আজ ২৫ শে জুন। ইরফানের মনটা খুব ভালো গত তিন দিন যাবৎ। আর আজ এই ঝরণার পাশে দাঁড়িয়ে অন্তত আঠারো বার মনে মনে আবৃত্তি করেছে বুদ্ধদেব বসুর ‘চিল্কায় সকাল’ কবিতাটি।
“কি ভালো আমার লাগলো এই আকাশের দিকে তাকিয়ে,
চারদিক সবুজ পাহাড়ে আঁকাবাঁকা, কুয়াশায় ধোঁয়াটে,
মাঝখানে চিল্কা উঠছে ঝিলকিয়ে!”
কি অনুপ্রাস! প্রতিটি শব্দে মনের ভেতর কেমন হাহাকার সৃষ্টি হয়। কিসের একটা শূণ্যতায় বুকের ভেতরটা খাঁখাঁ করতে থাকে। কতো প্রাচীন এই অনুভূতি কে জানে! চিরন্তন? ইরফান ভাবতে থাকে। মনের ভেতর কী এক আনন্দ। আজ সেই দিন। বহু প্রতীক্ষিত। আর মাত্র কিছুক্ষণ, এরপরই সে আসবে যার জন্য এতো অপেক্ষা। দীর্ঘ এগারো মাস। তার মনে পরে তিন বছর আগের এই দিনটির কথা। বাংলায় অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলো তখন। বইয়ের লাইব্রেরীতে বুদ্ধদেব বসুর বইটা দেখে পাশে রেখে রবীন্দ্রসংকলনের একটা বই দেখছিলো ইরফান। পাশে একটি মেয়ে এসেই বুদ্ধদেবের বইটা হাতে নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখতে লাগলো। ইরফান একটু বিরক্ত হয়েই বললো- ‘আপু, বইটা আমি এখানে রেখেছি। আমি নেব এটা ।’
মেয়েটা কেমন ঠুনকো হাসি হেসে তাচ্ছিল্যের স্বরে বললো- ‘নিবেন, মানে নেন নি! তাহলে তো এইটা আমিও নিতে পারি।’ বলে দোকানিকে বইটা দাম জিজ্ঞেস করলো।
ইরফান এবার রেগে গিয়ে বললো- ‘আপনি দেখি আস্ত অভদ্র! এটা আমি নেব বলার পরেও আপনি দামদর করছেন দোকানির সাথে। আপনি অন্য একটা নেন, তাহলেই হয়।’
মেয়েটি হেসে বললো- ‘আপনি আরেকটা নেন, তাহলেই হয়।’
ইরফান অপমান বোধ করলো একথায়। নিজেকে সামলাতে না পেরে দোকানিকে বললো- ‘ভাই, আমার বই লাগবে না, রেখে দিন। আমি গেলাম।’ এই বলে দ্রুত পায়ে সে চলে এলো। পেছন থেকে সমস্বরে দোকানি ও মেয়েটি তাকে ডাকছে। সেদিকে কর্ণপাত না করে সোজা হেঁটে রাস্তা পাড় হয়ে গেলো ইরফান। পরদিন ক্লাস শেষ করে আসার পথে সামনে পড়লো মেয়েটি। ইরফান পাশ কাটিয়ে চলে যেতে উদ্ধত হলে মেয়েটি পথ আগলে দাঁড়িয়ে বলতে লাগলো- ‘-কোথায় যাচ্ছেন? কাল আমাকে এতোগুলো কথা শুনালেন আপনি? আমি খুব কষ্ট পেয়েছি জানেন?’
ইরফান ইতস্তত জিজ্ঞেস করলো- ‘কি? আমি আপনাকে কথা শুনালাম মানে?’
মেয়েটি বললো- ‘কাল এভাবে না আসলেও পারতেন। আপনি চলে আসায় দোকানি আমাকে অনেক কিছু বলেছে।’
এবার ইরফান মেয়েটির দিকে ভালো করে তাকালো। প্রথমেই তার মনে এলো ‘অপূর্ব’ শব্দটি। বড় বড় চোখ দুটো গাঢ় কালো, সে চোখে একপ্রকার অপরাধবোধে জল ছলছল করছে। মুখাবয়ব গোল, যাকে বলে চাঁদবদনী, ইরফানের ভাষায় মেয়েলি আকৃতি! মেয়েটির শ্যামল মুখখানা কেমন অন্ধকার হয়ে আছে। বুঝতে বাকী নেই এটা তার উপর রাগের বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু মেয়েটির দিকে এতোক্ষণ তাকিয়ে থেকে কী বলবে খুঁজে পাচ্ছিলো না ইরফান। নিজেকেই এখন অপরাধী মনে হচ্ছে। অযথা তুচ্ছ একটা বিষয় নিয়ে এমনটা করা তার মোটেও ঠিক হয়নি। বইতো অন্য একটা সে নিলেও পারতো, এ আর এমন কি?
মেয়েটি ক্ষীণ আদ্র কণ্ঠে বললো- ‘জানেন, বইটি আমার দরকার ছিলো না। আমার একটা বদ অভ্যাস আছে যে কোনো মানুষকে রাগানোর। কাউকে রাগাতে পারলে আমার খুব আনন্দ হয়। তাই আপনাকেও রাগাতে চেয়েছিলাম। ভাবেছিলাম রেগে আপনি আমার সাথে ঝগড়া করবেন আর আমি আপনাকে আরো রাগাবো হেসে হেসে। কিন্তু আপনি উল্টো আমাকেই ফাঁদে ফেলে দিলেন!’
ইরফান অন্যমনস্কভাবে দাঁড়িয়ে নিশ্চুপ। এই অপরিচিতার সাথে এখন সে কী বলবে? ক্ষমা চেয়ে চলে যাবে? নাকি এর সাথে বকবক করবে?
মেয়েটি আবার বললো- ‘কী ব্যাপার, আপনি একদম চুপ? বুঝেছি, আপনি বিরক্ত হচ্ছেন।’ ব্যাগ থেকে বুদ্ধদেবের বইটা বের করে ইরফানের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো- ‘এই নিন আপনার বই। অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও বইটা কিনতে হলো। কিনেই যখন নিয়েছি তাই ভাবলাম দেখা হলে আপনাকেই দিয়ে দেব। আমার কোনো কাজে আসবে না এটা। আপনি নিয়ে যান।’
‘না, না, তা কি করে হয়?’ ইরফান লজ্জিত ভঙ্গিতে বললো- ‘আসলে ঘটনাটা এভাবে হবে ভাবিনি। আমি খুবই দুঃখিত। ক্ষমা করবেন আমার ব্যবহারের জন্য।’ বলে মেয়েটির চোখের দিকে তাকালো আবার। মেয়েটিও তার দিকে তাকিয়ে আছে। ইরফান মেয়েটির চোখের প্রতি একটা দূর্বলতা অনুভব করতে লাগলো।
এরপরে কতো কথা, কতো ইতিহাস!
সব মনে আছে ইরফানের। এই স্বল্প সময়ে তার জীবন এমনভাবে ভরে উঠবে তা সে কখনোই কল্পনা করেনি। কল্পনা করেনি মেয়েটিও। মেয়েটির নাম ইভা। একই বর্ষের ইকোনোমিক্সে পড়ে। একটু চঞ্চল ও বাচাল প্রকৃতির। দারুণ বুদ্ধিপ্রখর। মানুষের সাথে দ্রুত মিশতে পারে, আবার দ্রুতই সঙ্গ ত্যাগ করতেও পারে। যতো চঞ্চলই হোক, ছলনাময়ী সে নয়। যত বাচালই হোক, কথা বলে একদম সোজা সোজা। তাই তার কথা শুনে সবাই রেগে যায়! বন্ধু-বন্ধুনীর সংখ্যা এ কারণে সীমিত।
কিন্তু ইরফানের সাথে অল্প দিনেই ভাব হয়ে যায় তার। ইরফান প্রতিদিন একটা করে কবিতা আবৃত্তি শোনায়। ক্লাস শেষ করে প্রতিদিন আড্ডা চলে অনেকসময়। কখনো পার্কে বসে, কখনো কোনো লেকের ধারে, কখনো খোলা মাঠে। দিনদিন দূর্বলতা বাড়তেই থাকে দু’জনার। সময়টা তড়তড় করে চলে যাচ্ছিলো। কেউ টের পায় নি!
ঘড়ির দিকে তাকাত ইরফান। আর মাত্র পনেরো মিনিট। কিন্তু অপেক্ষার সময় যেনো ফুরাতেই চায় না। অস্থির লাগছে একটু একটু। কিন্তু চূড়ান্ত ফলাফলের কাছে এই ক্ষুদ্র অস্থিরতা তুচ্ছ। এগারো মাস পর ইভার সাথে দেখা হবে আজ এই নির্জন ঝরনার পাশে। চারপাশ পাহাড়ে ঘেরা, সবুজে সবুজে ছেঁয়ে আছে পাহাড়, ঝরণাধারার সাথে আলোর সে কি উল্লাস।! মনে পরে বুদ্ধদেবকে-
“রুপোলী জল শুয়ে শুয়ে স্বপ্ন দেখছে,
সমস্ত আকাশ নীলের স্রোতে ঝড়ে পড়ছে
তার বুকের উপর, সূর্যের চুম্বনে।”
ঝরণার জল এসে যেখানে পড়ে সেখানে অনেকগুলো ছোট-বড় আকারের পাথর। এখানে মানুষের আনাগোনা কম। তাই বড় পাথরগুলোতে শ্যাওলা পড়েছে মাঝে মাঝে। একটা পরিষ্কার দেখে পাথরের উপর বসলো ইরফান। তার হাতে বুদ্ধদেব বসুর বইটা। আজ এই খুশির দিনে ইভাকে সে এই বইটাই উপহার দিতে চায়। ইভা নিতে চাইবে না, তবুও জোর করেই দিবে ইরফান।
দু’জনের সম্পর্ক হওয়ার পর খুব কাছাকাছি ছিলো মাত্র ২৩ মাস। এই ২৩ মাসে কতো স্মৃতি! পরিচয়ের পর থেকে বন্ধুত্বের হাত ধরে প্রেমের সম্পর্কে পরিণত হতে সময় লেগেছিলো মাত্র দু’মাস। প্রথম কবে ইভার হাত ধরেছিলো তারিখটা মনে আসছে না ইরফানের। দ্রুত ক্যালেন্ডারে ইভেন্ট দেখে নিলো। আগস্ট মাসের ২৮ তারিখ। সেদিন হঠাৎ ইভা বায়না ধরলো আজ সে ক্লাস করবে না। একটা মুভি এসেছে নতুন। দু’জন মিলে মুভি দেখবে। ইভার জেদ কিছুতেই ভাঙানো না যাওয়ায় অগত্যা সিনেমা হলে যেতে হলো ইরফানকে। আর এর মাশুল দিতে হয়েছিলো এক বিষয় পরিপূরক পরীক্ষা দিয়ে! যদিও ইভা তার জেদের দায় স্বীকার করে খুব দুঃখিত ছিলো। তবে যাই হোক, একটাই তো পরীক্ষা দিয়েছে সে পরিপূরক, তাতে কি! ইভার জন্য প্রয়োজনে জীবনও বাজি রাখতে পারে তখন ইরফান।
সিনেমাটা ছিলো হিন্দি রোমান্টিক। সিনেমা দেখতে দেখতে কখন যে দু’জন দু’জনের হাত আঁকড়ে ধরেছিলো সে কথা কারোই মনে ছিলো না। যখন বিরতি দেখিয়ে হলে আলো জ্বলে উঠলো তখন স্বম্বিত ফিরে পায় দু’জন। ইতস্তত লজ্জায় ও প্রথম পরশের শিহরণে হঠাৎ শরীর কেঁপে উঠে দু’জনের! দ্রুত হাত সরিয়ে নেয় তারা। সেই সাথে মনের মধ্যে কেমন যেন হুহু করে উঠে! ইচ্ছে হয় দু’জন দু’জনকে আঁকড়ে ধরে বিলীন হয়ে যায় এই লোকচক্ষু থেকে! কিন্তু তা এখন সম্ভব না। লোকজনের হুড়োহুড়িতে দ্রুতপায়ে বাইরে বের হয়ে এলো দু’জন। একটা চায়ের দোকানে গিয়ে দু’কাপ চা নিলো। মাঝেমধ্যে সিগারেটের অভ্যাস আছে ইরফানের। এখন মনের যা অবস্থা তার একটা সিগারেট খুবই জরুরি। কিন্তু ইভার সামনে কি করে নেবে? অনেক্ষণ ভেবে শেষে বলেই ফেললো-‘ একটা সি...’
‘সিগারেট খাবে এইতো? নাও। তবে এখানে না, নির্জনে গিয়ে খাবে, চলো।’
দু’জন হাঁটতে হাঁটতে একটা জনহীন গলির ভেতরে গেলো। ইরফান সিগারেট ফুঁকছে, ইভা তাকিয়ে আছে তার দিকে। ইরফানকে অবাক করে দিয়ে হঠাৎ ইভা বলে উঠলো- ‘মাকে দাও তো একটু, দেখি কেমন লাগে!’
ইরফান ঠাট্টা ভেবে দিতে নারাজ হলে ইভা জোর করে নিয়ে দু’তিনটা টান দিয়েই আবার ইরফানকে দিয়ে দিলো।
রাতে মোবাইলে ইভা ম্যাসেজ করেছিলো-
‘আজ সিনেমা দু’জনের হাত মিলালো, আর সিগারেট মেলালো ঠোঁট।’
ইরফান উত্তরে জিজ্ঞেস করলো- ‘কেমন লাগলো তোমার আজ?’
-‘আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ দিন। তোমার?’
-‘আমারও। মানে শ্রেষ্ঠতর।’
-‘তুমি তো যেতেই চাও নি, কতো জোর করতে হলো।’
-‘ক্রেডিট নিচ্ছ? দিয়ে দিলাম, আজকের দিনের সব প্রাপ্তি তোমার, আমার কিছু নেই!’
এভাবে কতো ম্যাসেজ সে রাতে আদান প্রদান হলো তার হিসেব কেউ রাখেনি। এভাবেই শুরু হয়েছিলো অবাধ সময় কাটানো। সারারাত ক্লাস ফাঁকি দিয়ে এখানে ওখানে ঘুরাঘুরি, সারারাত মোবাইলে ম্যাসেজিং। ইভা বলেছিলো মোবাইলে কথা বলা বারণ। অথচ ইরফানের বুকটা খাঁখাঁ করতো একটু কথা শোনার জন্য। কিন্তু ইভা এ পর্যন্ত কখনোই মোবাইলে কথা বলেনি। এমনকি আজ এতোদিন পর আসবে, দেখা হবে, সেটাও ম্যাসেজের মাধ্যমে জানালো!
একটু দূরে গাড়ির শব্দ শোনা গেলো। ইভা বোধহয় এসে গেছে। ঘড়ির দিকে তাকায় ইরফান। আর মাত্র তিন মিনিট। ইভা বলেছিলো ঠিক সকাল ০৮.১৫ মিনিটে দেখা হবে। এখন ০৮.১২ বাজে। ইরফান রাস্তার দিকে তাকায়। ঐতো ইভা আসছে। যেমনটা বলেছিলো নীল শাড়ি পড়ে আসবে। আহ, কতো অপেক্ষা এই ক্ষণের জন্য।
ইরফানের মনে হতে লাগলো- ‘আচ্ছা, ইভা কি দৌঁড়ে এসে আমাকে আলিঙ্গন করবে আগের মতো? যদি না করে তাহলে কী বুঝে নেবো?’ বুঝে উঠতে পারে না ইরফান।
একটা সময় এসেছিলো যখন দেখা হলেই ইভা ইরফানকে জড়িয়ে ধরতো প্রবলভাবে। আর বলতো- ‘আমাকে কখনো ছেড়ে যাবে না তো?’
-‘একথা বলো না! দোহাই তোমার, তাহলে মরে যাবো।’ বলে ইভার প্রশস্ত কপালে একটা শীতল চুমু জমা করতো। প্রতি আলিঙ্গনের বিপরীতে একটা চুমু, এমনটাই কথা হয়েছিলো দু’জনের মাঝে।
ইভার পায়ের নিচে পথের দিকে তাকিয়ে আছে ইরফান। পথ যেন ফুড়ায় না! তার মনে হচ্ছে প্রতি কদমে ইভা পাড়ি দিয়ে আসছে সাত সাগর কিন্তু পথ তা ছোট করে বানায় এক কদম! মাত্র আড়াই ফুট! আর মাত্র পঞ্চাশ গজ দূরত্ব। ঐতো ইভার মুখটা বেশ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। ‘আচ্ছা, ইভা কি সেই আগের মতো আছে? নাকি বদলে গেছে?’ এই এগারো মাস তার কোনো খোঁজ নেই। অনেক চেষ্টা করেছে ইরফান কিন্তু কোনোভাবেই যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। ইভার বিয়ে ঠিক হয়েছিলো পারিবারিকভাবে। তাই ইভার সিদ্ধান্তেই সবকিছু ছেড়ে দু’জন পালিয়ে যায় অজানায়!
কিন্তু ইভার ধনী বাবা পুলিশ দিয়ে ঠিকই ধরে আনে দু’জনকে। যে রাতে পালিয়েছিলো, আহ। জীবনের প্রথম স্বাধীন রাত্রি। পিছুটানহীন অবাধ সময়। সে রাতে ইভা কামড়ে ধরেছিলো ইরফানের ঠোঁট, ইরফানও কামড়ে দেয় ইভার ওষ্ঠাধর। ইরফান তখন হেলাল হাফিজের কবিতা শুনিয়েছিলো ইভাকে-
“দেখবো দেখাবো পরস্পরকে খুলে
যতো সুখ আর দুঃখের সব দাগ,
আয় না পাষাণী একবার পথ ভুলে
পরীক্ষা হোক কার কতো অনুরাগ।”
এরপর! এরপর শিহরণে শিহরণে কেঁপেছিলো দু’জনের শরীর। ইভার মৃদু শিৎকারে ভরেছিলো ইরফানের কান। ধবধবে সাদা চাদরে দু’জনের আদিম কীর্তি চলছিলো অবিরাম! থেমে থেমে পরস্পরের ওষ্ঠাকর্ষণ। সে রাতে কেউ কাউকে বাঁধা দিলো না। একসময় ঝড়ে বিদ্ধস্ত লতার মতো জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে ছিলো দু’জন পরম সুখে। সে সব কি মনে আছে ইভার? সে রাত তো ভুলার নয়! ভাবতে থাকে ইরফান।
-‘কেমন আছো তুমি? কিভাবে কাটালে এতোটা দিন একা একা? ইরফান জিজ্ঞেস করে ইভাকে। ইভা চলে এসেছে। বহু প্রতিক্ষিত এইক্ষণ! ইরফান বুদ্ধদেবকে স্মরণ করে-
“এখানে জ্বলে উঠবে অপরূপ ইন্দ্রধনু
তোমার আর আমার রক্তের সমুদ্রকে ঘিরে,
কখনো কি ভেবেছিলে?”
ইরফান এতোক্ষণে খেয়াল করে ইভা খুব গম্ভীর, কঠোর মুখে দাঁড়িয়ে আছে। ইভার এই রূপ সে কোনোদিন দেখে নি। তার মনে পড়ে গেলো পুলিশ যখন তাকে হাজতে ঢুকালো ইভার সে কি কাঁন্না! ইভাকে নিষ্ঠুরভাবে টেনে হিঁচড়ে তার বাবা দের করে নিয়ে গেলো। পাঁচমাস হাজত খেটেছে ইরফান। আর কখনো বাড়ি ফিরে যায়নি। বাড়ির কেউ তার খোঁজও নেয় নি। তারা ইরফানকে চিরতরে বাইরে থাকার বার্তা দিয়েছে! কি কঠিন সময় পাড় করেছে ইরফান! তবুও জেল থেকে বের হয়ে ইভাকে খুঁজেছে প্রতিমুহুর্ত। কোথাও কোনো খোঁজ পাওয়া গেলো না। হঠাৎ করে তিনদিন আগে একটা ম্যাসেজ আসে মোবাইলে।
“২য় ঝরণার পাশে থেকো, ২৫ তারিখ সকাল ০৮.১৫ মিনিটে। নীল শাড়িতে আমি আসছি। ইভা”
ম্যাসেজটা পাওয়ার পর পাগলের মতো হয়ে যায় ইরফান। প্রতিমুহুর্ত কল দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু নম্বর বন্ধ। তিনদিনের মধ্যে এক সেকেন্ডের জন্যেও নম্বরটা চালু হয়নি। ইরফান এই তিন দিন ঘুমায় নি। ঘুমহীন চোখ রক্তিম, নেশাখোরের মতো চেহারা হয়ে গেছে ইরফানের! জেলেও তার এতো কষ্ট লাগেনি। কিন্তু এ কষ্ট আনন্দের। মাথার ভেতরটা কেমন যেন চিনচিন করে ইরফানের। চিনচিন করে বুকের ভেতরটাও!
‘এটা কি ইভা আমাকে দেখে বুঝে না? তাহলে সে এমনভাবে কেনো আমার দিকে তাকাচ্ছে?’মনে মনে ভাবে ইরফান। আর মুখে প্রশ্ন করে-
- ‘কি হয়েছে তোমার? অভিমান?’
নিরুত্তর ইভা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। চোখে-মুখে কাঠিন্য। ইভার এই পাথর চাউনি ইরফানকে আরো বেশি ব্যথা দিতে থাকে। আর ‘এমন নির্বাক! এটাতো ইভার স্বভাব নয়!’ ভাবে ইরফান।বুকের ভেতরটা তার ছটফট করে। খাঁচার পাখিটা বের হয়ে যেতে চাইছে। ইরফান সহ্য করতে পারে না। বুকটা অসম্ভব ব্যথা করছে তার। চোখ দু’টো ছলছল করছে। তবুও নিজেকে সংযত করে ইরফান। ‘পুরুষ মানুষ কাঁদে না’ প্রবোধ দেয় নিজেকে। মায়ের কথা মনে হলে প্রায়ই তার এমন হয়। তাতে কি? একলা চলা অভ্যেস হয়ে গেছে তার!
- ‘এই এগারো মাস খুব কষ্টে গেছে দিনগুলি, ইভা। পড়ালেখা, পরিবার সব শেষ। আমার কাছে কেবল তোমার স্মৃতি ছাড়া আর কিছুই ছিলো না। তোমার দেয়া বইটা আমি এক মুহূর্তের জন্যও হাতছাড়া করিনি।’ ইরফান গলগল করে বলে যায়। ‘জেলে বসে পাঁচ মাসে কতো কবিতা বানিয়েছি তোমাকে নিয়ে, তোমাকে শুনাতে পারিনি। বের হয়ে পরিচিত সব জায়গায় তোমাকে খুঁজেছি। কোথাও পাইনি। পরিচিত যার কাছেই গেছি দূরদূর করে তাড়িয়ে দিয়েছে সবাই। তোমার খোঁজ কেউ দেয়নি। কোথায় ছিলে তোমরা? ইরফান অসহায়ের মতো ইভা মুখের দিকে তাকায়। ইভার দু’চোখে অশ্রুর প্লাবন। কঠিন মুখখানা হঠাৎ শিশুর মতো হয়ে গেছে!
- ‘বড় ভুল হয়ে গেলো জীবনে। দু’টো উজ্জ্বল জীবন ছাই হয়ে গেলো। এতো বেহিসেবী হয়েছিলাম দু’জন!’ ইরফান বলেই যাচ্ছে। বহুদিনের জমানো আক্ষেপগুলো বুক চিঁড়ে বেড় হয়ে আসছে তার। সব হারিয়ে জীবনের এই বিধ্বস্ত মুহূর্তে বড় পাপী মনে নিজেকে। ইভাকে দেখার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত খুশিতে আত্মহারা ছিলো সে। কিন্তু তাকে দেখার পর সব অভিমান কেনো এসে ভর করলো তার উপর? ইরফানের মাথাটা ঝিমঝিম করতে থাকে।
এসময় ইভা ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে জড়িয়ে ধরে ইরফানকে। প্রচন্ড শক্তিতে আঁকড়ে ধরে। ইরফানও আপম করে ধরে রাখে ইভাকে। তার মনে পরে যায় পুরোনো দিনের কথাগুলো আবার। আর ঝাপসা চোখে দেখলো অদূরে গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে থাকা যুবকটি মাথা নিচু করে পায়চারি করছে। তার বুঝতে বাকি রইলো না কিছুক্ষণ পর সে চিরতরে একা হয়ে যাবে। পৃথিবীতে চিরন্তন বলে কিছু নেই। এই তার শেষ আলিঙ্গন। বৈধ নাকি অবৈধ! তা এখন সে হিসেব করতে চায় না। সারা জীবন যার হিসেব মিলে নি, এইটুকুতে সে হিসেব মিলাবে কি করে? এই সময়টা যতোক্ষন আছে সে শুধু অনুভব করতে চায় দু’জনের হৃৎস্পন্দন। এবং সে অনুভব করে শারীরিক বন্ধনের ঊর্ধ্বে ভালোবাসা যায় কিন্তু সেখানে অস্তিস্বের প্রশ্ন থেকে যায়!
- ‘আমাকে কখনো ক্ষমা করো না।’ বাষ্পকণ্ঠে এই প্রথম কথা বলে উঠে ইভা। ‘বেঁচে থাকার অভিনয়টা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত করতে চাই। কিন্তু জেনে রেখো তোমার বাঁধন খুলে যাওয়া মানেই আমার মৃত্যু! যা দেখবে সবাই কেবল আমার শরীর, আমার নাম! ঐ যে গাড়ির পাশের লোকটা সে হয়তো আমার শরীর খুবলে খাবে, কিন্তু আমি তো জানি আমার সারা অঙ্গে তোমার সেই প্রথম পরশ!’ ইরফান কিছু বলে না। সে ইভাকে জড়িয়ে আছে, এই নির্জন পাহাড় ঘেরা ঝরণার পাশে। তার কাছে এরচেয়ে বড় সত্য নেই, এরচেয়ে বড় প্রাপ্তি নেই!
- ‘আর কখনোই আমাকে দেখবে না। এই দিনে আমাদের উৎসব শুরু হয়েছিলো, বেহিসেবী জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তির দিনে নিজেকে আজ বেদনার রঙে জড়িয়ে নিলাম। আর মুড়িয়ে দিলাম তোমাকেও। আমার মতো তুমিও স্বার্থপর হয়ে যেও, অন্তত শেষ বিদায়ের মুহূর্তে একটু স্নেহ পাবে।’ বলে ইভে নিজেকে ইরফানের বুক থেকে মুক্ত করে নেয়। ইরফান বাঁধা দেয় না। সে তো অন্য কারো স্নেহের কাঙাল হতে চায় না। ইভার কপালে চুমু খাওয়ার কথা ভুলে যায় সে। জীবনের শেষ চুমু! কেমন যেন লাগছে তার। সারা শরীর অসম্ভব ঠান্ডা হয়ে আসছে, দাঁড়িয়ে থাকার মতো শক্তি পাচ্ছে না পায়ে। হাত থেকে খসে পড়ে বইটা। ধপ করে পড়ে যায় মাটিতে। ইভা মাথা নিচু করে দৌঁড়ে চলে যাচ্ছে। তার প্রতি পদে পদে ইরফানের প্রাণটা কেঁপে কেঁপে উঠছে! পাহাড় ঘেড়া এই অপরূপ স্থানটাকে বদ্ধভূমি মনে হচ্ছে এখন তার কাছে! দম বন্ধ হয়ে আসছে। শ্বাস নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে তার।চারদিক ঝাপসা হয়ে আসছে ইরফানের।
রিকশার ক্রিংক্রিং শব্দে ঘুম ভাঙ্গে ইরফানের। ঝাপসা চোখে ঘড়ির দিকে তাকায় সে। ক’টা বাজে? রাত ন’টা! পেছন থেকে একটা লোক খুব তেড়ে আসছে তার দিকে- ‘এই পাগল, রাস্তা ছাড়!’ ইরফান ভয়ে সরে দাঁড়ায় আর বিড়বিড় করে বলে ‘আমাকে পাগল বলিস? তুই পাগল, তোর চৌদ্দ গোষ্ঠী পাগল। শালা!’ এই বলে কুড়িয়ে পাওয়া ভাঙা ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকে। ঘড়িতে এখন রাত ন’টা বাজে! কোত্থেকে যেন ভেসে আসছে-
“দ্যাখো, দ্যাখো, কেমন নীল এই আকাশ,
আর তোমার চোখে কাঁপছে কতো আকাশ,
কতো মৃত্যু, কতো নতুন জন্ম,
কেমন করে বলি!”
ইরফান আকাশের দিকে তাকায়। তার কাছে আকাশ অন্ধকার বলে মনে হয়। তাহলে কে এখন বলে আকাশ নীল? ইরফান জোরে চিৎকার করে বলে- ‘পাগল।’ আর রাস্তার সব লোক তার দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে খিল খিল করে হাসে আর বলে –‘পাগল!’