ছোট সেলটার এককোণায় দুহাঁটুকে হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে গুঁটিসুটি মেরে বসে আছে রুবি। চোখে উদাস দৃষ্টি। চোখের কোণা থেকে গাল পর্যন্ত শুকিয়ে যাওয়া চোখের পানির সাদা দাগ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। শুকনো ঠোঁটদুটো এমনভাবে লেগে আছে যেন একটু নাড়াতে চাইলেই ফেটে রক্ত বেরিয়ে আসবে। মাথার লম্বা চুলগুলো দীর্ঘদিনের অযত্নে ধূসর রং ধারণ করেছে। উষ্কখুষ্কো চুল ছড়িয়ে আছে কাঁধে, কানের দুপাশে আর ঢেকে আছে কপাল। একসময় মাথাভর্তি লম্বা চুল ছিল প্রাণোচ্ছ্বল। বিকেলের দখিনা বাতাসে ঘন কালো চুল উড়িয়ে মেঠো পথ ধরে দৌড়াতো সে। সইদের সাথে নদীর ধারের কাশবনে লুকোচুরি খেলায় মত্ত হতো। গৌধুলী লগ্নে গোড়ালী পর্যন্ত তোলা লালপেড়ে সবুজ শাড়ি পরে, কোমরে রুপোর বিছার চিকচিকে আলো ছড়িয়ে ছুটে যেত দিগন্তপানে। বাতাসে কাঁধ ছাড়িয়ে রূপকথার কেশকন্যার মতো দীর্ঘ চুলের খেলায় বিমোহিত করত পথিককে। ছায়ামূর্তি হয়ে আবছা আলো-অন্ধকারে হেঁটে যেত উদাস ভঙ্গিতে। তার চুলের সৌন্দর্য যে কত যুবককে কবি বনে নিয়ে গিয়েছিল তার ইয়ত্তা নেই। পূব পাড়ার মন্নান তো একবার পাঁচ পাতার কবিতা নিয়ে এসেছিল। কাগজ হাতে নিয়ে সে কী হাসি রুবির। সেই মাতাল করা কিন্নরকণ্ঠী হাসি দেখে চৌরাস্তায় বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিল মন্নান। তারপর অষ্টাদশী রমণী হবার পর দাদী ডেকে নিয়ে নারিকেল তেলে চুবিয়ে দিলেন মাথা ভর্তি চুল, খোঁপায় বন্দী করলেন পাড়ায় পাড়ায় ছুটে বেড়ানোর সাধকে।
.
ঘরে বিছানার সাথে লেগে থাকা বাপ। একচালা নড়বড়ে ঘরের মাঝখানে বাঁশের বেড়া দিয়ে একপাশে দাদীর সাথে থাকত সে। অন্য পাশে থাকত মা, বুড়া বাপ আর তিন বছরের ভাই রাকিব। চারপায়ী চৌকি ছিল না কারোরই, মাটিতে পাটি বিছিয়ে শুয়ে পড়ত সবাই। দরিদ্রতার ক্লেশ ধীরে ধীরে তলিয়ে যেত ক্লান্তির ঘুমে। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে আর কলেজে যাওয়া হয়নি। মনের কোন এক কোণে ক্ষুদ্র গণ্ডিতে পরম যত্নে লালন করা স্বপ্নের অপমৃত্যুতে কষ্ট হবার কথা ছিল, কেঁদে বুক ভাসাতে পারত সে। তার বদলে নদীর পাড়ে গিয়ে শূন্য দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়েছে দিগন্তে। শেষ বিকেলের অপাংক্তেয় সূর্যটার বিষণ্ণ, বিষাদপূর্ণ, আবছা আলোটা নদীর পানিতে পড়ে আঁকাবাঁকা হয়ে ক্রমশ মিশে গেছে দূরে। সেদিকে তাকিয়ে হতাশা আর বুকফাটা কষ্টকে বিসর্জন দিয়ে এসেছে। পুরো বিকেলটা কাটিয়ে দিয়েছে সেখােন। সূর্যটা আকাশের কোলে মুখ লুকোতেই যখন দিগন্তবিস্তৃত অন্ধকার নেমে এলো চারপাশে, অন্ধকারের চাদর যখন বিষাদের রুপরেখা হয়ে স্মৃতি চিহ্ন আঁকতে লাগল- তখন এলোমেলো পা ফেলে ধীরপায়ে ফিরে এসেছে ঘরে। বেখেয়ালে কখন যেন বড় খোঁপা খুলে গিয়েছিল। ঘরে এসে হারিকেনে তেল ভরে এক এক করে গুছিয়ে নিতে থাকে বইগুলো, সেই সাথে বইয়ের ভাঁজে থাকা স্বপ্নগুলো। দাদী এসে তার মাথায় হাত রাখে, 'কষ্ট হচ্ছে, রুবি?'
ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে ছিল সে। অজান্তেই চোখের কোণ বেয়ে নেমে এসেছিল অশ্রুর ঢল। কানের পর্দায় একই কথা প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল বারবার, 'কষ্ট হচ্ছে, রুবি?' তার কী কষ্ট হচ্ছিল?
দাদীর বুকে মাথা রেখে সেদিন ডুকরে উঠেছিল কেবল। বাঁশের বেড়ার অপর পাশে তখন ছেঁড়া আঁচলে মুখ গুঁজে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে ছিলেন রুবির মা। স্বপ্ন ছিল রুবি পড়ালেখা করে বুড়ো বয়সে বাপের খেয়াল রাখবে। দুবেলা অন্ন যোগান হবে ছোলার ডালের সাথে। তখন অন্তত নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর কষ্টে রাকিবকে পানি খেয়ে ঘুমানোর বৃথা চেষ্টা করতে হবে না। বিছানায় লেপ্টে থাকা গণি মিয়া তখন চোখ বুজে ছিলেন। জগতের কঠিনতম নিয়ম আর নিজের অপারগতার কাছে হার মেনে গিয়েছিলেন পুরোপুরিভাবে। হাত নাড়ানোর শক্তি নেই তাঁর, শক্তি নেই মুখ খুলে মেয়েটাকে কাছে ডেকে একটু সান্ত্বনা দেয়ার। সামর্থ্য নেই তিন বছর ঘরে একই কাপড় পরে মুখে ক্লান্ত হাসি মেখে ঘুরে বেড়ানো নিজের স্ত্রীকে একটা নতুন কাপড় কিনে দেয়ার, নেই ছোট ছেলেটাকে পেট ভরে ডালভাত খাইয়ে দেয়ার বিন্দুমাত্র ক্ষমতা। বিধাতা কষ্ট দিলে সেটাকে কষ্ট মনে হয়- যতক্ষণ সেটা কষ্টের গণ্ডিতে থাকে। যখন সেই গণ্ডি পেরিয়ে কষ্টের মাত্রা ছাড়িয়ে যায়, তখন কী নামে ডাকতে হয় সেটাকে?
.
দিন দুয়েক পরে দূর থেকে সম্বন্ধ আসে। কেশকন্যার জন্য ভিনদেশী রাজপুত্রের মতো। সংসার জীবনের ধূসর স্বপ্ন তখনও দেখতে শুরু করেনি রুবি। একটিবারও ভাবতে পারেনি চঞ্চল জীবনের কবর দিয়ে গম্ভীরমুখো দায়িত্বশীলা হবার কথা। কিন্তু সবকিছু যে চাওয়ায় হয় না। কী দেখে, কেন সেদিন ওসমান তাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল সেটা একসময় অমীমাংসিত রহস্য হলেও আজ তার কাছে সদ্য উদ্ভাসিত হওয়া নতুন সূর্যের মতোই উজ্জ্বল। রাহেলা বেগম পরম স্বস্তিতে সেদিন সৃষ্টিকর্তার পায়ের কাছে অশ্রু বিসর্জন দিয়েছিলেন। বুকে জমে থাকা পাহাড়সম কষ্ট গলে সেদিন দুচোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়েছিল সুযোগ পেয়ে, 'অভাগীর একটা ব্যবস্থা করলে বুঝি !'
সেই প্রথম মেয়ের হরিণী চোখের মায়ার দিকে তাকালেন রাহেলা বেগম, দুচোখ ভরে দেখলেন ফর্সা ত্বকে অনিন্দ্য সুন্দরের কারুকার্য। পরম তৃপ্তিতে সেদিন আকাশের দিকে মুখ তুলে বলেছিলেন, 'গরীবের বুঝি রূপই সম্বল!' ভেবেছিলেন এই রূপের মহীমাই টেেন এনেছে সুপাত্র। বিয়েটা হয়ে যায়। বিষাদসমুদ্রে ক্ষণিকের জন্য নিরব, নিথর, বিষণ্ণ, জমে থাকা আনন্দস্রোত মৃদু দুলে ওঠে। পিতৃগৃহের পাঠ চুকিয়ে, পিতার বোঝা হালকা করে, আরো কিছু অন্ন বাঁচিয়ে এলোকেশী রাজকন্যা পা বাড়ায় সংসার নামক কুরুক্ষেত্রে।
.
রুবির গভীর চোখে সেদিন একরাশ স্বপ্ন, পিতার কষ্ট লাঘবের তৃপ্তি, 'ছোট ভাইটা কিছু বেশি ভাত পাবে', এই ভাবনার বিক্ষিপ্ত আলোড়ন মস্তিষ্কে। কাঁদেনি সে একটুও। পরিণয়েই যদি কান্নার জোয়ার আনতো তবে যে চোখের জলে ঘাটতি হতো- দুদিন পরেই যে কাঁদতে হয়েছিল রাজকন্যাকে। ওসমান ব্যবসা করত, কীসের ব্যবসা সেটা জিজ্ঞেসের সাহস হয়নি নির্লিপ্ত রাজকন্যার। রাহেলা বেগমের কাছেও সুদর্শন, ব্যবসায়ী আর টাকা পয়সার মালিক জামাইয়ের চেেয় আর বেশি কিছু ছিল না। দূর থেকে এসেছে। বড় মাথার কেউ ছিল না বলে খোঁজ নেয়া হয়নি, পাত্রের উপযুক্ততা বিচারের যথেষ্ট বুদ্ধিও ছিল না রাহেলা বেগমের। যোগ্য পাত্রের হাতে কন্যা সম্প্রদান হয়েছে এটাই ভেবেছিলেন তিনি। অন্তত মেয়েটা সুখী হবে। দুমদামের বালাই ছিল না। ঘরোয়া ভাবে চার পাঁচজনের উপস্থিতিতে বিয়ে হয়ে যায়। কে জানত পরের অধ্যায়? জীবন নামের এই কালজয়ী উপন্যাসের প্রতিটি শব্দের নিখুঁত গাঁথুনী, বোঝার সাধ্য নেই স্থুল মস্তিষ্কের মানুষের। আর তাই যুগ যুগান্তরে ধৈর্য নিয়েই পড়ে যেতে হয় প্রতিটি পাতা।
.
বাসর রাতে দীর্ঘক্ষণ বসে থাকার পর বাইরে মৃদু হাসির শব্দ শোনে রুবি। ওসমানের বন্ধুরা হাসি ঠাট্টা করছে। নতুন জায়গায় একরাশ ভয় আর অস্বস্তি এসে ঘিরে ধরে তাকে, কী যেন এক অজানা আশংকা গভীর থেকে কুহু ডেকে ওঠে। একটু পর খট করে খুলে যায় দরজা, আবছা আলো ঘরে। বৈদ্যুতিক বাতি নিভিয়ে দিয়ে গেছে কেউ একজন, একপাশে মোম জ্বালানো ছিল। মোমের মায়াবী আলোয় তাকিয়ে পার করেছে প্রতিটি মুহূর্ত। দরজা দিয়ে যে মানুষটি প্রবেশ করে তাকে অচেনা মনে হতে থাকে রুবির। অসংযত পদক্ষেপে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে থাকে ছায়ামুর্তিটি। ওসমান তো এমন নয়, তাহলে? সামনে আবির্ভূত হয় অন্য এক ওসমানের, নেশায় বুঁদ হয়ে জাগতিক জ্ঞানের ইস্তফা দেয়া ওসমান। হামলে পড়ে রুবির উপর। যন্ত্রণায় কোঁকিয়ে ওঠে সে। খুবলে খুবলে ছিঁড়তে থাকে তার নারীত্বের প্রতীক। নিজের স্বামীর হাতে ধর্ষিত হয় প্রথমবার। বিয়ে হয়েও ধর্ষিতা !
.
পরেরদিনের সূর্যটা আগের মতো দীপ্তি ছড়িয়ে আকাশে নিজের জায়গা করে নেয় না। দিনভর বিষণ্ণ বর্ষণ। জানালার পাশে বসে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে দূরে। আকাশ গলে বিষণ্ণতা ঝরে পড়ে ধরার বুকে। সেই সাথে রুবির চোখ বেয়ে নামতে থাকে কষ্টের লাভা। যে উত্তাপে দগদগে গা হয়ে যায় রুবির আত্মার প্রতিটি ভাঁজে। অনমনস্ক হয়ে বসে থাকে সে, এরই মাঝে ওসমান ডেকে যায় কাপড় গুছিয়ে দিতে। বিষাদের সীসায় কান বন্ধ হয়ে থাকে রুবির। একদৃষ্টিতে দূরে তাকিয়েই থাকে। হঠাৎই 'আহ' করে কুঁকড়ে যায় সে। কেশকন্যার ঘন চুলগুলো হাতের মুঠোয় ধরে আছে ওসমান।
'নবাবজাদী, বাপের বাড়িতে যা করার করেছিস, এখানে চোখ কান খোলা রাখতে হবে। নাহলে খদ্দের জুটবে না!'
'খদ্দের !', কানের গভীরে শোঁশোঁ করতে থাকে শব্দটা। এক ঝটকায় দৃষ্টি ঘুরিয়ে নেয় রুবি। প্রতিবাদী সত্তা জ্বলে ওঠে ধপ করে, যেন তার অস্তিত্বে বারুদ ঘষে দেয়া হয়েছে।
'নতুন বউয়ের সাথে এভাবে কথা বলছেন, লজ্জা করছে না আপনার?', চোখের আগুনে পুড়িয়ে ফেলতে চায় সে। সেই আগুন নিমিষে নিস্তেজ হয়ে আসে। ওসমান সশব্দে চড় মারে তাকে, 'তোর মতো ভিখেরীর মেয়েকে তুলে এনেছি, এখানে পেট পুরে খেতে পারবি'
এ কী সংসার? নাকি জেলখানা? জেলখানার চার দেয়ালের কষ্ট এর চেয়ে কম নাকি বেশি? সেলের দরজায় ঝনঝন শব্দ শুনে সেদিকে চোখ ঘোরায় রুবি। মহিলা জেলার এক প্লেট ডালভাত নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গত তিনদিন ধরে কিছু খায়নি সে। জেলার অনেক বলে রাজী করিয়েছে খাওয়ার জন্য। রুবির শেষ ইচ্ছে এক প্লেট ডালভাত খাওয়ার। কথাটা শুনে জেলার কেবল করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল কিছুক্ষণ। ভাতের প্লেটটা ঠেলে দেয় জেলার, 'খেেয় নে, মা। সময় বেশি নেই।'
রুবির দৃষ্টি ভাতের প্লেট থেকে সরে যায় সুদূর অতীতে।
.
এক প্লেট ভাত দিয়ে যায় ওসমান। প্লেটভর্তি গরুর মাংস। এক গ্লাস দুধ আর কিছু ফলমূল।
'খেয়ে নে, রূপ ধরে রাখতে হবে তো। ওটাই তোর সম্বল।', একটু থেমে আবার বলে সে, 'এই কাপড়গুলো পরে নিবি, একটু সেজে থাকবি।'
ঝকমকে কাপড়গুলো সেদিন ছুঁয়েও দেখেনি রুবি, আর না তো মাংস ভর্তি প্লেটটা। আঁচড়ায়নি মাথার চুলও। তাতে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ করেনি প্রথম খদ্দের। নির্বাক হয়ে যাওয়া এলোকেশী রাজকন্যাকে খুবলে খেয়েছে সেদিন রাতে। পুরো রাত ধরেই চলেছিল নারীত্বের নৃশংসতা, রূপের ধ্বংসলীলা। শেষ রাতে সংসার (!) নামক পতিতালয় থেকে বেরিয়ে এসে ক্লান্ত ভঙ্গিতে পা বাড়ায় সে। রেল লাইন ধরে খানিকটা হাঁটার পর ঝকঝক করে মৃত্যবাহী ট্রেন ছুটে এসে সরে দাঁড়ায় সে। বাপকে দেখার আগে এই গল্পের শেষ করতে চায় না সে। ঘুরে পা বাড়ায় চিরচেনা সেই গ্রাম, সেই নদীর ঘাটের দিকে।
.
মুখ খুলে বলতে পারে না জমে থাকা কষ্টগুলোকে। কেবল সজোরে কাঁদতে থাকে মা'কে জড়িয়ে ধরে। সারা দেহে অসূর শক্তির প্রভাবে তীব্র ব্যাথা বাসা বাঁধে। একদিনের অভুক্ত রুবি রাহেলা বেগমের কাছে অন্ন ভিক্ষা করে। উদভ্রান্তের মতো চেয়ে থেকে পাতিলের তলা থেকে সবটুকু ভাত এনে দেয় রাহেলা বেগম। ডাল আর পেঁয়াজ দিয়ে পরম তৃপ্তিতে চেটেপুটে খায় রুবি।
'অক্ষম বাবা হওয়ার চেেয় মরে যাওয়ার স্বাদটা অমৃতের মতো।', রুবির দিকে তাকিয়ে নিজে নিজে কথাগুলো ভাবতে থাকেন গণি মিয়া। জানেন না কী হয়েছে তাঁর আদরের চঞ্চলা কেশকন্যার। কেবল বুঝতে পারছেন মেয়েটা খুব কষ্ট আছে। আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকে একটি বার মুখ খুলে বলতে, 'মা রে, তোর বাপ তোরে কুরবানী দিলো নাকি!' তারপরই নিথর হয়ে যায় গণি মিয়া। জগতের মায়া ত্যাগ করে পাড়ি জমায় অজানা গন্তব্যে। তিনি কী জানতেন যে তাঁর শেষ কথাটা রুবির কানে পৌঁছেছিল? সৃষ্টিকর্তা গণি মিয়া অধ্যায়টার সমাপ্তি এভাবেই করেছিলেন। ঝট করে ঘুরে তাকায় রুবি। তার বাপ কথা বলেছে, বুক ফাটা আর্তনাদের শেষ শ্লেষাত্মক কথাটা বলেছে এইমাত্র। কিন্তু উত্তর শুনে যেতে পারেননি। মুখ থেকে ভাত বেরিয়ে বুকের উপর পড়ে রুবির। চিৎকার করে ওঠেন রাহেলা বেগম।
.
সেলের তালা খুলে মহিলা জেলার এগিয়ে আসে।
'কী রে মা, এখনো খাসনি?'
চোখ তুলে তাকায় রুবি। এভাবে, এত আদর দিয়ে তার মা কি কখনো ডেকেছিল? শেষ সময়ে এসে সবাই এমন হয়ে যায়? তার হাতে সময় নেই খুব একটা, পৃথিবীটা তার সব সৌন্দর্য এখনই তুলে ধরছে? মায়া বাড়ানোর জন্য নাকি !
ভাতের লোকমা তুলে এগিয়ে আনে জেলার, 'খা, মা!'
ভাত মুখে নেয় রুবি, কিন্তু গলা দিয়ে নামে না। শুকনো গলা অন্নের ছোঁয়া পেতেই দম বন্ধ হয়ে আসে, কেশে ওঠে সে।
.
পরদিন দুপুরের দিকে ওসমান অাসে। মুখে অমায়িক হাসি। মিষ্টি কথায় জালে ফাঁসায় রাহেলা বেগমকে।
'আমার সাথে রাগ করে চলে এসেছে, মা।'
মুখ খুলে সেদিন ধর্ষিতা হবার গল্প বলতে পারেনি রুবি। ওসমান নিয়ে আসে আবারও, প্রতিবাদের স্বরটাও মরে পড়ে আছে কণ্ঠনালীর গোড়ায়। সেদিন রাতে জীবনের সবথেকে কঠিন সিদ্ধান্তটা নিয়ে নেয় রুবি। সিলিঙয়ের সাথে বেঁধে রাখে নাইলনের মোটা দড়ি। যত্ন করে ভাত রান্না করে, মিশিয়ে দেয় প্রাণনাশী বিষ। একটা না একটা উপায়ে মৃত্যু আলিঙ্গন করবেই। সব ঠিক করার আগেই চলে আসে তার প্রথম খদ্দের-ওসমান। ওসমানের মা কোথায় যেন গিয়েছিল সেদিন। ওসমান ঢুকতেই হেসে জড়িয়ে ধরে রুবি। নারীত্বের মোহের চেয়ে আর কিছু নেই। যত্ন করে খাইয়ে দেয় ওসমানকে।
'এভাবে থাকলে তোমার কোনো অসুবিধা হবে না'. গদগদ খুশিতে গলার স্বর পাল্টে যায় ওসমানের। তারপর, মাত্র কয়েক সেকেন্ড। হঠাৎ চিৎকার করে ওঠে সে। গলা পুড়ে যাচ্ছে তার। ধাক্কা দিয়ে বিছানায় ফেলে দেয় রুবি। শাড়ির ভেতর থেকে বের করে চকচকে ছুরি। তীব্র ক্রোধের সবটুকু শক্তি দিয়ে সপাং করে চালিয়ে দেয় সেটা, ওসমানের ঘৃণ্য লিঙ্গটা একপাশে রক্তারক্তি হয়ে গড়াতে থাকে। সিলিঙয়ের দড়ির সাথে ঝুলিয়ে দেয় ওসমানকে। জিহ্বা বেরিয়ে আসে ওসমানের, কোটর থেকে বেরিয়ে আসে লোভাতুর পিশাচ দৃষ্টি। থুথু নিক্ষেপ করে সেদিকে রুবি। তারপর সকাল হবার আগ পর্যন্ত ওসমানের দেহে একটু একটু করে ছুরি চালায় সে। জমে থাকা ঘৃণার সবটুকু বেরিয়ে আসে সুযোগ পেয়ে। সকাল পতিতালয় থেকে বেরিয়ে আসে রাজকন্যা, সারা গায়ে রক্তের সজ্জা !
.
রুবির পাশের সেলে মাথা নিচু করে বসে আছে ওসমানের মা। আসলেই মা? রুবিকে বিয়ের নামে পতিতালয়ে আনার জন্য সাময়িকভাবে মা সেজেছিল ঐ মহিলা। ওসমানের মা-বাবা থাকত শহরে। গ্রামের সহজ, সরল আর অসহায় মেয়েগুলোকে এভাবেই বিয়ের ফাঁদে ফেলে বন্দী করত সাংসারিক পতিতালয়ে। গরীব মা-বাবাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে স্বপ্ন দেখাতো নানা কসরতে। ওসব মনে পড়লেও এখন আর ভাবের বিকার হয় না রুবির। তওবা করানো হচ্ছে তাকে। একটু পর জগতের মায়া কাটিয়ে চলে যাবে সে। সংসার নামক পতিতালয় থেকে মুক্ত সে-চিরতরে। এলোকেশী রাজকন্যা আর দৌড়াবে না কর্দমাক্ত নদীর কাশবন মাড়িয়ে। এই মুহূর্তে রুবির ঘরের দিকে তাকালে দেখব মেঝেতে একটা লাশ-রুবির দাদীর। একপাশে মাটিতে হাত পা ছাড়িয়ে বসে আছেন রাহেলা বেগম, মুখ থেকে কথা সরে গেছে চিরতরে। উদভ্রান্তের মতো দৃষ্টি শূন্যে। ধর্ষিতা রাজকন্যার লাশটাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য কেউ বাকি নেই আর !