নগণ্য পরিসরে ছোট্ট একটি গাছ। প্রায় মরে গেছে। যত্নের বড়ই অভাব। মরচে ধরা কয়েকটা পাতাবিহীন ডাল। তাতে অবলীলায় ঝুলছে বেশ কিছু কাঠগোলাপ। মুমূর্ষু গাছটার দিকে ভাঙা শিকের জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে একজোড়া চোখ। সে চোখে রাজ্যের বিষণ্ণতা। জমে আছে এক মহাকাশ কষ্ট।
মাস তিনেক হতে চলেছে ময়না বিছানায়। সর্বনাশা রোগটা তাকে ছাড়তেই চাইছে না। থেকে থেকে শরীরটাকে কুড়েকুড়ে খাচ্ছে। ঠিক যেভাবে খেয়েছে তাঁর স্বামীকে। হঠাৎ করেই তরতাজা মানুষটা একদিন বিছানায় পড়ল। আর উঠল না। ময়নাকে একা করে পরবাসী হল নির্দ্বিধায়। একবার ভাবলও না কিভাবে তাকে ছাড়া থাকবে ময়না। কি করেইবা দেড় বছরের কচি ছেলেটার মুখে দুবেলা খাবার তুলে দিবে। তবে সব কষ্ট ছাপিয়ে মনকে শক্ত করতে পেরেছিল সে। স্বামী যখন চলে গেল ময়নার পৃথিবীটা অন্ধকার করে, টানা দু'মাস অঝোরে কেঁদেছে। ছেলে বিল্টুকে বুকে নিয়ে রাতের পর রাত আকাশের দিকে সিক্ত চোখে তাকিয়ে থেকেছে। ছেলে বউয়ের কষ্ট দেখে যদি ফিরে আসে মানুষটা। তবে সে যে না ফেরার দেশে চলে গেছে। আসবেনা আর কোনদিন। ফিরবেনা তাঁর রক্তমাংস দিয়ে গড়া ঘরটাতে। একথা মেনে নিতে বেশকিছু সময় লেগেছে। যখন দেখেছে ছেলেটার কচি মুখখানা ক্ষুদার জ্বালায় শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। ছেলেটার মুখে দুবেলা খাবার তুলে দিতে সব কষ্ট বুকের এক কোণে কবর খুঁড়ে মাটিচাপা দিয়েছে। বেরিয়েছে একটা কাজের সন্ধানে। লেখাপড়া কিছুই জানেনা। কে দেবে তাকে কাজ? অনেক খোঁজাখুঁজি করে একটা বাসায় বুয়ার কাজ পেল। মালিকের বাসায় মোট চারজন মানুষ। সাহেব, সাহেবের স্ত্রী আর দুটো মেয়ে। বড় বড় পাঁচটা রুমের একটা ফ্লাট। তাঁর কাজ প্রতিদিন রুমগুলো ঝাড়ু দেয়া, মোছা, আসবাব মোছা, কাপড় কাচা আর বাথরুম ধোয়া। সব শেষে দুপুরের রান্নার জন্য মাছ-সবজি তরকারি কেটে দেয়া। বেশ ভালোই চলছিল তাঁর কাজ। সকালে সূর্য ওঠার সাথে সাথে চলে যেত। সব কাজ শেষ করে দুপুর ছুঁইছুঁই বাসায় ফিরত। ছেলেকে পাশের বাসার মিনুর মার কাছে রেখে যেত। মিনুর বয়স দু'বছর। প্রায় সমান বয়সের হওয়ায় দুজনে সারাক্ষণ খেলে। মিনুর মাকে একদম জ্বালায়না। এইটুকুন বাচ্চা ছেলেটাও বুঝতে পারে হয়তো ওর মায়ের কষ্ট। বাসায় ফিরে বিল্টুকে নিয়েই সময় কাটিয়ে দেয়। বিল্টুই যে এখন তাঁর বেঁচে থাকার একমাত্র সম্বল।
মাস সাতেক হয়ে গেল কাজের বয়স। হঠাৎ একদিন ময়নার মেমসাহেব অসুস্থ হয়ে পড়লেন। হাসপাতালে ভর্তি করা হল তাকে। বাসার সব কাজের দায়িত্ব এসে পড়ল ময়নার ঘাড়ে। সকালের নাস্তা, দুপুরের খাবার, রাতের খাবার সব ময়নার দায়িত্ব। মাঝেমাঝে মেমসাহেবের জন্য হাসপাতালে খাবার পাঠানোর জন্যও আলাদা রান্না করতে হত। এত কাজের ভীরে ময়না প্রথম দুদিন বাসায়ও ফিরতে পারেনি। এরপর থেকে বিল্টুকে নিয়েই কাজে যাওয়া। কাজ শেষে সময় বেঁচে গেলে বাসায় ফেরা, নয়তো ওখানেই থাকা।
এভাবে চললেও চলতে পারত। তবে চলেনি। ময়নার বয়সইবা কত ছিল? বিশ কি বাইশ বছর। তাঁর সূর্যের ন্যায় প্রখর যৌবনের দীপ্ত শরীরে চোখ পড়ল সাহেবের। প্রায় সময়ই লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত। আশেপাশে কেউ না থাকলে নানা বাহানায় ছুঁয়ে দিত ময়নার শরীর। বহুকালের অভুক্তের ন্যায় হুমড়ে পরত। এমন অবস্থাকে আর সামাল দিতে না পেরে ময়না কাজ ছেড়ে দিল। মাসখানেক আবার ঠায় বসে থাকা। আকাশের দিকে তাকিয়ে বিধাতাকে শাপ-শাপন্ত করা।
কপালগুণে একটা ইটের ভাটায় কাজ মিলে যায়। আরো বেশ কয়েকজন মহিলা কাজ করে তাঁর সাথে। ভালোই যাচ্ছে এখন দিনগুলো। সকাল সন্ধ্যা কাজ। রাতে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে হাজারো স্বপ্ন বোনা।
কাজে কাজে তরতাজা শরীরটায় বার্ধক্য এসে গেছে যেন। তিনমাস ধরে তিলে তিলে জমানো টাকার বলি দিচ্ছে। ডাক্তার দেখিয়েছে কত বার। ঔষধপত্রও খেয়েছে বেশ। তাও রোগ সারার নাম গন্ধও নাই। শরীরটা আস্তে আস্তে কংকালসার হয়ে যাচ্ছে। বিল্টু একটু পরপর এসে জিজ্ঞেস করে যাচ্ছে,
'মা, আইজকাও উডবানা?'
জড়ানো কন্ঠে ময়না উত্তর দেয়,
'নারে বাপ, শরীলডা ভালানা। উডবার পারুম না। তুই মিনুগো ঘরে খাইস। ঘরেতো রান্ধিনাই।'
-'পত্তেক দিনইতো মিনুগো ঘরে খাই। তুমি উডো, আর ভালা লাগেনা ওগো ঘরে খাইতে।'
'ক্যানরে বাপ! ওগো ঘরে কেউ তোরে কিছু কইছে?'
-'না মা, কেউ কিচ্ছু কয়নাই।'
'তাইলে আইজকা খা, কাইল দেহি শরীলডা ভালা ঠেকলে আমিই রান্ধুমনে।'
-'কাইলকা রানবাতো?'
'হ, রান্ধুম। যা খাইয়া আয়।'
-'আইচ্ছা ঠিকাছে যাইতাছি। তয় দশটা টেকা দেওন লাগবো।'
'টেকা কই পামু? নাই আমার কাছে। আর তুই দশ টেকা দিয়া কি করবি?'
-'লাগবে। দেও।'
'নাইতো। ক্যামনে দিমু?'
-'জানিনা, দেও। না দিলে খাইতে যামুনা।'
'এমনডা করিস না বাপ। খাইয়া আয়, যা।'
-'টেকা না দিলে খামুনা কইছিনা!'
'আইচ্ছা খাইয়া আয়, দিমুনে। মিনুর বাপরে একটু আইতে কইস।'
-'খাইয়া আইলে দিবাতো?'
'হ, দিমু।'
কাল ছাব্বিসে মার্চ। ঢাকার রাস্তা অনেক সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। জায়গায় জায়গায় বড় বড় রঙিন পোস্টার লাগানো হয়েছে। বিল্টু সেই দশ টাকা নিয়ে কি যেন এনেছে। সারারাত বসে খুটুরমুটুর করে কি যেন করছে। ময়না বিছানা থেকেই বার জিজ্ঞেস করছে, 'কিরে বাপ, কি করস? ঘুমাস না ক্যান?
-'কাম করি,পরে ঘুমামু। তুমি ঘুমাও। '
'এত রাইতে কি কাম করস তুই?'
-'কাইলকা কমুনে। তুমি ঘুমাওতো।'
'তোর শরীলডাও খারাপ করবো। ঘুমাইয়া যা বাপ। কাম কাইল করিস। '
-'ঘুমামুনে, তুমি ঘুমাও।'
সকাল থেকে বিল্টুর খবর নেই। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলেছে। কই যে গেলো কে জানে!
দুপুরে খেতেও আসেনি। ময়নার বিষণ্ণ চোখ জোড়ায় চিন্তার ছাপ। মরা শরীরটাকে নাড়াতেও পারছেনা যে ছেলেটাকে খুঁজে দেখবে। ভাঙা শিকের জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকা ছাড়া কিছুই করতে পারছেনা বলে নিজেকে মনে মনে খুব বকছে ময়না। চোখ গলে ফেটে পড়ছে সৃষ্টিকর্তার প্রতি তীব্র ক্ষোভ।
সন্ধ্যা ছুঁইছুঁই। এমন সময় বিল্টু এসে হাজির। হাতে একটা ব্যাগ। হাসি হাসি মুখে এসে মায়ের সামনে দাঁড়িয়েছে। ময়না ছেলেকে দেখে স্বস্তি ফিরে পেয়েছে।
'কিরে, কই আছিলি সারাদিন?'
-'কামে গ্যাছিলাম।'
'কামে গ্যাছিলি? কিয়ের কাম? তোরে কামে যাইতে কইছে ক্যাডা?'
-'কেউ কয়নাই । আমিই গ্যাছি। এই দ্যাহো কত্তটেকা পাইছি কাম কইরা।'
'কিয়ের টেকা! কিয়ের কাম? কি কস তুই?'
-'তুমি আর চিন্তা কইরো না মা। আর মিনুর বাপের থেইক্যা ধার আনতে অইবোনা। আমারও মিনুগো ঘরে খাইতে অইবোনা। তোমারে ভালা ডাক্তার দেখামু। তুমি ভালা অইয়া যাইবা। হেরপর আমি কাম করুম আর তুমি রাইন্ধা খাওয়াইয়া দিবা।'
'কি কস এইগুলান তুই? '
ময়না কাঁদছে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে। বিল্টু মায়ের জন্য পাউরুটি এনেছে। দুধ এনেছে। কলা এনেছে। এক এক করে মাকে দিচ্ছে আর মা সুখের কান্না কাঁদছে। ভেতরে কষ্টে তার বুকটা ফেটে যাচ্ছে। মাত্র এগারো বছর বয়সের ছেলের কামাই তাকে খেতে হবে। এখনতো এই ছেলের পড়াশুনা করার সময়। তার নিজের প্রতি খুব ঘৃণা হচ্ছে। সমস্ত পৃথিবীটা তাঁকে যেন উপহাস করছে।
কাল দশ টাকা দিয়ে এক বান্ডেল ছোট কাগজের পতাকা কিনেছিল বিল্টু। রাস্তা থেকে ঘুরে ঘুরে কতোগুলো আইসক্রিমের কাঠি জোগার করেছিলাম। সেগুলো কেটে কেটে ভাত দিয়ে আঠা বানিয়ে পতাকা লাগিয়েছে তাতে। ছাব্বিসে মার্চ রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে সেগুলো বিক্রি করেছে। দুইদিন আগে পাশের বস্তির একটা লোকের কাছে দেখেছিল এমন লাঠির ডগায় বাংলাদেশের পতাকা। তাকে জিজ্ঞেস করেছিল কি করবে এগুলো। সে বিক্রির জন্য এনেছে শুনে বিল্টু দোকান থেকে পতাকা কিনে এই ব্যবস্থা করেছে। ওরটা দেখতে ততটা সুন্দর না হলেও ছেলেমেয়েরা কিনেছে। এখন থেকে ও এই কাজটাই করবে বলে ঠিক করেছে। তাই মার জন্য কেনাকাটার সাথে আরো এক বান্ডেল পতাকা কিনে এনেছে। মনে মনে খুব খুশি। আর ওকে কারো ঘরে খেতে যেতে হবেনা। ওর মাও ভালো চিকিৎসা পেলে সুস্থ হয়ে উঠবে। এসব চিন্তা করে ওর চোখ খুশিতে চকচক করছে।
সাতাশে মার্চ সকালে উঠেই বিল্টু ওর কাজে নেমে পড়েছে। হাতে বাংলাদেশের পতাকা। আইসক্রিমের কাঠির ডগায় বাতাসে দুলছে পতাকা। খুশিতে ওর মনটাও দুলছে।
রাস্তার মোড়ে এসেই বিল্টু আকাশ থেকে পড়ল। রাস্তায় তেমন মানুষ নেই। কেউ লাল সবুজ পোশাকও পরেনি। কাল বিক্রি করা পতাকাগুলো অনায়াসেই জায়গা করে নিয়েছে ডাস্টবিনে। রাস্তার ধুলোর সাথে লুটোপুটি খাচ্ছে লাল সবুজ রং। রাস্তা ঝাড়ু দেয়া মানুষগুলো নির্দ্বিধায় ঝাড়ু দিয়ে ডাস্টবিনে ফেলছে ওর সারা রাতের কষ্টের ফসল। হেঁটে হেঁটে সবার সামনে পতাকা দুলিয়ে চলেছে বিল্টু। কিন্তু আজ কেউ ওর পতাকার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছেনা। ঘন্টাখানেক ঘুরে একটা পতাকাও বিক্রি করতে না পেরে বিল্টু দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে বস্তির লোকটার কাছে এসেছে। লোকটা তখনো ঘুমাচ্ছে। ডেকে তুলে বিল্টু কান্না জড়ানো কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
-'চাচা, আইজকা কেউ পতাকা কিনতাছে না ক্যান? '
'কি কস তুই? আইজকা মাইনষে পতাকা কিনবো ক্যা?'
-'কিনবো ক্যা! কি কও?'
'আরে বাপ, আইজকাতো কুনো দিবস টিবস না। তয় পতাকা কিন্না কি করবে? '
-'পতাকা কিনতে দিবস লাগবে?'
'হ রে বাপ। এইডা আমাগো মৌসুমি কাম। কুনো দিবস আইলে মাইনষে পতাকা কিনে। যেমন ধর একুশে ফেবুয়ারী, ছাব্বিসে মার্চ, ষোলই ডিছেম্বার। -'এ ছাড়া কিনে না?'
'নারে, এছাড়া কিনেনা।'
বিল্টু রাস্তার উঁচু ফুটপাতে বসে আছে। চোখের তারায় এক দীঘি বিষাক্ত জল টলটল করছে। পতাকাগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে ঝাপসা চোখে। বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠছে ওর মায়ের কথা ভেবে। কি করবে কিছুই ভেবে পাচ্ছেনা। এই মৌসুমি কাজ করে কিভাবে ওর মায়ের চিকিৎসা করবে! কিভাবেই বা দুবেলা খাবারের ব্যবস্থা হবে! অন্যকোনো কাজ খুজবে! নাকি পতাকাগুলো রেখে দিবে কোনো দিবসের অপেক্ষায়....!
২৭ মার্চ - ২০১৬
গল্প/কবিতা:
৬ টি
সমন্বিত স্কোর
৫.৪৫
বিচারক স্কোরঃ ২.৪৫ / ৭.০
পাঠক স্কোরঃ ৩ / ৩.০
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪