১.
ব্যক্তিগত কথা বলতে আমার অফিসে আসবেন। বসেন!
বিনতা চৌধুরী, সবাই যাকে বিনু নামেই চেনে রীতিমতো অবাক! অপমানিত হয়ে মুখ, গাল লাল করে বসে গেল। রাগে শরীর জ্বলছিল! বিনুতো অফিসিয়াল কথা বলতে দাঁড়িয়েছিল। আর না শুনেই জনাব সিরাজুল ইসলাম ওকে এভাবে থামিয়ে রীতিমতো বসিয়ে দিলেন। সেদিনের সেমিনারে মূলত কেউই কিছু বলতে চেষ্টা করে সুবিধে করতে পারেনি।
কার কেমন প্রতিক্রিয়া হয়েছিল জানা নেই। কিন্তু এমন 'ডিক্টেটর' কেবল নিজের পরিবারের বড় ভাইকেই দেখেছে ছোটবেলা থেকে। যেখানে নিজের কথাই শেষ কথা।
পরের সেমিনারে সিরাজুল ইসলামকে খুব প্রত্যাশা করেছিল বিনু। কিন্তু তিনি আসেননি। সেদিন প্রধান অতিথির কাছে বিনু নিজের এবং অন্যদের হয়ে কথাগুলো বলতে পেরেছিল। তারপরের সেমিনারেও সিরাজুল ইসলাম আসেননি। হয়তো তাঁর আসবার কথা ছিল না।
এর মাঝে বিনুদের প্রফেশনাল গ্রুপটা সিরাজুল ইসলামের কাছে গিয়েছিল নিজেদের দাবী দাওয়া জানাতে। তিনি দেশের বাইরে থাকাতে সেদিনও সাক্ষাৎ হয়নি।
পরের সেমিনারের তারিখটা হঠাৎ করেই দুদিন আগে হয়ে গেল। বিনু অনেক কষ্ট করে সময় বের করে সেখানে হাজির হয়েছিল। সেদিন ওর জন্যে কী অপেক্ষা করছিল...ও কি নিজেও জানতো?
সিরাজুল ইসলাম, এসেছিলেন প্রত্যাশিত সময়ের দুই ঘন্টা আগে। সবাই যার যার কাজের মাঝ থেকে হুলস্থুল করে হাজির হয়েছিল প্রধান সেমিনার কক্ষে।
সিরাজুল ইসলাম উপস্থাপককে কোন ভূমিকার সুযোগ না দিয়ে মাউথ স্পিকার নিয়ে কথা বলা শুরু করলেন। বিনু শুধু অবাক হয় তাকিয়ে থাকে! কিন্তু এবার রাগ হয়নি ওর। কেমন অদ্ভুত মায়ায় ভরে যাচ্ছিল বুকের ভেতরটা। সেদিনের রাগী, জাদরেল সেই মানুষটি আজ কেমন যেনো ক্লান্ত, কিছুটা মলিন। কিন্তু ব্যক্তিত্ত্বের দৃঢ়তায় সেই একইরকম অবিচল!
মনটা কেমন যেনো টানছে! তিনি খুব অল্প সময়েই কথা শেষ করে উঠে রওনা করলেন। সাথে আর সবাই। বিনু খুব চেষ্টা করলো দুর থেকেই তাঁর সাথে একটা সেলফি তোলার...কিন্তু তাঁর হাঁটার গতির সাথে বিনুর স্মার্টফোনের ক্যামেরার গতি হেরে গেল। সিরাজুল ইসলামকে বাঁধতে পারেনি নিজের তোলা সেলফিতে।
সেদিনের সেই ক্লান্ত মুখটা বিনুকে বড্ড অস্থির করে তুলেছিল। কোন ছল করে হলেও তাঁর সাথে যে বিনুর দেখা করা চাইই চাই।
অনেক কষ্টে দেখা করার একটা উপলক্ষ তৈরি করতে পারলো।
কিন্তু একমিনিটের সাক্ষাতের জন্যে সেদিন বিনু সকালের নাস্তা না খেয়ে অপেক্ষা করতে করতে দুপুরের খাবারের সময়ও গড়িয়ে গেল। যখন ওর সাথে সাক্ষাতের পালা এলো সিরাজুল ইসলামের অসাধারণ বিনয় বিনুর হৃদয় ভরিয়ে দিয়েছিল। বিশেষ কিছু তো নয়। কেবল সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করেছেন বিনু ভালো আছে কি না। আর সাথে যথেষ্ট সময় দিতে না পারার জন্যে দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
ক্লান্ত, বিধ্বস্ত, ক্ষুধার্ত বিনু তাতেই যেনো মোমের মতো গলে যাচ্ছিল। একমিনিটের চেয়ে বেশি কোনভাবেই হবে না।
কোনরকম রোমান্টিক কথা নয়, আকর্ষণ করার কোন রকম চেষ্টাই নয়। কিন্তু চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়া জল ও আটকাতে পারছিল না কোনভাবেই।
এমন কঠোর, রাগী মানুষেরও কেউ প্রেমে পড়ে!!
কিন্তু বিনুরতো তাই!
বিনু যেনো কিছুই ভাবতে পারছে না।
সবাই সূর্যকে পুজো করে। কিন্তু বিনু সূর্যকেই ভালোবেসেছিল। জানে না সূর্যের তেজে ও পুড়ে যাবে কি না।
২.
বিছানা থেকে টেনে হিঁচড়ে শরীরটাকে নামিয়ে কোন রকমে ফ্রেশরুমে গিয়ে মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে ইস্তিরি করতে হয় না এমন একটা জামা বেছে পরে নিল। ছবিটা স্টুডিও থেকে নিতে হবে আজই। কাল সকাল বেলাতেই পৌঁছে দিতে হবে।
হাঁটতে গিয়ে মাথা ঝিমঝিম করছে। তবুও খুব শক্ত পা ফেলে বাড়ির কাছের স্টুডিতে গিয়ে বড় করে বাঁধাই করা দুজনের ছবিটা দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল। বেশ কয়েকবার করে দেখে নিল । আশ যেনো মিটতেই চায় না! একসময় খেয়াল করলো বেশ আদিখ্যেতা করে ফেলছে।
রাস্তায় যখন নেমে এলো ছবিটা ফ্রেমে বাঁধাই করে কাচের বাধানো বলে সতর্কতার জন্যে বুকের কাছে আগলে ধরলো দুহাত দিয়ে। মানুষের ভিড়ে বিনু খেয়াল করছে প্রিয়জনকে বুকের ভেতর আগলে রাখার যে অনুভূতি ওর ভেতর তেমন অনুভূতির সৃষ্টি হচ্ছে!
ওর দেখা সেরা দম্পতির যুগলবন্দী ছবি ও ফ্রেমবন্দী করে উপহার দিতে রওনা হয়েছে ওরই পরম আরাধ্যজনকে।
পৃথিবীতে যেই বিবাহিত নারী স্বামীর ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত তার চেয়ে দুঃখি বুঝি আর কেউ নেই। এই দুঃখের কথা জনে জনে বলে বেড়িয়ে নিজেকে হালকা করার কোন সুযোগ নেই। কোন এক অদ্ভুত অজানা কারণে বিনু চেষ্টা করেও মন পায়নি ওর স্বামীর! তাই বিনুর কাছে 'ভালোবাসা' শব্দটা খুব অচেনাই রয়ে গেছে। কাছে এসেও যেনো ধরা দেয়নি।
ধরা দেয়নি দাম্পত্য জীবনের সুখ!
সেদিন সিরাজুল ইসলাম বিনুকে বসিয়ে রেখেছেন অনেকটা সময় ধরে। সবাইকে বিদেয় দিয়ে তারপর হাসিমুখে তাকিয়েছেন বিনুর দিকে। বিনু উঠে দাঁড়িয়ে সিরাজুল ইসলামকে ফটোফ্রেমটা তুলে দেয় হাতে। তিনি অবাক হয়ে দেখেন তাঁদের যুগলবন্দী ছবি। সিরাজুল ইসলাম নিজের স্ত্রীকে খুব ভালোবাসেন। তাই স্ত্রীর সাথে নিজের যুগল ছবি উপহার হিসেবে পেয়ে খুব খুশি হলেন।
বিনুও তৃপ্তির হাসি দিয়ে তাকিয়ে রইল তাঁর দিকে।
তুমি কি সত্যিই খুব খুশি হয়েছো?
প্রশ্নটা করে সিরাজুল ইসলাম বিনুর চোখের দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে থাকেন। যেনো ভেতরের ভাবনাগুলোও পড়ে ফেলছেন।
আচমকা প্রশ্নটাতে বিনু কেঁপে উঠে।
কয়েক সেকেন্ড বিনুর গলা দিয়ে কোন রা' বেরয় না। সিরাজুল ইসলাম তাকিয়ে থাকেন।
এবার পরিষ্কারভাবেই জিজ্ঞেস করেন, আমাদের দু’জনের ছবি দেখে তুমি কি সত্যিই খুব খুশি হও?
বিনুর চোখ বাধা মানছে না শত চেষ্টাতেও। শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিয়ে দু'হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ওঠে। কান্নার দমকে পিঠের উঠানামা দেখেও সিরাজুল ইসলাম ঠায় বসে থাকেন নিজের জায়গায়। তিনি জানেন বিনু লুকোতে পারবে না নিজেকে। ভালোবাসা লুকোনো যায় না।
দু’জনের সম্পর্কটা জাগতিক দেনা-পাওনার ছিল না। দু'জনের কাছে দু'জন বাঁধা পড়েছিল মনের টানে, স্বচ্ছতা আর সরলতায়। সামাজিকতার কোন খাতির চলে না এমন সম্পর্কে। কিছু সম্পর্ক থাকে কোন ছাঁচে ফেলে তাকে সংজ্ঞায়িত করা যায় না। ওদের দু'জনের সম্পর্ককেও কেউ ছাঁচে ফেলতে পারেনি।
পৃথিবীতে কতো অদ্ভুত সম্পর্কই না রয়েছে!
৩.
সাত বছরের সংসার জীবনে মনোয়ার বেশ অনেকবারই বিনতাকে জবাব দিয়েছে।
'জবাব' কী বুঝলেন না?
'যাও, আর ফিরে এসো না, প্লিজ।
বিনতা খুব সম্ভাবনাময় ছিল। মনোয়ারের প্রেমে না পড়লে অথবা বলা যায় মনোয়ারকে বিয়ে না করলে নিজেকে খুব স্বচ্ছল, স্বাবলম্বী করেই গুছিয়ে নিতে পারতো। কিন্তু এতোবছর পর ঘরের সব হ্যাপা সামলে, দিনে রাতে শ্বশুর, শাশুড়ি, ননদ-দেবর, স্বামী সামলে ডুবে ছিল 'এই আমার ঘর, এই আমার বেহেস্তে...'
এতোদিন পর মনোয়ারের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। বিনতা এখন পুরনো ভৃত্যের চেয়েও অপছন্দনীয়। পুরনো ভৃত্যকে তবুও মনিব মায়া করে বিদায় বেলা বলে দেয়, "কোন প্রয়োজনে কিছু চাইতে সংকোচ করো না"। কিন্তু ঘরের বউকে একসময় যেমন দেবী করে মাথায় তুলে রাখতো, তেমনি গৃহকর্তার অবহেলায় কখন যে গৃহের এই লক্ষী তুলসী গাছটি যত্ন, পানির অভাবে শুকিয়ে গেছে সেদিকে গৃহকর্তার নজর নেই। প্রয়োজন পড়েনি নজর দেবার। আজ যখন মনে হলো নাহ একে দিয়ে আর চলছে না, এ বড় অবাঞ্চিত তখনই এতোদিনের চেনা কড়িকাঠ, চেনা চৌকাঠ সব ছেড়ে আসা অফিস ঘরের মতো পর হয়ে যায়।
বিনতা নিজের সাজানো বাগানের দিকে চেয়ে দেখে। কচি গাছ এখন সবুজে সবুজে ডালপালা ছড়িয়ে নিজেদের অবস্থানের সগৌরব জানান দিচ্ছে। বিনতা শুধু ভালোবেসে নিজেকে বিলিয়েছে। নিজের কথা ভাবেনি। আজ যখন নিজের কথা ভাববার সময় এসেছে তখন পেছন ফিরে দেখে নিজের জন্যে এতোগুলো বছর কিছুই করেনি, কিছুই রাখেনি নিজের সঞ্চয়ে...শুধু অবহেলা আর বঞ্চনা। তারপরও হাসিমুখে সব অপমান সামলে কাটিয়ে দিয়েছে রান্নাঘরে।
হাসি খুশি একজন নারী, যে প্রতিনিয়ত মানসিকভাবে বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত হয়ে রান্নাঘরে রান্না করার সময় প্রায়ই ভাবে এই আগুন সে নিজের গায়ে লাগিয়ে শেষ করে দিবে এই যন্ত্রণাময় জীবন!
কখনো মাছ, মাংস, শাক-সবজি কাটতে গিয়ে সেই ধারালো অস্ত্রটা নিজের শরীরকেই কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলতে ভয়ঙ্কর ভাবে মাথাটা চারা দিয়ে উঠে।
অথবা কখনো সে ফ্যানের বাতাসে নিজের ক্লান্ত দেহটাকে আরাম দিতে চায়...সেই ফ্যানের দিকেই তাকিয়ে ভাবে ওড়নাটা শক্ত করে একদিন বেঁধে ঝুলে পড়বো এই ফ্যানে। চুকিয়ে দেব সব জ্বালা-যন্ত্রণা । শেষ করে দিব বিষময় জীবন!
অনেকেই তার সন্তানদের কথা ভেবেই শুধুমাত্র এই বিষময় জীবনটা বিষাক্ত নীল হয়ে মনে মনে মরেই যায় ! সেই বাঁচাটাকে আসলে বেঁচে থাকা বলে না !
এমন খবর কিন্তু আমরা পাই না। কারণ এমন খবর আমাদের কাছে আসে না। নারীর নীরব কান্না, অভিমান, অপমান আমাদের কাছ পর্যন্ত পৌঁছায় না।
যখন সব শেষ হয়ে যায়, তখনই কোন কোন সময় তা খবরের শিরোনাম হয়।
এতো ভালবাসার জীবনটিকে আত্মহত্যার মাধ্যমে শেষ করা অবশ্যই মুখের কথা নয় ! অনেক যন্ত্রণা, অনেক অবজ্ঞা, অনেক অপমান, অনেক নীরব কান্না ইতিহাস হয়ে তবেই শেষ হয় এই প্রিয় জীবনটি।
কাকে বলবো, তুমি আত্মহত্যা করে হেরে গেছো?
আমার সেই সাহস নেই এই কথা বলার।
যে আত্মহত্যা করেছে, সে পারেনি স্বার্থপর হতে... সে আরো অনেক কিছুই পারেনি বলেই চলে গেলো!
কিন্তু না! বিনতা পারেনি আত্মহত্যা করতে।
৪.
প্রিয় অংশুমান,
এই চিঠি যখন তোমার হাতে পৌঁছুবে ততক্ষণে তোমার আমার গন্তব্য বদলে গেছে।
মনে পড়ে অংশু, খুব করে তোমার হাসিমাখা মুখটা দেখতে চাইতাম। কেমন আকুল হয়ে তোমার হাসিমুখের জন্যে কাতর ছিলাম। তুমি কখনোই আমার সামনে হাসতে চাইতে না। অথচ ঠিক আর সবার সাথে, বন্ধুদের আড্ডায়, বান্ধবীদের রসিকতায় তোমার হাসি উপচে পড়তো। শুধু যেনো আমার জন্যেই তোমার কোন হাসি বরাদ্ধ ছিলো না। কখনো জিজ্ঞেস করলে বলতে হাসবার শক্তি পেতেই তুমি আমার কাছে আসো। কী অদ্ভুত! আমি খুব তৃপ্ত হতে চাইতাম। কিন্তু মন কখনোই মানেনি, কখনোই তৃপ্তির ঢেুঁকর তুলেনি। বরং সবসময়ই নিজেকে কেমন যেনো অবহেলিত মনে হয়েছে। মনে হয়েছে আমাকে 'ভালোবাসা' নয়, করুণা করছো তুমি। আজ খুব করে জানতে ইচ্ছে করছে, আমার জন্যে সত্যিই কি কোনদিন এতোটুকু ভালোবাসা ছিলো তোমার কাছে? আজ আর বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না। এতো অবহেলা, এতো অবজ্ঞা, বঞ্চনা, অপমান সয়েও কেমন করে ভাবি বলতো যে, তুমি আমায় সত্যিই ভালোবেসেছিলে!
আমি এখন কারো বুকে মাথা না রেখেই বেশ ঘুমুতে পারি। যখন একলা করে চলে গিয়েছিলে...রাতের পর রাত ঘুমুতে পারিনি। তেল-জল কোন কিছুই বাকী থাকেনি ঘুমের সাথে সন্ধি পাতাতে। সেই বিভৎস রাতগুলোর কথা ভাবলে এখন আমার হাসি পায়। কতো বোকা ছিলাম আমি। ভেবেছিলাম মরেই যাবো ওই বুক খামচে ঘুমুতে না পারলে।
অথচ এখন আমি দখিনা বাতাসে বেশ করে ঘুমিয়ে ভোর বেলা আড়মোড়া ভেঙ্গে আয়েশ করে ঘুম থেকে উঠি।
কী ভেবেছিলে? আমার পৃথিবী থেমে যাবে?
আমার পৃথিবী সত্যিই থেমে গেছে...
যেদিন থেকে মনের ভেতর এই বাজে বিশ্বাসটা বাসা বেঁধেছে, তুমি আমায় কখনোই ভালোবাসোনি!
লিখতে বসে চোখের জলে ভাসছি কেন?
আমার তো এখন মুক্তির আনন্দে উড়বার কথা!
তোমার পিঞ্জিরা থেকে মুক্তির!
কিন্তু আমি যে তোমার পিঞ্জিরাকেই আমার পৃথিবী ভেবেছিলাম! এখন এই খোলা আকাশে আমার যে বড় ভয় হয়!
কেমন করে উড়বো আমি!
তুমি ভালো থেকো।
ভালো সত্যিই থেকো।
আর কাউকে নিয়ে...আর কিছুকে নিয়ে।
ইতি
বিনতা
(কখনো তোমারই কেউ ছিলাম)
চিঠিটা লিখে খামে ভরে নিজের আলমারিতেই রেখে দিল খুব যত্ন করে। বাসা থেকে বেড়িয়ে এলো কাউকে কিছু না বলে।
শূন্য একটা অনুভূতি নিয়ে বিনু হাঁটতে থাকলো। হাতে পৌনে দুই ঘন্টা সময় আছে। বাসায় ঘর অন্ধকার করে একলা বসার উপায় নেই। উপায় নেই আয়নার সামনে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকবার। অথবা স্নান ঘরে অনেকটা সময় ধরে ভেজার। প্রশ্নের সম্মুখিন হতে ভালো লাগে না।
আজ কেউ প্রশ্ন করবার নেই। কারো কাছে কোন জবাবদিহি করতে হবে না। মাথায় বাড়তি কোন চাপ নেই।
সিমেন্ট দিয়ে বাঁধাই করে বসার জায়গা করে দেয়া হয়েছে। সেখানেই বসে পড়লো। আশেপাশে হরেক রকমের মানুষ। একটা জলপিপি ঝুপ করে ডুব দিয়ে উড়ে গেল। এখানে এর আগে এমন করে বসন্ত বাউড়ী চোখে পড়েনি! আর অবাক হয়ে দেখলো মিনিভেটও আছে! একা একাই হেসে ফেললো...স্কারলেট জোহানসন্স নামটা মনে পড়ায়। মিনিভেটের ইংরেজি নাম স্কারলেট...নায়িকা কতো চোখ ধাধানো সুন্দরী আর পাখিটার নাম কি অদ্ভুত!
ভালোবাসা চেয়ে কতো কেঁদেছে একসময়, ভালোবাসা পেয়ে ডুবে ছিল! ছিলো বিড়ালের মতো আহলাদীপনা অথচ আজ এই প্রকৃতির কাছে এসে মনে হচ্ছে ও কখনো কাউকে ভালোবাসেনি! ভালোবাসতে পারেনি। অনেক পেছন ফিরে তাকালো কেমন যেনো শূন্যতার বোধ গ্রাস করে ফেলছে ওর সমস্ত অনুভূতি!
জীবনটাকে নতুন করে দেখা শুরু করেছে বিনু। ওর কাছে একসময় সূর্যের মতোই অমলিন ছিল যেই মনোয়ার, ভালোবেসে যাকে অংশু নামে ডাকতো বড় আদর করে, সেই মনোয়ারই গত সাত বছরে অপমান, অবজ্ঞার কোন কমতি রাখেনি।
এতোদিন ভেবেছে ওর জীবনে মনোয়ারের কোন বিকল্প নেই। এবার যেনো সেই ধারণা বদলানোর সময় এসে গেছে।
ও জানে এই সমাজ ওর এই হৃদয়ের ভারকে মেনে নেবে না। মেনে নেবে না কেউই। কিন্তু দিনের পর দিন ওর অপমানিত মুখ, রাতের পর রাত ওর অতৃপ্ত হৃদয়ের খোঁজ কেউ রাখেনি।
৫.
সিরাজুল ইসলামের কাছে পৌঁছানো অনেকগুলো চিঠি, বিনতা লিখেছিল। ভালোবাসার আকুতিতে ভরা! যে সম্পর্ক হবার নয় তা নিয়ে ভদ্রলোকের ছিলো সবসময়ের সচেতনতা। বিনতা যেনো নাছোড়বান্দা। ওর ভালোবাসা বঞ্চিত মন তাঁর মনে রানির আসনটা দখল করেই ছাড়বে।
তিনি নিজেও জানতে পারেননি কখন থেকে নিজের অগোচরে ওর প্রতি অনুভূতি প্রগাড় হতে শুরু করেছিল।
বিনু জানে সিরাজুল ইসলামের চারপাশে সব ডানাকাটা পরিদের ভিড়। ও নিজে খুব আটপৌরে। হাত ভরা থাকে কাচের চুড়িতে, বছর জুড়ে থাকে মেহেদী রাঙানো নখ। আধাবিঘা উঁচু করে পরা শাড়ির সাথে বুট জোড়া কতোটুকু মানানসই তা কখনো ভেবে দেখেনি।
সিরাজুল ইসলাম বিনুকে ভালোবেসেছিলেন কেন?
মানুষ ভালোবাসা উপেক্ষা করার শক্তি পায়নি। বিধাতা তাকে সে শক্তি দেননি। বিনুর বানের মতো ভালোবাসায় সিরাজুল ইসলাম ভেসে গিয়েছিলেন। তাঁর চারপাশের ডানাকাটা পরিরাও তাঁকে ভাসাতে পারেনি যতটুকু ভাসিয়েছে পাগলী মেয়েটা। কিন্তু বিনু জানতে পারেনি, সিরাজুল ইসলামের মতো যন্ত্রমানবের বুকের ভেতরে তাঁর চারপাশের ডানাকাটা পরি নয় বরং বিনু নামের অস্থির পাগলীরই দাপাদাপির শব্দ।
সেদিনের কথা বেশ মনে আছে! বিনুর শীতল বরফ হাতটা ধরে চমকে উঠেছিলেন তিনি। জীবনের প্রথম দ্বিতীয় কোন নারীকে স্পর্শ করেছেন। লজ্জায় তরিতাহতের মতো সরিয়ে নিয়েছেন হাত। ভয় পেয়েছেন যদি বিনতা ভুল বোঝে তাঁকে।
ভালোবাসারা বিনতার কাছে আসেনি বরং বিনতাকেই কেড়ে নিয়েছিল!
বিনু ভুল বুঝেছিল।
মনোয়ারের অপমান, অবজ্ঞা বিনুকে যতটা ব্যথিত করতে পারেনি বরং সিরাজুল ইসলামের বিব্রতবোধ থেকে নিজেকে বিনুর কাছ থেকে ক্ষণিকের সরিয়ে নেয়াকেই বঞ্চিত, উপেক্ষিত, তুচ্ছ মনে হয়েছিল।
এগারোটা ঘুমের ঔষুধে মানুষ আসলে মরে না। কিন্তু ঔষুধ খাওয়ার পর যদি রাতের গভীরে নীরবে কোন পুকুরে এই মানবদেহটা ভাসিয়ে দেয় তবে?
হ্যাঁ, অভিমানী বিনু নীরবে জলকেই আলিঙ্গন করে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিল জলের বুকে।
সিরাজুলের মেসেঞ্জোরে বিনুর শেষ মেসেজটা ছিল-
“শুধু ধ্রুবতারার মতো পথরেখা হয়ে থেকো...”