরাবর ভালো মনের মানুষ এই মাজেদা বেগম,কিন্তু হঠাত করে যে কি হয়ে গেল……
না্, এই ছেইলেডার পরানডা,আন্ধারের মত হইয়ে যাইচ্ছে,কিছু একটা কইরতে হয়,মাজেদার কাছে আইজকে জিঙ্গেস কইরব এমন কইরে ছেইলেডারে গাঙে ভাসাই দিল ক্যান,একন আবার লাইগছে,নাতীডার পিছে।
মনে মনে সংকল্প করে সাইরাবানু,মাজেদা মানে জায়েদের দাদী তার পুরোনো বান্ধবী। তার কাছে কোন না কোন কারন নিশ্চয় জানা যাবে।জায়েদকে সে কথা দিয়েছে,তাকে আর এই যন্ত্রনার আগুনে শিশুকালেই জ্বলে পুড়ে মরতে দিবে না।
৪
মাজেদা কি ঘরে আছিস রে বোইন?কপীল আলীর স্ত্রি ঘর থেকে বেরিয়ে আসে।
চাচী কিমন আছেন,তা কি মইনে কইরে আইলেন,আপনেরে তো একন আর ইদিকে দিকায় যায় না।
শরীলডা ভাল-লাগেনা,গিরায় গিরায় ব্যথা,তাই ঘর থেইকে বাইর হতি পারিনা গো।তা তোমার শ্বাশুড়ী কি বাড়িতে আছে?
জী গো চাচী,কোনের খুপরীতে আছে ,গিয়া দ্যাখেন।
সাইরা বানু কোনার দিকের খুপড়ি ঘরটাতে প্রবেশ করে।মাজেদা বিবি খাটের উপর শুয়ে আছে,সাইরা বানুকে দেখে উঠে বসে।কিরে সই কইথিকা আইলি,এতদিন পরে, কি মনে কইরে,আইজ কাইল তো তরে দিকাই যায় না।
সে আর কইসনেরে সই,একা একা আর থাইকতে মনে চায় না,একন খালি দিন গুইন্তে থাকি কবে জানি চইলে যাই…যাইগকে সে কথা,আইজকে তোর সাথে কিছু কথা কইতে আছি।
তুই আমার ল্যাংটা কালের সই,কি কথা কয়ে ফালা।
সাইরা বানু হাত কচলাতে কচলাতে বলে না,তুই যদি আবার……
মনে কইরবার দিন কি আছে লো সই,কয়ে ফালা।
তবুও……
আইচ্ছা হইছে ক দিকি কি কথা?
শহীদ আলীরে তুই ফাসাইয়া দিলি ক্যানরে,বউডাতো মাটির মরা ছিলো,তারেও মাইরলি।
সাইরা বানুর এ ধরনের বক্তব্যে একদম হকচকিয়ে ওঠে মাজেদা বিবি।এমন কথা শুনার জন্যে সে আদৌ প্রস্তুত ছিল না।নিজেকে সামলে নিয়ে গলার স্বরটা একটু খাকরিয়ে উঠে মাজেদা বলল,এই সব কথা তোরে কিডা কইছে?
গেরামের ব্যাকলোকেই জানে,গন্ডগোলের ডরে কেউ রাও করে না।কিমন মারে তুই,নিজের ছেইলেরে কেউ এমন হাল কইরতে পারে!ছেইলেডার নাই দোষ ছিলো,বউডার?ধইরেনিলাম অরও দোষ ছিলো,নাতীডার কি দোষ তুই পাইলি?তুই তো এমন ছিলি নেরে মাজেদা!
অই আমার ছেইলে না।শূধু পেটে ধইরছি।
কি কইতে চাইস এই সব কথা?
যা কইছি,কইছি অ আমার ছেইলে না,তোগের ভাইয়ে যত-দিন ছিলো, পুইশেছি।আপদটা মইরছে গলা থিক্কে কাঁটা নাইমে গেছে।
কার ছেইলে ছিলো শহীদ?
আমার।
তাইলে?
শুনবি তাইলে?শুইনে যা,অগোরে কেন আমি দেইখতে পারি না।
মাজেদা বিবি তার এতদিনের হিংস্রতার কারন সাইরা বানুর কাছে বলতে রাজি হয়,তবে এই বয়সে আর লাঞ্ছনা,গঞ্জনার শিকার সে হতে চায় না।সাইরা বানুকে কথা দিতে হবে কেউ যেন আর এই গল্প তার জীবদ্দশায় শুনতে না পারে।সাইরা বানু মাজেদাকে কথা দিয়েছে,সে আর কাউকে এই কথা জানতে দিবে না।মাজেদা তার কথা শুরু করে,জীবনের কথা,অজানা কথা,রহস্যময়তায় ঘেরা কথা,তার জীবন্ত অতীতের কথা।
আমার স্বামীর তখন বেশ অভাব যাইচ্ছিল,ঘরে ছেইলে পুইলে মেলাডিক,কাম কাইজ খুব একটা থাইকতো না,কিন্তু সংসারে দুঃখ কষ্টের মধ্যেও শান্তি ছিইলো।তোগের ভাই বন্ধু বান্ধব আর হই হুল্লোইড় নিয়েই থাইকতো।অর বন্ধুরা প্রায়ই আমাগের বাড়িতে আইসতো।মাঝে মদ্ধ্যেই আমাগের উঠোনে তাস আর লুডু খেইলতো অরা।সন্ধ্যের পরেই বেশী খেইলতো।অনেক রাইত পর্যন্ত অরা আড্ডা দিত।ছোট ছোট ছেইলে পেইলে নিয়ে প্রায়ই আমি ঘুমিয়ে যাইতাম।সেইদিনও ঘুমিয়ে ছিলাম,রাইত তখন কত হবি কতি পারিনে,মাঝ রাত্তিরি হবে হয়তো।হঠাত কিসের যেন টান টান লাইগলো হাতে,ঘুম থেইকে জাইগে দেখি,আমার শাড়ি দিয়ে কিডা যেন আমার হাত বান্ধে রাখিছে।তিন চাইরজন তোগের ভাইরে মাইরতেছে,আমি উইঠতে চাইলাম,পাল্লাম না,জানোয়ারটা আমার সব…………
ঘটনার বর্ননায় মাজেদা চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে কাঁদতে লাগলো,সাইরা বানুর চোখেও জল।তারপরও কাঁন্না মাখা চোখে সাইরা জিঞাসা করলো কিডা সেই হারামীর বাইচচাডা সই?
নজু ব্যপারী।
নজু ব্যপারী?
না,অর সঙ্গে কাইশ্যা,কলিম,লতা মাষ্টার ছিইলো।
শহীদ কার ছেইলে?
সইয্য কইরতে পারবি তো?
পাইরব না ক্যান,তুই কয়ে ফ্যালা।
তোর ভাই জামালের।
সাইরা বানু যেন আকাশ থেকে পড়ল,জামাল তার আপন বড় ভাই,পিরের মত শ্রদ্ধা করত তার এই ভাইকে।ছোট বেলা থেকে কোন খারাপ কাজের সাথে কেউ কোন দিন দেখে নি।না –না তার সেই ভাই এমন কাজ করতেই পারে না।
তুই মিথ্যে কথা সাজিয়ে কচ্ছিস।
মিথ্যে?মিথ্যে কথা?তোর সাথে হঠাত কইরে কথা বন্ধ কইরে দিছিলাম ক্যান তুই কইতে পারবি?
তুইতো কইলি নজু,কাইশ্যা,কলিম আর লতা মাষ্টার ছিইলো,আমার ভাইরে টাইনলি কেন?
অরা একদিন আমার সর্বনাশ কইরছে,জামাইল্যা শুয়োর মরার আগের দিনও আমার ক্ষেতি কইরেছে।আমার ছেইলে পেইলে সবাই তখন ছোট্ট ছোট্ট,ওই ঘটনার পরে,পঞচায়েতে বিচার চায়েছিলাম।তোর বাপ ছিইলো মাতব্বর।সকালে যখন বিচার নিয়ে গেছি,তোর ভাই জামাল বারান্দায় বইসে ছিলো।তোর আব্বায় কইলো মান সম্মানের কথা ভাইবা সব ভুইলা যাও, গেরামের লোক ছি ছি দিবো।বিচার না পায়ে আপীলের বাপের বাড়ি আইসতে আইসতে পাও দুইডা অবশ হইয়ে গেল।কান্দা কাঁটা কইরা রাইতে আমার ঘুম আইসে গেছে এমন সময় জামাল আইসে আমার ছেইলে পুইলে আর অগো বাপেরে মাইরা ফেইল্ব কয়ে আমার ………।
একদিন দুইদিন না শাপে কাইটা মরনের আগেও অই আমার ক্ষেতি কইরে গেইছে,শহীদ তোগো ছেইলে,আমি কাল শাপের বাইচচারে শেষ কইরেছি,এখন অর ছেইলের পালা।কপীলের বাপের জন্যি কিছু কইরতে পারি নি আমারে বারবার কইতো অরতো কোন দোষ নাই।পাপের শরীর নিয়ে আমার স্বামির সামনে যাইতে পারতাম না,বঞচিত কইরছি তারে,হারামীর বাইচচা আমার শরীল খাইছে,অর ছেইলে খাইছে রক্ত,আমি ছাইড়ব না,খাইয়ে ফেইলব আমি,খাইয়ে…………
মাজেদা বিবির এ চরম নির্যাতনের কথা তার ছেলে মেয়েরা কেউ কিছু যানে না,কেবল মা শহিদের সাথে খারাপ আচরন করত বলে ওরাও করত,এ ভাবেই এক সময় প্রতিশোধের আগুনে পুড়ে যায় শহীদ ও তার স্ত্রী।যে সন্তান কে সে মেনেই নেয় নি তার সন্তানকে কদর করার প্রশ্নই আসে না।শহিদ যেমন কিছু জানত না,কিন্তু মাকে ভালোবাসতো,কে তাকে ফাসিয়েছে সে জানত,তবুও কখনও দোষ দেন নি।বাবা তাকে নিষ্পাপ ভেবে ঘৃনার বদলে কোলে তুলে নিয়েছেন।তাকে জানায় নি তার আসল পরিচয়,বুকের মাঝে দাউদাউ করে জ্বলা চাপা কষ্ট নিয়ে মরে যাবার সময় কেবল বলেছিল মাকে দেইখবি,দে…ই……।
মাজেদা বিবির মুখে সমস্ত ঘটনা শুনার পর সাইরা বানুর লজ্জায় মাথা হেট হয়ে আসে।যে অপরাধ একটা পরিবারের দূর্বলতার সুজোগ নিয়ে তার ভাই করেছে,তার কোন ক্ষমা নাই,হতে পারে না।তবুও সে মাজেদার হাত জড়িয়ে ধরে,সই একবার আমারে ক্যান জানাইলি না?নরপিশাচ মরছে,গজব অরে ছাড়ে নাই,যত্ত ছেইলে পেইলে অর বউয়ের হয়েছে সব মইরেছে।আসলে সবই অর পাপের ফল।
সাইরা বানু কাঁদতে কাঁদতে মাজেদার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে,প্রতিহিংসার আগুনে পোড়া ষাটোর্ধ্ব একজন মহিলা তার যন্ত্রনায় শেষ ঘী না ঢালা পর্যন্ত শান্ত হতে পারে না।এখন থেইকে সাবধানে রাইখতে হইবে জায়েদরে,নইলে রইক্ষে হইবে না,মনে মনে বিড়বিড় করতে থাকে সাইরা বানু।
জায়েদ আজকাল সাইরা বানুর বাড়িতে থাকে,সাইরা বানু তাকে এখন নিজের নাতি করে নিয়েছে,সেও হয়তবা তার পূর্ব পুরুষের কু কর্মের কিছুই কোন দিন জানতে পারবে না।কিন্তু বাবার কাছে দেওয়া কথা সে রেখেছে,মাঝে মাঝেই সুজোগ পেলেই সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে, তার দাদির খুপড়িতে ঢুকে পড়ে।দাদীও এখন আর রাগটাগ করে না,হয়তবা তার অন্তরের কষ্ট হাল্কা হয়ে গেছে।কিন্তু সন্তানদের মাঝে যে হিংসা আর শত্রুতা তৈরি হয়েছে,সেটা কি আর কোন দিন শেষ হবে?অপরাধীরা অপরাধ করে নতুন নতুন অপরাধের জন্ম দেয়।আর প্রায়শচিত্ত করতে হয় প্রজন্মের পর প্রজন্মকে।