মোবাইলে তখন কি গান বাজছিলো সেটা মনে পড়ছে না। মনে পড়বে কিভাবে? গান মাথায় ঢুকলে তো মনে পড়বে।
হেডফোনের একপ্রান্ত ছিল আমার কানে, এবং আরেক প্রান্ত ছিল অর্ধ-উন্মাদিনী মেয়েটার কানে। সূক্ষ্ম তার বেয়ে যেটুক ইলেক্ট্রিসিটি শব্দতরঙ্গ হয়ে কান পর্যন্ত পৌঁছায়, সেটা আমার মাথা পর্যন্ত পৌঁছতে গিয়েই অন্যরকম তরঙ্গ তৈরি করে ফেললো।
হতচ্ছাড়া সাউন্ড ওয়েভ, তোর তো মধ্যকর্ণ, অন্তকর্ণ পার হয়ে হাইপোথ্যালামাস পর্যন্ত গেলেই হতো, রুট বদল করে হার্ট দিয়ে ঘুরে যাওয়ার দরকারটা কি ছিল?
আমরা তখন ফার্স্ট ইয়ারে।
বাসে করে কুমিল্লা থেকে ঢাকায় ফিরছি তখন। সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে বেশ খানিকক্ষণ হলো। মেঘ-মশাইগণ ত্যাগের মহান ব্রত নিয়ে চালিয়ে যাচ্ছেন তাদের কর্মলীলা। সারাদিন পিকনিক করে, বাসে নাচ-গান করে শরীরের চার্জ শেষ ততক্ষণে। তাই মোবাইলের চার্জ দিয়েই বাকি রাস্তা পার করার প্ল্যানে ছিলাম।
খুব সম্ভবত ঘটনার শুরু ওখানেই।
আমার বামপাশে ছিল অর্ধেক খোলা জানালা, আর ডানদিকে গল্পের নায়িকা। গায়ে বৃষ্টির ঝাপটা এসে লাগছে। ভীষণ চঞ্চল আর বাচাল মেয়েটা তখন ক্লান্ত, চুপ হয়ে সিটে হেলান দিয়ে গান শুনছে... অসতর্ক ক্ষুদ্র বৃষ্টির ফোঁটাগুলো দুরন্ত এক মনোবিক্রিয়ার প্রভাবক হিসেবে নিপুণভাবে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু বৈজ্ঞানিক ভাবেই ব্রেইনের ডান-অংশ বা রাইট হেমিস্ফিয়ার তো আর যুক্তির চোখরাঙানিকে পাত্তা দেয় না। তাই আসন্ন হৃদয়ঘটিত জলোছ্বাসের ভয় না করে বাকিটা সময় ডানদিকের মেয়েটার দিকেই তাকিয়ে ছিলাম আমি।
কিউপিডের অব্যর্থ নিশানায় বিদ্ধ হলাম। তবে এরপরের সময়টুকু মনে হয় আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়।
কারণ ততদিনে আমি আটলান্টিকের বুকে। মাঝ সমুদ্রে মানুষ কালপুরুষ কিংবা সপ্তর্ষিমণ্ডল ধরে পথ চলে। আর আমি সাতপাঁচ না ভেবে একটা কুয়াশাতেই ঘুরপাক খাচ্ছি তখন।
একটা অদ্ভুত সুন্দর অনুভূতি।
কুয়াশার কুহেলিকায় শর্ট সার্কিটের এই দুর্ঘটনা যে সময়ের, ঐ সময়ের প্রকৃতিও আমার প্রতি সুপ্রসন্নই ছিল বলা যায়। তাই আমাকে আগস্ট মাসে বোনাস আরেকটা পূর্ণিমা উপহার দেয়া হলো। একই মাসে পূর্ণিমা দুইবার হলে দ্বিতীয় পূর্ণিমাকে বলে ব্লু-মুন। আমার এখনও মনে পড়ে, নীলচন্দ্রের ঐ পূর্ণিমা রাতটা কি ভীষণ অস্থিরতায় কাটে আমার। মাতাল চাঁদের ফাঁদে পড়েই এমনটি হয়েছে, তাই ভেবেছিলাম ঐ রাতে।
যতদূর জানি, ইংল্যান্ডে একসময় খুনীদের শাস্তি দেয়ার সময় পূর্ণিমা বিবেচনায় আসতো। পূর্ণচন্দ্রের রাতের খুনীদেরকে কম শাস্তি দেয়া হত। আর শুধু কি তাই, পূর্ণিমা রাতে টোয়াইলাইট মানবেরা ভাল্লুক পর্যন্ত হয়ে যায়, সুরতাং আমি তো ঐটুকু বেসামাল হতেই পারি!!
চাঁদ ছোট হতে থাকলো পরের দিন থেকেই।
কৃষ্ণপক্ষ একটু একটু করে গ্রাস করতে থাকলো মুটিয়ে যাওয়া চাঁদটাকে। কিন্তু আমার অস্থিরতা বাড়তেই থাকলো চক্রবৃদ্ধি আকারে। ওদিকে চন্দ্রদেবী শুক্লপক্ষে এসে হারানো স্বাস্থ্য ফিরে পাওয়ার সময় আমার দিকে রীতিমত টিটকারি দিয়ে কটাক্ষ করলো।
কী, খুব তো আমার উপর দোষ চাপালে, বৎস। এখন সামলাও নিজেকে।
আর এভাবেই বৃষ্টি দিয়ে শুরু হওয়া আমার অঘটনের ষোলকলা পূর্ণ হলো।
ঐ আগস্ট মাসেরই কথা।
একটা জন্মদিনের প্রোগ্রাম শেষ করে ফেরার সময় হুট করে মেয়েটা বলে বসলো, তোর কাজ না থাকলে চল্ একটু ঘুরে আসি। কাজ ছিল কিনা মনে নাই, তবে আমি গেলাম ওর সাথে। ভার্সিটিতে ভর্তির পর তখনও ডিওএইচএস এলাকায় সেভাবে যাওয়া-আসা শুরু হয় নি। তখন সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে। আমরা রিকশায় উঠলাম। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, ঐদিনও বৃষ্টি ছিল। টিপটিপ-আদুরে ধরণের বৃষ্টি।
ইসিবি চত্তর পর্যন্ত গেলাম। সত্যি বলতে গেলে, ঐদিনই ভালোমত জায়গাটা ঘুরে দেখলাম প্রথমবার।
রাস্তায় বেশি লোকজন ছিলনা।
“এখানে বসা নিষেধ” সাইনবোর্ডের সামনে বসে ছিলাম আমরা দুইজন। ওর কালো ড্রেসটা স্পষ্ট মনে আছে আমার, আর আমার কালো পাঞ্জাবী। ওর ক্যামেরায় আমাদের অনেক সুন্দর একটা ছবি আছে ঐদিনের। রিকশাওয়ালা মামাকে দিয়ে তোলানো। দাঁত বের করা আমরা দুইজন। অজানা কারণে আমাদের ফটোগ্রাফারও কেন যেন ছবি তোলার সময় দাঁত বের করে হাসছিল।
সত্যি বলতে কি, নিজেকে ব্যাবিলনের রাজা মনে হচ্ছিল। আর পিছনে ইসিবি চত্বরের ভাস্কর্যটাকে মনে হচ্ছিল ব্যাবিলনের সেই বিখ্যাত ঝুলন্ত বাগান।
আমি বলতে পারবো না কখনও ঐ মুহূর্তগুলো কেমন ছিল। শুধু বলতে পারবো, মিনিটে আমার হার্ট ছিয়াত্তরের চেয়ে অন্তত দশবার বেশি কাঁপছিল। তবুও বাচ্চাদের মত অর্থহীন একটা আনন্দ হয় তখন, কেমন একটা নেশার মতন।
মাঝে মাঝে ওর দিকে তাকিয়ে দশটা অতিরিক্ত হার্টবিটের কারণ খুঁজতে ইচ্ছা হচ্ছিলো। কিন্তু কি লাভ? আমার হার্ট আর ব্রেইন কেমন অদ্ভুত রকমের একটা পরকীয়ায় একজন আরেকজনের সাথে যুক্ত। এখানে যেন আমার ইচ্ছার কোনও দাম নেই।
ডিওএইচএসে রাস্তার দুইপাশে খালি জায়গাগুলোতে আমার অনেক সুন্দর কিছু দুপুর কাটে। নিচু দেয়ালের উপর পা ঝুলিয়ে আমি আর ও এলোমেলো সব প্ল্যান করতাম; অর্থহীন, অ-জ্ঞানগর্ভ সব আলোচনা করতাম। যদিও ঐসব প্ল্যানের স্থায়িত্ব বড়জোর দশ মিনিট।
তবে এরই মধ্যে আমাদের ঐক্যজোটে বিরোধী দল আক্রমণ করতো যথারীতি। আমাদের দুইজনের পশ্চাদ্দেশে পিষ্ট দেয়ালের বক্ষ-বিদীর্ণ করে এদিক-সেদিক থেকে যোগ দিত পিঁপড়া। কিন্তু এখানেও বিপত্তি, পিঁপড়া মারতে গেলেও মহারাণী চোখ গরম করে তাকাবেন।
- খামাখা মারলি কেন এটা, বল্ কেন মারলি?
সাঙ্গু নদীর শান্ত পানিতে ক্ষণিকের জন্য রোদের শাসনের রূপ দেখলে বুঝতেন, মাঝে মাঝে অকারণে কেন আমি দুয়েকটা পিঁপড়া মেরে ফেলতাম। পিঁপড়া সমাজ এতকিছু জানলে এই পাপের জন্য নিশ্চয়ই ক্ষমা করে দিত আমাকে।
ফাঁকা প্লটগুলোতে পুকুরের মতন ছিল তখন কয়েক জায়গায়। ওগুলোই ছিল আমাদের ভরদুপুরের লাবণী-পয়েন্ট, আর বৃষ্টির ছিঁটেফোঁটা থাকলে তা-ই হয়ে যেত মাধবকুণ্ড।
ছোট্ট একটা পাথরের উপর বসে আমরা একদিন ঠাণ্ডা পানিতে পা ডুবিয়ে ছিলাম অনেকক্ষণ। গল্পের মত টলটলে পানি ছিল না। বরং কাদা তো ছিলই, এমনকি কেঁচো-জোঁকেরও ভয় ছিল। কিন্তু আমাকে ঘেঁষে যতটুকু সময় ছিল ও, এগুলো মাথায় আসে নি একবারো।
জীবন একটা ‘লুপ’ হলে ঐ অংশটাই অসংখ্যবার রিপিট করাতাম আমি হয়তো।
সেদিন ওদিকটায় গেলাম অনেকদিন পর। জ্বলন্ত সিগারেটের ছাই ছড়িয়ে দিয়ে আসলাম এবার। আমার এবং আমার খুব প্রিয় একজনের মিশে যাওয়া পায়ের ছাপ আর পিষে যাওয়া পরাবাস্তবতার ওপর আমার পুড়ে যাওয়া দীর্ঘশ্বাসগুলো রেখে এলাম।
কারণ এখনও আমার কাছে ইসিবি ক্যান্টিনের মানে খুব সুন্দর ঐ মেয়েটা, খুব সহজেই যার চোখে আলো-আঁধারি খেলা করতো। এখনও করে নিশ্চয়ই। আমার ইচ্ছা করতো, খুব কাছ থেকে ওর দিকে তাকিয়ে থাকবো। নিঃশ্বাস ফেলা দূরত্ব না হোক, অন্তত ওর মন খারাপের সময় কয়েক সেকেন্ড মাথায় হাত দিতে পারার মত দূরত্ব হলেই চলতো আমার।
খুব দ্রুতই যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছে ঐ এলাকা। আমরা যেদিকটায় বসে অর্থহীন গাল-গল্প করতাম, এলোমেলো পায়ে ধূলাবালি উড়িয়ে হাঁটতাম; ওদিকটায় হয়তো দালানকোঠা উঠে যাবে কয়দিনের মধ্যেই।
আমাদের মুহূর্তগুলো যেখানে চাপা পড়ে গেছে, ওরকম কোনও জায়গাতেই হয়তো উপরের দিকে শরীর বাড়াবে অট্টালিকা। কনক্রিটের নিচে আমার ভূ-গর্ভস্থ স্বপ্ন আর মুহূর্তগুলোও ওখানেই আছে নিশ্চয়ই। হয়তো এলোমেলো চুলের আমার মতন কেউ বাস করবে সেই অট্টালিকায়। ভীষণ একরোখা কোনও একটা মেয়ের সাথে হাসতে হাসতে অবাস্তব প্ল্যান আর অমীমাংসিত তর্ক করবে ছেলেটা। আর যখন খুব অসহায় লাগবে, খুব কষ্ট হবে, খুব দেখতে ইচ্ছা করবে ঐ অবুঝ মেয়েটাকে, সে-ও হয়তো ইথার তরঙ্গে আঙুলের স্পর্শে ভাসিয়ে দিবে কয়েকটা শব্দ।
আই হেইট ইউ। আই হেইট ইউ।
ভার্সিটিতে আমার ফার্স্ট ইয়ারের ব্লু-মুন পাকাপাকিভাবেই একটা অনিন্দ্যসুন্দর মুখ খোদাই করে দিয়েছে আমার মধ্যে।
ঐ সময়টা শরৎকাল ছিল। আমাদের ভার্সিটির পেছনে একটা জংলা জায়গা আছে। ঝোপঝাড় পার হয়ে কিছুদূর হাঁটলেই বিরাট ফাঁকা জায়গা, তার ওদিকে কাশবন। আমরা তিন বন্ধু মিলে গিয়েছিলাম ওখানে। আর ওদিকে আমার শরতের নীলাকাশ জুড়ে সাইরাস মেঘ হয়ে তখন কেবল একজনই।
হাঁটলাম অনেকক্ষণ কাশবনের পাশ দিয়ে। হুটহাট ছন্নছাড়া বাতাসে কাশফুলের দুয়েক খণ্ড এলোচুল উড়ে এসে শরীর স্পর্শ করে গেলো কয়েকবার।
কিন্তু অযত্ন-অবহেলায় জেগে ওঠা এই ফুলটা ঐ মুহূর্তে আমার কাছে অমূল্য হয়ে গেলো কিভাবে যেন। গ্ল্যাডিওলাস, লিলি কিংবা রজনীগন্ধার নয়, কাশফুলের একটা তোড়া তৈরি করতে হবে আমাকে; যে করেই হোক।
কাশফুল ছিঁড়তে হয়েছিল খুব সাবধানে। নাহলে ছোট ছোট হয়ে উড়ে যায় পুরোটাই। গোড়াটা ধরে আস্তে করে ডালসহ ভেঙে ফেলতে হয়। এভাবে গোটা পাঁচেক কাশফুল দিয়ে ছোট্ট একটা তোড়া বানালাম। বক্ষপিঞ্জরে ক্রমাগত ভূমিকম্পের সেই জাদুকরী সময়টাতে নিজ হাতে শরতের মেঘের একটা তোড়া বানিয়ে ফেললাম ঐ মেয়েটার জন্য। বৃষ্টি হবে না এই মেঘে কখনও, তবুও খুব যত্ন করেই তৈরি করলাম।
মেয়েদের হল পর্যন্ত আসতে আসতে বেশ কিছু অংশ হারিয়ে গেলো ক্ষুধার্ত বাতাসে। শেষ পর্যন্ত যখন আমি ফুল হাতে নিচে দাঁড়িয়ে ওকে ফোন করলাম, আমি তখন মাতাল প্রেমিক বায়রন, কিংবা ভালোবাসার সূর্যসেন।।
ও নামতে পারে নি ঐদিন হল থেকে কি এক কারণে। কিন্তু কাশফুলের কথা ও জানতো না। এমনকি এরপর ওকে আর বলাই হয় নি কখনও ঐ ব্যর্থ তোড়ার কথা।
তারপর- বৃষ্টিহীন ঐ মেঘমালা আকাশে ভাসতে না পারার কষ্টে বাতাসে মিলিয়ে গেলো একসময়। ফিমেইল উইং এর সামনের রাস্তায় আমিই রেখে এসেছিলাম আমার যত্ন করে বানানো সারপ্রাইজটা।
কারণ কিছু জিনিস কখনও ফিরিয়ে নেয়া যায় না, কিছু উপলব্ধি রেখে দিতে হয় মাথার ভেতর খুব যত্ন করে।
হিসাব করে দেখা গেছে, প্রতি তিন বছর পরপর ফিরে আসে এই ব্লু-মুন। তাই গত বছরের জুলাই মাসের একত্রিশ তারিখেও হয়তো আমাকে খুব কষ্টের একটা চন্দ্রপূর্তি করতে হয়। গভীর রাতে ফোন হাতে নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগি অনেকক্ষণ। মেসেজ টাইপ করে মুছে ফেলি, তারপর আবার নতুন করে লিখি।
সেন্ড অপশনের উপর আঙ্গুল রেখে ওর সুন্দর চোখের ভাষা অনুমান করার চেষ্টা করি লম্বা সময় ধরে, প্রচণ্ড রহস্যময়, নীল রঙের জাদুকরী একটা চাঁদকে সাক্ষী রেখে।